সময় জানা নেই, আনুমানিক মধ্যরাত। স্থান অজ্ঞাত। অন্ধকার ঘর। জানালার এক চিলতে ফুটো দিয়ে জ্যোছনার কিছু আলো ঢুকেছে ঘরটিতে। সেই ঘরের মাঝখানে চেয়ারে হাত পা বাঁধা অবস্থায় এক অজ্ঞাত পরিচয় যুবককে আমরা দেখতে পাই। ঠোঁট ফেটে রক্ত ঝরছে। সেই রক্তের একটি বিচ্ছিন্ন স্রোত ধারা চেয়ার বেয়ে নিচে নেমে মেঝেতে জমাট বেঁধেছে। কোথা থেকে যেন হাজির হয়েছে একদল পিঁপড়া। পিঁপড়ার দল সেই রক্তের জমাটকে ঘিরে জটলা পাকিয়েছে। চোখ দুটোকে যতটা সম্ভব খোলা রেখে জ্যোছনার সেই আলোয় পিঁপড়াদের জীবন দেখার চেষ্টা করছে ছেলেটি। কতটা সময় পার হয়েছে জানে না সে। ক্লান্ত চোখ দুটো বুজে আসছে তার। ঘুম পাচ্ছে, অনেক প্রগাঢ একটা ঘুম। চোখ দুটো যখন প্রায় ঠিক বুজে এসেছে ঠিক সেই মুহূর্তেই খুলে যায় ঘরের সদর দরজা। এক সঙ্গে জ্বলে উঠে ৫০০ ওয়াটের দুটো বাল্ব। অন্ধকার প্রকোষ্ঠে দীর্ঘক্ষণ থেকে হঠাৎ এক তীব্র আলোকছটায় চোখ দুটো আরো খানিকটা কুকড়ে যায় ছেলেটার। পাতা দুটো মেলতেই চোখের সামনে দুটো অশরীরি মূর্তি দেখতে পায় সে। চলে তাদের কথোপকথন।
-কি ব্যাপার সাজ্জাদ, হারামজাদার মুখ দিয়ে কিছু বের হল ?
-না স্যার, হারামজাদাকে যতটা দুর্বল ভেবেছিলাম ততটা দুর্বল নয়। তেজ আছে ভালই।
-ডলা মনে হয় কম হয়ে গেছে?
-একচুয়ালি স্যার, ব্যাটার হাঁপানি আছে। ডলা দেওয়ার সময় একটু কেয়ারফুলি দিতে হচ্ছে।
-তা দিন কিন্তু মনে রাখবেন যে করেই হোক কালকে আমি এই ব্যাটাকে ম্যাজিষ্টেটের কাছে স্টেটমেন্ট দিতে দেখতে চাই।
-জ্বি স্যার, অবশ্যই।
-জানেন তো এই শেফালী মার্ডার কেস নিয়ে একেবারে চিড়ে চ্যাপ্টা হবার দশা। এক দিকে উপর মহলের চাপ আবার আরেক দিকে মিডিয়ার চাপ। টিএসসিতে প্রতিদিন মানব বন্ধন হচ্ছে।
-একচুয়ালি স্যার, শালাদের তো খেয়ে দেয়ে কোন কাজ নেই। যতসব ফালতু মানব বন্ধন। মানব বন্ধন বাদ দিয়ে একটু আসামী ধরে দেখা, দেখি কত বড় বাপের ব্যাটা তোরা।
-আজকেও একটা চ্যানেল থেকে কথা বলতে ডেকেছিল।
-গেলেন না কেন স্যার? ভাবী আর ছেলে মেয়েরা টিভিতে আপনাকে দেখে খুশি হত।
-আমার বাসায় কেউ খবর দেখে না তাছাড়া এখনকার সাংবাদিকেরা সব ঝানু মাল। কখন কোন কথার মারপ্যাচে ফেলে ঠিক নেই।
-তা অবশ্য ঠিকই বলেছেন স্যার, মিডিয়া হ্যান্ডলিং এর ব্যাপারে আমাদের পুলিশের আরো কিছু ট্রেনিং দরকার।
-হুম, যাই হোক হারামজাদাকে আজ রাতের মধ্যেই স্বীকার করানোর ব্যবস্থা করেন। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু ওয়াস্ট টাইম এনিমোর।
-জ্বি স্যার, অবশ্যই।

সাব ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ হোসেনের মনযোগ এবার একশো আশি ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরে যায়, আবর্তিত হয় চেয়ারে হাত পা বাঁধা সেই যুবকটিকে কেন্দ্র করে। এক হাতে ছেলেটির বিধ্বস্ত মাথাটি আলোর সামনে তুলে ধরে তিনি বলেন -বল হারামজাদা শেফালীরে কেন খুন করছস?
