নাগরিক হিসেবে আমি একজন KMBA (কোনো মতে বাঁইচ্চা আছি)। ব্যাপারটা এমন যে, বেঁচে থাকার গুরুত্ব যেমন অত্যন্ত কম, তেমনি মরে যাওয়ার গুরুত্বও নাই। কিন্তু তাই বলে VIP (ভেরি ইম্পর্টট্যান্ট পারসন) কিংবা VVIP (ভেরি ভেরি ইম্পর্টট্যান্ট পার্সন) দের প্রতি আমার কোন ক্ষোভ নাই। হিংসা নাই। ঈর্ষা নাই। অনেক চিন্তা ভাবনা করে বুঝলাম, তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র এলার্জিও নাই। একজন মানুষের খুব গুরুত্বপূর্ণ অথবা খুব খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা চাট্টিখানি কথা নয়, তা যেভাবেই হোক না কেন। জ্ঞান, বিজ্ঞান, চিন্তা, উদ্ভাবন, উৎপাদনে হোক আর চুরি চামারিতে হোক, গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে হলে আপনাকে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হবে, মগজ শানাতে হবে। একনিষ্ঠতা আর অধ্যবসায় ছাড়া এই জিনিস অর্জন করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাই পৃথিবীর সকল খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের সমীহ করে চলি, তাদের জন্য আমার হৃদয়ে বিনম্র শ্রদ্ধা ধারণ করি। এক কথায় আমি সফল মানুষের পক্ষে। এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিতে ন্যায় অন্যায়ের কোন ভূমিকা নেই, বিনাশেও থাকবে না। তারচে বরং ক’জন মানুষ তার স্বপ্ন পূরণ করেছে, কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরেছে, এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আমার টাইপের কোনমতে বেঁচে থাকা মানুষেরা বেশি নেয় না, বেশি দেয়ও না। যারা বেশি দেয় অথবা বেশি নেয় তাদের জন্য ঢাকা শহরের রাস্তায় আলাদা লেন হলে আমার একটু জ্বলবে হয়তো, কিন্তু এই জ্বলুনিটা অন্যায়, অনায্য। কারণ বিশেষ লেনে চলাচলের যোগ্যতা আমার নাই। যার যোগ্যতা নাই, তার জ্বলুনিও নাই।
যদিও আমি ভিআইপি না, তবুও ভিআইপিদের সাথে করমর্দন, পাশের চেয়ারে বসা, অন্যের সাথে তাদের কথোপকথন শোনা, অথবা দূর থেকে এক নজর দেখার সৌভাগ্য অসংখ্যবার হয়েছে। এজন্য আমি আমার কিছু অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুর কাছে কৃতজ্ঞ। তাদের লেজ ধরে এই সৌভাগ্য অর্জন করেছি। তবে আমার ভিআইপি দর্শন একটু অন্যরকম। অন্যরকম ভিআইপি দর্শনের কারণে চিন্তা ভাবনায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সর্বশেষ যেবার গ্রামের বাড়ি গিয়েছি, আমাদের পাশের গ্রামের এক বিখ্যাত সিঁদেল চোরের সাথে দেখা হওয়ার পর তাকে সালাম দিয়েছি, হাত মিলিয়েছি, প্রায় দশ মিনিট কথা বলেছি। আরো বলেছি তিনি যেন আমার জন্য দোয়া করেন। তারপর তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দেন। আসলে এই সম্মানটা তার প্রাপ্য ছিলো। এটা হচ্ছে জীবনের শিক্ষা।
