আগের পর্ব

দশ

ঘুম থেকে উঠে গেলাম সকাল সকাল। এখানে ভোর হয় বেশ আগে আগে, সন্ধ্যা হয় পৌঁনে আটটার দিকে।রাহুল সাংকৃত্যায়ণের লেখায় পড়েছিলাম এখানে বিদ্যুতের অভাব ছিল না সেই উনিশশো তিরিশের দশকে, এখনো নেই। ক্যামেরা-ব্যাটারি সব চার্জ দেয়া গেলো সহজেই। ঢাকার মতোই আযান শুনতে পাওয়া যাচ্ছে প্রতি অক্তে। সকালের নাস্তা সারলাম গেস্ট হাউজের পাশের ধাবায়।আলু আর পেঁয়াজের পরোটা, সাথে আচার আর চা। সস্তা ও সুস্বাদু।খেয়ে বুলেভার্দের ওখানে দাঁড়ালাম। সকালের ডাল লেক এর আরেক সৌন্দর্য। ভিড় ভাট্টা নেই, নিস্তরঙ্গ জলে, ২-১ টা হাঁস চড়ে বেড়াচ্ছে। এদিক -ওদিক হালকা হাটাহাটি করে সোজা চলে এলাম বাস স্ট্যান্ডে। গুলমার্গের বাস রেডি। দেখা হলো কবির ভাই ইভান ভাই দের সাথে। জিজ্ঞেস করলেন, “দেশের সব খবর ভালো তো ? ফ্যামিলি? ” আমাদের গতদিন ফোন বা চ্যাটিং কিছুই হয় নি দেশে, তবু মাথা নাড়ালাম, “হ্যা হ্যা ভালো।”

আগের দিনের মতোই বাস স্ট্যান্ডে “জম্মু জম্মু” বলে টানাটানি।আমরা জম্মু যাচ্ছি না শুনে আমাদের প্রতি আগ্রহ নাই। নিজেদের ভাষায় কি যেন বলাবলি করছে আমাদের দেখিয়ে। হালকা পানির বোতল কিনে চেষ্টা করলাম ফোন করার জন্য দোকান থেকে, বাস স্ট্যান্ডের দোকান আইএসডি কল করা যাবে না। আবার এসে দাঁড়ালাম স্ট্যান্ডের কাছে। ইভান ভাই আবার এসে দাঁড়ালেন কাছে, “দেশের খবর আসলেই ভালো তো?” এবার আমি ভয় পেলাম! “কেন কি হয়েছে বলুন তো!”

ইভান ভাই এর কাছে শুনলাম গুলশানের হোলি আর্টিসান বেকারিতে তার আগের রাতের সন্ত্রাসী হামলা ও বিদেশি নাগরিক জিম্মি করার ঘটনা।আমরা প্রায় বজ্রাহত। দেশের অবস্থা ভয়ানক এবং এই অবস্থায় আমরা কাশ্মীর ঘুরে বেড়াচ্ছি। খানিকক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে রইলাম। ইভান ভাইরা গত রাতেই খবর পেয়েছেন এবং সারা রাত টিভিতে ফলোআপ দেখেছেন। আমরা পুরোপুরি অন্ধকারে। এক ধরণের অপরাধবোধের মতনও তৈরি হতে লাগলো। ইভান ভাই এর ফোন থেকে ঢাকায় যোগাযোগ করা গেলো। ঘটনা টা একদমই হজম হচ্ছিল না। অনেকটা যন্ত্রচালিতের মতন বাসে গিয়ে বসলাম।ডাক্তার বেশ আতংকিত।দেশে ফিরে যাবো কি না সেসব কথাও বলতে শুরু করলো।

