এ কেমন রঙ্গযাদু?
ঢাকার যমুনা ফিউচার পার্ক শপিং মলের আন্ডারগাউন্ডে গিজগিজে মানুষ। ইন্ডিয়ার ভিসা প্রার্থীদের দীর্ঘতর লাইন। হাতে হাতে সবুজ পাসপোর্ট। লাইনে নানা বয়সী পুরুষেরাই শুধু। মেয়েরা এখানে সংখ্যালঘু, তাদের লাইন নাই। মেডিকেল ভিসা প্রার্থীদের আবার আলাদা খাতির। মোডে মোডে ওয়াকিটকি হাতে নিরাপত্তা রক্ষী। ব্যাগ ভেতরে যাবে না, ব্যাগ জমা দিয়ে টোকেন নিন – নির্দেশ তাদের। বিশাল হল রুমে গোটা চল্লিশেক ডেস্ক। ওপাশে পেশাদার তরুণ-তরুণী। ভিসার ধরণ বুঝে টোকেন নিয়ে পাসপোর্ট জমা। স্লিপ হাতে নিতে না নিতেই মোবাইলে টেক্সট– ভারত সরকারের ভিসা প্রক্রিয়াধীন, অপেক্ষা করিতে হইবে – ইত্যাদি।
সবখানে সুশৃংখল পেশাদারী হালচাল। আগের সেই বিস্তর ভোগান্তি আর নাই। দালালদের উৎপাত তো নাইই। এসি ফ্লোরের মোড়ে মোড়ে প্যাটিস-চা-কফির দোকান। স্ন্যাক্স খান, লাইন দিন, ভিসা নিন, ইন্ডিয়া যান-ভাবখানা এমন।
প্রতিদিন নাকি এইরকম ম্যালা লোকের মেলা বসে ইন্ডিয়া ভিসা অফিসে। সকাল ৯টা থেকে ৩টা আবেদন গ্রহণ। ভিসা প্রদান বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা। এতো মানুষ ইন্ডিয়ায় যায় কেনো? জনে জনে জিজ্ঞাসা, ভাই কেনো যাইতেছেন? আপনাদেরও কী উঠলো বাই, তো বইমেলা যাই?
উবার মোটো (মোটরসাইকেল) ডেকে ঘন্টা খানেকের ভেতর আবার কর্মস্থল দেশটিভি। নিউজ বুলেটিনের ফাঁকে ফাঁকে ইন্ডিয়া ফেরৎ সহকর্মীদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময়। যেন দুরু দুরু বক্ষ, কাঁপে তাহার হিয়া। ভিসা দিবো তো? মোদি সরকার নাকি সাংবাদিক ডরায়? তায় নয়া পাসপোর্ট। আগের হাতের লেখা পাসপোর্ট বাতিল হইছে, তাই। নইলে কইলকাতা দুই-চাইরবার, আর ত্রিপুরা দুইবার দেখা হইছে। সেই সব সিল-ছাপ্পর থাকলে দেখানো যাইতো।
নিজস্ব ভিসা কনসাল্টেন্ট রতন সরকারকে ফোন, মামা, ভিসা পামু তো?
-ভিসা তো দিবোই মামা। সাধারণ ট্যুরিস্ট ভিসা একবছর দেয়। কিন্তু আপ্নেরে ১০-১৫ দিন, কি ছয় মাস দিতে পারে। পাসপোর্ট-ভিসা আবেদনে সাংবাদিক লেখা ঠিক হয় নাই।
না, মামা, এইটা ঠিক কও নাই। পেশা লুকানো যাইবো না। ধরা পড়লে আর কোনোদিন ইন্ডিয়া ঢুকতেই দিব না। সাংবাদিক আইন মাইনা চইলবো, এইটা সাংবাদিকতার এক নম্বর শর্ত। …
দুইদিন পর পর ওয়েব সাইটে টোকাটুকি, ভিসা কি হইলো? হয় না কেরে! অন্যরা ভিসা পাইছে সাতদিনে। চণ্ডালরে ঘুরাইতেছে ক্যা? রুখসানা কাজল আপারে ফোন। আপা বলেন, আরে ধৈর্য ধরুন, বাচ্চাদের মতো করলে হয়? জানান, তারও ফেব্রুয়ারির পহেলাতেই কলকাতা নিমন্ত্রণ আছে। তারও ভিসা চাই। দেখা যাক, দুই চণ্ডাল এক সঙ্গে যাওয়া যায় কি না?
