ভূমিকাঃ
আমি বড় হয়েছি অত্যন্ত অসাম্প্রদায়িক পারিবারিক পরিবেশে। আমি বড় হয়েছিলাম এই বিশ্বাসে যে আমাদের দেশটাও অসাম্প্রদায়িক। এর একটা বড় কারণ সম্ভবত, আমার বাবা প্রচন্ড রকমের ইতিবাচক একজন মানুষ। দেশ নিয়ে তাকে আমি কোন অভিযোগ করতে শুনিনি কখনও। আমার মা রীতিমত ধার্মিক গোছের মানুষ হলেও পরধর্ম সহিষ্ণুতা নিয়ে আমাকে ভালই ট্রেনিং দিয়েছেন। পাশাপাশি ছোটবেলায় স্কুলে যখন ক্লাসের কেউ আমার হিন্দু ধর্ম বই নিয়ে হাসাহাসি করত মাকে সে কথা জানালে মা বুঝাতেন যে ক্লাসে দুইচারটা রকম দুষ্টু ছেলেপেলে থাকবেই। কিন্তু সবাই এরকম না। ফলে আমি একটা মিথ্যা বিশ্বাস নিয়ে বড় হয়েছিলাম, সেটি হচ্ছে বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ। বিশ্বাস করতাম, সাম্প্রদায়িক সহিংসতার যে ঘটনাগুলো পত্র-পত্রিকায় আসে সেগুলা রাজনৈতিক জিঘাংসার বহিঃপ্রকাশ (বিএনপি-জামায়াত সংঘটিত), এগুলো কখনও বাংলাদেশে ও বাংলাদেশিদের গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের অংশ হতে পারে না।
একটু একটু করে যখন নিজের কাছে প্রশ্ন করতে শিখলাম তখন থেকে বিভিন্ন বিষয়েই খটকা লাগতো। প্রথম যে বিষয়ে খটকা লাগলো, বন্ধুদের কাছে শুনতাম ইহুদিরা খুব খারাপ, এরা শয়তান ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার তখন মনে হল আইনস্টাইনও তো ইহুদি ছিলেন, এই লোক তাহলে দোজখে যাবে? কেন? এইটা কি অসাম্প্রাদায়িকতার কোন নিদর্শন হল? আবার অধিকাংশ বিষয়ে আশেপাশের মানুষকে ভাবলেশহীন দেখলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে চরম প্রতিক্রিয়া দেখতাম। যেমন, গাজা এবং ইজরায়েল প্রসঙ্গে। সারা পৃথিবীতে কত অনাচার, কত অন্যায়, কত খুনোখুনি ঘটে যাচ্ছে, সব কিছুতে তারা ভাবলেশহীন, এক ইজরায়েল গাজায় কিছু করলেই ব্যাস, একেবারে ফুটন্ত কড়াইতে পাবদা মাছ! বাংলাদেশে হাজার হাজার সংখ্যালঘু নির্যাতনের ব্যাপারে তারা নিশ্চুপ, ইহা প্রকৃত ইসলাম নয় বলেই খালাস (এখন সাথে এটাও যোগ করে যে , এরকম দুচারটা ঘটনা তো হতেই পারে, এ নিয়ে এতো আস্ফালনের কি আছে?), আর শাহরুখ খান আমেরিকার এয়ারপোর্টে স্বাভাবিকের বাইরে ২ মিনিট বেশি জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হলে সেইটা মুসলামদের উপর নির্যাতন, এটা মেনে নেয়া যায় না ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার ধরা যাক, শিয়া-সুন্নীর মারামারিতে মানুষ মারা গেলে সেখানে তাদের কোন অনুভূতি নাই, আর কোন মুসলমান জঙ্গি বোমা হামলা করলে ‘সে প্রকৃত মুসলমান না’ বলে মানবতার দরজা বন্ধ করে দেয়া কিন্তু ইউরোপের কোন ব্যক্তির দাড়ি আছে বলে তাকে আলাদা তল্লাশি করলে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠা—-এসবসব আরও বহু ইন্ডিকেশন থেকে কৈশোর পেরোতে না পেরোতেই আমি বুঝে গেলাম আমাদের দেশটা হচ্ছে অদ্ভুত একটা অনুভূতি দেশ।
আমাদের দেশের মানুষ মোটামুটি ঠিক করে রেখেছে যে দুনিয়াদারির অধিকাংশ বিষয়ে তারা মুখে কুলুপ এটে বসে থাকবে, শুধু ইজরায়েল, ইহুদি, আমেরিকা ও হালের ফ্রনাস বিষয়ে কিছু হলেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবে (সাথে একই ধরণের অন্যান্য বিষয়গুলো যোগ করা যেতে পারে)। আর এই পুরো অনুভূতির পোর্টালটিকে একটা নাজুক শব্দ দিয়ে বাক্য সংকোচন করা যায়-‘ধর্মানুভূতি’।
আজকে খুব সংক্ষেপে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া তিনটা ঘটনার কথা উল্লেখ করবো। আমি বিশ্বাস করি এই ঘটনাগুলো যথেষ্ট পরিমাণ তাৎপর্যপূর্ণ, ভয়াবহ বিপদের পূর্বাভাস, এবং এরপরেও দেশের মানুষের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া নেই কারণ এগুলো তাদের সেই অনুভূতির কোরিলেশন সমীকরণকে প্রভাবিত করে না।
১) ঢাকায় অনুষ্ঠান করতে এসে বিমানবন্দরে আটকে গেল ব্রাজিলিয়ান মেটাল ব্যান্ড
আপাত দৃষ্টিতে একটা ছোট ঘটনা। দেশে এতো এতো সমস্যার মধ্যে কোথাকোর কোন ব্যান্ড এসে অনুষ্ঠান করতে পারলো না, এতে এতো মাতামাতির কি আছে। অন্তত এই ব্যান্ডের ফ্যান বেইজের বাইরে বাকি লোকজনের মতামত এমনই। এখন কথা হচ্ছে, এটা একটা ছোট ঘটনা হতে পারে, কিন্তু এই অনেক কিছু নির্দেশ করে। প্রথমে বলা হচ্ছিল, এইসব মেটাল সংগীত হচ্ছে অপসংস্কৃতি, কিছু উশৃংখল পোলাপাইন এসে স্টেজে উন্মাদের মত মাথা ঝাকাবে, আর বিপথগামী তরুণ তরুণীরা ওখানে নিয়ে উশৃংখলতা করবে এটা তো আমাদের সংস্কৃতির সাথে যায় না, ইত্যাদি ইত্যাদি। সেক্ষেত্রে তো পালটা প্রশ্ন করা যায়, শাহরুখ খান যখন স্বল্পবসনা নারীদের দিয়ে নাচানাচি করতে আসে আমাদের দেশে তখন ও সেটা অপসংস্কৃতি তকমা দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয় না। ঘটনা কি?
