[ইয়োভাল নোয়াহ হারারির নতুন বই Homo Deus – A Brief History of Tomorrow এর ভাবানুবাদের একটি প্রচেষ্টা হচ্ছে নিচের এই সিরিজ। এটি পুরো বইয়ের ভাবানুবাদ নয়। বরং গুরুত্বপূর্ণ ও বেশিরভাগ অংশের সারসংক্ষেপের একটি প্রচেষ্টা]

উনিশ শতকের মাঝামাঝি কার্ল মার্কস তার বিখ্যাত তত্ত্ব দেন। প্রোলেটারিয়েট আর পুঁজিবাদীদের মধ্যে শ্রেণী সংগ্রাম অনিবার্য। এই যুদ্ধের শেষ মাথায় শোষিতরাই ক্ষমতায় যাবে। মার্কস প্রায় নিশ্চিত ছিলেন, এ সংগ্রাম শুরু হবে শিল্প বিপ্লবের আঁতুড়ঘরগুলোতে- ব্রিটেন, ফ্রান্স, আমেরিকা।

মার্কস ভুলে গিয়েছিলেন পুঁজিবাদীরাও পড়তে পারে। প্রথমে তেমন কেউ মার্কসকে গায়ে লাগায়নি। কিন্তু সমাজতন্ত্রীরা যখন ক্ষমতা পাওয়া শুরু করলো, পুঁজিবাদীরাও নড়েচড়ে বসলো। মার্কসের একই Das Kapital, একই ব্যাখ্যা তারাও ব্যবহার করা শুরু করলো। কঠোর পুঁজিবাদীরাও, যারা উঠতে বসতে মার্কসকে গালি দেন, তারাও মার্কসের এই প্রোলেটারিয়েটদের ক্ষমতায় যাওয়া নিয়ে চিন্তিত।

১৯৬০ এ যখন সিআইএ ভিয়েতনাম আর চিলির অবস্থা বিশ্লেষণ করে, তারা সমাজকে ভাগ করেছিলো মার্কসের মতো বিভিন্ন শ্রেণীতে। যখন নিক্সন বা থ্যাচার পৃথিবীর মানচিত্রে দিকে তাকান, একটাই প্রশ্ন তাদের মাথায় আসে, এই জায়গার ক্ষমতায় কে? জর্জ বুশ সিনিয়র ১৯৮৯ থেকে ৯১ পর্যন্ত কমিউনিজমের পতন দেখা লোক। সেই লোকই ৯২ এ ক্লিনটনের কাছে হেরে যান। ক্লিনটনের নির্বাচনী প্রচারণার শ্লোগান ছিল একলাইন- It’s the economy, stupid.

পুঁজিবাদীরা খুব ভালো করেই মার্কসের ভবিষ্যতবাণী জানে ও বুঝে। অনেক ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রীদের থেকেও বেশি। তাই তারা এমন ব্যবস্থা তৈরী করেছে যে মার্কসের এই জ্ঞান বেহুদা-অকার্যকর হয়ে পড়ে।

ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো পুঁজিবাদী দেশে পূঁজিবাদীরা শ্রমিকদের সামান্য বেশি পয়সা আর বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়া শুরু করলো। তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়া শুরু করলো। আস্তে আস্তে তাদের বিভিন্ন রাজণৈতিক দলে ঢুকানো শুরু হলো। তারা ভোটের অধিকার পেলো। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা জনগণকে যে ফাও একটা অনুভূতি দেয় যে দেশ চালানোতে তারও অংশ আছে, শ্রমিকরা সেই অনুভূতি পাওয়া শুরু করলো। ফলাফল কী?