মেসেঞ্জারে জনে জনে উত্তেজনা ছড়ানো। কইলকাতা বইম্যালায় গুরুর স্টল দেখতে আইতেছি। প্যাঁচার কালা গেঞ্জি গিফট চাই। পাইদিদি আর বিনায়ক রকুর সঙ্গে সেল্ফি তুলুম। সৈকতদার গিটার না শুইনা যামু না। হি হি হি…
দু্ই সপ্তাহ পর প্রত্যুষে মোবাইলে টেস্কট, মান্যবর, আপনার ভিসা হইয়াছে, জলদি আসুন, খোদ ভারত সরকার আপনাকে ভিসা দিতে অপেক্ষায় – এইরকম।
ওই সকালেই অফিস ছুটি নিয়ে পাসপোর্ট-ভিসা সংগ্রহ। ছয় মাসের ভিসা দিয়ে আশোক স্তম্ভ সবুজ কালিতে লিখেছে – কেবলই বেড়াইবার জন্য, পেশাগত বা সাংবাদিকতার জন্য প্রযোজ্য নহে! বোঝ কাণ্ড!
অনলাইন পাঠ অভিজ্ঞতা বলছে, মাসখানেক আগে ধর্ণা না দিলে ট্রেনের আপ-ডাউন টিকিট মিলবে না, তাই। ব্যাংক থেকে জমানো ব্যাঙের আধুলি তুলে ডলার এন্ডোর্সমেন্ট। যানজট ধুলোর মহানগরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ছুটোছুটিতে উবার মটোই ভরসা। এখন চালক-আরহী দুজনেরই হেলমেট আবশ্যক। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের কিশোর বিদ্রোহের পর ট্রাফিক পুলিশও খুব কড়া। পান খেকে চুন খসলেই জরিমানা।
পরদিন সাত সকালে অফিস ডিউটির আগেই কমলাপুর রেলস্টেশনে গিয়ে ধর্ণা। টিকিট কাউন্টার খোলার আগেই সেখানে ছোটখাট লাইন। কেউ ফিরবেন বলে টিকিট চান। কেউ ভ্রমণের তারিখ বদলাবেন। কারো আবার নতুন টিকিট চাই। কাউন্টারের ওপারে রেলের লোককে অবিরাম “ভাইয়া, ভাইয়া“ সম্বোধন বুঝিয়ে দেয়, তারা কলকাতার মানুষ। নইলে ঢাকায় আ-প্রত্যয় বাহুল্য, শুধু ভাইই যথেষ্ট। অধমের পালা এলে জানা যায়, কাংখিত ১ ফেব্রুয়ারির আপ ট্রেন আছে, তবে ৬ ফেব্রুয়ারির ডাউন ট্রেনের টিকিট নাই।
তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত, একযাত্রায় পৃথক ফল হবে কেন? বরং বাসেই হোক আসা-যাওয়া। ঢাকা-কক্সবাজার গ্রিন লাইনে লাগে ১৩-১৪ ঘন্টা। যানজটসহ ঢাকা-কলকাতাও তাই। রুখসানা আপার পরামর্শই তাই। তাছাড়া বাস ছাড়বে বাসার কাছ থেকেই।
কলকাতায় শীত কেমন? আর বোলপুর, শান্তিনিকেতনে? মেসেঞ্জারে প্রতিভাদি বলেন, কলকাতায় শীত প্রায় নেই। বোলপুরে ভালই ঠাণ্ডা এ সময়। কল্লোল দা বলেন, আমার তো একটি জ্যাকেটেই কাজ চলে যায়। পাইদি বলেন, আমি বলবো খুব শীত! কলকাতা কনসাল্টেন্ট তাপস দা হোয়াটস এপে বলেন, ধুর! শীত কোথায়?