এগারো

আমি আর ডাক্তার বাংলাতে ঢাকায় কী হলো তা নিয়ে আলোচনা করছিলাম, এর মধ্যে পিছন থেকে একটা চশমা পড়া ছেলে জিজ্ঞেস করলো, “তোমরা বাঙালি?” ওর নাম ডেল্টা।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। বাসে এখন আমরা পাঁচ বাংলাদেশি আর ভূপাল (মধ্য প্রদেশ) থেকে আসা একটা প্রবীণ দম্পতি। ডেল্টাকে পেয়ে ভালোই হলো, ওর সাথে পরিচিত হতে হতে গুলশান ঘটনার আকস্মিকতা থেকে কিছুটা ছাড় পাওয়া গেলো।ওর মধ্যে অবশ্য তেমন ভাব দেখলাম না, মনে হলো এমন একটা ঘটনা যেন ঘটারই কথা ছিল। আসলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে ন্যূনতম জ্ঞান থাকলে কারো অবাক হওয়া উচিত না এই ঘটনায়। তবু আকস্মিকতা ও প্রকরণের একটা চমক ও মানবতার জন্য শোক কি এড়ানো যায়? এর মধ্যে প্রবাস জনিত বিচ্ছিন্নতা বা যোগাযোগহীনতা।

ডেল্টাকে পেয়ে অনেক দিক দিয়েই লাভ হলো। ডেল্টা মানালি থেকে কাসৌল, কেলং হয়ে লেহ পৌঁছায়। সেখানে পারমিট যোগাড় করে ঘোরাফেরা করে একা একাই, এর পর কার্গিল এর পথ ধরে শ্রীনগর এসে পৌঁছেছে।ঠিক আমাদের উল্টা প্ল্যান।এক নম্বর লাভ হলো, পারমিট যে পাওয়া যায় এটা নিশ্চিত হলাম, যদি না গুলশানের ঘটনায় রাতারাতি বদলে যায় পরিস্থিতি, একজন ভারতীয় নাগরিক নিহত হবার কথাও শুনলাম। দুই, পথ সম্বন্ধে আরো কিছু ধারণা পাওয়া গেলো, কোথায় কিভাবে যেতে হবে তার এক প্রকার প্রত্যক্ষ ও সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা। তিন, ডেল্টার সাহস আমাদের অনুপ্রেরণা দিল. ওর বন্ধুদের সাথে আসার কথা ছিল, কাউকে না পেয়ে একলাই রওনা দিয়েছে। চার, ওর সাহচর্য আমাদের বিধ্বস্ত ও বিহ্বল অবস্থা থেকে খুব দ্রুতই বের করে নিয়ে আসলো। ডেল্টা কে আমার আর ডাক্তার দুজনেরই খুব ভালো লাগলো।

ডেল্টাও যাচ্ছে গুলমার্গ। তার উদ্দেশ্য পুরোপুরি পর্যটন না। ওখানে গ্রামের লোকদের সাথে কথা বলতে চায়। লেহতেও তার বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা বলল। কাসৌলে এক গুরুদুয়ারা তে ছিল তিনদিন।ডেল্টাকে সবচেয়ে পছন্দ হলো আমাদের সহযাত্রী মধ্যপ্রদেশের দম্পতিটির। ভদ্রলোক অবসরপ্রাপ্ত, সঙ্গিনী স্ত্রী। ডেল্টাকে পেয়ে খুশি হয়ে তার নাতির ছবি দেখাতে লাগলেন। নাতির নাম কানহাইয়া। কানহাইয়া কুমার এর কথা মনে আসলো। ডেল্টা ছবি দেখতে মন্তব্য করলো, “নাতি খুব দুষ্টু।”তাদের ইচ্ছা ডেল্টা তাদের সাথে পরের দিন পেহেলগাম যাক। কাশ্মীর এক অর্থে এদের জন্যও বিদেশ। অচেনা একটা ছেলেকে কত সহজে আপন করে নিচ্ছেন দেখে ভালো লাগলো, অবশ্য ডেল্টার সহজাত গুণেই।