নানা জল্পনা কল্পনার পর শেষমেশ আনুষ্ঠানিক বিবৃতি পাওয়া গেল এখানে এই প্রোগ্রামের উদ্যোক্তা র্যাপটর এন্টারটেইনমেন্ট নামে একট একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান রাফিউদ্দীন খান রুশো বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘গ্রেপ্তার নয়, তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছিল। অনুষ্ঠান হওয়ার কথা যেখানে ৯ই মে মঙ্গলবার, সেখানে সোমবারও অনুমতি না মেলায় আমাদের অনুষ্টান বাতিলের ঘোষণা দিতে হয়। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে শোয়ের অনুমতি পাওয়া যায় বলে জানান র্যাপটরের কর্মকর্তারা। তবে অনুষ্ঠানটি আর করা সম্ভব হয়নি। বেশকিছু শর্তে অঙ্গীকারনামা দেয়ার পর ব্রাজিলের ব্যান্ডের শিল্পীদের ইমিগ্রেশন থেকে মুক্তি মেলে।’ এবারে শুনুন শর্তে কি ছিলঃ
“শর্তে কী ছিল জানতে চাইলে মি খান বলেন, নির্দিষ্ট আসন সংখ্যার চেয়ে বেশি দর্শক থাকতে পারবে না এবং ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিতে পারে এমন কোনও পরিবেশনা করা যাবে না।”
ব্যাস, একেবারে অনুভূতির সমীকরণের সবচেয়ে বড় ঘাতওয়ালা চলক ব্যবহার করে ফেললো সরকার! এরপর সবাই ঠান্ডা। এখন কথা হচ্ছে, একটা ব্যান্ডের দল এসে কয়েকটা গান গেয়ে চলে যাবে, এরমধ্যেও ধর্মানুভূতির এলিমেন্ট খুঁজে বেড়াচ্ছে সরকার, এবং সরকার জানে এই কার্ড খেললে উচ্চবাচ্য করার কেউ থাকবে না। এই ছোট্ট ঘটনা প্রমাণ করে সভ্যতার যাত্রায় আমরা খুব জোরেশোরেই পেছনদিকে ধাবিত হচ্ছি। এমন ঘটনা এক সময় আমরা শুনতাম মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছে, আর এতে সরকার পাশে পাচ্ছে দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীকে।
এবার এই আলোচনার ২য় ধাপে আসি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে,
এইযে শাহরুখ ১৩ কোটি টাকার পারিশ্রমিক নিয়ে এদেশে এসে অনুষ্ঠান করে যায়, ওখানে তো স্বল্পবসনা মেয়েদের সমাহার থাকে মঞ্চে। প্রিয়াঙ্কা চোপড়া বা দীপিকা পাড়ুকোনদের জনপ্রিয়তার পেছনে তাদের দেহবল্লরীর ভূমিকা অন্যতম। এসব অনুষ্ঠান আমাদের দেশে অনুমতি পায় কিভাবে?
এইটার উত্তর হচ্ছে ভূমিকায় লেখা সেই অদ্ভুত অনুভূতির কোরিলেশন। আমি লিখেছি যে আমাদের দেশের মানুষ মোটামুটি ঠিক করে রেখেছে কোন জিনিসে তাদের অনুভূতি জাগ্রত হবে আর কোনটাতে হবে না। বলিউডি ফিল্ম আমাদের দেশে অসম্ভব জনপ্রিয়। কথায় কথায় যে ৯০% মুসলিমের দেশের রেফারেন্স শুনি সেই দেশে হিন্দি আইটেম সং আর যৌন সুরসুরি মার্কা হিন্দি সিনেমা অসম্ভব জনপ্রিয়। চরম পর্দা করা মেয়েটাও শাহরুখ খানের হটনেসের ফ্যান, আর ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়া ছেলেটাও সেক্সি প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার ফ্যান। এখন কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে যে আমি কিভাবে বলতে পারলাম নামাজি ছেলেটা হিন্দি মুভি দেখে, সেক্ষেত্রে উত্তর হবে- ১)আমার জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে। ২) কথায় কথায় তো আমরা শুনি যে এদেশ ৯০% মুসলমানের দেশ, সেই মুসলমানের দেশে হিন্দি গান ছাড়া বিয়ের অনুষ্ঠান হয় না, দেশি চিত্রপরিচালকরা হিন্দি মুভি দেশের হলে দেখানো হোক সেটা চান না কারণ এতে কেউ নাকি আর বাংলাদেশি সিনেমা দেখবে না—৯০% মুসলমানের দেশের বলিউডি নাচা-গানা যদি এতো জনপ্রয় হতে পারে তাহলে ধরে নেয়াই যায় এরা ধর্মকর্ম আর সানি লিওনিকে দেখা- দুটো কাজ একসাথেই করে। এছাড়া আর তো কোন গাণিতিক সমাধানে আসা তো সম্ভব নয়। অন্য সলিউশন হতে পারে এভাব যে, এটা ৯০% মুসলমানের দেশ না। ১০% মুসলমানের দেশ, সেক্ষেত্রেই ‘মুসলমান’রা হিন্দি সিনেমার নাচাগানা দেখছে না এটা প্রতিষ্ঠিত করা যায় । সেক্ষেত্রে বলতেই হবে, ১% নয়, ৯৯%-ই বিপথগামী বা ‘অপ্রকৃত’ মুসলমান।
কাজেই যেহেতু আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই ধর্মভীরু ডিস্কো মুমিন, সরকার এতো বিশাল জনগোষ্ঠীকে খেপিয়ে তুলতে চায় না। ব্রাজিলিয়ার ব্যান্ডের ক্ষেত্রে এই সমস্যা হয় নাই, কারণ এদের ফ্যান বেইজ ছোট। তবে এইসব ডিস্কো মুমিনরা মজা বুঝবে যখন দেশটা সত্যি সত্যিই সৌদি আরব ইরানের মত হয়ে যাবে। ক্যাটিরিনা কাইফের দেহবল্লরী দেখার শখ তখন মাঠে মারা যাবে।
২) প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ‘কটুক্তি’, মিরাক্কেল চ্যাম্পিয়ন আবু হেনা রনির বিরুদ্ধে মামলা
বন্যার পানিতে একজন পড়ে গিয়েছিল দেখে আবু হেনা রনি ফেসবুকে লিখেছিল- “কেউ পা ভেজায়, আর কেউ শরীর ভেজায়”। ব্যাস, এতেই গায়ে লেগে গেল এলাকার এক রাজনৈতিক নেতার। কারণ কয়েকদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে পা ডুবিয়েছিলেন। কেন শেখ হাসিনাকে খোঁচা মেরে কথা বলা হল এই জন্য ৫৭ ধারায় মামলা করা হয়েছে রনির বিরুদ্ধে। আমি বুঝলাম না, এই সামান্য বিষয়েও মামলা মোকদ্দমা?? খবরে এসেছে সিংড়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন জানিয়েছেন, “প্রধানমন্ত্রী সমুদ্র সৈকতে যে হেঁটেছিলেন, মামলায় তা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করার অভিযোগ আনা হয়েছে মীরাক্কেল চ্যাম্পিয়ন আবু হেনা রনির বিরুদ্ধে।” এখানে বিরূপ মন্তব্য কোথায় করা হল? আর এটি খুবই হালকা পর্যায়ের একটা হিউমার। আর তার চেয়েও বড় কথা, দেশে কি প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করা যাবে না? টিভিতে টকশোতে কি প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা হচ্ছে না? বিএনপির নেতারা তো অহরহই শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কটুক্তি করছে, ইতিহাস বিকৃত করছে। তাদের বেলায় তো পুলিশ কিছু করে না। এ থেকে আবারও প্রমাণিত হল আইনের প্রয়োগ এবং অপপ্রয়োগ আমাদের দেশে শুধু নিরীহ মানুষের উপরেই হয়। আর রেলিজিয়াস ব্লাসফেমির সাথে এখন সংযুক্ত হল পলিটিকাল ব্লাসফেমি।
৩) রাজশাহীতে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে দমকলকর্মী আব্দুল মতিন নিহত