এরই মধ্যে এক শুভাকাঙ্খী, শান্তিনিকেতনে গেস্ট হাউজ বুকিং করে দেন, দুদিন। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত, চণ্ডালের দৌড় তেমন কলকাতা নিউ মার্কেট, সদর স্ট্রিট, সলভেশন আর্মি রেড শিল্ড গেস্ট হাউজ। গুগল মামা জানায়, বছর দশেক আগে কলকাতা সফরকালীন নিবাস গেস্ট হাউজটি সগর্বে এখনো বিদ্যমান। ক্যাথলিক ক্রিস্টান পরিচালিত গেস্ট হাইজটি আগের মতোই ঝকঝকে। শুধু নাম কাটছাঁট করে এখন — রেড শিল্ড গেস্ট হাউজ। তখনই টেলিফোনে ডরমেটরিতে সহজেই বুকিং হয়ে যায়। বিকল্প হিসেবে পার্ক স্ট্রিটে আরেকজন আছে। পারমিতা দিদি, আরো দু-একজন দেন সৎ পরামর্শ। রুখসানা আপার শিডিউলের সঙ্গে মেলে না কিছুতেই। অগত্যা একলা চলো রে…।
ফেব্রুয়ারি ইন যশোর রোড
১ ফেব্রুয়ারি ঘড়ি ধরে রাত ১০টা ১০ এ কলাবাগান থেকে গ্রিন লাইনের সরাসরি বাস ছাড়ে। ভলবো বাসগুলোর সিট বেশ আরামদায়ক। আয়েশ করে পা ছড়িয়ে বসা যায়। ভাড়ি হ্যাভারশেক লকার বন্দি। সঙ্গে পাসপোর্ট-টিকিট ইত্যাদি বহনের জন্য ছোট একটি সাইড ব্যাগ মাত্র। দেশজুড়ে অসংখ্য বাস- মিনিবাস-ট্রেন ভ্রমণে এখনো ক্লান্তিহীন। সহযাত্রীদের অনেকেই ঘুমের আয়োজনে, বাকীরা ঘুমে ঢুলু ঢুলু। মোবাইল ফোন খুলে ইবুকে সন্দীপনের গল্পসমগ্র-১ পাঠ। কুইনি, টেলিফোন, ড. রণবীর পোদ্দারের আমেরিকা আবিস্কার, মাঝে মাঝে কার কাছে যাব, তৃতীয় চক্ষু, হৃদয়ের শব্দহীন জোৎস্নার ভিতর…ইত্যাদি। কিছু উপন্যাস অবশ্য আগেই পড়া। আর গুরুতে জানা গেছে– সন্দীপনী করো না!
রাত্রি গভীর থেকে গভীরতর হয়। মাওয়া ফেরি পেরিয়ে ফরিদপুরে যাত্রা বিরতি। আবার বাস এগিয়ে চলে। রাত সাবধান!…
ভোরে যশোর বেনাপোল বর্ডারে বাস দাঁড়ালে রেঁস্তোরায় জলখাবার। কাস্টমস-ইমিগ্রশন অফিস খোলার অপেক্ষা। সকাল ৭টায় পেরুনো গেল এপার। ওপারে ইমিগ্রেশন অফিসার পাসপোর্ট-ভিসা দেখে ছবির সঙ্গে মুখোচ্ছবি মেলান খুঁটিয়ে। ডেস্কের খুপরি থেকে বেরিয়ে “ওয়েট প্লিজ“ বলে পাসপোর্ট নিয়ে উধাও। মিনিট পেরুতে থাকে। সহযাত্রীরা যার যার মতো সীমানা পেরিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর এক সৈনিক এসে নিয়ে যান সুপরিসর কক্ষে। “চিফ ইমিগ্রেশন অফিসার“ বোর্ড লাগানো দেখে মনে মনে- হালারপুত কী যাইতে দিব না? তাইলে এতো নাটক কইরা ভিসা দিলা ক্যা?…
নাম বিস্তৃত অফিসারটি অমায়িক, বাঙালি। দুকাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে বলেন, আপনি সাংবাদিক দেখে মতামত নিতে ডাকলাম। বলুন, কেমন দেখলেন সব? কোনো যাত্রী হয়রানী?