২০১৪ সালে বসন্তের এক দারুন সন্ধ্যা। পাঁচ তারকা হোটেলের পুলসাইড রেস্তরার একটা টেবিল, আরাম বাতাস, প্রতিবেশী ফুলের সুগন্ধ, ঝরঝরে মানুষদের চঞ্চল হাঁটাচলা, খানিক দূরে বলিষ্ঠ হতে চাওয়া কিছু মানুষের শরীরচর্চা এবং বারবিকিউর মাংস পোড়া আদিম গন্ধ। খুউব ভালো লেগেছে তখন। মানুষ আমরা চারজন। দুইজন ভিআইপি, একজন আধা ভিআইপি (মনযোগী ছাত্র), আর আমি সুদক্ষ ছিদ্রান্বেষী। একের পর এক দুই ভিআইপির সফলতার গল্প শুনে যাচ্ছি। গল্পে আনন্দ আছে, বেদনা আছে। এডভেঞ্চার আছে, থ্রিল আছে। কিছু গল্পে হ্যাপি এন্ডিং, কিছু আনহ্যাপি। এসব গল্পের মাঝে একটা গল্প খুব মনে ধরেছে। একই কাজের জন্য ব্যাংক লোনের আবেদন করেছেন দু’জনই। একজন পেয়েছেন, আরেকজন পাননি। যিনি পাননি, তিনি এক বড় নেতাকে তুলনামূলক পাঁচ পার্সেন্ট কম উপহার অফার করেছেন। যার কারণে লোন মিস। তো, এই ঘটনা থেকে তিনি শিক্ষা নিলেন লোভ খুব খারাপ জিনিস। লোভ মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। তিনি যদি লোভ সামলে ছয় পার্সেন্ট উপহার বাড়িয়ে দিতে পারতেন, তাহলে লোনটা তিনিই পেতেন, তার বন্ধু নয়। তাহলে গল্পটা বদলে যেত। এখন লোন পাওয়া বন্ধুটি আপসোস করে বলতো, “আমি যদি লোভ সামলে উপহারের পরিমান কিছুটা বাড়িয়ে দিতাম, তাহলে লোনটা আমিই পেতাম।” ইনারা লোভ সামলানোর প্রতিযোগিতা করছেন, আর ওদিকে কারো কারো উপহারভাগ্যে নতুন নতুন পার্সেন্টেজ যোগ হচ্ছে। এখানে যারা লোভ সামলাচ্ছেন এবং যাদের পার্সেন্টেজ বাড়তেছে, উভয় পক্ষ ভিআইপি। তাদের এই দেয়া নেয়ার গল্পে আমি একজন শ্রোতা মাত্র। তাই ওই বিশেষ লেনে চলার যোগ্যতা নেই, এটা খুব ভালোভাবে বুঝি।
অনেকে মনে করছেন শহরের রাস্তায় ভিআইপি লেন খুব বাজে চিন্তা। এর মাধ্যমে সরকারের স্বৈরাচারী, দখলদারি, জনবিরোধী, হনুম্যানি চিন্তাভাবনা ফুটে উঠছে। কারণ এই বিশেষ লেনের জন্য নতুন রাস্তা তৈরি হবে না। বরং এখনকার রাস্তা থেকে একটা লেন ছিনিয়ে নেয়া হবে। কথাগুলো যৌক্তিক। কিন্তু আমার কাছে অবান্তর মনে হয়েছে। কারণ বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী একেএম শাহজাহান কামাল বলেছেন ঢাকা শহরকে ইসলামিক ট্যুরিজম সিটি ঘোষণা করা হতে পারে। এই ঘোষনাটা বাস্তবায়ন হলেই ভিআইপি লেনের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে ইসলামিক ট্যুরিজম সিটি ঘোষণা দেয়ার পর ঢাকা শহর থেকে হিজাব না পরা নারীদের বের করে দিতে হবে। পহেলা বৈশাখে রঙ মাখা, হ্যাপি নিউ ইয়ারে আতশবাজি ফুটানো পার্টিবাজ পোলাপানদের শহরছাড়া করতে হবে। শাহবাগ এলাকায় যারা ছবি আঁকে, গান গায়, কবিতা লিখে, তাদেরকেও বের করে দিতে হবে। তবে যারা ছবি আঁকার সময় তিন বছর বয়সী মেয়ের মাথায় হিজাব পরিয়ে দেয়, হামদ নাত লিখে, আল্লাহ ও তার বান্দা হাসিনাপার নামে গান গায়, তারা থাকবে। এভাবে হেফাজত বিরোধী, ওলামালীগ বিরোধী, খাঁটি মুসলমান হাসিনাপা বিরোধী, আজানজনিত শব্দদূষণে ক্যাঁ কুঁ করা লোকজনদের বের করে দেয়ার পর ঢাকার জনসংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে আসবে। তখন রাস্তা থেকে একটা ভিআইপি লেন এমনিতেই ঠেলে বেরিয়ে আসবে। কারণ তখন ভিআইপি লেন জাতির জন্য ফরজ হয়ে যাবে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পূণ্যবান মুসলমানরা আসবেন ঢাকা শহর দেখতে। তারা নিশ্চয় সাধারণ লেনে চলাচল করতে পারবেন না। এটা উচিতও হবে না।
