বইটা হাতে এলো আজ।

অনুভূতিটা কেমন যেন অদ্ভুত, যেন তুলে নিয়েছি হাতে সদ্যপ্রয়াত কোনো বন্ধুর লেখা চিঠি, যা সে আমার কাছে পাঠিয়েছিল আগেই, কিন্তু ডাকবিভাগের দায়িত্বশীলতায় এসে পৌঁছেছে তার মর্মান্তিক মৃত্যুর পরে। মৃত্যুপরবর্তী প্রকাশনা নেহাৎ কম নেই, বহুপ্রজ লেখকদের আরো বেশিই। এই তালিকায় অবশ্য জীবনানন্দ সর্বাগ্রে থাকবেন। জীবদ্দশায় ক্ষীণকায় কয়েকটি কবিতার বইয়ের জনক হলেও মৃত্যুর পর তাঁর লুকনো তোরঙ্গপেঁটরা থেকে দলে দলে বেরুতে থাকে বিষণ্ন নোটবুকের পাতায় পাতায় মুক্তাগুপ্ত গল্প, উপন্যাস, কবিতাও। সুকুমার দুর্ভাগা, তাঁর প্রকাশিত একটি বইও হাতে নিয়ে দেখার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি।

এহ বাহ্য!

এই বইটা লেখকের প্রথম ফিকশন বা কল্পসাহিত্য। রূপটা যদিও নাটকের, কিন্তু মুখ্য হয়ে উঠেছে এতে আদর্শবাদিতার জয়গান ও এক সংগ্রামী জীবনের ইতিবৃত্ত। তিনি এর আগে একাধিক গ্রন্থ (মৌলিক ও অনুবাদ), অজস্র প্রবন্ধ লিখলেও তাঁর একমাত্র সাহিত্য, তথা, নাটকটি শুধু এর সাহিত্যমান বা গুণ দিয়ে বিচার করলে চলবে না। এর সামাজিক দায়, ঐতিহাসিক দায়িত্ব, ও আদর্শিক দায়বদ্ধতার গুণটিও আনতে হবে সামনে।

আসুন, তার আগে আরেক কর্কশ, দুর্বাসা, রু্ক্ষ সন্ত হুমায়ুন আজাদের ‘আমার অবিশ্বাস’ থেকে পাঠ করি প্রথম দিককার কিছু অংশ, গ্রন্থেরও শুরুতে যা ছিল:
“এক বড়ো অশুভ সময় এসেছে পৃথিবীতে, যারা অন্ধ তারা সবচেয়ে বেশি দেখতে তো পাচ্ছেই, তারা অত্যন্ত বেশি বিশ্বাস করছে, এবং পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বাসের বিকট মহামারী। এখন সবাই বিশ্বাস করছে, সবাই বিশ্বাসী; কারো পক্ষে এখন বলা সম্ভব হচ্ছে না – আমি বিশ্বাস করি না, আমি অবিশ্বাস করি।…এখন পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন বিধাতা পালন করছে অত্যন্ত শক্তিশালী রাজনৈতিক ভূমিকা, আর গণতন্ত্রমত্ত শক্তির উৎসরা নির্বাচিত করে চলেছে বিভিন্ন বিধাতাকে। তবে বিশ্বাস শুধু অতিমানবিক ভূমিকাতেই সীমাবদ্ধ নয়; হাজার হাজার শূন্য প্রথা বিশ্বাস করে চলেছে তারা, যা খুবই ক্ষতিকর। বাংলাদেশে আজ সবাই বিশ্বাসী; শক্তিমানতম থেকে দুর্বলতম বাঙালিটি প্রচণ্ডভাবে পালন করে চলেছে বিশ্বাস।”

এবং পরে, বইটির ভেতর: “বিশ্বাসের সঙ্গে অন্ধকারের সম্পর্ক গভীর, বিশ্বাস অন্ধকারের আত্মজ; আলোর সম্পর্ক তার কম বা নেই।”