মনে পড়ে, ১৯৯২-৯৩ সালের দিকের প্রথম কলকাতা সফরে সীমান্ত পেরুনোর ভয়ংকর অভিজ্ঞাতা। দুইপারে কাস্টমস-ইমিগ্রেশন অফিস বলতে দুই-একটি টিনশেডের বাংলো। আর কেঁচো-কেল্লোর মতো কিলবিলে ঘুষখোর-বদমাশ কাস্টমস-ইমিগ্রেশন-দালাল-টাউট-কুলি। প্রতি পদে পদে ধাপ্পাবাজি, ঘাটে ঘাটে টাকা আদায়। খাঁ খাঁ রোদ্দুরে শত শত আম জনতার সীমানা পেরুনোর অশেষ ভোগান্তি। সে তুলনাই সীমান্ত এখন অনেক পরিচ্ছন্ন। টাউট-দালাল-হয়রানী নাই, দুপারেই। অবশ্য লুঙ্গি পরা লোকজন পেলে কেমন আচরণ হয়, সেটি অজানা! হা হা হা …
ইমিগ্রেশন পেরিয়ে ওপারে যেতেই উদ্বিগ্ন বাস চালক-সুপারভাইজারের শুকনো মুখ, আপনার এতো দেরি? আমরা ভাবলাম, আপনাকে বোধহয় আটকে দিয়েছে!
সাংবাদিক দেখে চা খেতে ডেকেছিলেন – শুনে তারা হাঁফ ছাড়েন।
বাস এগিয়ে চলে ১৯৭১ এর সেই যশোর রোড ধরে। এলেন্স গিনসবার্গের সেপ্টেম্বর ইন যশোর রোড, মৌসুমী ভৌমিকের গানে এখনো দৃশ্যমান। ১৯৯৯ সালের আরকে টুকরো স্মৃতি হানা দেয়, শ্যামলী পরিবহনের প্রথম ঢাকা-কলকাতা বাস সার্ভিসের প্রথম ট্রায়াল রান। এনালগ থেকে ডিজাটাল যুগে উত্তোরণের কালে ওই ট্রিপে সাংবাদিক টিমে অংশগ্রহণ।
এপারে বেনাপোল সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা চিত্রিত শ্যামলীর এসি বাস যখন ধীর গতিতে ওপারে (সেখানেও যশোর রোড, যশোর জেলা, কি আয়রনি!) পেট্রাপোল পৌছায়, তখন বিস্ময়ে পুরো বাস যাত্রীরা হতবাক। শত শত গ্রামের মানুষ পথ আটকে বসে আছেন রাস্তায়, শুধু এক নজর বাসটিকে দেখবেন বলে।
নানা বয়সী নারী-পুরুষে, ছেলেমেয়েতে হুলুস্থুল। বাড়ির বউরা শাঁখ বাজান, উলু ধ্বণী দেন, ঢাক-ঢোল-কাঁসর বাজতেই থাকে। স্কুলের ছেলেমেয়েরা বাসটিকে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে শুভেচ্ছা জানায়। অসংখ্য মানুষ ঘিরে ধরেন বাসটিকে। আরো দূরের যারা, তারাও কাছে আসার জন্য ঠেলাঠেলি করেন!
টিম লিডারকে বলে অভুতপূর্ব এই দৃশ্যবন্দী করতে বাস থেকে লাফিয়ে নামা। অলিম্পাস অটো এসেলার ক্যামেরায় একের পর এক ছবি উঠতে থাকে। খালি পা, সাদা মলিন থানের এক বৃদ্ধা বাসটিকে ছুঁয়ে হাউমাউ করে কাঁদেন। ঠাকুমা, কাঁদছেন কেন? হট্টগোল ছাপিয়ে বুড়ির মুখের কাছে কান পেতে শোনা যায়, একটি কথাই বারংবার, বাংলাদ্যাশের বাস! আমাগো বাংলাদ্যাশের বাস!
এক নিমিষে উন্মোচিত হয় মহাসত্য। এই বিশাল জনস্রোত আসলে দেশ বিভাগের শিকার জনগোষ্ঠী। তারা এখনো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ধারণ করেন ফেলে আসা পূর্ববংলা। আর দেশবিভাগের গোপন শেল বিঁধে থাকে পরানের গহীনে।
চমৎকার! ধরা যাক দু-একটি মাউস এবার!