বারো

শ্রীনগর থেকে গুলমার্গ ৫৬ কিলোমিটারের মতন। শ্রীনগরের উচ্চতা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে মাত্র দেড় হাজার মিটার, গুলমার্গের আড়াই হাজার। পাহাড় আসবে জানা ছিল, কিন্তু প্রথম অংশটা মোটামুটি শ্রীনগর শহরের ভিতর দিয়ে, কাশ্মীর উপত্যকার মধ্যেই। পথে চোখে পড়লো জম্মু-কাশ্মীর ব্যাংক, শ্রীনগর হাইকোর্ট, মেডিকেল কলেজ ইত্যাদি।বেশ কিছু দোকানের সাইন বোর্ড খেয়াল করলাম “ভাট স্টোর।” এরা হচ্ছে আদি ভট্ট ব্রাহ্মণ সম্পদায়ের যারা পরবর্তীতে মুসলিম হলেও নামের শেষে পূর্বের উপাধি রেখে দিয়েছিলো।

২-১ টা পাহাড়ি নদী পার হতে হয়, প্লেন থেকে যেগুলিকে দেখেছিলাম, তাদের সাথে মিল অাছে। শ্রীনগরের বাড়িঘর গুলি সুন্দর। এগুলি অাসলে শহুরে অংশে, অপেক্ষাকৃত ধনী লোকজন মনে হলো। রাস্তার গাড়িগুলি অাধুনিক না একেবারেই। কারণ অনুমেয়। অামাদের বাসটা ওদের হিসেবে ডিলাক্স, কিন্তু অামাদের দেশে বহু অাগে এরকম জিনিস রামপুরা-সদরঘাট লাইনে চলত। এটা তবু আরামদায়ক, ট্যুরিস্ট বাস আর যাত্রী মাত্র ৭ জন। পাবলিক বাসগুলিতে বেশ ঠাসাঠাসি, প্রকৃত অর্থেই মুড়ির টিন, জানালা আর পেছনের কাঁচের উপরে লোহার খাঁচা বসানো। একটা জায়গায় গাড়ি থামিয়ে, ড্রাইভার কি যেন ঠিকঠাক করে নিল। একটা লোককে দেখলাম ঢোলবাদক, কিছু একটা ইশতেহার প্রচার করছে স্থানীয় ভাষায়।

রাস্তা মোটামুটি ভালোই, পিচ ঢালা, রাস্তার দুপাশে অজস্র বুনোফুল এর ঝোপ, দেবদারু, চিনার, এপ্রিকট আর আপেলের বাগান। ট্যাঙমার্গ পর্যন্ত রাস্তা এক রকম সোজা আর সমতল। এখানে আসার পর অল্প বিরতি দিল। ডাক্তারের পীড়াপীড়ি তে আমি একটা রোদ চশমা কিনলাম সস্তায় ফেরিওলার কাছ থেকে। এটা পরে অবশ্য অনেক কাজে লেগেছে। একদল ফেরিঅলা এসে বলতে লাগলো জুতা, ওভারকোট ভাড়া করার জন্য। উপরে গেলে নাকি লাগবেই, তার উপর বৃষ্টি হলে বিপদ ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা আবহাওয়া বা তাপমাত্রা সম্বন্ধে ধারণা নিয়ে এসেছিলাম, এদের তেমন পাত্তা দিলাম না। তবে শীতের সময় এগুলি লাগবে সেটা বোঝা গেলো। খানিক পর পাহাড়ে উঠতে শুরু হলো। সবুজ পাহাড়, বাম দিকে তুষার শুভ্র শৃঙ্গ আফারওয়াৎ দেখা যাচ্ছে, এর চুড়াই আমাদের লক্ষ্য। পাহাড়ের রাস্তার দুধারে মখমলের মতন বুনোফুল ছিটিয়ে আছে, সুন্দর ঘাস। অল্প সময়ের মধ্যেই গুলমার্গ পৌঁছে গেলাম। গুলমার্গ থেকে আফারওয়াৎ এর চূড়া দেখা যায়, চূড়াটা বাদে পাহাড়টা সবুজ, চূড়ার বরফ গরমকাল বলে ধীরে ধীরে গলছে, এখনো খাজগুলিতে বরফের চিহ্ন ভালোই রয়ে গেছে, ওর থেকে ঝর্ণা বের হয়ে পড়ছে।

