লিখেছেন: জীবন

বেশভুষা-ভাষা-চিন্তা ত্রয়ের প্রকাশ-প্রয়োগ এবং যাপিত জীবনের সাযুজ্যতা বিবেচনায় নিলে বাউল-ফকির-বৈঞ্চব-বৈরাগ্য অনুসারী-মতবাদীগণকে একই গোত্রভুক্ত বোধ হলেও স্পষ্টতই এঁদের সাধণা-ভাবনা-চিন্তা-ক্রিয়ার রীতি-নীতি ও প্রয়োগে অনেক ভেদ-প্রভেদ আছে। শুধু তাই নয়, বাউল-ফকির বৈঞ্চব-বৈরাগ্য শব্দ গুলোর উৎপত্তি ও বুৎপত্তিও নিয়েও এখনো বেশ সরব তর্ক-বির্তক চলছে। বিদগ্ধ গবেষকগণ কয়েক শতক বছর ধরে অক্লান্ত চেষ্টা করেও শব্দগুলোর উৎপত্তির গ্রহণযোগ্য উৎস্যমূলে পৌচ্ছাতে পারেননি। তবে, গবেষকগণ একটা আশাব্যঞ্জক সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছেন যে-বাউল-ফকির-বৈঞ্চব-বৈরাগ্য সাধনা বা বিশ্বাসে আশ্রয়ীগণ সমাজের তথাকথিত নীচুস্তর-বর্ণ-পেশার দলিতজন। যারা যুগের পর যুগ শ্রাস্ত্রানুধ্যায়ীদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়েছেন-দগ্ধ হয়েছেন-নিষ্পেষিত হয়েছেন। সংখ্যালঘুতার কারণে দৃশ্যমান প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করা হয়তো তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু তাঁরা যেটা করেছেন, সেটা শ্রাস্ত্রানুধায়ীদের জন্য একটি বিশাল “ধাক্কা” বটে। মূলত ষোড়শ শতক থেকেই এই বাংলায় পরিবর্তনের ক্ষেত্রটি দাঁনা বেধে ওঠতে শুরু করে। তবে, এর আগেই অবশ্য বৌদ্ধ সহজিয়া এবং সুফিদর্শন বেশ নাড়া দিয়ে রেখেছিলো জাহিরি মতবাদীদের। পরবর্তীতে বড়ু চন্ডিদাস এবং শ্রী চৈতন্যদেব কর্তৃক প্রবর্তিত সহজপথে তথা একমঞ্চে সকল স্তরের-বর্ণের মানুষের সম্মিলণে ঈশ্বর ভজন-সাধন এর যে প্রক্রিয়া সরব হয়ে ওঠে এবং নিশ্চিত করেই বলা যায় যে, পরবর্তীতে তার পূর্ণতা প্রাপ্তি ঘটে মহাত্মা লালন, ফকির লালন, বাউল লালন, শাহ্ লালন,দার্শনিক লালন এর গান-ভাবণা-চিন্তার প্রয়োগ-প্রসরতার মাধ্যমে। বর্ণিত দ্রোহ-বিপ্লবের ছায়াতলে শুধু হাজার হাজার মানুষ আশ্রিতই হয়নি, এর উত্তাপ সমাজের উঁচুস্তরের মানুষকে বেশ থতমত করে দিয়েছিলো তা নিঃশঙ্ক চিত্তেই বলা যায়। তার যথেষ্ঠ সবুদও ইতিহাসের পরতে পরতে গ্রন্থিত হয়ে আছে।

