রোহিঙ্গারা মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জনগোষ্ঠী। বর্তমানে সেখানে ৮ লক্ষ এবং বাংলাদেশে ৫ লক্ষের মত রোহিঙ্গা বাস করছে। রোহিঙ্গারা বেশিরভাগই নিরক্ষর, অতি-দরিদ্র। অপরাধ-প্রবণতার অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। মধ্যপ্রাচ্য সহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করে তাদের অনেকেই বিভিন্ন অপরাধে জড়িত হয়ে বাংলাদেশের ভাবমুর্তির ক্ষতি করছে। এছাড়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অনর্থ সাধন, উগ্রবাদি কার্যকর্মে জড়িত হওয়া সহ বিভিন্ন ধরণের উপদ্রব সৃষ্টির কারণে সাধারণ মানুষ এদের প্রতি অত্যন্ত বিরক্ত। অনেকে ধর্মীয় কারণে এদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন তবে বাস্তবতা হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ যারা রোহিঙ্গাদের উপদ্রব সহ্য করেছেন তাদের বেশিরভাগই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার বিরুদ্ধে।

রোহিঙ্গাদের নিয়ে অনলাইন একটিভিস্টরা বেশ দ্বিধা-বিভক্ত। একদল চাচ্ছেন রোহিঙ্গাদের যাতে আশ্রয় দেয়া হয়, অন্যরা ঠিক এর বিপরীত মনোভাব পোষণ করছেন। যারা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন তাদের যুক্তিগুলো নিয়ে আলোচনা করা যাক:


এক
‘রোহিঙ্গারা দেশে ঢুকলে জঙ্গিবাদ বাড়বে’

মায়ানমারে থাকা এই ৮ লক্ষ রোহিঙ্গাদের নিয়ে আমাদের চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন আছে। এদের মধ্যে যদি উগ্রবাদের উত্থান ঘটে তবে সেটা আমাদের জন্যও ভোগান্তি নিয়ে আসবে। সাধারণ মানুষ আসতে না পারুক, রোহিঙ্গা জঙ্গিদের যে এদেশে ঢুকতে কোন সমস্যা হবেনা সেটা বলাই বাহুল্য।

নিচের ছবি দেখুন, এদেরকে কী জঙ্গি বলে মনে হয়?

জঙ্গিবাদের যে অভিযোগ রোহিঙ্গাদের উপর সেটা খুবই খেলো। এমন তো নয় যে আমাদের দেশে জঙ্গি নেই। আমাদেরকে যারা হত্যা করছে, যারা চাপাতি নিয়ে ঘুরছে এরা তো বাঙালি, তাই না? এদেশে এতটাই জঙ্গিবাদের প্রসার ঘটেছে যে তারা দেশের ৬৩ টি জেলায় একযোগে হামলা চালাতে সক্ষম। ঘোষণা দিয়ে, তালিকা করে দিনের পর দিন হত্যাযজ্ঞ চালাতে সক্ষম, সেখানে রোহিঙ্গারা দেশে ঢুকলে জঙ্গিবাদ বাড়বে এ ধরণের অভিযোগ হাস্যকর শোনায়। জঙ্গিবাদ বাড়ার বাকি আর কী কিছু আছে?

রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করুক আর না করুক তাদের মধ্যে যাতে জঙ্গিবাদ না ছড়ায় সেটা নিয়ে পরিকল্পনার প্রয়োজন। যারা দেশের মধ্যে আছে তাদেরকে বিশেষ তদারকির মধ্যে রাখাও দরকার। রোহিঙ্গাদেরকে উগ্রবাদি কার্যক্রমে যুক্ত করার ষড়যন্ত্র অনেক আগ থেকেই চলে আসছে। জামাতি ও বিভিন্ন ইসলামি এনজিও সাহায্যের নামে এগুলো করে যাচ্ছে।

শুধু রোহিঙ্গা নয়, ধর্মীয় উগ্রপন্থা থেকে রক্ষার জন্য সকলের মধ্যেই সেক্যুলারিজমের ব্যাপক চর্চা দরকার। সকল মুসলিম সমাজের জন্য এটি অপরিহার্য হয়ে দাড়িয়েছে।