তেরো

গুলমার্গ বাস আমাদের নামিয়ে দিল, ড্রাইভারের নির্দেশ বিকেল চারটার সময় ওখানেই ফিরতে হবে। এখন আমাদের যা খুশি। নেমেই দেখি এক গাদা টাট্টু আর তাদের মলমূত্র ইত্যাদির ভীষণ দুর্গন্ধ। টাট্টু চড়ার ইচ্ছে তেমন ছিল না শারীরিক দুর্ভোগের কথা ভেবে। কিন্তু মুশকিল হলো, ক্যাবল কারের স্টেশন এখন থেকে দৃশ্যমান নয়। কোথাও পড়েছিলাম ১ কিলোমিটারের মতন, হেটেও যাওয়া যায়। কবীর ভাই – ইভান ভাই হাটা ধরলেন। ডেল্টা নিজের পথে, গ্রাম খুঁজতে গেলো। ভূপালী দম্পতি দুটো টাট্টুতে ঘুরতে চলে গেলো, ওরা ক্যাবল কার নিবে না। এখানেই একটা শিব মন্দির হয়ে গেছে, বাঙালি (মনে হলো পশ্চিম বঙ্গের) কিছু পরিবার কে দেখলাম বরফের জন্য রাবার বুট, ওভারকোট ভাড়া করছে। আফারওয়াৎ এর উপরে বরফ দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু ওভারকোট আর বুটের ভার জড়ানোর মতন মনে হলো না। পর্যটকদের অনেকেই হুড়হুড় করে ততক্ষণে টিলার উপরের শিব মন্দিরে উঠে গিয়ে ফটো তুলতে শুরু করে দিয়েছে। শিব মন্দির খুব একটা পুরানো মনে হলো না (স্থাপিত ১৯১৫), ধর্মভাব অপ্রতুল, শারীরিক পরিশ্রমেরও ইচ্ছা নাই, আমরা ওদিকে আর গেলাম না। কী কী ভেবে টাট্টু নিয়ে নিলাম, শুধু ক্যাবল কার স্টেশন পর্যন্ত। পথেই একটা গলফ কোর্স, কেউ খেলছে না, স্থানীয় মুরুব্বি গোত্রের কয়েকজন বসে আড্ডা দিচ্ছে। বেগুনি রঙের চমৎকার কিছু ফুল ফুটে আছে পথে।

টাট্টু থেকে নেমেই ক্যাবলকার এর অফিস। এখান থেকে টিকেট দেখিয়ে বোর্ডিং পাস নিতে হবে, ভিড় তেমন নেই, দালাল ধরে বসলো। তার দাবি বোর্ডিং পাস সে লাইন ছাড়াই এনে দিবে আর গাইড হিসেবে যাবে। অনেক কষ্টে বোঝালাম লাইনে দাঁড়াতে আমাদের সমস্যা নেই, আর গাইডও লাগবে না। বোর্ডিং পাস নেবার পরে এক লোকের কাছ থেকে গুড় দেয়া বাদাম কিনলাম খাবার জন্য। পাশেই ফেরিওয়ালারা খিরাই (ওরা বলে ক্ষিরা) বিক্রি করছিলো ছুলে লবণ মাখিয়ে, খুব ইচ্ছে হলো, কিন্তু ডাক্তার রাজি না। কাহবা দেখে আর কথা শুনলাম না। কাহবা দারুন জিনিস – কাশ্মীরি চা (গ্রিন টি) বলা যায়, কেশর (জাফরান), আলমন্ড, মধু, এলাচ, দারুচিনি, ইত্যাদি মেশানো, খুবই সতেজকারক পানীয়।

