লিখেছেনঃ রাজেশ পাল

তৌকির আহমেদ এর “অজ্ঞাতনামা” ছবিটি নিয়ে লিখতে বসলাম।সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইনে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে ছবিটি। আর সেই আগ্রহ থেকেই দেখলাম ছবিটি। একেবারে ক্লাসিক মাস্টারপিস টাইপের কিছু না হলেও ছবিটি আমার ভালো লেগেছে নিঃসন্দেহে। আর সেই ভালোলাগার কিছুটা অংশীদার করার সুপ্ত বাসনা থেকেই এই লেখাটি।

প্রতি বছর এদেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ পাড়ি দিচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্যে জীবিকার তাগিদে। তাদের পাঠানো রেমিটেন্স পরিণত হয়ে উঠেছে আজ এদেশের বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনের অন্যতম উতসে।দেশীয় বাজারে চাকরি নামক সোনার হরিণটি ক্রমশঃ দূষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠায় ক্রামশঃ বেড়ে চলেছে এই প্রবাসমূখী কাফেলা। নিজের শেষ সম্বল ভিটেমাটি, হালের বলদটা পর্যন্ত বিক্রি করে দক্ষ ও অদক্ষ বেকার তরুণরা পাড়ি জমাচ্ছেন প্রবাসে , বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে। কিন্তু সবাই কি পাচ্ছে সেই সোনার হরিণের সন্ধান? অবশ্যই না। অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো এখানেও এসে জড়ো হয়েছে মধ্যস্বত্বভোগী প্রতারকের দল।যাদের খপ্পড়ে পড়ে সহায়সম্বলহীন নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে প্রান্তিক মানুষেরা। আর সেই মানুষদের গল্প নিয়েই তৈরী তৌকির আহমেদ এর “অজ্ঞাতনামা”

প্রথমে তাকাই একবার চলচ্চিত্রের কাহিনীর দিকে, নিতান্ত সাধারণ গ্রামবাসী কেফায়েত প্রামাণিকের ছেলে আছিরুদ্দিন প্রামাণিক থাকে মধ্যপ্রাচ্যে। গ্রামে রয়েছে তার বৃদ্ধ পিতা মাতা,স্ত্রী আর সন্তান।কিন্তু কিছুদিন ধরে তার খবর পাচ্ছেনা পরিবার। এ নিয়ে দুশিন্তায় সবাই।আর পরিবারের বাইরে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ বিউটি নামের একটি মেয়ে।বিউটি অকাল বিধবা। বিয়ের বছর না ঘুরতেই মারা যায় তার স্বামী।রেখে যায় একটি সন্তান। এখন তার জীবন কাটে পরের রক্ষিতা হয়ে। কিন্তু এই জীবন থেকে মুক্তি চায় সে।চায় মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমাতে।আর সেই জন্যই তার দুশ্চিন্তা আছিরকে নিয়ে।কারণ আছিরের বউ সাজিয়ে তাকে মধ্যপ্রাচ্য পাঠানোর স্বপ্ন দেখিয়েছে রমজান দালাল।বিনিময়ে রমজানের রক্ষিতা হয়ে জীবন কাটে তার।তবে শুধু রমজান নয়, তার অনুগ্রহপ্রার্থী আছে আরো অনেকেই। স্থানীয় থানার দারোগা ফরহাদ তাদেরই একজন। ফরহাদ যদিও মুখে সবসময়ই বলে বিউটিকে আসলে ভালোবাসে সে,দেখায় ঘর বাধার স্বপ্ন, কিন্তু বিউটি তাতে বিশ্বাস করেনা মোটেই।জীবনে বারেবারে প্রতারণার শিকার হতে হতে পুরুষজাতির উপরে সব আস্থা হারিয়ে ফেলেছে পুরোপুরি।এসব মিস্টি কথায় তার মন তাই আর ভেজেনা এখন।