দুই
‘রোহিঙ্গারা অপরাধ-প্রবণ। তারা দেশে ঢুকলে অপরাধ ও উপদ্রব বেড়ে যাবে’

এটা হয়তো ঠিক যে দেশের প্রচুর মানুষ রোহিঙ্গাদের উপর বিরক্ত। কিন্তু অসহায় মানুষদের মধ্যে অপরাধ-প্রবণতা থাকলেও তাদের আশ্রয় দিতে হয়। কারণ আমরা মানুষ, আর মানুষ হওয়া একটা যন্ত্রণাপূর্ণ ব্যাপার।

রোহিঙ্গাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটলে তাদের এই প্রবণতা কমবে। শিক্ষার হার বাড়ানো, নিরাপত্তা বৃদ্ধি এবং স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা ধীরে ধীরে তাদেরকে সে প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবে। এমনকি মায়ানমারে থাকা রোহিঙ্গাদের মধ্যেও কিভাবে শিক্ষার হার বাড়ানো এবং অশিক্ষা ও ধর্মান্ধতা থেকে মুক্তি দেয়া যায় তা নিয়ে ভাবা দরকার। রোহিঙ্গাদের জঙ্গিবাদী মাদ্রাসাগুলো বন্ধের জন্য কিছু উদ্যোগ নেয়াও দরকার।

আমাদের দেশের মানুষ এতই অপরাধ-প্রবণ যে যখন রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে এটি বলা হয় তখন বিব্রত বোধ করি।

তিন
‘রোহিঙ্গারা দেশে দারিদ্র্য বাড়াবে, সাধারণ মানুষের কাজের সুযোগ কমে যাবে’

মাত্র ৮ লক্ষ মানুষ বাংলাদেশের ১৬ কোটির তুলনায় খুব একটা বড় নয়। আর এই ৮ লক্ষের মধ্যে হয়ত কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে চায় প্রতি বছর। এদের মধ্যে যেহেতু শিক্ষার হার খুব কম তাই তারা শুধু নিম্নবিত্ত মানুষদের সাথেই প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম। যদি রোহিঙ্গাদেরকে শরণার্থী ক্যাম্পে রাখা হয়, ক্যাম্পগুলো ভিন্ন জেলায় স্থাপন করা হয়, এদেরকে বিভিন্ন জেলায় স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করা হয় তাহলে সমস্যা তুলনামূলকভাবে কম হবে।

চার
‘রোহিঙ্গারা পাকিস্তানপন্থী’

ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যার পরও যেখানে আমাদের দেশের প্রচুর মানুষ পাকপন্থী সেখানে নিরক্ষর এবং পাকিস্তানিদের হাতে নির্যাতিত না হওয়া মুসলমানদের পাকিস্তানের প্রতি আগ্রহকে খুব একটা গুরুত্ব না দেয়াই ভাল। বরং এদেরকে শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধির সুযোগ দেয়া হোক।

এখন আসি ভিন্ন আলোচনায়। রোহিঙ্গাদের নিয়ে আমাদের কী করা উচিত?

১। বাংলাদেশ সরকারের উচিত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের ব্যাপারটি তুলে ধরা। মায়ানমারের উপর চাপ বৃদ্ধির সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।

২। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদেরকে অন্যান্য দেশে আবাসনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ।

৩। রোহিঙ্গাদেরকে কিছুটা হলেও শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করা, স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করা – এদের অবস্থা বড্ড শোচনীয়।

৪। সেক্যুলারাইজেশন, উগ্রপন্থা থেকে রক্ষা। মাদ্রাসার কবল থেকে বাচানো।

৫। অবস্থা স্থিতিশীল হলে রোহিঙ্গাদেরকে কিভাবে নিরাপদে মায়ানমার প্রত্যাবর্তন করানো যায় তা নিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণ। রোহিঙ্গাদের অনেকেই ফিরতে চায় না, কিন্তু পর্যাপ্ত নিরাপত্তা থাকলে নিজ দেশে ফিরে না যাওয়ার কোন কারণ থাকতে পারেনা। তাই এজন্য মায়ানমারের প্রতি চাপ দেয়ার কোনো বিকল্প নাই। কিন্তু বাংলাদেশ বরাবরের মত এক্ষেত্র চরম কূটনৈতিক ব্যর্থতা দেখাচ্ছে।