গুলমার্গ মূলত স্কী করার জন্য তীর্থস্থান। সবচেয়ে বেশি ট্যুরিস্ট আসে মার্চের দিকে। এখন অমরনাথ এর সময় সব লোক ওদিকে, টাট্টুতে উঠার লোক নেই, তাই যাত্রী নিয়ে কাড়াকাড়ি, এখন যারা আসছে, তারা আমাদের মতো বা ভিড় এড়িয়ে সবুজ গুলমার্গ দেখার জন্য। ক্যাবলকারে উঠছে বরফ দেখার জন্য। ক্যাবলকার খুব বেশি পুরানো না, তবে পৃথিবীর সর্বোচ্চ ও দীর্ঘতম গুলির মধ্যে অন্যতম। আমরা এর আগে কেয়ার্নসে ক্যাবলকারে চড়ে ছিলাম, আবারো তুলনা এসে গেলো। কেয়ার্নসে ক্যাবলকারে এক দিকে ছিল পাহাড় আরেক দিকে সমুদ্র। ওটার আবেদন একরকম, কিন্তু এখানে মূল আকর্ষণ উচ্চতা। আফারওয়াৎ এর শৃঙ্গে উঠে যায়, ৪০০০ মিটার এরও উপরে।মাঝের কংডুরীর উচ্চতাই ৩০০০ মিটার। আমাদের জন্য একটা ছোটো খাটো পরীক্ষা হয়ে যাবে উচ্চতা নিয়ে। আফারওয়াৎ এর উপর থেকে বা খিলনমার্গ থেকেও নাঙ্গা পর্বত দেখতে পাওয়ার কথা, কিন্তু এদের কাউকে জিজ্ঞেস করে কিছু বোঝা বা বোঝানো গেলো না।

চৌদ্দ

ক্যাবলকারের উপর থেকে স্থানীয় একটা ছোট্ট পাড়া চোখে পড়লো। এলাকায় বেশিরভাগ লোক মুসলিম ও দরিদ্র। হয় পর্যটনের সাথে যুক্ত কোনো একভাবে অথবা গরু-মোষ-ছাগল-ঘোড়া পালে, কৃষিকাজ করে। কিছু বাড়িঘর দেখলাম, বাঁশ-বেত-কাঠের, চালের উপর মাটির স্তর, বরফ থেকে বাঁচতেই কিনা, সেই চালের মাটির উপর গাছ গজিয়ে গেছে। হতদরিদ্র অবস্থা। পানির সুব্যবস্থা নেই এত উপরে, নিচ থেকে পানি বয়ে আনতে হয়। সরকারি কোনো সুবিধা চোখে পড়লো না। দুজন গ্রাম্য মহিলাকে দেখলাম পিঠে মাথায় করে লাকড়ি কাঠ সংগ্রহ জোরে আনতে। একজন মোল্লা মতন কাউকে দেখা গেলো। জায়গাটা পাকিস্তান এর কর্তৃত্ব সীমার একদম কাছে। এখানে কাছাকাছি বড় শহর বারামুল্লা। বেশির ভাগ লোকই ওখান থেকে এসেছে। সারাদিন কাজ-ধান্ধা শেষ করে হয়তো আবার ফেরত যাবে ওখানেই। কংডুরীতে নামলাম। এ জায়গাটা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে। টের পাওয়া যাচ্ছে হালকা বাতাসে। অক্সিজেন খুবই কম। শ্বাস নিতে অল্প কষ্ট হচ্ছে, একটুতেই হাঁপিয়ে যেতে হয়। কিন্তু জায়গাটা দারুন সুন্দর। সবুজ উপত্যকা, পিছনে সবুজ বা তুষারশুভ্র পর্বত শৃঙ্গ। এখান থেকে আফরোয়াৎ এর উপরে আরেক দফা ক্যাবলকার চলে গেছে।ইভান ভাই কবির ভাই ওদিকে চললেন। আমি আর ডাক্তার খিলনমার্গের দিকে। জিরু খান নামের একজনের সাথে চুক্তি হলো- এবারেও টাট্টু। আমাদের পথ প্রদর্শকের নাম বিলাল হুসেন। এতিম, চাচার কাছে প্রতিপালিত।লেখাপড়া কিছু হয় নি, ঘোড়া পেলে আর ঘোড়া টেনে মানুষ। ছেলেটার বয়স ১৩-১৪ হবে। টাট্টু বা ঘোড়াগুলির মালিক একজন, তার নাম – জিরু খান। বিলাল বলল, জিরু খান কোটিপতি, কিন্তু অহংকার নাই, দানখয়রাত করে। আসলে জিরুখান একটা কোম্পানি। ঘোড়া-শ্লেজ সবই তার। অনেক লোক লেগে আছে কাজে। জিরু খান তাদেরকে দিনপ্রতি স্বল্প মূল্যের মজুরিতে রেখে দিয়েছে। বিলালের মতন সবাই এক প্রকার দিনমজুর। জিরুখানের মতন আরো কয়েকজন আছে, এদের সবার বাড়ি বারামুল্লা।