তখন ওই বিশেষ লেনে এম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস ও ভিআইপিদের পাশাপাশি মুসলিম মেহমানরাও চলাচল করবেন। এবং লেনের নাম বদলে ‘মুসলিম লেন’ করা যাবে। কারণ আমার মনে হয় না ততদিনে মুসলিম ভিআইপিরা অমুসলিম ভিআইপিদের ওই লেনে চড়তে দিবে।
তবে, এই যে একটা শ্রেণীর লোকদের শহর থেকে বের করে দেয়ার কথা বললাম, এটাতে ঝুঁকিও আছে। এমন হতে পারে তখন অহিজাবী কোন নারী পাওয়া যাবে না, হেফাজত হাসিনাপাসহ এসকল বিরোধী কোন লোকজন পাওয়া যাবে না। সবাই দ্বীনের পথে, লীগের পথে চলে আসবে। তখন ভিআইপি লেন এমনিতেও হবে না। একদিকে প্রায় দুই কোটি বাসিন্দা, অন্যদিকে ইসলামিক ট্যুরিজম সিটি দেখতে আসা উপচেপড়া পর্যটক। রাস্তা থেকে একটা লেন বের করে আনা অসম্ভব হয়ে যাবে। আল্লাহর যাদুকৌশলে কিছু হলে হতে পারে, এছাড়া কোন সম্ভাবনা নাই।
তবে চারপাশ যে অন্ধকারে ঘিরে আছে, এটা মিথ্যা কথা। অন্ধকারের চিপায়চাপায় তীব্র আলোর রেখাও দেখা যাচ্ছে। তার আগে বলে নিই প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন আমার অত্যন্ত আগ্রহের বস্তু। এই বস্তুখানার হাবভাব দেখে মনে হয় তিনি রাজি হননি দেখেই হামিদ সাহেবকে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হতে হচ্ছেন। খোকন সাহেবেরই প্রেসিডেন্ট হওয়ার কথা ছিলো। এই লোক পেশাগত কারণে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় আহত হয়েছিলেন। সেদিন তিনি মরেও যেতে পারতেন। হয়তো তিনি জানতেন না সেদিন গ্রেনেড হামলা হতে পারে, তবুও তিনি যে সাহসী, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিটের সাংবাদিকরা অনেক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। বিশেষত আওয়ামীলীগ কভার করা সাংবাদিকরা। কারণ এই দলের শীর্ষ নেতাদের উপর অসংখ্যবার হামলা হয়েছে। তো, তিনি তার এই আহত হওয়াকে ব্যবহার করে একজন অনুসরণীয় সাংবাদিক হতে পারেন নাই। কয়েক বছর পর তিনি হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সচিব। ডেপুটি প্রেস সচিব হওয়ার পর এক জায়গায় বলেছেন নাস্তিকদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে। হয়তো ভেবেছেন নাস্তিকরা উনাকে সামনে পেলে কামড়ে দিবে। কিন্তু ঘটনা আসলে তা নয়। এটা তার মিথ্যা অনুমান।
যা হোক, এই আগ্রহোদ্দীপক বস্তুটি ফেসবুকে এক পোস্টে বলেছেন ওই বিশেষ লেনের প্রস্তাবনা মূলত এম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও ভিআইপিদের জন্য। তার এই কথায় আলো আছে, সত্য আছে। এজন্য আমি একজন প্রবল আশাবাদী মানুষ। এই দেশ, এই সমাজ থেকে সৎ মানুষেরা পালিয়ে যাননি, মরে যাননি। তারা এখনো আমাদের চোখের সামনে প্রশ্ন প্রসব করেন। ভিআইপিদেরকে কেন এম্বুলেন্স আর ফায়ার সার্ভিসের লেনে ঢুকতে হবে? তারা কি রুগ্ন? মৃত্যুপথযাত্রী? নাকি তারা এই দেশে এই সমাজে