লেখাটি শেষ করছি অতি সম্প্রতি রাজশাহী জঙ্গিবিরোধী অভিযানে অংশগ্রহণকারী দমকলকর্মী আব্দুল মতিনকে স্মরণ করে। রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটা ইউনিয়নের বেণীপুর গ্রামের জঙ্গি আস্তানায় বৃহস্পতিবার (১১ মে) ‘সান ডেভিল’ নামে অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। এ অভিযানের সময় জঙ্গিদের পাঁচজন আত্মঘাতী হয়েছে বলে দাবি পুলিশের। এদিকে জঙ্গিদের ঘটানো বিস্ফোরণের সময় আহত ফায়ার সার্ভিসের কর্মী আবদুল মতিন হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা গেছেন। ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ ও ভিডিওচিত্র পাওয়া যাবে এখানে ।
ভিডিওচিত্রে এক মহিলা জঙ্গি যেভাবে চাপাতি দিয়ে আব্দুল মতিনকে কোপাচ্ছে সে দৃশ্য দেখে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। এভাবে ঘরে ঘরে জঙ্গির বাম্পার ফলন হয়ে যাচ্ছে আর এদেশের সংখ্যাগুরু জনতা পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে, কারণ এতে তাদের তো কোন সমস্যা হচ্ছে না। একের পর এক ব্লগার, লেখক ও প্রকাশক হত্যার পরও সংখ্যাগুরুর প্রতিক্রিয়া ছিল ১)তারা প্রকৃত মুসলমান নহে ২)ধর্মের বিরুদ্ধে লেখালেখি করলে এমন পরিণতি তো হবেই। যে দেশের অধিকাংশ মানুষ এমন ধারণা পোষণ করে সে দেশে জঙ্গির বাম্পার ফলন হবে না তো কি হবে? আব্দুল মতিন আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যও ছিলেন না, এরপরও জঙ্গি দমনের ফ্রন্ট লাইনে তিনি ছিলেন। তার মৃত্যুতে কয়টা ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখেছি আমরা? আজকে ডোনাল্ড ট্রাম্প এর কোন বক্তব্য যদি মুসলমানদের বিরুদ্ধে যেতো, ব্যাস ফেসবুকে সমালোচনার বাহার, আর আবদুল মতিনের মত এক নিরীহ দমকলকর্মী যে ভয়ংকর জঙ্গিদের হাতে নিহত হল সেটা নিয়ে এদেশের মানুষের কোন প্রতিক্রিয়া নেই। গাজায় হামলা হলে হ্যাশট্যাগের বন্যায় ফেসবুক ভরে যায়, আর আবদুল মতিনের আত্মত্যাগ আমাদের নজরের বাইরেই থেকে যায়। এই হচ্ছে আমাদের দেশের অদ্ভুত অনুভূতির ফেরিওয়ালা মানুষগুলো।
উপসংহারঃ
দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এ বিষয়গুলোতেও আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ নিশ্চুপ। কারণ তারা মনে করছে এতে তাদের তো কোন সমস্যা হচ্ছে না। একমাত্র ধর্মানুভূতিতে না লাগলে অন্য কোন কিছুইতেই তাদের সমস্যা নেই। একারণেই দলে থাকার জন্য আওয়ামী-লীগ যখন হাটহাজারির পথ ধরে তখন দেশের অধিকাংশ মানুষের সেটাতে মৌন সমর্থন থাকে। শুধুমাত্র লেখালেখির কারণে আবু হেনা রনির নামে যখন মামলা হয় তখন সেটার প্রতিবাদ করার প্রয়োজন তারা বোধ করে না। ঠিক একই মনস্তাত্ত্বিক কারণে তারা ব্লগার হত্যা ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রতিবাদ থেকে বিরত ছিল। এজন্যই বলি, একমাত্র ফ্রান্সে বোরকা নিষিদ্ধ করলে আর গাজায় হামলা হলেই এদেশের মানুষের মানবতাবোধ জাগ্রত হয়, বাকি সময় তারা শীতনিদ্রায় থাকে। আর এই শীতনিদ্রার সুযোগেই সরকার একনায়কতান্ত্রিক আচরণ করার সুযোগ পায়।