কংডুরী থেকে খিলনমার্গের দূরত্ব বেশি না। কিন্তু চড়াই আর রাস্তা পাথুরে হবার কারণে হাঁটার সিদ্ধান্ত বাদ দিতে হলো। ঘোড়ায় চড়ে গিয়ে উপরে দেখি খিলনমার্গের উপরে একটা ছোট্ট ক্যাম্প, কয়েকটা চায়ের দোকান। চা ছাড়া বিস্কুট আর ম্যাগি পাওয়া যায়। আমরা চায়ের অর্ডার দিলাম। উপর থেকে নিচের গুলমার্গ দেখা যাচ্ছে। ডাক্তার একটু দুর্বল বোধ করায় তাকে দোকানে বসিয়ে পাহাড়ের খাজে ঝর্ণা আর বরফ দেখতে গেলাম। এরই মধ্যে সে একবার ভূপতিত হয়েছে পা পিছলে। আফরোয়াতের উপর থেকে খাজ বেয়ে বরফ জমে আছে। বরফের দিন প্রায় শেষ, তবু লোকজন কে স্লেজে বসিয়ে চূড়ার কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে, আনন্দিত পর্যটকেরা বরফের গোলা বানিয়ে ছোড়াছুড়ি করছে। এক জায়গা থেকে বরফ গলে ঝর্ণা বের হয়ে গেছে। বরফ নিচের দিকে ঝকঝকে সাদা না, পাথুরে বালির আস্তর পরে কালো মতন হয়ে আছে, হঠাৎ দেখলে বরফ মনে হয় না। খিলনমার্গের পাশের পাহাড়েই একটা বন। দূর থেকে দেবদারু মনে হতে পারে। কিন্তু এগুলি আসলে বার্চবন। এলাকা জুড়ে পরিচিত “পেপার ট্রি” হিসেবে। এগুলিই সেই ঐতিহাসিক ভূর্জপত্র, যার উপরে লেখা হতো আকবর বাদশাহর কাগজ প্রচলনের আগে পর্যন্ত। কাশ্মীরি পন্ডিত এমনকি কালিদাসের লেখায় এগুলির উল্লেখ আছে।

