boat man

এক

বারো বছর বয়সে আমি বিশাল আঁতেল হয়ে উঠেছিলাম। যেখানে যে বই পাই তাই গোগ্রাসে গিলতাম, এ অভ্যাস দীর্ঘদিন ছিল। আর আমি নিজেই যে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট দার্শনিক তাতে খুব একটা সন্দেহ ছিল না।

তখন আবার মাঝেমাঝে অভিযানের শখ জাগত। একটি বড় ধরণের অভিযান ছিল নদীর ওপারে গিয়ে বেড়ানো, ওখানে কিছু বন্ধুও জুটে গিয়েছিল।

বর্ষায় নদীর দু’ধার উপচে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন মনে হল ওপার থেকে ঘুরে আসি। খেয়া পারাপারের জন্য আছে শর আলী মাঝির ঘাট। শর আলীর আসল নাম হয়ত শহর আলী বা সবুর আলী। লোক মুখে বদলে হয়ে গেছে শর আলী। এক দুষ্টু বন্ধু বলেছিল, শর আলীকে দ্রুত ‘শুওর আলী’ বলে ডাকলে সে নাকি বুঝতে পারে না। একদিন ব্যাপারটি পরখ করার সুযোগ পেয়েছিলাম অবশ্য।

এ ঘাট দিয়ে নদী পার না হলে আরো দুই কিলোমিটার হেটে গিয়ে পার হতে হবে। শর আলী তাঁর ঘাটটিকে নিজের সম্পত্তি মনে করে, আর কারো নৌকা ওখানে ভেড়ানো নিষেধ আছে।

নদী পারের জন্য শর আলীর ঘাটে গেলে দেখলাম এক ছোটখাট জটলা। সবকিছু শোনে বুঝতে পারলাম, শর আলী পাগল হয়ে গেছে। এভাবে বছরে একবার নিয়মিত পাগল হয় সে। একদিন পর সেরেও যায়। ঐদিন যা পরেন না কেন, সে সবাইকে লুঙ্গি খুলে নৌকায় উঠতে বলে, আদেশ না মানলে মাঝ নদীতে নিয়ে গিয়ে নৌকা ডুবিয়ে দেয়। আর ঐদিন পারাপারে টাকাপয়সা নেয় না। তাই শর আলী পাগল হলে সবার উচিত – হয় লুঙ্গি খুলে নৌকায় উঠা, অথবা হেটে গিয়ে অন্য ঘাটের নৌকায় উঠা। এক মুরব্বি বুঝিয়ে বলছেন, দুই বছর আগে ইমাম সাহেবকে মাঝ নদী থেকে পাজামা খুলে সাতার দিতে হয়েছিল। নৌকা ডুবিয়ে দেয়ায় সাত/আট বছর আগে এক লোক ডুবে মরে গিয়েছিল। কিন্তু পাগল তো, একে মেরে কী লাভ!

বুঝতে পারলাম, নগ্ন হয়ে নৌকায় উঠেও নিজেকে নিরাপদ মনে করা যাবেনা। আমি শর আলীর সামনে গিয়ে প্যান্ট খুলতে গেলেই তিনি বললেন, তোর *** ছোড, লুঙ্গি খুলা লাগবেনা। এদিকে কয়েকজন লোক আহাজারি করছে তাদের নাকি এখনই ওপারে যাওয়ার বিশেষ প্রয়োজন । একজন কেঁদে কেঁদে বলছে, তাঁর নাকি তালতো ভাই এক্সিডেন্ট করেছে, দ্রুত না গেলে মরে যেতে পারে।

আমি চুপি চুপি গিয়ে মাঝির কাছে বসলাম। আস্তে করে বললাম, শুওর আলী চাচা, ঐ যে লোকটা, সত্যি বিপদে, ওকে কি মাফ করা যায় না?

তিনি চোখ গোল করে আদেশ করলেন, লুঙ্গি খোল।

আমি খুশি মনে প্যান্ট খোলে নৌকায় বসে থাকলাম। শর আলি জিজ্ঞেস করলেন, সিগারেট খাস?