সেদিন আর বেশি দেরি নেই যেদিন এদেশে সত্যি সত্যিই শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠিত হবে, নাহলেও অন্তত পাকিস্তানের মত জবরদস্তি ইসলামিক স্টেটে পরিণত হবে। তখন এইসব সুশীল সুবিধাবাদী প্রজন্মের প্রেম করা, পার্টি করা, হিন্দি সিনেমা দেখা আর গেম অব থ্রোনস দেখা-একেবারে শরিয়া আইনের মধ্যে দিয়ে বুদবুদের মত উড়ে যাবে। হিজাবকে ফ্যাশন হিসেবে নিয়ে যেসব আপুরা সেক্সি ডাকফেস করে ছবি তুলতে পছন্দ করেন, তখন তারা বুঝবেন হিজাব জিনিসটা আসলেই ‘ফ্রিডম’ নাকি ‘ফোর্স’। আর প্র্যাকটিসিং মডারেট ভাইরা শুধু নিজেদের সুবিধামত প্র্যাকটিস করেই পাড় পাবেন না, শরিয়া আইনের নিচে চাপা পড়ে বুঝবেন কত ধানে কত চাল।
মন্তব্য করার পর তা যখন এখানে পোস্ট করার সাহস হয়না তখন বুঝতে হবে লেখক নিজেই নিজের লেখার ব্যাপারে সন্দিহান।
কমেন্ট সেকশন নিয়ন্ত্রণ লেখকের হাতে নেই, থাকলেও আমার জানা নেই। আপনার কমেন্ট পোস্ট হয়েছে দেখলাম।
লেখক নিজেকে একজন মানুস ভাবতে পারেনি। নিজেকে হিন্দু, সংখালঘু ভেবেছেন। একটি দেশে সংখালঘুদের ক্ষোভ থাকে সংখ্যা গরিষ্ঠ দের বিরুদ্ধে। তাই ওনার রাগ মুসলমানদের প্রতি,তাদের সমস্ত ভাবনার প্রতি। এ দেশে যদি সংখা গরিষ্ঠ মানুস খ্রিষ্টান বা বৌদ্ধ হত তখন তার লেখা উনাদের বিরুদ্ধে যেত। উনি নিজে যদি ভারতের হিন্দু হতেন তা হলে আজ এ লেখা উনি লিখতেন না।উনাকে বড় সাম্প্রদায়িক মনে হচ্ছে। কেঁদে কেটে শুধু ইসলাম ধরমের বিষাদাগার। ভারতে হিন্ধুরা কি করছে বা নিজ ধর্মের ভুল নিয়ে কোন বক্তব্য নাই।
১) এখানে ইসলামের বিষোদগার কোথায় করেছি, বা কোন বাক্যগুলোতে আপনার সমস্যা আছে- সেটা সুনির্দিষ্টভাবে বললে উত্তর দিতে সুবিধা হত। ব্লাঙ্কেট মন্তব্যের যুক্তিখন্ডন করা বেশ কষ্টকর।
২) আপনি আমার একটা লেখা পড়েছেন, সেটা পড়েই ধরে নিলেন নিজ ধর্মের ভুল নিয়ে আমার কোন বক্তব্য নেই। এমন মনগড়া কল্পনার ডাটা পয়েন্ট কি কি?
৩) উনি নিজে যদি ভারতের হিন্দু হতেন তা হলে আজ এ লেখা উনি লিখতেন না–কথা সত্য। তখন আমি ভারতীয় হিন্দুদের নিয়ে লিখতাম, উত্তর প্রদেশে চলমান সহিংসতার কথা লিখতাম, বাবা আদিত্যনাথের উত্থান নিয়ে লিখতাম, সমালোচনা করতাম।
৪) বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের জীবন বেশ দুর্বিসহ। তাদেরকে আসলে মানুষ হিসেবে ট্রিট করা হয় না। নিজেকে মানুষ ভাবতে পারলেও কখনও ১ম শ্রেণীর নাগরিক ভাবতে পারিনি একথা স্বীকার করব। তবে সেই দায় আমার নয়, সেই দায় সংখ্যাগুরু ১ম শ্রেণীর নাগরিকদের।
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।
ধর্ম এবং নৈতিকতাকে বাংলাদেশের মানুষ একসাথে মিলিয়ে-গুলিয়ে ফেলে এটাই একটা প্রবলেম, ধর্ম ছাড়াও যে মানুষ নৈতিক এবং সুস্থ-স্বাভাবিক লাইফ যাপন করতে পারে সেটা মানুষ বুঝেনা।
ধর্ম অনৈতিক কাজ করতে বললেও মানুষ সেটাকে নৈতিক ধরে নেয়। এই যেমন বউ পিটানো!