এমন সময়ে ঢাকা থেকে কল আসে স্থানীয় থানার ওসি সাহেবের কাছে যে আজমান প্রবাসী শেখ আব্দুল হাকিমের ছেলে শেখ আব্দুল ওয়াহাব একটি দূর্ঘটনায় মারা গেছেন। একদিন পরে তার লাশ আসবে ঢাকা বিমান বন্দরে।সেখান থেকে তা রিসিভ করতে হবে পরিবারের সদস্যদের। কাজেই সংবাদ দিতে হবে রাতের মধ্যেই। ঝড় বাদল উপেক্ষা করে ওসি সাহেব যান সেই গ্রামে গভীর রাতেই। স্থানীয় মেম্বারের সহায়তায় খুঁজে নেন শেখ আব্দুল হাকিমের বাড়ী। দেন দুঃসংবাদটি।সন্তানের মৃত্যু সংবাদে প্রচণ্ড ভেঙে পড়েন হাকিম সাহেব। কিন্তু ৩ দিন আগে মৃত্যুর সংবাদ শুনে তিনি প্রতিবাদ করেন সংবাদের। কেননা তার আগের রাতেই তার ছেলে ওহাবের সাথে কথা হয়েছে তার। আর ওহাব আগে আজমান থাকলেও এখন থাকেন ইতালীতে।কাজেই মৃত ব্যক্তি আব্দুল ওহাব হতেই পারেনা।ওসি সাহেব নিজেও পরে যান সংশয়ে। সংশয় কেটে যায় মোবাইলে আব্দুল ওহাবের সাথে কথা বলার পরে। তিনি জানান যে, তার আগের পাসপোর্টটি ইতালী আসার আগে রমজান দালাল নিজের কাছে রেখে দেয়।রমজানকে আনা হলে, প্রথমে সে অস্বীকার করলেও পরে স্বীকার করে যে সে এই পাসপপোর্টটি ত্রিশ হাজার টাকার বিনিময়ে কেয়াফত প্রামাণিকের ছেলে আছিরুদ্দিন প্রামাণিকের কাছে বিক্রি করেছে। এরপর অনেক নাটকীয়তার পরে লাশ রিসিভ করা হয় ঢাকা বিমানবন্দর থেকে। কিন্তু আছিরুদ্দিন নয়, আদুল ওহাব পরিচয়ে। লাশ দাফন করতে গিয়ে ঘটনা মোড় নেয় অন্যদিকে। দেখা যায় লাশটি খতনাবিহীন কোন অমুসলিম ভদ্রলোকের। আবারো লাশ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকায়। কিন্তু প্রবাসী কল্যাণ, পররাষ্ট্র, স্বররাস্ট্র, স্বাস্থ্য কোন মন্ত্রণালয় রাজী হলোনা লাশটি গ্রহণ করতে।এরই মাঝে খবর আসে সেদিন আজমানে দূর্ঘটনায় মোট ৬ জন নিহত হয়েছিলেন। যাদের প্রতিটি লাশেরই একই অবস্থা। এদিকে লাশ পচে শুরু হয় দূর্গন্ধ।চরম বেকায়দায় পরে সবাই যখন দিশেহারা অবস্থায়, ঠিক তখন আছিরুদ্দিনের পিতা কেফায়েতউদ্দিন প্রামাণিক বলে ওঠেন, এই লাশ তিনিই নিয়ে যাবেন গ্রামের বাড়ীতে, দাফন করবেন আছিরুদ্দিনের পরিচয়ে।হিন্দু,মুসলিম,বৌদ্ধ খ্রিস্টান যাই হউক না কেন, দাফন পাওয়ার অধিকার তো সকলেরই থাকে। ফিরতি পথে যবনিকাপাত হয় ছবিটির।

কাহিনীর দিক থেকে বিচার করলে অজ্ঞাতনামা ছবিটিতে ছায়া পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মিত সেলিম আল দীনের চিত্রনাট্যে মোরশেদুল ইসলামের “ চাকা” ছবিটির। সেই ছবিতেও দেখা গিয়েছিলো একটি অজ্ঞাতনামা লাশ নিয়ে এক গাড়োয়ান, তার সহকারী আর দুইটি ষাড়ের অন্তহীন যাত্রার কাহিনী।সেদিক দিয়ে বিচার করলে এটিকে মৌলিক চিত্রনাট্য বলা যায়না মোটেই।শুধু বদলে গিয়েছে প্রেক্ষাপট। একটি স্বাধীনতা সংগ্রামের আরেকটি প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামের। আর দুটি ক্ষেত্রেই শেষে ঠাই পেয়েছে একটি অজ্ঞাতনামা লাশকে ঘিরে জীবিত মানুষদের মানবিকতার পরিচয়।