বাই লাইনে বলা যাক, গুরুচণ্ডা৯র (গুরুচণ্ডালি ডটকম) বর্ণ পরিচয়। ২০০৬-৭ সালের দিকে সামরান হুদা, ওরফে শ্যাজাদি আর সুমেরু দা “কারুবাসনা” নামে এপারে দু-একটি সাইটে ব্লগিং করেন। তখন ব্লগ বারান্দায় পরিচয়, পরে ফেসবুক হয়ে বাস্তবে। তারাই গুরুর কথা প্রথমে বলেন। শুরুর দিকেই শুধুই লেখা পাঠ। মতামত, টই, বুলবুল ভাজা – সব কিছু প্রায় দুর্বোধ্য, বিষয়বস্তু অনেকটাই অচেনা। তায় বেশীরভাগই অজ্ঞাতনামা লেখক-পাঠক। তবু আস্তে আস্তে আলোচনা, টই, ভাট, বুবুভাতে ঢুকে যাওয়া। তখনো লগিন পদ্ধতি হয় নাই। হরিদাস পালও আসেন নাই। তবু সব সময় পুরো নাম, ইমেইল দিয়ে সবখানে দাঁত ফোটানোর আপ্রাণ চেষ্টা।
এই ইমেইলের সূত্রে একদা পাইদি, সৈকত দার ইমেল, গুরুতে লেখার নিমন্ত্রণ। ২০০৫ সাল থেকে বিডিনিউজে কাজ করা। আর ২০০৬ সাল থেকে বাংলা ব্লগিং। অনলাইনে লেখালেখির বাতিক থাকেই। এপারে তখন ব্লগ থেকে ব্লগে খুব অস্থিরতা। দলবাজি আর ভণ্ডায়তনের কেন্দ্র কারুবাসনা তোপ দাগান, ওইপারে থুতু টলমল। মুক্তমনা তখনো ব্লগ সাইট হয়নি, কেবলই অনলাইনপত্র মাত্র।
তাই লেখার নতুন মঞ্চ পেয়ে আঠা দিয়ে সেঁটে থাকা। শম্বুক গতির ইন্টারনেটই ভরসা। তখনো মোবাইল ভার্সন নাই। টু-জি ফোনে চোখের মাথা খেয়ে কখনো সাইট পড়া যায়। কখনো আবার তাও যায় না। বাংলাদেশের সমসাময়িক ঘটনা, আদিবাসী প্রসংগ নিয়ে লেখার চেষ্টা। এপারের কিছু কিছু লেখাপত্র প্রকাশের জন্য তাগাদা। কিছু কিছু লেখা সম্পাদনা করাও চলে। সব কিছুই হয়ে ওঠে খুব আনন্দময়। সে সময় একদিন পাইদির ফোন! উনি বোধহয় তখন বিদেশে। মানে ইন্ডিয়াও বিদেশ, কিন্তু আরো দূরের বিদেশে হয়তো! সেদিন বুঝি খুশীতে অনেকটা বাকবাকুম।
তারপর মুক্তমনা ব্লগ হলো, গুরুতেই হলো ব্লগ। হু হু বাবা, এ হলো ক্ষমতাহীনের মিডিয়া, ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়! হরিদাস পালও দু পয়সা দান করার হিম্মত রাখে!
এদিকে কলি বাস যাত্রা বিরতিতে কেনা গেছে এয়ারটেল ভারতীয় সিম। একমাসের আন লিমিটেড টক টাইম, আন লিমিটেড নেট, এইসব হাবিজাবি প্যাক। পথেই মেসেঞ্জারে জানা যায়, সৈকতদা কাজে আটকে গেছেন, বইমেলায় আসতে পারছেন না। প্রতীভা দি দুঃখ প্রকাশ করেন, তিনি কলকাতার বাইরে। বিনায়ক রুকুর স্পেশাল মম সুমন জানান, বুধবারের আগে তার সময় নাই। কি আর করা? না হয় পরের বার!