আমি তাঁর হাত থেকে সিগারেট নিয়ে পায়ের উপর পা রেখে বসে থাকলাম। আমাকে প্যান্ট খুলতে দেখে অবস্থা বেগতিক মনে করে আর দেরী না করে আরো তিনজন লুঙ্গি খুলে নৌকায় উঠে পড়লেন।

সবাই একে অপরের দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছে। আমি হাসছি না। কারণ বেকুবরা অকারণে হাসে, আমি বেকুব নই।

দুই

স্বঘোষিত বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট দার্শনিক নগ্ন হয়ে নৌকায় বসে আছেন। তাঁর মনে বেশ কিছু ভাবনা উকি দিচ্ছে। সব থেকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন নিরাপত্তাকে, কারণ ভাবতে হলে বাচতে হবে।

নৌকা ডুবিয়ে দিলে কী কী সমস্যা হতে পারে? এ নদীতে কি বিপজ্জনক কোনো প্রাণি আছে? সাতার কাটতে থাকলে এসব বিপজ্জনক প্রাণিগুলো ইয়ে ছোড বলে নিশ্চয় ছেড়ে দেবে না। কিন্তু এরকম কোনো প্রাণি নদীতে নাই। একসময় জলহস্তি ছিল বলে শোনেছি, কিন্তু এরা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে দাদার আমলেই। সেসময় মানুষ কম ছিল, কিন্তু মানুষ সংখ্যায় কম হলেও বিপজ্জনক।

শীতকালে সাতরে অপর পারে যেতে কোনো সমস্যা হত না। কিন্তু এখন বর্ষায় নদী যেন সাগরে রূপ নিয়েছে। পানির শা শা শব্দে বুকে কাঁপন উঠে। এর মাঝে আবার আছে কয়েকটা ঘূর্ণাবর্ত। হিসাব করে দেখলাম ডুবন্ত নৌকার অবস্থান যেখানেই হোক না কেন আমাকে কখনো নদীটির অর্ধেকের বেশি সাতার কাটতে হবেনা, যে পাড় কাছে সেদিকেই সাতার দিতে হবে। সাতরাতে হবে কিছুটা স্রোতের অনুকূলে। ভয় পেয়ে উলটো দিকে সাতরাতে থাকলে আর কোথাও যাওয়া হবেনা। ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে পড়ে গেলে বাচার প্রাণপণ চেষ্টা করতে গিয়ে মানুষ মারা যায়। তাঁর চেয়ে বরং নিজেকে মুক্তভাবে ছেড়ে দিলে কয়েক ফুট নিচে টেনে নিয়ে ছেড়ে দেয়, তখন আবার সাতার লাগাতে হবে। ও হ্যাঁ বলিনি, আমি বেশ পটু সাতারু ও ডুবুরি ছিলাম। প্রায় দুই মিনিট পানির নিচে অনায়াসে থাকতে পারার বিরল দক্ষতাও ছিল। তাই নৌকা ডুবার সময় শুধু খেয়াল রাখতে হবে কেউ যেন ধরে ফেলতে না পারে, নাহলে দুজনে মিলে সলিল সমাধি।

নিরাপত্তার পরে ইয়ে নিয়ে ভাবনা। ইয়ে মানে ইয়ে। ছোট মানুষের ইয়ে ছোট হবে সেটা পাগলও জানে। কিন্তু পৃথিবীর অনেকগুলো জাদুঘরে দেখলাম বেশ হৃষ্টপুষ্ট, শক্তিশালী পুরুষের ভাস্কর্যগুলোতে সব কিছু ঠিক আছে কিন্তু ইয়েটা ছোড। পরে জানতে পারলাম সৌন্দর্য ও দেহের কাম্য আঁকার-আকৃতির ধারণা বিভিন্ন যুগে খুবই ভিন্ন ও বিপরীতমুখী ছিল। আজ থেকে দুইশ’ বছর আগের সবচেয়ে সুন্দরী নারীকেও হয়ত বর্তমানে আপনার কাছে আকর্ষণীয় মনে হবেনা। প্রাচীন গ্রীস ও রোম সাম্রাজ্যে লিঙ্গের আঁকার ছোট হওয়াকেই স্বাভাবিক, সুন্দর ও কাম্য বলে মনে করা হত। ছোট লিঙ্গ বুদ্ধিমত্তা ও পৌরুষত্বের প্রতীক ছিল। অপরদিকে বড় লিঙ্গ আহম্মকি, কামুকতা ও কদর্যতাকে নির্দেশ করত। ব্যতিক্রমী যেসব বড় লিঙ্গের মূর্তি দেখা যায় তাদের ভাবমূর্তি সুবিধাজনক নয়। ইয়ামোটা ও দীর্ঘাকার লিঙ্গের মূর্তি গ্রীক উর্বরতার দেবতা প্রায়াপাসের। সে গ্রীক দেবতা জিউসের স্ত্রী ও দেবীদের রাণী হেরার অভিশাপে অনন্ত-ঋজু লিঙ্গ, যৌন-অক্ষম ও নির্বোধে পরিণত হয় এবং তাকে অলিম্পাস পর্বত থেকে ফেলে দেয়া হয়। উত্তিত লিঙ্গের সেটারের দেহেই রয়েছে পাশবিকতা। একসময় হয়ত কিছু মানুষ ইয়ের সাইজ নিয়ে ভাবত, কিন্তু বর্তমানে আমরা গণতন্ত্রের যুগে প্রবেশ করেছি, তাই হয়ত সবাই এটি নিয়ে ভাবে। কিন্তু বিপত্তি ঘটে অতিগণতন্ত্রে, যখন সবাই একে অন্যের সাইজ মাপতে শুরু করে।