অজ্ঞাতনামা চলচ্চিত্রের একটি ক্ষুদ্র বিষয় আমার মনে দাগ কেটেছে ভীষণভাবেই। সেটি হলো সন্তানের প্রতি মমত্ব। ছবিতে একাধিকবার দেখানো হয়েছে বিষয়টি। যেমন একটি দৃশ্যে দেখা যায় ওসি সাহেব বসেছেন আব্দুল হাকিমের বাড়ীতে ভাত খেতে। আব্দুল হাকিম সাহেব একপর্যায়ে ওসি সাহেবকে জিজ্ঞেস করেন তার ছেলেমেয়ে কয়টি? উত্তরে ওসি সাহেব বলেন তিনি নিঃসন্তান।তখন আব্দুল হাকিম সাহেব বলেন, “আপনার সন্তান হারানোর ভয় নেই”। একই রকম আকুলতা ফুটে ওঠে বিউটি যখন তার সন্তানকে কাছে নিয়ে আদর করে পরম মমতায়। আর পুরো ছবি জুড়েই আছিরুদ্দিনের পিতামাতার আহাজারি তাড়া করে ফেরে দর্শককে।

এই ছবির সর্বশেষ দৃশ্যে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয় বাঙালীর আবহমানকালের অসম্প্রদায়িক চেতনাকে। লাশটি যখন পচে দূর্গন্ধ ছড়ান শুরু করছিলো , যখন অন্যেরা বলাবলি করছিলো লাশটি ফেলে পালিয়ে যাওয়ার কথা, তখন কেফায়েত প্রামাণিক বলে উঠেন, লাশটি তিনিই দাফন করবেন আছিরুদ্দিনের পরিচয়ে।লাশটি যে একজন অমুসলিমের লাশ তা জানা ছিলো উপস্থিত সকলেরই। কিন্তু কেফায়েত প্রামাণিকের মানবধর্মের কাছে ভেঙে পড়ে সামাজিক বিধিনিষেধের তাসের ঘর। “সবার উপরে যে মানুষ সত্য” সে জয়গান আবারো গেয়ে ওঠেন নিরক্ষর প্রান্তিক মানুষ কেফায়েত প্রামাণিক।

ছবিটিতে শহীদুজ্জামান সেলিম, ফজলুর রহমান বাবু, শতাব্দী ওয়াদুদের অভিনয় ছিলো অত্যন্ত সাবলীল ও প্রাণবন্ত। সন্তান হারানোর সংবাদ পাওয়ার পরে ফজলুর রহমান বাবুর অভিব্যক্তি রীতিমতো স্তম্ভিত করে দেয় সকলকে। নিঃসন্দেহে বাবুর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ এটি। মোশাররফ করিমের অভিনয় ভালো হলেও তিনি তাঁর গতানুগতিক রূপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। ছবিতে একমাত্র অভিনয় দূর্বল মনে হয়েছে নিপুণের।বিউটি চরিত্রটি চাইলে আরো প্রাঞ্জল্ভাবেই হয়তো ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হতো।

ছবির কারিগরি দিকও যথেষ্ঠ মানসম্পন্নই মনে হয়েছে।তবে সূচনা সঙ্গীতের মতো সমাপ্তি সংগীত তেমন একটা হৃদয়গ্রাহী মনে হয়নি। আর পোশাক পরিকল্পনাও ছিলো এক কথায় চমৎকার। প্রান্তিক মানুষের দৈনন্দিন জীবনের বেশভূষণ বাস্তবভাবেই উঠে এসেছে পোশাকপরিকল্পনায়।

পরিশেষে শুধু এক কথায় বলি, অজ্ঞাতনামা একটি পরিচ্ছন্ন ছবি, প্রান্তিক জনগণের জীবন নিয়ে ছবি, বাজারচলতি ছবির ভিড়ে একটি ব্যতিক্রমী ভালো ছবি।