হোয়াটস এপে বার বার ফোন, টেক্সটে খবর নেন, তাপস দা, কলেজ স্ট্রিটের বন্ধু, গুরুচণ্ডা৯র পাঠক সুকান্ত। এখন কতদূর? বইমেলায় কখন? বিএড কোর্সের ছাত্র সুকান্ত পায়ের নখ উল্টে পড়ে আছেন। তাই চণ্ডালকেই যেতে হয় তার কাছে। পথেই এপারেরে উবার এপ (কলতায় অবশ্য- উবের) ফেলে দিয়ে ওপারের উবার এপ নতুন করে নেওয়া। দীর্ঘ রাতযাত্রায়, জাগরণে ক্লান্ত-বিদ্ধস্ত। দুপুর নাগাদ ডরমেটরিতে পৌঁছে বাথরুমে গরম পানির ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট। স্নানাহার সেরে তখনই উবার ডেকে বইমেলা হানা। শেয়ারের ট্যাক্সি এপে চলে দেখে খানিকটা বিস্ময়।
এক দশকে বেশ আধুনিক কলকাতা। অনেক উড়াল পথ। হলুদ ট্যাক্সি আর অটোর দেখা পাওয়া মুশকিল। জাপান-ভারত যৌথ প্রযোজনার প্রচুর ঝাঁ চকচকে গাড়ি। শহর অনেক পরিছন্ন। রাস্তার পাশে প্রচুর খাবারের দোকান; হরেক রকমের রোলের ছড়াছড়ি। গাড়িঘোড়ামানুষে পুরো শহরই যেন ঢাকার গুলিস্তান। মোড়ে মোড়ে হীরক রাণীর সচিত্র বাণী ঢাকার মতোই।
আগেই পণ ছিল, ভাষার মাসে সর্বত্রই বাংলা, ইংরেজী পারত পক্ষে নয়। হিন্দীভাষী হোটেল রিসেপশনিস্ট, রুম সার্ভিস, রেঁস্তোরা বয়, উবার ড্রাইভার, পুলিশ – সবাই বেশ বাংলা বোঝেন; তাইলে ইংরাজী কমু ক্যান?
পাইদিদি সকাশে
৬ নম্বর গেট দিয়ে এলে সোজা, ৯ নম্বর গেট দিয়ে এলেও সোজা, লিটিল ম্যাগ চত্বরের পাশে, ২৯৩ নম্বর গুরুর স্টল — ইত্যাদি জপ করতে করতে সল্ট লেক সেন্ট্রাল পার্কে পৌঁছে হতচকিত। এ যেন ঢাকার বাণিজ্য মেলা! এতো বিশাল, এতো ভীড়, এতো স্টল, এতো পুলিশ, এতো আলো!
অমর একুশের বইমেলার ফুরফুরে মেজাজ বা চরিত্র, কোনোটাই নাই – এক অগুনতি বইয়ের স্টল ছাড়া। তাও বিদেশী বইয়ের ছড়াছড়ি। ধুতি-পাঞ্জাবি, শাড়ি-চাদরে ষোলআনা বাঙালিআনা যেমন আছে, তেমনি হ্যাট-কোট, জিন্স-শার্ট পরা ঠাকুমাও কম নেই। মেশিনের চা, মেশিনের কফি, প্যাকেটজাত পানি মোড়ে। মঞ্চে বাউল গান, ইন্সুরেন্স কোং-এর স্টল ঘিরে কুইজের ভীড়, গিটারে দলছুট, মন্থর মিছিলে ম্যান্ডোলিন। তবে অনেকের হাতেই আছে বইয়ের প্যাকেট।
হোঁচট বা খাবি খেতে খেতে পৌনে এক ঘন্টা ম্যালা মচ্ছবের ছবি তোলা। গুরু, কিন্তু গুরুগম্ভীর নয় – শ্লোগানের উল্টোপাল্টা প্রতিষ্ঠানে অচেনা মানুষজনের ভীড়। ক্যাশ কাউন্টারে পারমিতা দিকে সনাক্তের পর পরিচয় দিতে তারও সহাস্য অভিবাদন। পরিচয় হয় রৌহিন দা, মারিয়া কোয়েল, একাদশের ছাত্র অরূপ এবং চিরতরুণ শেখর দার সাথে। শেখর দার প্রথম কথাই এরকম, প্যাঁচা গেঞ্জি দিতে পারছি না বলে দুঃখিত। আসলে একজনকে কয়েকটি গেঞ্জি বাংলাদেশে পৌঁছে দিতে বলা হয়েছিল। তিনি তা করেননি, পরে গেঞ্জিগুলোও উদ্ধার করা যায়নি।…
