অতি সম্প্রতি শ্রদ্ধেয় মুহম্মদ জাফর ইকবালকে তারই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে পেছন থেকে মাথায় ছুরিকাহত করা হয়েছে। এই হত্যাচেষ্টাটি সংঘটিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কোলাহলপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্যে, যেখানে তিনি শুধু নিয়োজিত নিরাপত্তাকর্মীদের দ্বারাই পরিবেষ্টিত ছিলেন না, সাথে ছিলে তাকে দেবতার মত শ্রদ্ধা করা ছাত্র-ছাত্রীরাও। স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায় এমন জনাকীর্ণ স্থানে তাকে যে হামলা করেছিল সে মোটামুটি এক ধরণের আত্মঘাতী চিন্তাচেতনা থেকেই এই কাজটি করেছিল। অর্থাৎ, তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল তাকে হত্যা করা, কার্যসিদ্ধির নিমিত্তে নিজের জীবনেরও তোয়াক্কা করেনি সে। কারণ এমন জনবহুল স্থানে কারও উপর হামলা করে সেখান থেকে পালিয়ে আসা কার্যত অসম্ভব। এই পরিণতি মাথায় নিয়েই সে হত্যাচেষ্টা চালিয়েছে। অর্থাৎ এটাকে এক ধরনের আত্মঘাতী হামলা বললেও অত্যুক্তি হবে না।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আপোসহীন লেখালেখির জন্য জাফর ইকবাল অনেক আগে থেকেই জামায়াতে ইসলাম ও ছাত্রশিবিরের অন্যতম টার্গেট ছিলেন। নিয়মিতই তিনি কাফনের কাপড় পেতেন পার্সেলের মাধ্যমে। একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে হুমায়ুন আজাদসহ দেশের আরও অনেক আপোষহীন লেখক-বুদ্ধিজীবীকে। জাফর ইকবালের আরেকটা বড় ‘অন্যায়’ ছিল তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে একটা প্রজন্মকে উদ্দীপ্ত করতে পেরেছিলেন, স্বাধীনতার পক্ষে একটা লড়াকু প্রজন্মের জন্ম দিতে পেরেছিলেন। এজন্য মৌলবাদী শক্তি তাকে আরও বেশি ভয় পেতো। দেশে স্বাভাবিকভাবেই যারা প্রগতিশীল চিন্তাভাবনার সাথে যুক্ত থাকে তাদেরকে শুরুতেই ‘ইসলামের শত্রু’ বলে চিহ্নিত করা হয়। এবং এতে কাজও হয়। দেশে এক বিশাল সংখ্যক ধর্মভীরু মানুষ আছে যারা ধর্মের প্রশ্নে বিনাবাক্যব্যয়ে যুক্তি ও নীতিবোধ বিসর্জন দেয়ার জন্য প্রস্তুত। আর অবিরাম জামায়াতে ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য এবং জামায়াতে ইসলামের সাথে সহবাস করার জন্য বিএনপিকে নিয়মিত চরম সমালোচনার মধ্যে রাখায় বিএনপির এক বিশাল সংখ্যাক সমর্থকগোষ্ঠীও জাফর ইকবালকে শত্রুর চোখে দেখে থাকে। এর পাশাপাশি আছে কিছু স্বঘোষিত বাম-সৈনিক, যাদের অভিযোগ জাফর ইকবাল আওয়ামীলীগের দালাল। জাফর ইকবাল নিজে কখনও আওয়ামীলীগের প্রতি কোন নিঃশর্ত দাসত্ব প্রকাশ করেন নি, বরং বিভিন্ন সময়ে যথাযথ সমালোচনাও করেছেন। তার একমাত্র অপরাধ তিনি অকপটে বলে ফেলেন যে তিনি ক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে দেখতে চান। বিএনপি যেহেতু স্বাধীনতাবিরোধীদের পক্ষাবলম্বন করে আসছে জন্মলগ্ন থেকে, কাজেই তার এই বক্তব্যের সুবিধা পায় আওয়ামীলীগ। এখন, এটা তো উনার অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে না। উনি তথাকথিত নিরপেক্ষতা না সরাসরি বলেন যে মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে উনি কোন আপোষ করবেন না। বিএনপি মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের সাথে নিয়ে রাজনীতি করতে এই দায় তো উনার না, এই দায় বিএনপির। উনি অন্ধভাবে আওয়ামীলীগ সমর্থন করেন- বাম-সৈনিকদের এই যুক্তি তাই অবাস্তব ও হাস্যকর।