ক্লান্ত-রক্তাক্ত ছেলেটি ম্রিয়মান কন্ঠে জবাব দেয় – না স্যার, আমি করি নাই।
-তুইই করছস, প্রথমে রেপ করছস তারপর খুন করছস।
-না স্যার, আমি করি নাই।
-শেফালী তোর প্রেমের প্রস্তাবে রাজী হয় নাই তাই খুন করছস।
-না স্যার।
-ওর ছোট বোনের সাথে ফষ্টি নষ্টি করতে চাইছিলি, না পাইরা বড় বোনরে খুন করছস।
-না স্যার, আমি করি নাই।
-গার্মেন্টসের চাকরীতে শেফালীর প্রমোশনে হিংসার বশে খুন করছস।
-না স্যার।
-ইজ্জত লুটতে ব্যর্থ হইয়া ধস্তাধস্তি কইরা খুন করছস।
-না স্যার।
-তোর মোবাইলে থাকা গোপন ভিডিও দেইখা ফেলানোয় মান বাঁচাইতে খুন করছস।
-না স্যার আমি করি নাই।
-তুই করছ নাই?
-না স্যার।
-কেন করিস নাই হা্রামজাদা? তোরে করতে কি কেউ মানা করছিল? করিস নাই কেন?

কর্কশ আর্তনাদ আর কান্নার ঘোলাটে শব্দ ছাড়া সেই ঘর থেকে আর কিছু বের হয়ে আসেনা। জমাটবদ্ধ সেই ঘরে থেকে দম যেন খানিকটা বন্ধ হয়ে আসে ডিবির তদন্তকারী কর্মকর্তা ইন্সপেক্টর নাজমুল হোসেনের। ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় আসেন তিনি। এক দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ নিস্তব্ধ আকাশের রুপালী চাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। কি সুন্দর চাঁদ উঠেছে। ছাত্রাবস্থায় তার জ্যোছনা দেখার বাতিক ছিল। পূর্ণিমার রাতে বন্ধু কামালের সঙ্গে বাড়ির পাশে সেই ছোট নদীর তীরটিতে ছুটে যেতেন তিনি। প্রায় শেষরাত পর্যন্ত জ্যোছনা দেখে বাড়ি ফিরতেন। মধ্যরাতে যখন জ্যোছনার পরিবেশ বদলে যেত তখন অন্য এক অনুভূতির জন্ম হত হৃদয়ে। আহারে সেই সব দিন! কাব্য আর জ্যোছনা প্রেমী সেই মানুষটাকে আজ চোর,ডাকাত, খুনী, ধর্ষক নিয়ে কাজ করতে হয় এটাই বাস্তবতা, এটাই জীবন। প্যারালাইসিসে আক্রান্ত কামালটা যে এখন কেমন আছে কে জানে, বহুদিন খোঁজখবর নেওয়া হয় না। কিশোরী শেফালীকে খুনটা কে করেছে তা খুব ভাল করেই জানেন নাজমুল সাহেব। কিন্ত কি আর করা উপর মহলের চাপ, যে করেই হোক মামলাটা ডিসমিস করতে হবে। মিডিয়াকেও একটা ষ্টোরি দিতে হবে। সাব ইন্সপেক্টর সাজ্জাদের উপর তার বিশ্বাস আছে, সে ঠিকই একটা না একটা স্বীকারোক্তি আদায় করে ফেলবে। পকেট থেকে বেন্সন এন্ড হেজেসের প্যাকেটটা বের করে সিগারেটে আগুন ধরান তিনি। দুটো নির্লিপ্ত টান দিয়ে সিগারেটের টুকরাটি বাইরে ছুঁড়ে মারেন। সিগারেটের গন্ধটা আজ তার কাছে বড়ই বিস্বাদ ঠেকে।

২)
-এই শুনছো এই…
স্ত্রী রিজওয়ানার ডাক শুনে ঘুম ভাঙ্গে নাজমুল সাহেবের। ভোররাতে ডিউটি শেষে বাসায় ফিরে একটু ঘুমানোর চেষ্টা করেছিলেন তিনি। ঘুম জড়ানো কন্ঠেই তিনি বলেন- কেন কি হয়েছে?