বিলালের টাট্টু দুটোর নাম: করণ ও অর্জুন। মুসলিম মালিকের ঘোড়ার নাম কর্ণার্জুন। বিলাল এদের কে খড়-বিচালি ছাড়াও আস্ত কাঁচা ডিম খাওয়ায়। নামার সময় হঠাৎ অর্জুন চেঁচাতে শুরু করলো, আমি ভয় পেয়ে গেলাম, বিলাল বললো ও কিছু না পাশেই একটা ঘোটকী কে দেখে নাকি এই দশা। হ্রেষা রবের মূল কারণ, বিলালের ভাষায় “ইশক।” ডাক্তারকে অনুবাদ করে বোঝাতে হলো। নিচে নামার সময় ক্যাবলকার অপারেটর (সরকারি কর্মচারী) মিষ্টি খাওয়ার টাকা চেয়ে বসলো, ১০ টাকা দিয়ে পিছু ছাড়ালাম। নিচে নামতে নামতে দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে এসেছিলো। প্রথমে ভেবেছিলাম বাকি রাস্তা হেঁটেই আসবো। ডাক্তারকে একটা টাট্টুতে তুলে দিয়ে হাটছিলাম। হঠাৎ এক বৃদ্ধ টাট্টুওলা বললো, “বিশ রুপি দিও তাও ওঠো”। না করতে পারলাম না। লোকগুলি আসলে প্রচন্ড গরিব। এই মৌসুমে তেমন কাজও নেই। উপরন্তু সে আমাকে বললো বিশ টাকার কথা যাতে কাউকে না বলি। আসল ব্যাপার হলো, এই বাস স্টপ থেকে আনা নেয়ার জিম্মা জিরুখান জাতীয় লোকজনের, এর বাইরে এসব বৃদ্ধকে হয় ওদের অধীনে কাজ করতে হবে, ওদের বেঁধে দেয়া রেটে, নয়তো কাজ করতেই পারবে না। গলফ কোর্স দেখলাম লোকজন নামাজ পড়তে লেগেছে। টাট্টুওলাকে ১০০ টাকা দিয়ে দিলাম। দুপুরের খাবার কাশ্মীরি দম আলু, সাথে চাপাতি। দেখি বাঙালি পরিবারটি তখন ভাড়া করা জুতা আর ওভারকোট গুলি ফেরত দিচ্ছে বিরক্তির সাথে।

পনেরো

গুলমার্গে এক পাবলিক টয়লেটে কথা হচ্ছিলো দুজনের সাথে। বাংলাদেশ শুনে জিজ্ঞেস করলো তামিম ইকবাল আর সাকিব আল হাসানের কথা। আমি বললাম, হ্যা এরা খুব বিখ্যাত আমাদের দেশে। তখন বলল মাশরাফির কথা, মাশরাফি কিছু দিন আগে এসেছিলো এবং খুব দিলদরিয়া, সবার সাথে মিলে মিশে গেছে। আমি বললাম, হ্যা সেও অনেক জনপ্রিয়। ক্রিকেটে এরা অনেকেই বাংলাদেশ কে ভালোই সমর্থন করে পাকিস্তান অপেক্ষা “বেহতর” বিকল্প চিন্তা করে। দেশ-ধর্ম দুই ই রক্ষা পায় তাতে! ঘুরে ফিরে সেই কাশ্মীরের রাজিনৈতিক ইতিহাস, ক্রিকেট খেলায়ও। সামনে সে ইতিহাস সংক্ষেপে বলা যাবে। বাস একটু দেরি করে শ্রীনগরের দিকে রওনা দিল, পথে এক বুড়ি কে উঠিয়ে নেয়া হলো। আমাদের ড্রাইভার সদয় মানুষ মনে হলো। জাতে মুসলিম।বুড়ির কাছ থেকে কোনো ভাড়া রাখলো না। বুড়ি তাকে সাত পুত্রের পিতা হবার আশীর্বাদ করে চলে গেলো। কন্যার আশীর্বাদ কেউ চায় না। টাট্টুওলারও দু:খ তার সব কন্যা সন্তান, পুত্র ছাড়া কে দেখবে শেষ বয়সে?