এবারে আসি কারা তার উপর এই হামলা চালাতে পারে। প্রথমেই বলেছি, তিনি অবিরাম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলেন দেখেই, একটা প্রজন্মকে প্রগতিশীলতার চর্চায় উদ্বুদ্ধ করেছেন দেখেই মৌলবাদী শক্তি একটা প্রধান টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। সর্বশেষ যা খবর পাওয়া গেছে, হামলাকারী মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ছিল, এবং ইসলামের শত্রু হিসেবে জাফর ইকবালকে হত্যা করা সে তার ঈমানী দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছিল। ‘নাস্তিক, কুলাঙ্গার’ জাফর ইকবালের ফাঁসী চাওয়া তো নতুন কোন ঘটনা নয় এই বাংলাদেশে। আচ্ছা, বলুন দেখি ‘নাস্তিকদের ফাঁসী চাই’ এই শ্লোগানটা কি খুব অপরিচিত লাগছে? আচ্ছা, এর আগে আরেকটা ঘটনার কথা বলি।
হলি আর্টিজানে হামলার পর পত্রপত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষজনের যে প্রতিক্রিয়া দেখেছিলাম তার সারমর্ম করলে এই দাঁড়ায় যে- ‘সবাই হতভম্ভ, এমন ঘটনা কিভাবে ঘটল কেউ ভেবে পাচ্ছে না, সবাই মারাত্মক রকমের শকড’। অর্থাৎ দেশের নিরীহ, গোবেচারা, নির্বিকার মানুষগুলো যেন আঁচই করতে পারেনি এমন কিছু হতে পারে। ইংরেজিতে বলতে গেলে, They didn’t see that coming! অথচ একের পর এক মুক্তমনা ব্লগারদের যখন পিটিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছিল তখন এই দেশবাসী নির্বিকার ছিল। এই ঘটনাগুলো তাদের বিচলিত করতে পারেনি।
একটা অংশ খুব জোরেশোরেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল যে নাস্তিক মারা যাওয়ায় তারা খুব খুশি। আরেকদল ছিল যারা সরাসরি হত্যাকান্ড সমর্থন করে নি, কিন্তু ইনিয়ে বিনিয়ে এটাকে জায়েজ করতে চেয়েছিল। তাদের বক্তব্য ছিল অনেকটা এরকম- হত্যাকাণ্ডকে আমি সমর্থন করি না, কিন্তু এভাবে ধর্ম নিয়ে লেখালেখি করলে তো এমন পরিণতি আসবেই। অর্থাৎ প্রকারান্তে, তারা এই হত্যাকাণ্ডগুলোকে বৈধতা দিয়েছিল। আরেক পক্ষ ছিল, যারা বরাবরের মতই নিশচুপ নির্বিকার ছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই ৩ ধরণের বাইরে সংখ্যায় খুবই অল্প একটি অংশ ছিল যারা বারবার বলার চেষ্টা করেছিল যে, এই ধরণের হত্যাকাণ্ড শুধু নিন্দনীয়ই নয়, এর পরিণতিও ভয়াবহ। ২০১৫ সালে যখন অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হল তখন আমরা হতাশ ও ক্রুদ্ধ হয়েছিলাম। উপরন্তু, সরকারের পক্ষ থেকে যখন ‘নাস্তিক হত্যার দায় সরকার নেবে না’ এই ধরণের বক্তব্য এলো তার ফলশ্রুতিতে আমরা দেখলাম নীলয় নীল, ওয়াশিকুর বাবু, আরেফিন দীপন হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন, এবং সেই একই মৌলবাদী শক্তির দ্বারা। আর এর পাশে বিভিন্ন সময়ে ৫৭ ধারার মাধ্যমে বায়বীয় অভিযোগে কতজনকে গ্রেপ্তার-হয়রানি করা হল। বাংলাদেশ যে ক্রমেই ধর্মীয় চরমপন্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে, এই ঘটনাগুলো ছিল তার ওয়ার্নিং পয়েন্ট। অথচ প্রতি ক্ষেত্রে এদেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদরা নির্বিকার থেকেছে। ক্ষেত্র বিশেষে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে নির্লিপ্ত থেকেছে। এই নির্লিপ্ত নির্বিকার জনগোষ্ঠী যখন হলি আর্টিজান ঘটনার পর ‘আকাশ থেকে পড়ল’ তখন আমার অতি দুঃখে হাসি এসেছিল।