১৯৯৭-এ লেখা এই বইটি প্রায় কুড়ি বছর পরেও যেন আজ মহাসত্যটা আরো তীব্রতর করে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আজ পুঁজিবাদের পাশাপাশি অনন্ত হিংস্রতা আর জিঘাংসা নিয়ে পথরোধ করে সভ্যতার গোড়া উপড়ে ফেলতে দাঁড়িয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদও, যার উত্থান ও বিকাশ পুঁজিবাদের হাত ধরেই। বাংলাদেশেও এর সদাপট বিষবাষ্প ছেয়ে ফেলেছে এর মুক্তস্বাধীন আকাশ আর জলমাটির কারখানা। লাল-সবুজের প্রিয় পতাকাপাত্র আজ রং দুটির ভিন্ন, ও ভয়ার্ত অর্থ দাঁড় করিয়েছে যেন।

এই লাল সেসব মুক্তচিন্তকদের, যাঁরা ধর্ম নামের পূতপবিত্র শব্দের মুখোশের আড়ালে ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন, নৃশংস মুখটি টেনেছিঁড়ে বের করার দায়িত্বে রত ছিলেন, তাঁদের ক্ষতাক্ত মৃতদেহের চিহ্ন যেন, যেসব দেখে আমরা শিউরে উঠেছি বারংবার। আহমেদ রাজীব হায়দার, বা থাবাবাবার গলা দুফাঁকরা মৃতদেহ, অভিজিৎ রায়ের মুখ থুবড়ে-পড়া লাল পাঞ্জাবি পরিহিত নিথর শরীর, ওয়াশিকুর রহমান বাবুর সহনাতীত বিচ্ছিন্ন মুখের দম-আটকানো চিত্র। সবেতেই সেই লাল, রণজিৎ সিংজির সেই ভবিষ্যদ্বাণী যেন, “সব লাল হো যায়েগা!”

আর সবুজ যেন সেই আরব্য ধর্মীয় সাম্রাজ্যবাদের চিহ্ন, যা অনেকের কাছেই শ্রদ্ধা ও গ্রহণযোগ্যতার মূর্ত প্রতীকায়ন, সংস্কারাচ্ছন্ন, অন্ধ এক গোত্রের অন্ধ, রুচিহীন, মূঢ় জিগীষার ছাপ।

কোথায় গেল বাংলার আদিতম মিলমিশের সংস্কৃতির ইতিহাস, কোথায় গেল ধর্মান্ধতার বিপক্ষে রুখে-দাঁড়ানোর বা অগ্রাহ্য করার সক্ষমতা, কোথায় গেল একাত্তরে ধর্মহিংস্রতার বিপক্ষে জনতার জয়ের ফলে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা গ্রহণের উদার ঐতিহ্য?

বাস্তবে ফিরি।

অনন্ত বিজয় দাশ নামে সিলেটে একজন মুক্তমনার প্রাথমিক সদস্য ও ঋদ্ধ প্রাবন্ধিক খুন হয়ে পড়েছিলেন পাপবিদ্ধ বাংলাস্তানে, অসুস্থ মাবাবাকে ফেলে নিরাপদে পালিয়ে যেতে যিনি পারেননি। হ্যাঁ, বিজ্ঞানবিষয়ক লেখকই ছিলেন তিনি মূলত, কিন্তু হিন্দু ও মুসলিম, দুটি ধর্মেরই অবৈজ্ঞানিকতা, অযৌক্তিকতা, অমানবিকতা নিয়ে তিনি সোচ্চার ছিলেন তাঁর নানাবিধ লেখাতেই। হিন্দু মৌলবাদী সংগঠন ইসকনের বিজ্ঞানবিষয়ক ভন্ডামো ও গোঁজামিল নিয়ে যেমন তিনি সোচ্চার ছিলেন, তেমনি কোরানে বিজ্ঞান বা গাণিতিক চমৎকার খোঁজার ব্যবসায়িক প্রবণতাও তিনি রোধ করার চেষ্টা করেছিলেন সোচ্চার কলমে কিংবা কিবোর্ডে। এসব অপরাধের মূল্য তাঁকে দিতে হয়েছে সবচে চড়া মুদ্রাটি দিয়ে, তাঁর প্রাণ।