মানুষের জন্ম হওয়ার পর থেকেই যদি রক্ষণশীলতার মধ্যে বড় হয় যেমনটা আমি হয়েছি তাহলে তার সুস্থ-স্বাভাবিক বিকাশ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে।
যত যা’ই বলেন, যুক্তিহীন এই সব অসুস্থ ভাবনাগুলোর ভিত্তি কিন্তু শিশুকালেই তৈরী করে দিয়েছে ধার্মিক মা বাবা কিংবা ঘরের বড়রা। এটা সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বড় বড় পাশ দেওয়া সো-কল্ড শিক্ষিত মানুষ সকলের জন্যই প্রযোজ্য। শিশুকে যখন মগজ ধোলাই দেওয়া হয় তখন বড়রা ভেবেও দেখেনা যে তারা তাদের শিশুকে ভয় দেখিয়ে শিশুটি’র ভাবনাকে কন্ডিশন্ড করে দিচ্ছে। এই শিশুটিই বড় হয়ে ধর্ম রক্ষার নামে মানুষ জবাই দেখে কিংবা জবাই করেও নির্বিকার থাকে। এত বড় অন্যায়’কে অন্যায় না দেখে এটাকে নিয়ে নেয় স্বাভাবিক একটা দৈনন্দিন কাজকর্মের মতই। আজকে নায়ারে তাকবীর, কালকে বৈশাখী মেলা আর পরশু জুম্মা পড়ে শনিবার প্রতিমা ভাঙার সমর্থক।
ধর্মানুভুতির কারণে চাপাতি খুনের সমর্থক। এই সব মানুষ কিন্তু তৈরী করেছে সযতনে তাদের’ই মা বাবা এবং গুরুজনেরাই। সজ্ঞানে ও অজ্ঞানে। এই ধরণের জনগোষ্টির থেকে সুস্থ স্বাভাবিক সুন্দর কিছু আশা করা অনেকটাই অবাস্তব আজ। তবু হোক; কেউ কেউ; কিছু মানুষ তো আলো জ্বেলে পথ দেখাবেই; যেখানে যে কোন মূল্যেই।
শক্তিশালী লেখাটির জন্য ধন্যবাদ।
একের পর এক লেখক, ব্লগার ও মুক্তবুদ্ধির মানুষদের জন্য হত্যা করা হল তখন কিন্তু আমাদের এই সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় তখন চোখ বুজে ছিল। জঙ্গিবাদের বিরোধিতা তো করেইনি, বরং এমন লেখালেখি করা ঠিক না, এমন মতামত দিয়েছিল। আর সেই মতামতেরই প্রতিফলন ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতি। দেশের অধিকাংশ মানুষ তখন হাত্তালি দিয়েছিল।
কিন্তু হোলি আর্টেজানের ঘটনার পর সবাই ভোল পালটে ‘যেকোন রূপে জঙ্গিবাদ রুখতে হবে’ সারিন্দায় এই সুর তুলেছিল। খুব বেশি লোক কিন্তু বলে নি যে রাত বিরাতে রেস্টুরেন্টে যাওয়া হারাম, ছেলে মেয়ের অবাধ মেলামেশা হারাম, সুতরাং এমন করলে তো কোপ খেয়ে মরতেই হবে। কারণ, এইটা দেশের মানুষের লাইফ স্টাইলের সাথে কনসিস্টেন্ট। তাই ঐ ঘটনার পর প্রথমবারের মত তারা বুঝলো তাদের কল্লাও নিরাপদ না, আর এজন্যই ‘আইসিস রুখো, জঙ্গিবাদ রুখো’ গান শুরু করল। এই ডায়লগ কিন্তু অভিজিৎ রায়কে হত্যা করার পর তারা বলে নাই।