হেফাজতে ইসলামের উত্থান, সংখ্যালঘু নির্যাতন গুনোত্তর হারে বেড়ে যাওয়া, শহরে-নগরে-গ্রামে-গঞ্জে রাজনীতিতে ধর্মীয় মৌলবাদীদের প্রবেশ-সব কিছুই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে আমরা মৌলবাদ এখন সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশের প্রতিনিধিত্ব করছে না, এটি প্রবেশ করেছে আমাদের মননে, সংস্কৃতিতে, জীবনাচরণে এবং সর্বোপরি রাজনীতির মূল ধারায়। জন্মগত ও ইতিহাসগতভাবে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা করা আওয়ামীলীগ ভোটব্যাঙ্কের জন্য হেফাজতে ইসলামের সাথে সন্ধিস্থাপন করেছে, সেইসাথে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সেন্টিমেন্ট বুঝে ব্লগার ও মুক্তবুদ্ধির চর্চা করা মানুষদের উপর নেমে আসা বিপর্যয়ে অন্ধের ভূমিকা পালন করেছে। অন্ধের ভূমিকা পালন করেছে বললে ভুল হবে, প্রায়শঃই মৌলবাদী শক্তিকে তুষ্ট করতে ও জনসাধারণের মাঝে ‘ধার্মিক’ ভাবধারা বজায় রাখতে আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীরা মুক্তবুদ্ধির চর্চার বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছে এবং ব্লগার হত্যার মীমাংসা তো দূরে থাক, মৌলবাদীকে ও জঙ্গিদের সমালোচনা না করে উলটো ব্লগারদেরই সমালোচনা করেছে। এরই ফলশ্রুতিতে, কেন্দ্র থেকে প্রান্তীয় পর্যায়ে মৌলবাদী মনোভাব সম্পন্ন ধর্মান্ধ মানুষের রিক্রুটমেন্ট ঘটেছে আওয়ামীলীগে, আরও শক্ত ভাষায় বলতে গেলে, এদের আত্মীকরণ করেছে আওয়ামীলীগ।
জাফর ইকবালের স্যারের উপর হামলার ঘটনা নিয়ে লেখায় এ কথাগুলো কেন বললাম? এর কারণ হচ্ছে, উনার উপর হামলা যে করেছে এবং এর পেছনে যারা আছে তারা সেই মৌলবাদী শক্তিরই প্রতিনিধি যারা বাংলাদেশকে একটি ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়, যারা মনে করে মুক্তবুদ্ধির চর্চা হতে হবে সীমিত আকারে, এবং রাষ্ট্র সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মমতের মানুষদের অগ্রাধিকার দেবে। অর্থাৎ, সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে সাম্প্রদায়িক আধিপত্বের ভিত্তিতে। ঠিক এই শক্তিই ব্লগার-মুক্তমনাদের উপর নাখোশ, এই একই শক্তি পরিকল্পনামাফিক একের পর এক ব্লগার-লেখকদের উপর হামলা চালিয়েছে। অর্থাৎ, জাফর ইকবালের উপর হামলা আসলে কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ক্রমাগত প্রগতিশীলতার চর্চা করা মানুষদের কোনঠাসা করে, মেরে ফেরে, শেষমেশ এই শক্তি সাহস করেছে জাফর ইকবাল স্যারের মত এক মহীরুহের উপরো চড়াও হতে। কাজেই, আজকে আমি ক্রুদ্ধ, হতাশ, কিন্তু অবাক নই। এটা নতুন কোন বাংলাদেশ নয়।
এটা চিরচেনা সেই বাংলাদেশ যে বাংলাদেশে শাহরিয়ার কবির আর মুনতাসির মামুনকে মুরতাদ ঘোষণা করা হয়, আহমেদ শরীফকে শয়তান উপাধি দেয়া হয়, হুমায়ুন আজাদকে কুপিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলে যাওয়ার হয়। এটা সেই বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশে অভিজিৎ রায়ের মগজ রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে আর সোশ্যাল মিডিয়ার প্রকাশ্যে জনগণ উল্লাসধ্বনি উচ্চারণ করে একজন নাস্তিক মরেছে বলে। এই বাংলাদেশে জাফর ইকবালের উপর হামলা তাই আমাকে আর অবাক করে না। এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল, তাই না?