এরপর এল লুঙ্গি খোলা নিয়ে ভাবনা। এই লোকগুলো জীবনের ঝুঁকি নিয়েও লুঙ্গি না খোলে নৌকায় উঠতে চাচ্ছিল। আসলে সমস্যা কী? এই প্রশ্নও কমন পড়েছিল। এর অনেকগুলো কারণের একটি হল মেইন কারেক্টার সিন্ড্রোম। আমরা নিজেকে এ বিশ্ব-নাট্যশালার প্রধান চরিত্র বলে মনে করি, আমি এতটা গুরুত্বপূর্ণ যে মহাবিশ্বের সবকিছুই আমাকে ঘিরে হচ্ছে । এখন শার্ট একটু ছিড়ে গেলে বা দুই ধরণের মোজা পরলে মনে হয় দুনিয়ার সবাই আমার দিকে তাকাচ্ছে, তাদের কারো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কারো অতটা মাথাব্যথা নাই আমাকে নিয়ে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এ সমস্যা অনেকটা দূর হয়ে যায়। তবে প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। যারা নিজেকে এত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে, সেসব মানুষ কিভাবে দলদাসে পরিণত হয়, যুগের পর যুগ কোনো একটি রাজনৈতিক দলের, কোনো একটি মতাদর্শের, কোনো একটি ধর্মের, কোনো একজন লোকের দাসত্ব করে যায়?

এর মধ্যে খেয়াল করে দেখলাম। নৌকা মাঝ নদীতে পৌঁছে গেছে।

সবশেষে যে বিশাল ভাবনাটা মনকে উতাল-পাতাল করে তুলল সেটা হচ্ছে, এখানে কয়েক হাজার মানুষ বাস করছে। সবাই দশকের পর দশক এই শর আলী পাগলার নৌকা দিয়া পার হয়। নৌকাও খুব ছোট, বেশি মানুষ ধরে না, ঝুঁকি আছেই। এছাড়া পাগল হলে নৌকা ডুবায়, একজন মরেই গিয়েছিল। কেন সবাই মিলে একটা নৌকার ঘাট তৈরি করে নিতে পারে না, একটি ভাল নৌকা কিনে একজন মানসিকভাবে সুস্থ মাঝিকে দায়িত্ব দিতে পারেনা? মরছে তো মাত্র একজন, পাগল তো বছরে মাত্র একবার হয়, এই নৌকায় কাজ চলছে যখন চলুক, শর আলী মাঝির বিকল্প নাই এসব ভাবনা থেকে এতগুলো লোকও এত বছরেও কেন বেরোতে পারেনা? আর আমি নিজেই কেন এই নৌকায় উঠে পড়লাম, খুব কি প্রয়োজন ছিল?

তিন

আমাদের আরেক শর আলী মাঝি পাঁচ বছর পর পর পাগল হয়, শুরু হয় তার ইলা-বিলা। সময় আর বেশি নাই, লুঙ্গি খুলে নৌকায় উঠে পড়েন। এতসব ভেবে কী লাভ, দীর্ঘ পাঁচ বছর পর তো!