বাসস্টপে আসতে আসতে ডেল্টার সাথে কথা হলো, পরের গন্তব্য ঠিক করে উঠতে পারছে না। মাঝে অমৃতসর অার পাঞ্জাবি গ্রামের গল্প করেছিলাম অল্পক্ষণ। হয়ত এতদিন পর বাংলাদেশিদের দেখা পেয়ে বিমর্ষ হয়ে উঠেছে, তাও হতে পারে। ইভান ভাই-কবীর ভাই যাবেন পেহেলগাম। ড্রাইভার এর প্রস্তাব, শবে কদর এর পবিত্র রজনী, সব অামার সাথে চলো, অাড্ডা দিবে সারা রাত, এর পর ঠিক হবে কোথায় যাওয়া। খুব ইচ্ছে হলো যাই, কাশ্মীরি জীবন-যাপন কাছ থেকে দেখা যাবে।কিন্তু পারছি না। ভুপালী দম্পতি ডেল্টার কাছ থেকে বিদায় নিলেন পরের দিন সকালের কথা বলে। অামরা নেমেই বুক করতে চাইলাম লেহর বাস। কাউন্টার বললো পরের দিন বাস নেই! পরের দিন সোনমার্গ যাওয়া যেতে পারে। সেখান থেকে দেড়দিনে লেহ। অামরা প্রমাদ গুণলাম। এরাই গতকাল বলছিল, বাস প্রতিদিন অাছে এবং অাগের দিন বিকেলে বললেই যাওয়া যাবে।অামাদের অার কোনো বিরতি নেবার ইচ্ছে নেই, উপরন্তু দেড়দিনের সোনমার্গ-লেহ ধকল নেয়ার কোনো ইচ্ছে নেই। এখন বিকল্প জিপ ভাড়া করা। খরচ বাড়বে তাতে । কী মনে করে অাবার টিঅারসির দিকে গেলাম।এবারে রিশিপশনে পাকিস্তানি ক্রিকেট প্লেয়ার ইমরান খানের মতন দেখতে একজন। উনি সব শুনে ফোন লাগালেন, ফোনে কাশ্মীরি ভাষায় কী কী সব বললেন, অামাদের বললেন অাবার কাউন্টারে যাও বাস অাছে। গিয়ে দেখি সত্যি বাস অাছে, সেই অাগের লোক দিব্যি টিকেট দিয়ে দিল। অনুমান করলাম, সোনমার্গের অমরনাথ এর ট্রিপ গছানোর চেষ্টা করছিল হয়ত। লেহর বাস পরের দিন সকাল অাটটায়।

টিকেট হাতে পেয়েও সন্দেহ গেল না এদের অদ্ভুত অাচরণের জন্য। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একটা মানি এক্সচেঞ্জ খুঁজে বের করলাম। টাকাগুণে বুলেভার্দে বের হয়ে অাবার পেয়েগেলাম ডেল্টাকে। ডেল্টা থাকে সামনের দিকের একটা হাউজবোটে। হাউজবোট গুলির নাম লক্ষ্য করলাম অাজকে: কানাডা, প্রিন্স অব ওয়েল, নিউজিল্যান্ড, ইটালী ইত্যাদি ইত্যাদি । ডেল্টাসহ শেষ বারের মতন অামি অার ডা্ক্তার শিকারা ভ্রমণে বের হলাম। এবার ডাক্তার বেশ কেনাকাটা করল। একটা কাশ্মীরি কোট, একটা পশমিনা চাদর। অামরা কাহবা, পাকোরা দিয়ে বিকেলের নাস্তা করলাম। সুর্য়াস্ত থেকে শুরু করে সন্ধ্যার পর পর্যন্ত অনেকটা সময় লেকেই কাটলো। রাতের খাবারের অাগে ইভান-কবীর ভাই দের সাথে দেখা। এটাই এই ট্যুরে তাদের সাথে শেষ দেখা। অামরা ডেল্টাসহ রাতের খাবার খেলাম অাগের দিনের তিব্বতি হালাল দোকান টায়, এবার অাগে ভাগে ওয়াইফাই সংযোগ নিশ্চিত করে নিলাম। অামি নিলাম তিব্বতি থুকপা। থুকপা ভালো হলো না, ডাক্তার অার ডেল্টা নিয়েছিল কাশ্মীিরি বিরিয়ানি – অথেনটিক কিছুর স্বাদ নিবে এই ভরসায়, তারও ভাগ্য খারাপ, রান্না ভালো না। যাহোক অামরা পরের দিনের যাত্রার জন্য বেশকিছু চকলেট, ক্যান্ডি অার জলের বোতল কিনে ডেল্টাকে বিদায় বলে গেস্ট হাউজে ফিরে এলাম। অাগামীকাল লেহর দিকে যাত্রা শুরু।

(চলবে)