লিখেছেনঃ নিকসন কান্তি

কাউকে কোন ব্যাপারে কনভিন্স করতে পারা একটি বিশেষ স্কিল। স্থান কাল ভেদে বিষয়টি এতই সফিসটিকেটেড যে এটিকে
বেশ কয়েকটি পাঠ্য বিষয়ে স্থান দিতে হয়েছে; যেমন, মার্কেটিং, কমিউনিকেশন, সাইকোলজি। এই স্কিলটি ডেভেলপ করার
জন্য নানান ফর্মাল ইনফর্মাল কোর্সও চালু আছে। কনভিন্সিং পাওয়ার যাদের থাকে তারা প্রায় সবক্ষেত্রেই সফল হন। তবুও
এরা নন; আজ আমি চিনতে চাচ্ছি যারা কনভিন্সড হন তাদেরকে। কাদেরকে কনভিন্স করা যায়? মোটামুটি সহজে? তাদের
মাঝে কি কোন কমন বৈশিষ্ট্য থাকে? নাকি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নয়, বিশেষ কোন সময়ে এপ্রোচ করাটাই ফ্যাক্টর?

না, এটা কোন নাক উঁচু একাডেমিক আলোচনা নয়। সমকালীন ঘটনার সাথেই সম্পর্কিত। ধর্মের কথা বলে খুনোখুনি করতে
কাদেরকে কনভিন্স করা যাচ্ছে সেটাই আমি বুঝতে চাচ্ছি।

কমন ফ্যাক্টর

বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এ জাতীয় ঘটনায় ধরা পড়া/আইডেন্টিফায়েড হওয়া খুনির সংখ্যা খুব কম। তাই এদেরকে কোন
সাধারণ বৈশিষ্ট্যের আন্ডারে ফেলা কঠিন। এরা সবাই কি মাদ্রাসার ছাত্র? সাম্প্রতিকতম ঘটনায় দেখা গেল শেষ পর্যন্ত সেটাও
ঠিক নয়। সবাই কি নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা ভবিষ্যতহীন হতাশাগ্রস্থ মানুষ? না। তাও নয়। ব্রোকেন ফ্যামিলির?
সেটাও বলা যায় না। অশিক্ষিত? সেটাও সবক্ষেত্রে না। তাহলে? একমাত্র যে জিনিসটা কমন পাওয়া যাচ্ছে তা হল এরা সবাই
অল্প বয়সী ছেলে।

এরা কনভিন্সড হয় কেন?

কারণ এটাই স্বাভাবিক। ন্যায় হোক অন্যায় হোক, যে কোন যুদ্ধেই প্রথম সারির সৈন্য হয় তরুনরাই। যুগে যুগে এরাই কামানের
খাদ্য। তবুও একটা যুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপটে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর তরুনদেরকে খেপিয়ে তোলা এক জিনিস আর কোনরকম
দৃশ্যমান কারণ ছাড়া সম্পুর্ণ অচেনা কাউকে খুন করতে রাজী করানো সম্পুর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। এটা কিভাবে করা যাচ্ছে?

ধর্মবিশ্বাস কম বেশী অধিকাংশ মানুষের মধ্যেই থাকে। কিন্তু সেই বিশ্বাস কি ধর্মগ্রন্থ পড়ে তৈরী হয়? প্রায় কোন ক্ষেত্রেই না।
বিশ্বাস তৈরী হয় পরিবার থেকে, পারিপার্শ্বিকতা থেকে এবং মোস্ট ইম্পরটেন্টলী খুব ছোটবেলা থেকে ধর্মীয় আচরণ চর্চা
করতে করতে। তাই ধর্মগ্রন্থে খুন করার কথা আদৌ বলা আছে কি না তা অধিকাংশ তরুনেরই জানা থাকে না। তাদের জীবনের
সাথে জড়িয়ে মিশিয়ে থাকে পাঠ্য বইতে পড়া বা মুরুব্বিদের কাছে শোনা ধর্মীয় গল্প, পারিবারিক নৈতিক শিক্ষা, শিক্ষকদের
আদেশ নিষেধ, খানিকটা খেলার দিকে ঝোঁক, কিছু সিনেমাপ্রীতি, পরীক্ষায় হালকা-পাতলা নকল করা, বাবার দুর্নীতি দেখেও
না দেখা আরও কত কি। যার সারমর্ম- অগভীরতা। তাই মাঝে মাঝেই দেখা যায় হঠাৎ করেই অতি অল্প সময়ে কেউ কেউ
হুজুর হয়ে ওঠে; সেটা তাবলীগের মাধ্যমেই হোক, শিবিরই হোক অথবা হিজবুত তাহরীর। মূলতঃ অগভীর চিন্তা চেতনা,
প্রশ্নহীন মস্তিষ্ক এবং ক্রিটিকাল থিংকিং এর অনভ্যাস এদেরকে বিপথে নেবার সফট টার্গেট হিসাবে তৈরী রাখে। সেই বিপথ
কারো বেলায় হয় আইসিস, কারো বেলায় ইয়াবা।

কেন এই অগভীরতা?