কাজেই আমাদের দেশের মানুষ জঙ্গিবাদ বিরোধী এইটা আমার মনে হয় না, নিজেদের কল্লার নিরাপত্তা পেলে অন্যদের কল্লা থাকলো কি থাকলো না এইটা নিয়ে তারা নির্বিকার।
একদম সত্য কথা। রবীন্দ্রনাথের ‘নারীদের বড় শত্রু নারী’ এটাই বারবার মনে হয়।
শুভেচ্ছা 🙂
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সাবলীল লেখা। আশি নব্বুই-র দশকে, আমার কৈশোর আর তারুণ্যে যে বাংলাদেশকে দেখেছি তার থেকে এখনকার বাংলাদেশকে অনেক গোঁড়া মনে হয়। আমার পরিবারেই ধর্মের বিধিনিষেধের কড়াকড়ি দেখতে পাই যা আগে বেশ শিথিলই ছিল। লেখকের কথা ঠিক যে আমাদের ‘মডারেট’ ভাই বোনেরা না পুরোপুরি সহিহ ইসলামের মানেন, না উদারমনা হতে পারেন। দুটোর মাঝামাঝি একটা সুবিধাবাদী অবস্থায় তারা সানন্দেই ত্রিশঙ্কু হয়ে বিরাজ করছেন। মাঝে মাঝেই অন্তর্জালে এদের মতামতে চরম ইসলাম প্রেম আর গোঁড়ামির পরিচয় পাওয়া যায়। তবে ব্যক্তি-জীবনে এদের অনেকেই পাঁচ ওয়াক্ত নামায বা রোজা করেন কিনা সন্দেহ আছে। আর নামায-রোজা করলেও ইসলামে নিষিদ্ধ এমন বিষয়ে এদের অনেকেরই এমনই আমল যে পরকালে বেহেশত নসীব তো বহু দূর, বেহেশতের সুবাস পাওয়ার মত যোগ্যতাও হয়ত হবে না। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া রেইন-ট্রি হোটেলে দুঃখজনক নারী-নির্যাতনের ঘটনায় এই ‘মানবতার ধর্ম ইসলাম’-র অনুসারীদের মন্তব্যে পুরুষ অপরাধীর নিন্দা না বরং নির্যাতিতাদেরই অপরাধী বানানোর চেষ্টা চলছে। তাদের যুক্তি মেয়েরা ইসলামী ধারায় না চলে পুরুষদের সাথে মেলামেশা করাতেই এমন হয়েছে। এই যদি দেশের বেশীরভাগ মানুষের অবস্থা হয় তাহলে এই দেশে শরীয়া আইন আসা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।
সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ খুব সামান্য বিষয়েও নৈতিকভাবে অসৎ। এরা খুব সহজেই নিজেদের অপকর্মকে হালালিকরণ করতে ওস্তাদ, ওদিকে অন্য কারও পান থেকে চুন খসলে কল্লা চাই কল্লা চাই শুরু করে। যেমন, ঘুষ খাওয়া নিয়ে আপনি শুনবেন না ইহা ৯০% মুসলমানের দেশ, যখন নারীনীতি বাস্তবায়ন করতে যাবে তখন শুরু হবে ৯০% মুসলিমের দেশে এইটা হবে না ঐটা হবে না ব্লা ব্লা। ৯০% মুসলমানের দেশে প্রকাশ্যে ধুমপান কি করে চলে সেই প্রশ্ন কেউ করে না, কারণ এদেশের মানুষ এটাকে তাদের সেলফ-মোরালিটিতে হালাল করে নিয়েছে। একই কথা ঘুষ বা উপরির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এরকম কিছু সূত্রের মধ্যে পড়লে সাত খুন মাফ, এর বাইরে উচিত কথা বললেই এদের গায়ে একেবারে ফোস্কা পড়ে যায়।