মেলা এক চক্কর ঘুরে আসেন তাপস দা। সবাই হৈ হৈ করে মেশিনের কফি খাওয়া হয়। কেউ পাইদির নামে এক বাক্স চাউমিন নিয়ে আসেন। কিন্তু প্রচার হলো- পাইদির (সম্ভবত দিল্লী) ফ্লাইট বিলম্বিত, তিনি সেদিন আসছেন না। শুনে কি একটু মন খারপ হয়? এদিকে পাইদির চাউমিন হাতে হাতে ঘুরতে ঘুরতে হাপিস।
খানিকটা বিরতি নিয়ে মেলার ভেতর এলোমেলো পরিভ্রমণ। গুরু স্টলের সীমানায় নীচু প্রাচীরে বসে গান করে একদল ছেলেমেয়ে। গিটার বাজান মাঝ বয়সী, গোল গলার গেঞ্জির, মাঝখানে সিঁথির এলোমেলো চুলের একজন। আপনি সৈকত দা? খপ করে ধরে ফেলা যায় তার কবজি। ভ্যাবাচ্যাকা দঙ্গল উঠে দাঁড়ায়। গিটারিস্টের বিচ্ছিরি কর্কশ কণ্ঠ ও মৃদূ ভুড়ির আভাসে ভাঙে ভ্রম।
ইয়ে, শেষে খাপ থেকে বের হয় ব্রহ্মাস্ত্র। কলি ছেড়ে পুরাই ঢাকার সদরঘাট। প্রচুর সরি-টরি কইয়া নিস্তার লাভ। দাদা, বাংলাদ্যাশ থিকা পৌনে দুই ট্যাকার সাংবাদিক আইছে। ক্যাবলাকান্ত হাসির লোক্টারে দ্যাখছেন? ইত্যাদি।
নাহ, এসব নিছকই দিবাস্বপ্ন। বাস্তবে এমন হলেও হতে পারতো, তবে হয় নাই। অবশ্য ওইরকম গানের দল, আর এলোমেলো চুলের দলনেতাকে দেখে এক সেকেন্ডের জন্য ব্যাটাকে সৈকত দাই মনে হয়েছিল।
দেড়দিন শান্তিনিকেতন ঘুরে ৫ ফেব্রুয়ারি বিকালে আবার গুরুর স্টলে হানা (অফটপিকে: শান্তিনিকেতনে আসলে অন্তত দিনদশেক ঘোরা চাই। ঝটিকা সফরে দেখা হয় নাই তেমন কিছুই। তাই ওই পর্ব আপাতত উহ্য। শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস, রবীন্দ্রনাথের হ্যান্ডল পেন, সিঁধু-কানহুর সাথে সেলফি ও ফুলডাঙার মোহন মুর্মূর অসুর পূজার পর্ব পরে হয়তো)।
দ্বিতীয় পর্বে মেলার মচ্ছব অনেকটাই সরগড়। গুরুর স্টলে প্রথমেই চোখে পড়ে ব্যস্ত-সমস্ত পাইদিকে। লাল শাড়ির আঁচলে ধ্যানী প্যাঁচাসমূহ সার দিয়ে উপবিষ্ট, যেন একেকজন তথাগত। তিনিই হাত বাড়িয়ে দেন, আরি ব্বাস! দেখা হলো তাহলে! হুম, বছর দশেক পর, তাই না? পাইদি এখন ভার্চুয়াল থেকে একচুয়াল! হাসতে হাসতে চোখের কোন কি ভিজে উঠলো? মনে কি পড়লো অহেতুক অভিজিৎ রায়? নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে জীবনে বড় কিছু নাই।…
একে একে আরো গুরুভ্রাতা ও ভগ্নিগণের আগমন। প্রচুর হাসিগান, খুচরো আড্ডা। ছবি, সেল্ফিবাজী, ভিডিওগ্রাফি। পাইদির সঙ্গে টুকরো আলাপচারিতার ভেতরেই হুটহাট করে ঢুকে পড়েন অনেকে। প্রচুর গুরুভক্ত ও গুরু পাঠক ঘিরে ধরেন তাকে। পাইদি জনে জনে পরিচয় করিয়ে দেন, উনি অমুক হন বাংলাদেশের বিরাট তালেবর, ইত্যাদি। দুজন ছাত্রকে মোবাইল খুলে গুরুর সাইট দেখান, লিখতে উৎসাহ দেন।
পরে রাত ৮টায় মেলার ঝাঁপ নামলে একে একে বিদায়। কলেজ স্ট্রিটের বন্ধু সুকান্তর ডিনার উইথ ম্যাজিক মোমেন্টের নিমন্ত্রণ রক্ষার তাড়া। পরদিন ভোরে আবার ঢাকার বাস। সেই চেনা পাষানপুরীতে কলম পেষা, নিউজ ক্লার্ক!
এই দেশেতে এই সুখ হইলো, আবার কোথায় যাই না জানি।…
Leave A Comment