পূঁজিবাদীরা মার্কসকে অগ্রাহ্য করে এখনো রাতে আরাম করে ঘুমাতে পারে। এই কারণে কমিউনিস্ট অভ্যুত্থান কখনোই আমেরিকা-ব্রিটেনের মতো অর্থনৈতিক শক্তিকে দখল করতে পারেনি। এবং বরাবরের মতোই শোষিতরা ক্ষমতায় যাবে- এই মহান বাণী ডাস্টবিনে।

এটাই জ্ঞানের বিভ্রান্তি। যে জ্ঞান মানুষের আচরণ পরিবর্তন করে না, সেটা বোগাস জ্ঞান। কিন্তু যে জ্ঞান খুব তাড়াতাড়ি আচরণ পরিবর্তন করে, তা খুব তাড়াতাড়িই কার্যকারিতা হারায়। যত বেশি তথ্য হাতে থাকবে আমরা ততো বেশি ইতিহাস বুঝতে পারবো। কিন্তু ইতিহাস যত তাড়াতাড়ি বাঁক ঘুরবে, ততো তাড়াতাড়ি আমাদের ঐ বিষয়ের জ্ঞান পুরনো হয়ে যাবে।

কয়েক শতাব্দী আগে আমাদের জ্ঞান এগিয়েছে খুব ধীরে, ফলে রাজনীতি অর্থনীতিও এগিয়েছে ধীরে। ১০১৬ সালে এটা ভবিষ্যতবাণী করা খুব সহজ ছিল ১০৫০ সালে ইউরোপ কেমন হবে। হ্যাঁ, ডাইনেস্টি ধ্বংস হবে, যুদ্ধ হবে, কিন্তু প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যেতো ১০৫০ সালও ইউরোপ চালাবে রাজা আর প্রিস্টরা, মানুষ থাকবে কৃষিজীবী।

এখন আমাদের জ্ঞান বাড়ছে প্রতি মূহুর্তে দূর্দান্ত গতিতে। তাত্ত্বিকভাবে, আমাদের ভবিষ্যৎ আন্দাজ করার ক্ষমতাও বাড়া উচিত ছিল। বাড়েনি। কারণ জ্ঞান বিভ্রান্তি।

দ্রুত জ্ঞান বাড়ার সাথে সাথে অর্থনীতি ও রাজনীতি এগোচ্ছে প্রচন্ড গতিতে। তাই এখন থেকে ৫০ বছর পর ইউরোপ কেমন হবে তার ভবিষ্যৎবাণী করা খুব কষ্টকর। নতুন রাজনৈতিক পদ্ধতি কি আসবে? অর্থনীতি কি পরিবর্তিত হবে? নাকি পারমাণবিক বোমা মেরে আমরা সব ধ্বংস করে দেবো?

15036229_10154897505799674_1803988701359912794_n

ইতিহাস পড়ার উদ্দেশ্য কী? ইতিহাস পড়ে আমরা কী আমাদের পূর্বপুরুষদের চমৎকার সিদ্ধান্তগুলো পুনরাবৃত্তি আর ভুল সিদ্ধান্ত এড়াতে পারবো? দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধে হানিবালের টেকটিকস কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে? ক্যাভলারির যুদ্ধ কৌশল কি সাইবার যুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে?

ভবিষ্যৎবাণী করাটা বিজ্ঞানের অন্যতম একটা উদ্দেশ্য। যেমন, আবহাওয়াবিদরা আগামীকাল বৃষ্টি হবে না, রোদ হবে আন্দাজ করেন। একজন ডাক্তার ভবিষ্যৎবাণী করেন, রোগীর জন্য কেমো ভালো হবে, না রেডিওথেরাপি। ইতিহাস পড়ে কি আমরা ভবিষ্যৎ আন্দাজ করতে পারবো?

ইতিহাস পড়ার উদ্দেশ্য মানুষকে মুক্তি দেয়া। ‘টানেল ভিশন’ থেকে মুক্তি দেয়া। মানুষকে বুঝানো, আমরা এখন যে পরিস্থিতিতে আছি, এটা চিরস্থায়ী নয়। আমরা আগে এই করেছিলাম বলে এখানে আছি। এই যদি করি আমরা আরো ভালো থাকবো। এই কারণে মার্ক্সিস্টরা পুঁজিবাদের ইতিহাস পড়েন, আফ্রিকান আমেরিকানরা দাসপ্রথার।