বোধহয় ধর্মই বলে, “অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা”। আমাদের তরুনরা হাত পায়ের পরিশ্রম যথেষ্ঠই করে কিন্তু মস্তিষ্কচর্চা
কি তেমন একটা করে? নিয়মিতভাবে এমন কিছু কি করে যাতে মাথাটা খুব খাটে? ছাত্ররা? কিংবা হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে
যারা? তারাতো পড়াশুনা মধ্যেই থাকে। মাথা খাটায়। … না, আরেকটু তলিয়ে দেখতে হবে। আমাদের দেশের পড়াশুনার
জগতের এইচ এস সি লেভেল পর্যন্ত সময়টা মোটামুটি অর্থহীন হয়ে গেছে। প্রশ্ন ফাঁসের কথা ছেড়েই দিলাম; শিক্ষকদেরই
যেখানে বেশী বেশী নম্বর দেয়ার জন্য চাপ দেয়া হয় সেখানে পড়াশুনাতে ছাত্রদের খুব যে মাথা খাটাতে হয় না সে তো বোঝাই
যায়।

কিন্তু এর পরের লেভেলগুলো? বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের লেখাপড়া? ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথ, কম্পিউটার সায়েন্স এসব নিখাদ
টেকনিকাল বিষয়গুলো বাদ দিলে (প্রত্যক্ষভাবে জানিনা বলে বাদ দিলাম) বাকি যা থাকে সেগুলোর অনেকগুলোতেই পরীক্ষার
সময় স্রেফ হাতের লেখার প্রতিযোগীতা চলে। প্রশ্ন হাতে পেয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় নেই, দরকারও হয় না; হড়বড় করে
লিখে যেতে হয় শুধু। শিক্ষকরা বেশীরভাগ সময় আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং যাচাই করেন না, নলেজ যাচাই করেন। আমরা
কতটুকু বুঝেছি তা যাচাই করেন না, কতটুকু জেনেছি সেটা দেখতে চান। ফলে আবারো সেই একই চক্কর- মস্তিষ্কের প্রসেসিং
পাওয়ারটার তেমন ব্যবহার হয় না; শুধু মেমোরীটা ভরে যেতে থাকে, অনেক সময়ই, আবর্জনায়।

আর এর পরের লেভেলে- চাকরির প্রস্তুতির পড়াশুনায়? দলে দলে বিসিএস দিই আমরা। আমি সেই সুদূর অতীতে বিসিএস
এর একটা গাইড উল্টেপাল্টে দেখে সেই যে ঘাবড়ে গেলাম, জীবনে আর এই পরীক্ষায় বসার সাহস করিনি। উদ্ভট সব প্রশ্ন।
বিসিএস এর প্রিলিমিনারী ছাড়া বাকী জীবনে আর কোনদিন কোন কাজে লাগবে না এমন হাজার হাজার নাখাস্তা তথ্য মুখস্ত
করতে হবে। সুন্দরবনে কয় প্রকার হরিণ আছে? উগান্ডার মৎস্য মন্ত্রীর নাম কী? … তো এখানেও সেই একই অবস্থা। নো
থিংকিং, নো এনালাইজিং, নো ক্রিয়েটিং। এদিকে বয়স ততদিনে পঁচিশ-ছাব্বিশ পেরিয়ে গেছে। সম্পুর্ন পরিনত একজন মানুষ;
যার মধ্যে মাথা খাটানোর অভ্যাসটিই গড়ে ওঠেনি।

আর এর পরের ধাপে কর্পোরেট দুনিয়ায় প্রতিটা কাজ এত শতখন্ডে বিভক্ত থাকে, এমন ওয়েল স্ট্রাকচার্ড থাকে যে মোটামুটি
একটা উঁচু পর্যায়ে না ওঠা পর্যন্ত হাত-পায়ের পরিশ্রমই কেবল হয়। মাথা তেমন খাটাতে হয় না। এক উইন্ডোতে এক্সেল, অন্য
উইন্ডোতে ফেসবুক খুলে আমরা দিব্যি কাজ করে যেতে পারি।

আর এই অলস মস্তিষ্কটিই বারবার আক্রান্ত হয় কিছু কিছু সোশাল ভাইরাস দিয়ে। কখনো সেটা অন্ধ রাজনৈতিক আনুগত্য,
কখনো ড্রাগ, কখনো বিকৃত চিন্তা, কখনো- ইদানিং ভয়াবহ মাত্রায়- উগ্র ধর্মান্ধতা।

করনীয়

কি করনীয়? আসলে জানিনা। বিষয়টা এত জটিল পর্যায়ে চলে গেছে যে প্রফেশনাল লোকজন ছাড়া অন্যকারো এখন কিছু
করার নেই। তাৎক্ষনিক ব্যবস্থাগুলো তাদেরকেই নিতে হবে। টিভি স্ক্রলে দেখতে পাচ্ছি জঙ্গী সমর্থক কোন কিছুতে লাইক
দিলেও নাকি পুলিশে ধরবে। ভালো। এমন জিরো টলারেন্স নীতি যদি সত্যিই বাস্তবায়ন করা শুরু হয় তাহলে সেটা একটা
আশার কথা। সন্দেহজনক যে কোন তৎপরতার খবর জানানোর জন্য ইমেল এড্রেস দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে
সিরিয়ালী অংশ নিতে হবে। আর দীর্ঘমেয়াদী কাজগুলোর প্রায় সবটাই তো সাধারণ মানুষের। শিক্ষা ব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টে
ফেলার কথা নতুন করে আর বললাম না। এসব নিয়ে বিস্তর কথা হয়েছে। প্রতিটি সরকার বুঝিয়ে দিয়েছে তারা কিছু করবে না।
তাই সন্তানকে সুশিক্ষা দেয়া, তাকে মস্তিষ্কের ব্যবহার শেখানো, তার ব্যক্তিত্বের চারদিকে একটি সুদৃঢ় শুভবুদ্ধির দেয়াল গড়ে
তোলা আমাদেরই দায়। কেবল এইটুকু বলে শেষ করি- ‘আমার ছেলে মাশাল্লাহ ওসবে জড়াবে না’- এমন চিন্তা করবেন না।
রোহানদের বাবা-মায়েরাও মাশাল্লাহ এমনটাই ভেবেছিলেন।