-একটু নুতুন আইটেম রেধেছি, চেখে দেখবে কেমন হয়েছে?
-তুমিই তো দেখতে পারো। আমাকে ডাকছো কেন?
-তা পারি, তবে শুনেছি পুলিশের নাকি ঘ্রাণ শক্তি ভাল হয়। ভাবলাম ঘরে যখন পুলিশ আছে তাকে দিয়েই টেষ্ট করাই।
নাজমুল সাহেব লক্ষ্য করেন স্ত্রীর ঠোঁটের কোণায় বিদ্রুপের হাসি। সেই হাসিটিকে পাত্তা না দিয়েই তিনি বলেন- তা কি রান্না করলে?
-পটল ইলিশ।
-পটল ইলিশ! এটা আবার কি ?
-পটলের চামড়া তুলে কিছু গরম পানিতে ভাব দেওয়া হয়, তার পর সরিষার তেলে ভেজে আগে থেকে ভেজে রাখা ইলিশের সাথে কিছুক্ষণ চুলায় রাখতে হয়।
-কোথা থেকে শিখলে এই জিনিস?
-টিভিতে, গতকাল রান্নার এক অনুষ্ঠানে এক অভিনেত্রী রেধেছিল।
– ও আচ্ছা।
-আচ্ছা বললে হবে না, খেয়ে দেখ কেমন হয়েছে?
-একবারে ভাতের সাথে খেয়ে দেখি।
-তাহলে উঠ তাড়াতাড়ি, আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি।
টেবিলে ভাত খেতে খেতে সাংসারিক কথা বার্তা বলা নাজমুল সাহেবের দীর্ঘদিনের অভ্যাস। তিনি সারাদিন চোর ডাকাতের পিছনে ব্যস্ত থাকেন। স্ত্রী রিজওয়ানা একাই এক হাতে সংসারের সব কিছু দেখা শোনা করেন। ডাইনিং টেবিলেই যা একটু সাংসারিক আলাপের সুযোগ মেলে।
সাদিয়া কি এখনো ভার্সিটি থেকে ফেরেনি?- স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন তিনি।
-না। ও তো ওর বন্ধুদের সঙ্গে কক্সবাজার গেছে। তুমি জান না?
-ও আচ্ছা। কবে ফিরবে জানো?
-বলে গেছে দুই তিন দিন।
-ও।
গতকাল রাতে সাদিয়ার দেওয়া ফেসবুক ষ্ট্যাটাসের কথা মনে পড়ে নাজমুল সাহেবের। মেয়ে সাদিয়ার সঙ্গে ফেসবুকে যুক্ত আছেন তিনি। মেয়ের লেখা ফেসবুক ষ্ট্যাটাস তিনি নিয়মিতই পড়েন। মেয়ের পাউচ সেলফিতে লাইক দেন, কমেন্ট করেন। “পূর্ব-পশ্চিম” ইউনিভার্সিটিতে পড়া তার এই বড় মেয়ের সঙ্গেে মোটামুটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই তার বলা চলে। বাংলার বাপেরা মেয়ের প্রেমিককে পছন্দ করে না কিন্ত নাজমুল সাহেব আর দশটা সাধারন বাংলার বাপের মত নন। তিনি সাদিয়ার প্রেমিক ইয়ো ইয়ো জুনায়েদে মুগ্ধ না হলেও একে বারে অপছন্দও করেন না। ছেলেটা কোন এক ব্যান্ডে্র নাকি লিড গীটারিষ্ট, বাপের নাকি জুতার ফ্যাক্টরিও আছে। বাংলার মেয়েরা গিটার ওয়ালা, বাইক ওয়ালা আর ক্রিকেট ওয়ালাদের প্রেমে পড়তে পছন্দ করে। তার মেয়েও পড়েছে। কি আর করা? যুগ পাল্টায়, পাল্টায় রুচি। এটাই এ যুগের স্মার্টনেস। পুরনো ধ্যান ধারণা আঁকড়ে রেখে তো কোন লাভ নেই। শুধু