মৃত্যুর পর তাঁর সুহৃদসুজনেরা প্রকাশ করেছেন তাঁর একমাত্র নাটক, ব্রুনোর দণ্ড।

শুরুতে সেই বইটির কথাই বলছিলাম।

ছোট্ট বইটিতে প্রকাশক, প্রচ্ছদশিল্পী, প্রকাশসংক্রান্ত কোন তথ্যই নেই, কারণ সেগুলোও আজকাল আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠছে। যেমনটা হয়েছিল গত শতকের বিশের দশকে পাঞ্জাবে রঙ্গিলা রসুলের প্রকাশক, যেমনটা হয়েছে গত বছরেই অভিজিৎ রায়, বন্যা আহমেদ, অনন্ত বিজয় দাশদের প্রকাশক, কেউ মরেছেন, কেউ মরতে মরতে বেঁচেছেন, সেই আহমদ রশীদ টুটুল, ফয়সাল হক দীপনেরা। তাই আত্মরক্ষাই শিরোধার্য করতে হয় বাধ্য হয়ে।

আমরা যাঁরা ধর্মহিংস্রতার শহিদি স্মারক হিসেবে এক নিঃশ্বাসে নামগুলো নিতে অভ্যস্ত, তাঁরা ব্রুনোকে চিনলেও তাঁর সম্পর্কে বিশদভাবে জানি না অনেকেই। অনন্ত এই নাটিকাটিতে তাঁর চরিত্রচিত্রণে যতটা না আগ্রহী, তারচে অনেক বেশি আগ্রহী তাঁর জীবন, ইমানদারি, ও লক্ষ্যপ্রেমের কথা কইতে।

এটি একটি একাঙ্কিকা, যার দৃশ্য দশটি। এই দশ দৃশ্য ব্রুনোর জীবনের দশ দশারই প্রতীক ও মূর্তায়ন যেন, তাঁর জীবনকাহিনির সাথে সঙ্গত করে। আমি আগে যা বলেছি, তার পুনরাবৃত্তি করছি এখানেও। এই সাহিত্যকর্মটি শুধু সাহিত্যগুণ ধরেই বিচার করা যাবে না, করতে হবে সামগ্রিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের অন্যতম আয়ুধ হিসেবে। অনন্ত ব্রুনোর গল্প শুনিয়ে আমাদের সচেতন করতে চান যে ধর্ম যেখানে বিশ্বাসের ওপর জোর দেয়, সেখানে মানবের অনুসন্ধিৎসু হৃদয় খুঁজে ফিরেছে খ্যাপার মতন পরশপাথর, যা হৃদয়ের মুক্তি এবং চিন্তার স্বাধীনতার স্বর্গরাজ্যের সিঁড়ি খুলে দেবে। অনন্ত আমাদের সাহস জুগিয়ে বলতে চান যে আলোর পথ কখনোই সুগম ছিল না, কখনোই সরল ও মসৃণতর ছিল না, কখনোই পৌরাণিক ঈশ্বরাদেশের মতন কুন, ফায়া কুন কিংবা লেট দেয়ার বি লাইটের মতন ইচ্ছাধীন ছিল না। অনন্ত আমাদের ভরসার বাণী শোনাতে চান যে যুগে যুগে ক্ষমতা মদমত্ততা, অন্ধত্ব, ও সংস্কারাচ্ছন্নতার বলদর্পিতা নিজেদের মহত্ত্ব ও শৌর্যপরাক্রমের জয়গান গাইলেও শেষমেষ সত্যই জেতে, যেভাবে জেতে মোমবাতির একটুকরো ছোট্ট আলো সহস্র বৎসরের প্রাচীন ঘরের ভেতরের অন্ধকারের বিপরীতে। মহাত্মা গান্ধির কথামত অনন্ত যেন নিরুচ্চারে বলেন, প্রথমে তারা অগ্রাহ্য করে তোমায়, তারপর করে ব্যঙ্গ, তারপর করে লড়াই, এবং তারপরেই জয় হয় তোমার।