ছবি: ইন্টারনেট

(২)
বৌদ্ধ সাধণার পরব গুলো বেশ কঠিন ও জটিল হওয়ায় সবার পক্ষ্যে সেই সাধণার অংশগ্রহণ করে বোধিপ্রাপ্ত হওয়া সম্ভব হতো না। পরর্বতীতে একদল সাধক এই সিদ্ধান্তে স্থির হলেন যে, যেহেতু বুদ্ধ সকলের অন্তরে অবস্থান করেন, সেহেতু বুদ্ধের কৃপা অর্জনে কঠিন পথে সাধণা অমূলক এবং অসার। তাই তারা সহজে পথে বুদ্ধের কৃপা প্রাপ্তির জন্য সাধণার পথ খুঁজে বের করেন। মূলত এই মতবাদটি বৌদ্ধ সহজযান বা সহজিয়া মতবাদ হিসেবে স্বীকৃত। এই উপমহাদেশে এঁরাই প্রথম সহজপথে ঈশ্বরের কৃপা প্রাপ্তির প্রবর্তক। বৈঞ্চব-বৈরাগ্য গোত্রদ্বয় বেশ সাযুজ্যতাময়। প্রকৃতপক্ষে বাংলার প্রকৃতি তথা ঋতু বৈচিত্রতার কারণে সকল মানুষের মধ্যেই বৈরাগ্যতার প্রভাব বেশ লক্ষ্যনীয়। তাই তো ঋতু বদলক্রিয়া অনেকটা অগোচরেই মানুষকে উদাসিন-ভাবুক করে তুলে। মানুষ ভেবে ওঠে কে আমি ? কোথায় আমার উৎস্য? কোথায় আমার গন্তব্য?। কিন্তু এই আত্মজিজ্ঞাসার বাইরে যাওয়া সাধারণ্যের পক্ষ্যে সম্ভব হয়ে ওঠেনি কোনদিন। মূলতঃ শ্রাস্ত্র-কিতাব-স্বর্গ-নরক ভাবণা অধিকাংশকেই থামিয়ে দেয়-দমিয়ে রাখে। তবে, কিছু লোক সব সময়ই থাকেন, যাঁরা সকল বাঁধা অতিক্রম করার সাহস নিয়ে জন্মায়, তাঁরা বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার ক্ষমতা রাখেন। তারাই বৈরাগ্যতাকে ধারণ করেন। তবে তাঁরা ধর্মত্যাগী না হলেও নিশ্চিতভাবেই বেদাশ্রিত নয়, মানুষ পূজারী। যেখানে ধর্ম, বর্ণ বেশ গৌণ্য হয়ে ওঠে। মূলত সকল স্তরের মানুষের মধ্যে তাঁরা অবতার শ্রীকৃষ্ণকে খুঁজে বেড়ান। গৌড় বর্ণের বস্ত্র এদের পোষাক। এই পর্যায়েও সমাজপতিগণ বৈরাগ্যতাকে কলুষিত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মূল বৈরাগ্য সাধণায় অনাচারের জায়গা নেই। তবে, বৈরাগ্যতার আড়ালে-আবডালে অনাচার কিছু সংঘটিত হলেও তা ব্যতিক্রম। মনে রাখা উচিত যে,
ব্যতিক্রম কখনো দৃষ্টান্ত হতে পারেনা। অপরদিকে, বাংলায় বৈঞ্চবদের দু’টি মতবাদ ছিলো এবং এখনো তা চলমান। একটি বড়ু চন্ডিদাস কর্তৃক প্রবর্তিত সহজিয়া বৈঞ্চব মতবাদ। অপরদিকে, শ্রী চৈতন্যদেব কর্তৃক প্রবর্তিত গৌড়িয় বৈঞ্চব মতবাদ। এ দু’টি মতবাদেই সকল স্তর-বর্ণের-গোত্রের মানুষের সম্মিলন বেশ লক্ষ্যনীয়। তবে সাধণার প্রকৃতি-ধরণে পার্থক্য বেশ স্পষ্ট। বড়ু চন্ডিদাসের সহজিয়া মতবাদে সাধণার আঙ্গিক-আচার হিসেবে পরকীয়া প্রেমকে স্বীকৃতি প্রদান করলেও গৌড়িয় মতবাদ পরকীয়া প্রেমকে ত্যাজ্য করে মানুষপ্রেম-মানুষভজনের মাধ্যমে স্রষ্টাকে পাওয়ার সাধনা করেছে। কিন্তু এ দু’টি মতবাদ তৎকালীন সময়ে বেদাশ্রিত সমাজপতি ব্রাহ্মণকূলকে বেশ ভুগিয়েছে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। তাইতো শ্রী চৈতন্য দেবের অকাল মৃত্যুকে এখনো তাঁর অনুসারীগণ ব্রাহ্মণকূল কর্তৃক সংঘটিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে বিশ্বাস করে। তবে, তারপরেও তাঁর মতবাদ থেমে থাকেনি এবং এখনো তা টিকে আছে বেদাশ্রিত শাস্ত্রানুধ্যায়ীদের বৃদ্ধাংগুলি প্রদর্শন করেই।

বাংলায় মুসলমানদের আগমন ব্যবসা-শাষন-শোষনের জন্য হলেও তাঁরা সাথে করে নিয়ে আসেন আসমানী কিতাব “কোরআন”। তাইতো ব্যবসা-শোষন-শাষনের সঙ্গে সঙ্গে আসমানী কিতাবের বাণী প্রচার-প্রসারেও তারা বেশ মনযোগী হয়ে ওঠেন। কখনো ধর্ম প্রচারে-প্রসারে শাষকগণ শক্তি প্রয়োগও
করেছেন বেশ। তবে, বিশেষেভাবে লক্ষ্যনীয় যে, এই কিতাব ও কিতাবস্থিত আয়াতকেও বিভিন্ন মনিষি বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ নিয়েছেন তাইতো আগত মুসলমানদের মধ্যেও ধর্ম পালন-লালন কিংবা সাধণার ধরণ-পরব গুলোও বেশ ভেদপূর্ণ হয়ে ওঠেছিলো। তাই এই ধর্মটি প্রচারের
ক্ষেত্রেও প্রচারকগণ শরিয়ত ও মারফতী (সুফি) মতাবাদে বিভক্ত হয়ে যায়। সুফিবাদে বিশ্বাসীগণ বিশ্বাস করেন যে, জাহিরি বা দৃশ্যমান ধর্মীয় আচারিক কর্মকান্ডগুলো অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয়। যেহেতু কলব (আত্মা) এর শুদ্ধতা ভিন্ন স্রষ্টার কৃপা অর্জণ সম্ভব নয় সেহেতু কেবলমাত্র সে লক্ষ্য অর্জন করতে আধ্যাত্মিকতার আশ্রয় নিতে হবে। তবে এক্ষেত্রে এই মতবাদীগণ সংখ্যালঘু হওয়ায় শরীয়তপন্থিদের দ্বারা তারা বারংবার নিগৃহীত হয়েছেন এবং এখনো হচ্ছে। কেবল তাই নয় অনেক সুফি দার্শনিককে তাঁদের মতবাদের কারণে হত্যাও করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে মনসুর হাল্লাজ-এর নাম স্বরণ করা যেতে পারে।