বাংলাদেশের মূলধারায় মৌলবাদীদের অনুপ্রবেশ প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা অর্জনের এই খেলা অনেক আগেই শুরু হয়েছে এবং এটা এখন পরিণত। তীব্রতা পেয়েছে নষ্টামি ও পতনের বেগ। এখান থেকে সুস্থতায় ফিরতে পারা দ্রুতবেগে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে।
আশংকাটি এইখানে, আর এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে অনেক আগেই।
জনপ্রিয় এই লেখক সরকারের সমালোচনা করায় সিলেটের একটি গোষ্ঠী দীর্থদিন ধরে তাকে বলে প্রচার করে আসছে। এই গোষ্ঠিটির নেতৃত্বে সরকারি দলের পাণ্ডারা যেমন আছেন, মৌলবাদীরাও আছেন। যদিও হামলার পর টিভি সাক্ষাতকারে তিনি বলেছেন, তিনি কখনো ধর্মের সমালোচনা করে একটি বাক্যও কোথায় লেখেননি।
এই “নাস্তিক” প্রচারের ভেতর জাফর ইকবালকে সরাতে পারলে মৌলবাদীদের এক ঢিলে দুই পাখি মারা হয়, একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি নাশ ও “নাস্তিক” নিধন।
মুহাম্মদ জাফর ইকবাল ইস্যুতে দেশের নানা স্থানে নানা জনে প্রতিবাদের চিত্র দেখে মনে হয় আমরা সত্যি বুঝি কিছুটা এগিয়ে গেলাম। মন্দকে মন্দ বলে সনাক্ত করতে পারা এবং প্রকাশ্যে তাকে মন্দ বলার মাঝে সভ্যতার লক্ষণ খুব স্পষ্ট। কিন্তু একটু গভীরভাবে যদি চিন্তা করি তখন মনে হয় এর মাঝে কোথাও যেন একটা ফাঁক রয়ে গেছে। প্রতিবাদতো করছি কিন্তু কার বিরুদ্ধে করছি ? যে ঘটনাটি ঘটিয়েছে সেতো আধাশিক্ষিত একটা বাচ্চাছেলে সে ইতোমধ্যে ধৃত হয়ে উত্তম-মধ্যম খেয়ে পুলিশ হেফাজতে আছে। এখন তার আইনানুগ বিচার হবে। পুলিশ তার কাছ থেকে যতটুকু তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছে তাতে স্পষ্ট সে কোনো সন্ত্রাসী গ্রপের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। অনেকটা ‘লোন উলফ’ জাতীয় অপরাধী। পশ্চিমা জগতে এই লোন-উলফ’রা অনেক হত্যাকান্ড সংঘটিত করে থাকে। তো এ নিয়ে এত মাতামাতি এত হাহাকার কেন ? এর উত্তর সম্ভবতঃ এই, ছেলেটি জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে এই হামলা করেছে। মানুষের প্রতিবাদ তাহলে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ? জঙ্গিবাদ জিনিষটা কী ? এটা কি আকাশ থেকে পতিত কোনো মতবাদ? না কি আমাদের প্রতিদিনকার জীবন যাপন পঠনপাঠন স্তুতি বিশ্বাস থেকে উদ্ভুত?