প্রথম দৃশ্যে আমরা দেখতে পাই অস্থির, দগ্ধহৃদয় ইতালীয় তরুণ ধর্মযাজক জিওর্দানো ব্রুনোকে তার অধীরতা ও আন্তর্বেদনা প্রকাশ করতে। সে অধীত ধর্মশাস্ত্রে তার দৃশ্যমান জগতের ঘটনাবলির যথাযথ সমাধান না-পেয়ে চিন্তিত, বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত; নিজের চারপাশে গড়া বিশ্বাসের দুর্গদেওয়াল খসে পড়তে দেখে্ উদ্বিগ্ন নিজেকের মানসিক সুস্থতা নিয়ে; পরমকারুণিক মহাশক্তির উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান, যার সবকটিই ঘোরতর পাপ বটে, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। আমরা তার এই উত্তেজনা, অব্যবস্থিতচিত্ততার ভেতর দেখি সেই মানবচিত্তটি, যে বিশ্বাসের দালান ভেঙে পড়তে দেখে ভীতসন্ত্রস্ত, আশাহীন, কারণ সে অজ্ঞ। আমার মনে পড়ে যায়, আমার নিজের কিশোর বুকের ভেতর কী পরিমাণ যন্ত্রণা, দাহ, ও শূন্যতার অনুভব হয়েছিল বিশ্বাসত্যাগের সময়, মনে হত কেউ তীক্ষ্ণধার করাতে চিরছে আমার বুকের ভেতরটা, এবং আমি সেটা নিজের চোখে দেখছি, অনুভব করছি প্রতিটা টানের রক্তাক্ত কাতরানি!

দ্বিতীয় দৃশ্যে তাকে দেখতে পাই তার বান্ধবী এ্যাগ্রিপ্পিনা এ্যানজেলা-র সাথে, যার কাছে সে হৃদয় উন্মুক্ত করছে কিছু বলার আশায়। তার পোড়া মনের যাতনার কথা যে না-বলে সে মুক্তি পাচ্ছে না! ব্রুনো আক্ষেপ করে, চার্চের কাছে, এর আশ্রয়ে তার মনোভূমির শান্তি সে অর্জন করেনি কখনোই। স্তব্ধ এ্যানজেলার কাছে সে তার বিক্ষত অন্তরাত্নার উন্মোচন করে:
“জানো এ্যানজেলা, কিছুদিন আগে আমি ইরাসমাসের একটি উক্তি পড়েছিলাম, “খ্রিস্টই পবিত্র – এ কথা ঠিক নয়।” আর আমার মনে হয় ‘বাইবেল সত্য’ – একথাও ঠিক নয়। সত্য অনেক বড়, আরো প্রসারিত। সত্য, যুক্তি-প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের পবিত্র গ্রন্থের কোন বক্তব্যই তো যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করা যায় না, যাচাই-বাছাই করা যায় না। এমন কী কোন প্রশ্নও করা যায় না। শুধু অন্ধভাবে মেনে নিতে হয়, বিশ্বাস করতে হয়। এ কেন? কেন এই নিষেধাজ্ঞা? যুক্তির প্রতি, প্রশ্নের প্রতি তাদের কিসের এত ভয়? এত শঙ্কা?”

শুনে আঁতকে ওঠে এগ্রিপ্পিনা: “হায়! তোমার এসব কথা, চার্চের অন্য কেউ শুনলে ভীষণ ক্ষেপে যাবে। তোমার বিরুদ্ধে ফাদারের কাছে ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ আনবে। বেঁচে থাকতে দেবে না, তোমাকে ওরা মেরে ফেলবে। তোমার কথা শুনে আমার ভীষণ ভয় হচ্ছে। তোমার কি ভয় করে না?”

দ্বন্দ্বদীর্ণ, অথচ সৎ ব্রুনো বলে: “হ্যাঁ করে। অবশ্যই ভয় করে। বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এর থেকেও বেশি ইচ্ছে করে মুক্তচিন্তা করতে, যুক্তি দিয়ে যাচাই করতে, প্রশ্ন করতে, উত্তর খুঁজতে।”

এই আগুনটাই কাজ করেছে সব মুক্তমনাদের মননে, মগজে। মরণেও ভয় পাননি তাঁরা। তাঁদের হাতিয়ার ছিল প্রশ্ন, কৌতূহল, জিজ্ঞাসা। মৃত্যু, শাস্তি, পাপের ভয়ও তাঁদের জানার পথ রুদ্ধ করতে পারেনি পুরোপুরি। তাঁরা সক্রেটিসের মতন ঠোঁটের সামনে বিষপাত্র তুলে ধরার আগ অবদি প্রশ্ন করে গেছেন, আক্রমণ করে গেছেন প্রথাপ্রতিষ্ঠানের আপাতদৃঢ় দেওয়ালে। তাঁরা সত্যজ্ঞানের নেশায় সব তুচ্ছ করেছেন।

বলেছেন, জেনেছেন, ও মেনেছেন:

মহাবিশ্বজীবনের তরঙ্গেতে নাচিতে নাচিতে
নির্ভয়ে ছুটিতে হবে, সত্যেরে করিয়া ধ্রুবতারা।
মৃত্যুরে করি না শঙ্কা। দুর্দিনের অশ্রুজলধারা
মস্তকে পড়িবে ঝরি — তারি মাঝে যাব অভিসারে
তার কাছে, জীবনসর্বস্বধন অর্পিয়াছি যারে
জন্ম জন্ম ধরি। কে সে? জানি না কে। চিনি নাই তারে —
শুধু এইটুকু জানি — তারি লাগি রাত্রি-অন্ধকারে
চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তর-পানে
ঝড়ঝঞ্ঝা-বজ্রপাতে, জ্বালায়ে ধরিয়া সাবধানে
অন্তরপ্রদীপখানি। শুধু জানি যে শুনেছে কানে
তাহার আহ্বানগীত, ছুটেছে সে নির্ভীক পরানে
সংকট আবর্তমাঝে, দিয়েছে সে বিশ্ব বিসর্জন,
নির্যাতন লয়েছে সে বক্ষ পাতি মৃত্যুর গর্জন
শুনেছে সে সংগীতের মতো। দহিয়াছে অগ্নি তারে,
বিদ্ধ করিয়াছে শূল, ছিন্ন তারে করেছে কুঠারে,
সর্ব প্রিয়বস্তু তার অকাতরে করিয়া ইন্ধন
চিরজন্ম তারি লাগি জ্বেলেছে সে হোম-হুতাশন —

এই আত্মবলিদানের বেদিতেই জন্ম নেয় পরবর্তী প্রজন্মের মুক্তিজবা, সভ্যতার আলোকরশ্মি, সত্যের নক্ষত্রজ্যোতি। ইতিহাসের প্রেমিক হয় চিরক্রান্তির ভাবনা ও দর্শন। পরিবর্তন যেমন সত্যি, তেমনই সত্যি এই লড়াই। যুগে যুগে ও কালে কালে। আমরা আমাদের সময়েও তার মহান ও রক্তক্ষয়ী রূপ দেখে যাচ্ছি, গেলাম। ইতিহাসের এই বাঁকবদলই বলে দেবে আমাদের গতিপথ কোনদিকে হবে, স্বাধীনতা, সাম্য, ও ভ্রাতৃত্বের আলোকিত পথে, কিংবা, অন্ধকার, সংস্কারপিছল, অমানবিকতার গোঁড়ামির কানাগলিতে।

ব্রুনো পালিয়ে বেড়ান বনপোড়া হরিণের মতন, চার্চ থেকে বহিষ্কৃত হয়ে, নিজের মতামতের কারণে, যা ঈশ্বরদ্রোহিতার মতন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শাস্তির যোগ্য। তিনি ফ্লোরেন্সে যান, ছাত্রদের ভেতরে নিজের মনকথা ছড়িয়ে দিতে চান শিখা থেকে শিখায় আগুন জ্বালানোর মতন। সেখান থেকেও পালাতে হয় তাঁকে, কারণ ধর্মবিরোধিতার, আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মতে যা বিকৃত রুচি এবং পর্নোর সমান, খ্যাতি সেখানেও অর্জন করেছেন তিনি। প্রিয় ছাত্র গিয়োভান্নির সহায়তায় নারীর পোশাক পরে তিনি পালান সুইজারল্যান্ডে। সেখান থেকে জার্মানি, ইংল্যান্ড হয়ে অবশেষে কপর্দকশূন্য হয়ে আসেন প্যারিসে। কিছুটা ঠাঁই মিললেও শান্তি সেখানে পুরো মেলেনি। কিছু ছাত্র এখানেও পেলেন তিনি। তাঁদের তিনি শেখান:
“এই বিশ্ব কারো নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। নেই এর কোন নিয়ন্ত্রকও। আছে শুধু কিছু প্রাকৃতিক নিয়ম, যা এখনো আমরা পরিপূর্ণভাবে জানতে পারিনি। তাই আমাদের জ্ঞান আহরণ বন্ধ করলে চলবে না। আরো, আরো বেশি করে জানতে হবে আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়ম সম্পর্কে। কোন নির্দিষ্ট উপাস্য গ্রন্থ পাঠ করলে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে জানা যাবে না। মনে রাখতে হবে, কোন বিষয়ে পরিপূর্ণভাবে জানতে হলে অবশ্যই মনের মধ্যে সন্দেহ-সংশয়-আগ্রহ থাকতে হবে। উপাস্য গ্রন্থগুলো পড়ার আগেই বিশ্বাস করতে বলে, মেনে নিতে বলে। এতে কি পরিপূর্ণ জ্ঞান আহরণ সম্ভব?”

