“বিশ্ব নারী দিবস” উপলক্ষে অনেকেই অনেক ধরণের বক্তব্য দিয়ে থাকেন তবে আমি ভাবছি; ধর্মীয় অনুশাসনে চলা মুসলিম নারীদের কথা, যারা টিভি ক্যামেরার সামনে গর্ব করে বলেন-আল্লাহ হুকুমে আমি ঘরে অবস্থান করছি। কোরান হাদিসের বয়ানের আলোকে তারা ধর্মীয় অনুশাসন মেনে জীবন-যাপন করছেন। নারী মুক্তির মূল সংগ্রামটি করতে হয় নারীদের। পুরুষ হয়তো সহায়তাকারী হিসেবে থাকবে কিন্তু মূল যুদ্ধটা আসলে নারীর।

ইসলামের ইতিহাসে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বিবি খাদিজা (খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ) ও হয়রত আয়েশা (আয়েশা বিনতে আবু বকর) । নবী মুহাম্মদের অসংখ্য স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও এই দুইটি চরিত্র ১৫’শ বছর ধরে ইসলামের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে অবস্থান করে আছেন। অবশ্য হযরত আয়েশার বিষয়ে শিয়া’দের একটু ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি আছে তারপরও চরিত্রটি মুসলিম সমাজে গুরুত্বপূর্ণ।

বিবি খাদিজা ছিলেন ধনী বিধবা, পেশায় ব্যবসায়ী, ধর্মে খ্রিস্টান। নবী মুহাম্মদ তাঁর অধীনে কাজ করতেন। অর্থ-বিত্ত না থাকায় নবী মুহাম্মদের চাচা নিজের কন্যার সাথে মুহাম্মদের বিয়ে দেননি। অতঃপর মুহাম্মদের দক্ষতা ও সততা দেখে বিবি খাদিজা তার থেকে ১৫ বছর ছোট মুহাম্মদকে বিয়ে করেন। খাদিজা অত্যন্ত সম্মানিত ও সম্পদশালী ব্যবসায়ী মহিলা হওয়ার কারণে অনেক কুরাইশ যুবক তাকে বিয়ে করতে আগ্রহী হলেও তিনি বিয়ে করেন সম্পদহীন মুহাম্মদকে। খাদিজা নিজেই উভয় পক্ষের বিয়ের খরচ বহন করেছিলেন । শুধু এখানেই শেষ নয় নবী মুহাম্মদের কাছে যখন জিবরাইল ওহি নিয়ে আসলেন তখন তখন তিনি বাসায় এসে প্রথম খাদিজাকে জানান। এবং খাদিজা প্রথম ব্যক্তি যিনি নবী মুহাম্মদকে নবী হিসেবে প্রথম চিহ্নিত করেন ও স্বীকৃতি দেন। ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম নারী হিসেবে খাদিজা যতোটা গুরুত্বপূর্ণ তার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নবী মুহাম্মদের ইসলাম ধর্ম প্রচারের অর্থ খাদিজার সম্পদ থেকেই ব্যয় হয়। সুতরাং ইতিহাসের বিচারে আমরা দেখতে পাচ্ছি খাদিজা ছিলেন সেই ব্যক্তি যিনি একজন পুরুষের মাঝে তার শ্রেষ্ঠত্ব আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন। যেহেতু তিনি ব্যবসায়ী ছিলেন সেহেতু তিনি সারাদিন ঘরের কোনে বসে থেকেই জীবন পার করে দেন নাই। পুরুষের মতন ব্যবসা বাণিজ্যেও অবদান রেখেছেন।