বিজ্ঞানের কল্যাণে অমৃত এবং বিষ দুটোই এখন আমাদের হাতের নাগালে। যখন যা ইচ্ছা তা অনায়াসে হাত বাড়িয়ে পেতে পারি। ফয়জুল নামের আধা শিক্ষিত কিশোরটি অমৃতই নিয়েছে অন্ততঃ তার দৃষ্টিতে। শুধু তার দৃষ্টিতেই বলি কেন আমাদের দৃষ্টিতে নয় কি? ইউটিউবে অসংখ্য ভিডিও আছে দেশের বিখ্যাত সব আলেম মাশায়েকদের। এরা য্যান ত্যান কেউ নন। পঞ্চাশ হাজার থেকে শুরু করে এক লাখ টাকা পর্যন্ত ফিস নিয়ে হেলিকপ্টারে উড়ে গিয়ে জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দান করে থাকেন। সে ভাষণ আবার ভিডিও করে ইউটিউবে দেয়া হয়। এরকম অসংখ্য ভিডিও আছে যাতে মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে নাস্তিক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং নাস্তিককে হত্যা করার ফরমান দেয়া ভিডিওর সংখ্যা আরও অনেক বেশি। হুজুরগণ কোরান হাদিস থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখিয়েছেন নাস্তিক বিধর্মীকে কীভাবে হত্যা করতে হবে এমনকি তারা হজরত মুহাম্মদ (দঃ) এর যাপিত জীবনের দৃষ্টান্ত দিয়ে দেখিয়েছেন ভিন্ন মতাবলম্বী ইসলামের সমালোচনাকারী কতিপয় ইহুদি কবিকে হত্যা করার জন্য স্বয়ং মহানবী কীভাবে ভক্তদের অনুপ্রাণিত করছেন। এসব গাল-গল্প নয় এমনকি বিধর্মীদের অপপ্রচারও নয়। দেশ বিখ্যাত মৌলানাদের বক্তব্য। না এরও সুন্দর সাজানো জবাব তৈরি আছে। বলবেন- হুজুরগণ ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা করছেন। কিন্তু একটি আধুনিক এবং সর্বশ্রেষ্ট ধর্মের এত ভুল ব্যাখ্যা এত পরস্পর বিরুধী সাংঘর্ষিক বক্তবের এত অবাধ অবকাশ কেন এই প্রশ্নে না গিয়ে যদি খুব সাদামাটাভাবে প্রশ্ন করা হয় এইসব ভুল ব্যাখ্যা এবং হত্যায় উদ্বুদ্ধ করার অপরাধে কজন আলেমকেে গ্রেফতার করা হয়েছে? এরাতো ফেসবুকে ফেক আইডির মুখোশধারী নন। এরা বিখ্যাত ব্যক্তি। এদের হাজার হাজার ভক্ত আছে। এক একটা ভিডিওর লক্ষ লক্ষ ভিউ শত শত শেয়ার,সরকারের তরফে মুগ্ধ-মৌনতা ভিডিওগুলির বৈধতার স্বপক্ষে বড় প্রমান। ইউটিউবে সংরক্ষিত এইসব ওয়াজ নসিহত থেকেই ফয়জুল জেনেছে জাফর ইকবাল ইসলামের শত্রু এবং ইসলামের শত্রুকে কী করতে হবে তাও স্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছে। ইসলাম ছাড়া লোকটি সরকারেরও শত্রু। এই মাত্র ক’দিন আগে সিলেটের একজন সরকার দলীয় এমপি প্রকাশ্য জনসভায় বলেছেন জাফর ইকবালকে চাবুক দিয়ে পেটানো উচিৎ। ফয়জুলকে রাষ্ট্র এবং ধর্ম সমান অনুপ্রেরণা দিয়েছে। অতঃপর একদিন সুযোগ বুঝে ফয়জুল মাভৈ বলে নাস্তিক হত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
আইন কি ফয়জুলকে হত্যায় উদ্বুদ্ধকারী এইসব আলামত পর্যন্ত যেতে পারবে? আমাদের প্রতিবাদ কি ফয়জুলকে অতিক্রম করে তার শেকড় পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে ? নাড়াতে পারবে এর ভিত্তিকে? আদৌ না। যখন বুঝতে পারব আমার এ প্রতিবাদ আসলে আমারই বিরুদ্ধে সাথে সাথেই থেমে যাবে সকল নর্তনকুর্দন। আমার তখন বিষম বিবমিষা হবে।