বড় মেয়ে সাদিয়াই নয় ক্লাস সেভেনে পড়া ছোট মেয়ে নাদিয়ারও পড়াশোনার খোজ খবর রাখেন তিনি। অবসর সময়ে মাঝে মধ্যে মেয়ের সঙ্গে কম্পিউটার গেমস খেলেন। সব মিলিয়ে বলা যায় একজন স্বার্থক আধুনিক বাপ ও হাজবেন্ড হিসেবে নাজমুল সাহেব নিঃসন্দেহে গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়ার সক্ষমতা রাখেন।

দুপুরে খাবার পর ড্রইং রুমে বসে খানিকক্ষণ টিভি দেখা নাজমূল সাহেবের অভ্যাস। আজ টিভি দেখতে দেখতে খানিকটা ঝিমুনির মত এসে গিয়েছিল তার। হঠাৎ আরো একবার স্ত্রীর ডাক শুনে ঝিমুনি ভাব কাটে নাজমুল সাহেবের।
-এই শুনছো ?
-হ্যা শুনছি বল?
-নাদিয়া না এখনো বাসায় ফিরেনি।
-কি বলছো তুমি? ওর মোবাইলে ফোন দিয়েছ?
-হ্যা, ট্রাই করেছিলাম ফোন বন্ধ।
-কি বলছ এই সব ?
-হ্যা। আড়াইটায় ওর স্কুল ছুটি হবার কথা। প্রতিদিন তিনটা, সাড়ে তিনটায় মধ্যে বাসায় আসে। এখন প্রায় সাড়ে চারটা বাজে।
-ওর প্রিন্সিপালকে ফোন দিয়েছ?
-প্রিন্সিপালের নাম্বার ছিল ফোনে। এখন খুঁজে পাচ্ছি না।
-কি যে কর না তুমি? অন্য কোন স্যার ম্যাডামের নাম্বার আছে?
-না। তুমি যে এরকম ষ্টুপিডের মত কাজ করতে পারো আমি ভাবতেই পারিনি। আমার শার্টটা দাও।
স্ত্রীর এগিয়ে দেওয়া শার্টটা কোন রকম গায়ে লাগিয়ে হন্ত দন্ত করে ছুটে বাসা থেকে বের হন নাজমুল সাহেব। দ্রুত একটা সিএনজি নিয়ে ব্লু বার্ড স্কুলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন তিনি। টেনশনে ঘামছেন। পুলিশের চাকরী করেন তিনি, শত্রুর তো তার অভাব নেই। কেউ কি তার উপর প্রতিশোধ নিতে তার মেয়ের কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করছে? শরীরের রক্ত হিম হয়ে আসে নাজমুল সাহেবের, আর বেশি কিছু ভাবতে পারেন না তিনি। স্কুলে পৌঁছতেই গেটের সামনে একদল ছেলে মেয়েকে দেখতে পান তিনি। জটলা পাকিয়ে গল্প করছে তারা। তার খুঁজে পাবার আগেই তাকে দেখে চিৎকার করে উঠে নাদিয়া- হাই আব্বু…
পিছনে ফিরে তাকিয়ে মেয়েকে দেখতে পান তিনি। নিস্তব্ধ শরীরে যেন খানিকটা প্রাণ ফিরে আসে নাজমুল সাহেবের। কোন মতে হাত নেড়ে মেয়েকে জবাব দেন তিনি।
বিস্মিত নাদিয়া চিৎকার করে বলে উঠে-আব্বু তুমি স্কুলে! আই কান্ট বিলিইভ!!
-হ্যা। তোমার স্কুল না আড়াইটায় ছুটি হবার কথা, কি করছো তুমি এখনও স্কুলে?
-কেন তুমি জান না নেক্সট উইকে আমাদের কালচারাল প্রোগ্রাম আছে? সেটারই রিহার্সাল ছিল।
-কই আমি জানি নাতো।
-কেন আম্মু তো সব জানে। তোমাকে বলেনি?