এবার আসি হযরত আয়েশার প্রসঙ্গে। তিনি সম্ভবত ইসলামের ইতিহাসে প্রথম নারী যার অধীনে মুসলিম পুরুষরা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। খলিফা ওসমান খুন হবার পর আলি’র সাথে যুদ্ধে আয়েশা সশরীরে অবতীর্ণ হয়েছেন। সেই যুদ্ধের নাম আমরা জামাল বা উটের যুদ্ধে হিসেবে জানি। কারণ আয়েশা একটি বিশাল উটের উপর বসে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন। উটের উপর বসে থাকা আয়েশার নামে যুদ্ধের নাম করণ না হয়ে কেন যে উটের নামে যুদ্ধ হল সেটি একটি বড় প্রশ্ন। অন্য যুদ্ধগুলোর নাম করণ স্থানের নামে হলেও এই যুদ্ধটির নাম হয়েছে উটের নামে। বলা যায় পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই উটের নামে যুদ্ধের নাম করণ করা হয়েছে। নারীর ধর্ম ঘরে বসে থাকে এমন বয়ান তাহলে আয়েশার ক্ষেত্রেও খাটে না। নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর পর যে নারী যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন সেই নারীর অনুসারীরা আজ টিভি ক্যামেরার সামনে হাসি মুখে বলছেন-আল্লাহ ইচ্ছায় আমি ঘরে বসে আছি। আয়েশা’কে একবার খলিফা ওসমান বলেছিল-আল্লাহ আয়েশাকে ঘরের ভেতর থাকতে বলেছে। ওসমানের সৎ ভাই মদ খেয়ে ফজরের নামাজ পড়াতে গিয়ে দুই রাকাত বেশি পড়িয়েছিলেন-এই অভিযোগ এলে ওসমান তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেন নাই। অভিযোগকারীরা তখন আয়েশার কাছে যান। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওসমান ও আয়েশা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। মুসলিমরা তখন দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে যায়। একপক্ষে আয়েশাকে রাজনীতি না করে ঘরে থাকতে বলছে অন্যপক্ষের মত ছিল আয়েশা জ্ঞানী ও উপযুক্ত মহিলা, তিনি তার অধিকার অনুযায়ী কাজ করছেন। অবশেষে দুই পক্ষের জুতা মারামারির মধ্য দিয়ে ক্যাচালের সমাপ্তি ঘটে। এছাড়া খলিফা ওমরও নারীদের মসজিদে নামাজ পড়া পছন্দ করতো না। কিন্তু কখনো আইন করে বারণ করার সাহস পান নাই।

আমাদের আজকের মুসলিম সমাজের ধর্মীয় অনুশাসনে চলা নারীরা নিজেদের ঘরে ভেতরে থাকাই আদর্শ-জ্ঞান করে। আবার হুজুররা আয়েশা খাদিজার মতন নারী হওয়ার শিক্ষা দেয়। তাহলে প্রশ্ন আসে আয়েশা খাদিজা যদি মুসলিম সমাজের আদর্শ হয় তাহলে মুসলিম নারীরা ঘরে কেন?

এবার আসি আমাদের হুজুরদের কাছে। ওনাদের এই প্রশ্ন করা হলে বলবেন; তারা তো সাধারণ নারী ছিল না। কোরান হাদিসের আলোকেই আমাদের চলতে হবে, এটাই নিয়ম। যদিও হাদিস নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। আমার অফিসের সহকর্মী নিজেই বলেন- তিনি হাদিস মানেন না! কারণ হাদিস সংকলন হয়েছে নবী মুহাম্মদ মারা যাবার অনেক পড়ে। এছাড়া যারা হাদিস বয়ান করেছেন তারা কেউ তো নবী-রসূল ছিলেন তা সুতরাং তাদের কথা সব সত্য এমনটা তিনি বিশ্বাস করেন না। যাই হোক, তাহলে প্রশ্ন আসে ইসলামের আইন তাহলে ব্যক্তি বিষয়ে আলাদা। আর তারা যদি অসাধারণ নারী হোন তাহলে নবী মুহাম্মদও তো ছিলেন অসাধারণ পুরুষ। তাহলে সাধারণ মানুষের পক্ষে তাঁর জীবন-যাপন অনুসরণ করে সুন্নত করা কীভাবে সম্ভব? আয়েশা, খাদিজাকে যদি অনুসরণ করা না যায় তাহলে নবী মুহাম্মদকে মানুষ অনুসরণ করবে কীরূপে? ধর্মমতে তিনি তো আয়েশা খাদিজার থেকে বেশি অসাধারণ ছিলেন। ভাবা যায় যে ধর্মটির প্রচার ও প্রসারে খাদিজার প্রত্যক্ষা আর্থিক ও অনার্থিক অবদান ছিল স্মরণীয় সেই ধর্মের ধর্মগুরুরা আজ নারীফোবিয়াতে আক্রান্ত!