ব্লগার হত্যায় অংশ নেয়া হেফাজতিসহ কিছু মানুষের খুব আবেগ দেখা যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের প্রতি কারণ এরা মুসলমান। অথচ এদেশে সংখ্যালঘুদের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালানো হচ্ছে দিনের পর দিন, এগুলো নিয়ে তাদের কোনো বিকার নেই। রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের কোনো অনুভূতি থাকত না যদি এরা অমুসলিম হত তখন বরং এরা নিজেরাই চাপাতি নিয়ে সীমান্ত পাহারা দিত। দেশের মধ্যে যখন মানুষ বিপদগ্রস্থ তখন তারা ফিলিস্তিনে কেউ নিহত হলে সেটা নিয়েই শুধু প্রতিক্রিয়া দেখাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আবার মুসলমানদের হাতে হাজারো মুসলমান যখন নিহত হয় তখন তাদের কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখা যায় না, পাকিস্তান কর্তৃক একাত্তরে এদেশে চালানো গণহত্যাকেও তারা অবজ্ঞা করতে চান। তাই বলি, ধমানুভূতি জিনিসটাই ভয়ংকর, সেটা মানবতাবোধকে খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলে।

আমরা দেখবো মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে। রোহিঙ্গা সমস্যাকে উটকো সমস্যা বলে মনে করার কোন কারণ নেই। আশেপাশের কোন দেশে বিপর্যয় ঘটলে তা যে আমাদেরকে স্পর্শ করবে সেটা স্বাভাবিক এবং এই একই ধরণের সমস্যায় রয়েছে অনেক দেশই। বাংলাদেশ থেকে প্রচুর মানুষ ভারতে চলে যায় প্রতি বছর, শুধু হিন্দু নয় মুসলমানরাও। পাকিস্তানে এখনো বিশাল সংখ্যক বাঙালি বসবাস করে, স্বাধীনতার পরেও কিন্তু অনেকেই চলে গেছে রোজি-রোজগারের সন্ধানে। বাংলাদেশ থেকে প্রচুর মানুষ রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছে উন্নত দেশগুলোতে।

আগে মানুষ, তারপর দেশ। মানুষকে বাচতে দিতে হবে। যখন কিছু মানুষ হাড় জিরজিরে মহিলা-শিশুদের নিয়ে জীবন বাচানোর জন্য একটা ভাঙ্গা নৌকায় পানিতে ভাসতে ভাসতে আমাদের দেশে পাড়ি জমায় তখন এদেরকে ফিরিয়ে দেয়ার কোনো মানবিক যুক্তি আমার জানা নেই।

রোহিঙ্গাদের জীবনাচরণ, সংস্কৃতি সব কিছু বড্ড বেশি মিলে যায় এদেশের মানুষের সাথে। একজন রোহিঙ্গার ছবি দেখলাম মাটে কাজ করছে, না বলে দিলে বোঝা কঠিন যে সে বাঙ্গালদেশি নয়। রোহিঙ্গাদের ভাষা মোটামুটি বুঝি, চট্টগ্রাম অঞ্চলের সাথে পুরাই মিলে যায়। যখন একটা বোধগম্য ভাষায় কেউ এসে বাচার আকুতি জানায় তখন এদেরকে ফিরিয়ে দেয়ার দৃশ্যটা কেমন হতে পারে ভেবে দেখুন!

এই রোহিঙ্গা শিশুটাকে দেখে মনটা ভার হয়ে আছে। মায়ের কোল মনে করে মাটিকে জড়িয়ে ধরেছে শিশুটি, এই মাটির উপর মানুষ হিসাবে সবার সম-অধিকার আছে।

পৃথিবীর সর্বত্রই মানুষগুলো বেচে থাকুক। মানুষ বেচে থাকলে তারা ভবিষ্যতে একটা মানবিক পৃথিবী তৈরি করবেই।