-নাতো।
-আম্মুর যা ভুলো মন!
-কিন্ত তোমার মোবাইল বন্ধ কেন?
-চার্জ শেষ হয়েগিয়েছিল।
-অন্য কারো ফোন থেকে কি বাসায় ফোন করতে পারতে না?
-সরি আব্বু। রিহার্সালে এত ব্যস্ত ছিলাম যে ফোন করার টাইমই পাইনি।
-আমি তো তোমাকে বুদ্ধিমান ভাবতাম। তুমি কবে থেকে এমন ষ্টুপিড হলে বল তো? তুমি জানো তোমার জন্য আমরা কি রকম টেন্সড ছিলাম?
-আই এম এক্সট্রিমলি সরি আব্বু। প্লিজ ফরগিভ মি।
মেয়ের হাতজোড় করা মিনতি দেখে আর রাগ পুষে রাখতে পারেন না নাজমুল সাহেব। শুকনো একটা হাসি দিয়ে বলেন -ইউর এপলজি একসেপ্টেড। চল বাসায় চল।
-আব্বু একটা রিকোয়েষ্ট আছে।
-কি বল?
-আজকে স্কুলের গাড়িতে বাসায় যাব না। চল না আজ রিকশায় করে বাসায় যাই।
-রিকশায় যাবে?
-হ্যা।
-ঠিক আছে।

একটা রিক্সা নিয়ে নাদিয়াকে নিয়ে বাসায় ফিরতে থাকেন নাজমুল সাহেব। রিকশায় উঠতেই তাকে জড়িয়ে ধরে নাদিয়া। বলে-আব্বু তুমি জান আজ কতদিন পর আমরা এক সঙ্গে রিকশায় যাচ্ছি?
-নাতো। কত দিন পর?
-এক বছর দুই মাস … দাঁড়াও দাঁড়াও এক বছর দুই মাস তেইশ দিন পর।
-তুমি কি এই সব হিসাব রাখো নাকি?
-হ্যা। তোমার সাথে তো খুব একটা ঘোরা হয় না, যেই দিন হয় সেই দিনটা মনে রাখি।
-সরি আম্মু, কাজে এত ব্যস্ত থাকি।
-আমি জানি আব্বু, আব্বু আইসক্রিম খাবে?
নাজমুল সাহেব হাসতে হাসতে বলেন- কে খাওয়াবে তুমি?
-আমার কাছে যে টাকা আছে তাতে দুই জনের হয়ে যাবে। খাবে?

রাস্তার মোড়ে এক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খেতে থাকেন নাজমুল সাহেব। এখন জানুয়ারী। প্রকৃতি থেকে শীত এখনো বিদায় নেয় নি তবুও আইসক্রিম খেতে খুব একটা খারাপ লাগছে না তার। আইসক্রিমের রস তার গাল বেয়ে নিচে নামছে সেটা দেখে হাসছে নাদিয়া। নাজমুল সাহেব মেয়ের হাসি হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। কিশোরী মেয়েটির হাসি দেখতে তার ভাল লাগছে। হঠাৎ নাদিয়ার মাথার উপর অন্য একটি পরিচিত মুখায়বের ছায়া দেখতে পান তিনি। একটি বিক্ষত রক্তাক্ত কিশোরী মুখায়ব। কিছু প্রশ্ন তার ঐ মায়াবী চোখ জোড়ায় যে প্রশ্নগুলোর উত্তর নাজমুল সাহেব জানেন না। সেকেন্ডের কাঁটা অতিক্রম করে, গাঢ থেকে গাঢতর হয় সেই রক্তিম বৈকালিক ছায়া। জানুয়ারীর শীতেও প্রবল ভাবে ঘামতে থাকেন নাজমুল সাহেব। ঘন কালো সেই রক্তিম ছায়ার তীব্র অন্ধকারে চোখ দুটো বুজে আসে তার। নাদিয়া জিজ্ঞেস করে- কি হয়েছে আব্বু? কোন সমস্যা?
দৃষ্টিটাকে অন্য দিকে ফিরিয়ে নাজমুল সাহেব উত্তর দেন- না, কিছু না।