এই বাংলায় শরিয়তপন্থিদের এই যে, প্রসারতা তার পেছনে অগ্রদূত হিসেবে কাজ করেছেন হাজী শরিয়তুল্লাহ গং গণ। আজকে এই পন্থিদের উগ্রতার উত্তাপে সোনার বাংলার রক্ত ঝরছে প্রতিদিন। সোনার বাংলার ভবিষ্যৎও যে বেশ বন্ধুর তা বেশ নিশ্চিতভাবেই বলে দেয়া যায়।

(৩)
উপরে বর্ণিত ধাক্কাগুলোতে ধর্মাশ্রয়ী অহংকারী সমাজ-রাষ্ট্র কিছুটা নড়বড়ে ওঠলেও তা অনেকাংশেই চূর্ণ করে দেয় মহাত্মা লালন, ফকির লালন, বাউল লালন, শাহ্ লালন, দার্শনিক লালন (জন্ম: ১৭৭৪, মৃত্যু: ১৮৯০)। আমাদের লালন বলেন :

(ক)
“এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে।
সেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে ।।”

(খ)
“ডানে বেদ, বামে কোরান,
মাঝখানে ফকিরের বয়ান,
যার হবে সেই দিব্যজ্ঞান
সেহি দেখতে পায়।”

(গ)
“মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।
মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই
মূল হারাবি।
মানুষ ছাড়া মনরে আমার
দেখিরে সব শুণ্যকার
লালন বলে মানুষ আকার
ভজলে পাবি।”

কিন্তু ভাবতে স্থবির হয়ে যাই, এই মানুষটির ধর্মভেদ নির্ণয়ের জন্য গবেষকগণ যে পরিমান পরিশ্রম করেছেন, তার সিকিভাগ যদি লালনের ভাবাদর্শের ভেদ নির্ণয় এবং তা সমাজ-সংসার-রাষ্ট্রে বিতরণের জন্য ব্যয় করতেন তবে সত্যই এই দেশটি সোনার মানুষে ভরে ওঠতো। একদল বলেন লালন হিন্দু।
আরেকদল সবুদ দিয়ে বলেন লালন যবন। অথচ লালন নিজেকে মানুষ ভেবেছেন, মানুষ ভবেছেন, মানুষ পূঁজেছেন। যেখানে বর্ণ-ধর্ম-গোত্র কেবল অসার শব্দ এবং মূল্যহীণ ফালতু বিষয়। তাই তো আমাদের লালন আবার বলে ওঠেন:

“সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে ।।​
লালন কয় জাতের কী রূপ​
আমি দেখলাম না দুই নজরে।​
সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে ।।
কেউ মালা’য় কেউ তছবি গলায়,​
তাইতে যে জাত ভিন্ন বলায়​
যাওয়া কিম্বা আসার বেলায়​
জাতের চিহ্ন রয় কার রে​
সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে ।।
যদি ছুন্নত দিলে হয় মুসলমান,​
নারীর তবে কি হয় বিধান,​
বামণ চিনি পৈতা প্রমাণ,​
বামণি চিনে কিসে রে​
সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে ।।
জগত্ বেড়ে জেতের কথা,​
লোকে গৌরব করে যথা তথা​

লালন সে জেতের ফাতা ঘুচিয়াছে সাধ বাজারে’​
সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে ।।”

এরপরে আর কিছু বাকী থাকে কি? থাকার কথাও নয়। যুক্তিতে-তত্ত্বে-দর্শনে ধর্মাশ্রিত নাকউঁচু সমাজপতিগণ বারবার পরাজিত হয়েছেন। কিন্তু দমে যাননি। তাইতো তারা বারংবার তাঁকে আঘাত করেছে, অপবাদ দিয়েছে, ব্যভিচারী বলেছেন। সেই দলে শিক্ষিত ও বিশিষ্টজনও ছিলেন এবং এখনো
আছেন। কিন্তু এতোকিছুর পরেও লালন ঝড় সব অহংকারীর অবয়বে যে চপেটাঘাত করেছে তা কিন্তু বেশ স্পষ্ট। দারুনভাবে স্পষ্ট।

সূত্রসমূহ:
১. হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি- গোলাম মুরশিদ
২. লালন সমগ্র-আবদেল মাননান
৩. মহাত্মা লালন ফকির-শ্রী বসন্ত কুমার পাল