বড় বড় বিপ্লবের জন্য যা প্রযোজ্য, তা একইভাবে আমাদের প্রতিদিনের ছোটখাট ঘটনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আপনি একটা চাকরি করেন। বউ-বাচ্চা আছে। অনেক দিন চাকরি করে ভালো টাকা-পয়সা জমিয়েছেন। এখন একটা বাড়ি বানাতে চাচ্ছেন। আর্কিটেক্ট এর কাছে গিয়ে বললেন, “একটা সুন্দর বাড়ির নকশা দেন। বাড়ির সামনে যেন একটা লন (Lawn) থাকে।”

লন কেন? লন তো একটা বেহুদা জিনিস। সেখানে আপনি ছাগলকে ঘাসও খাওয়াতে পারবেন না। আলু চাষও করতে পারবেন না। বরং লন পরিষ্কার ও সুন্দর রাখতে আপনাকে প্রতি মাসে হাজার হাজার টাকা গুণতে হবে। তাহলে আলাস্কা থেকে বালি পর্যন্ত আধুনিক মানুষেরা টাকা থাকলেই লন বানাতে চায় কেন? এর পিছনে ‘ইতিহাস’ আছে।

আপনার আমার পূর্বপুরুষ যারা ছিল গরীব কৃষক, তাদের লনের কোন উপযোগিতা ছিলোনা, সামর্থ্যও ছিলনা। দামি জমি লন বানিয়ে ফেলে রাখার মতো বোকাও তারা ছিলোনা।

মধ্যযুগের শেষে লন আসে ফ্রেঞ্চ আর ব্রিটিশ আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে। দেখো দেখো, আমি এতো ধনী, আমার এতো জমি-টাকা-পয়সা আছে যে, আমি আমার বাড়ির সামনে এতো বড় লন রাখতে পারি। আমি তোমাদের মতো গরীব চাষা না।

যত বড় যত পরিষ্কার লন, ততো বড় ধনী, ততো অভিজাত। আপনি একজন ডিউকের বাড়ি বেড়াতে গেলেন। দেখলেন ভদ্রলোকের লনে ছাগল ঘাস খাচ্ছে। বুঝবেন, ভদ্রলোকের অবস্থা খুব খারাপ।

দুইশ তিনশো বছর আগে যখন রাজারা ক্ষমতা হারানো শুরু করলেন, আর রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীরা ক্ষমতায় আসা শুরু করলেন, তার ক্ষমতার চিহ্ন হিসেব এই লন রেখে দিলেন। হোয়াইট হাউস থেকে বাকিংহাম পেলেস, সুপ্রিম কোর্ট- সব জায়গায় লনের জয়জয়কার। এমনকি গত দুই শতাব্দীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলা হয়েছে লনে- ফুটবল, টেনিস, ক্রিকেট। পুরো আমেরিকায় ভুট্টা আর গমের পর সর্বাধিক উৎপাদিত হয় কী? ঘাস।

পৃথিবীর প্রায় সব জায়গায় এখন লনকে আভিজাত্য, ক্ষমতা আর টাকার সমার্থক ধরা হয়। ইংল্যান্ডে একজন লর্ডের বাড়িতে যান। আভিজাত্যের জন্য তার বাড়িতে লন থাকবে। মরুভূমির মাঝখানে কাতার বানিয়েছে মিউজিয়াম অব ইসলামিক আর্ট। তার চারদিকে ১ লক্ষ স্কয়ার মিটার ঘাস। সেই ঘাসকে প্রতিদিন সুপেও পানি খাওয়াতে কাতার খরচ করে কয়েক মিলিয়ন ডলার। এখানে ঘাস টাকার প্রতীক। আর হোয়াইট হাউজের সামনের লন রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতীক। এই লন আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে ইউরোপিয়ান উপনিবেশবাদী আর পুঁজিবাদি কর্পোরেটরা। এই ঘাস ঠিক রাখার পেছনের কর্পোরেট মার্কেট বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের।
ইতিহাস পড়ার স্বার্থকতা এখানেই যে, এখন আপনি আপনার বাড়ির সামনে লন বানানোর আগে দুইবার ভাববেন।

15136014_10154905706609674_6677523694536037310_n

#Homo_Deus_ইয়োভাল হারারি । ভাবানুবাদ । চ্যাপ্টার ১ কিস্তি ৬ ও শেষ