আগুন লাগিয়ে রেখেছেন? নাকি তারা ব্যক্তি হিসেবে একটি বাহিনীর চেয়েও দুর্নীতিপরায়ন হয়ে উঠেছেন? ওই বিশেষ লেনে ভিআইপিদের সহযাত্রী বাছাই এমন কেন? সবচেয়ে ভালো হতো ভিআইপিরা যদি সহযাত্রী হিসেবে জরুরী রপ্তানি কাজে নিয়োজিত বড় বড় গাড়িগুলোকে বেছে নিতেন। তাহলে নতুন এক সম্ভাবনা, নতুন এক আশাবাদের জন্ম হতো। হয়তো কোন একদিন এক পড়ন্ত বিকেলে ঘরে ফেরা পাখিদের ভিঁড়ে পথ হারিয়ে ওই গাড়িগুলোর ভেতরের পণ্যের মত আমাদের ভিআইপিরাও অন্য কোথাও রপ্তানি হয়ে যেতে পারতেন। যদি সত্য সত্য এমন কিছু হতো, তবে কয়েকশ বছর ধরে মার খেতে থাকা এই অঞ্চলের মানুষগুলো প্রাণে বেঁচে যেতো। সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা এই নরকের বুকে হঠাৎ জন্ম নিতো সবুজ শান্তির ছায়া।
কিন্তু তা আর হলো কোথায়! ভিআইপিরা এম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস আর পুলিশের লেনেই থাকবেন। সম্পদের চাপে হঠাৎ অসুস্থ হলে এম্বুলেন্সের রোগী নামিয়ে নিজে উঠে যেতে পারবেন। টেকা আর ক্ষমতার গরমে গায়ে আগুন লেগে ফ্রাই হওয়ার আগে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি থামিয়ে জলসেবা নিতে পারবেন। আর কোন কারণে কোন ভিআইপির উপর যদি পাবলিক ঝাঁপিয়ে পড়ে, তাহলে পাবলিকের পেছনে পুলিশ লেলিয়ে দিতে পারবেন। আপনি আমি যাই বলি না কেন, ওই বিশেষ লেনটিই তাদের জন্য উপযুক্ত। নিরাপদ। কারণ শেষ কবে কোন ভিআইপিকে গুণীজন হতে দেখেছেন? আজ যাকে গুণীজন ভাবছেন, কাল দেখবেন তিনি ব্যাংক লুটে জড়িত, আর্থিক কেলেংকারির হোতা, বস্তিপোড়া মাটিতে কয়েক কাঠা জমির মালিক, জাল দলিলে খাল দখলকারী, প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।
এই দেশে ভিআইপি মাত্রই মুক্তিযুদ্ধ আর ধর্ম বেচে খাওয়া কতিপয় বদমাশ। তাই এরকমই হচ্ছে, এরকমই হবে। কিচ্ছু করার নাই।
বের করে দেবার আগে যে তাহারুশ খেলার ‘লাইভ শো’ হবে এইটা বললেন না যে? হালাল ট্যুরিস্টরা খুশি হবে, বারবার আসবে। ওই যে পয়লা বৈশাখে হলো না? ঐটাই, যেই খেলায় একজন বা একাধিক মেয়েকে অনেকগুলো বিকারগ্রস্ত ধর্ষকামী পুরুষ তাদের মাঝখানে রেখে ঘিরে ফেলে। চারদিকে গড়ে তোলে আড়াল। এই আড়ালেই মেয়েটিকে ইচ্ছেমতো শারীরিক ভাবে নাজেহাল করা হয়। শরীরের বিভিন্ন অংশ ধরে টানাটানি করে জামা কাপড় ছিঁড়ে ফেলে। ধর্ষকামী খেলোয়াড়দের কয়েকজন এমন ভান করবে যে মেয়েটিকে যেন তারা বাঁচানোর চেষ্টা করছে। এইসব পাতানো গোলমালের মধ্যেই বিকারগ্রস্ত পুরুষগুলো মেয়েটিকে অসহায় করে যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণ চালাবে নিজেদের সকলের চোখের সামনেই। ইসলামিক ট্যুরিজমের স্পেশাল এট্রাকশন বা ইভেন্টে এই হালাল খেলার চর্চা না থাকলে কেমনে কি? এইটা কিন্তু পাবলিক মানে মডারেট মুসলমানদের খুবই প্রিয় খেলায় রূপান্তরিত হতে পারে। ইসলামিক চেতনায় বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করবার পরে এই খেলায় ওদের অংশগ্রহণ থাকবে না এটা তো হতেই পারেনা।