এই প্রশ্ন আবহমান ধর্মতাত্ত্বিকতার মুখে, একনায়কসুলভ স্বৈরশাসনের বিপক্ষে, চিন্তারাজ্যের পরাধীনতার বিরুদ্ধে এক চপেটাঘাত, মহান সত্যসন্ধানে। জ্ঞান ঐশ্বরিক নয়, স্বর্গীয় নয়, দৈবানুগ্রহে প্রাপ্ত নয়। মানুষ অনুসন্ধানের ও নিষ্কাশনের রাস্তায় থেকে তুলে এনেছে পবিত্র, যুক্তিতথ্যপ্রমাণঋদ্ধ, মহতী জ্ঞান, যার সম্পর্কে গীতায় বলা হয়েছে, নহি জ্ঞানেন পবিত্রমিহ বিদ্যতে।

শুরুর সংশয়াকুল, দ্বিধাকণ্টকিত, অগ্নিস্পৃষ্ট ব্রুনো যে-কাতরতায় ডুকরে ওঠেন:
“ভগবান, ভগবান, রিক্ত নাম তুমি কি কেবলই,
তুমি কি সত্যিই
আরণ্যিক নির্বোধের ভ্রান্ত দুঃস্বপন?”
সেই ব্রুনোই এখন স্থিতপ্রজ্ঞ, দৃঢ়চিত্ত, জ্ঞানবিবুধ।
“আমায় অজ্ঞতা আর বিশ্বাসের মৃত শান্তির চাইতে বরং দাও চিন্তা আর কর্মের ঝড় ও তুফান! যদি চাও আমায় ছুঁড়ে ফেল ইডেন থেকে; কিন্তু প্রথমে আমায় জ্ঞানবৃক্ষের ফল তো খেতে দাও!” (রবার্ট জি. ইঙ্গারসোল)।

ডাক আসে তাঁর সেই প্রিয় ছাত্র গিওভান্নির কাছ থেকে, ফ্লোরেন্সে সে তার প্রাক্তন শিক্ষাগুরুকে চায়, শিক্ষা নিতে চায় তার কাছ থেকে। তিনি আবেগের ভেলায় চেপে সব অসুবিধে তুচ্ছ করে হৃদয়ের টানে পৌঁছে যান প্রিয়শিষ্যের কাছে।

কিন্তু, হায়!

বিশ্বাসের ভাইরাস যে এতোদিনে তার মজ্জাস্নায়ু কুরে কুরে খেয়ে তাকে পরিণত করেছে জীবন্মৃত ধার্মিকে, যে তার শিক্ষাগুরুকে বিশ্বাসঘাতকতা করে ধরিয়ে দেয় চার্চের হাতে, একদা যাঁকে সে সহায়তা করেছিল পলায়নে, জানিয়েছিল তাঁর বিপক্ষে প্রাণনাশের ষড়যন্ত্রের খবর।

আজ যেন কিছুটা সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে নারায়ণগঞ্জ শহরের পথ ও প্রাসাদের চরিত্র। শ্যামল কান্তি ভক্ত নামের দুর্ভাগা শিক্ষকটি আজ তাঁর সুযোগ্য ছাত্র রিফাতের হাতেই মরণফাঁস গলায় পরে নিলেন, সেই চারশ বছরের পুরনো ধর্মাবমাননার দায়ে। মিশে কোথায় একাকার হয়ে যায় নারায়ণগঞ্জ আর ফ্লোরেন্সের ইতিহাসভূগোল। যে-রিফাত টিভিক্যামেরার সামনে মাসহ স্বীকার করে তার শিক্ষক শ্যামল কান্তি মোটেও কোনো ধর্ম বা ঈশ্বর নিয়ে অবমাননার কথা বলেননি, সে-ই আবার দিব্যি উল্টে গিয়ে মৌলবাদের খপ্পরে পড়ে তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার দাবি তোলে।

যেমনটা গিওভান্নি বলছে নাটকে:
“আপনি তো প্রায়ই সত্য সন্ধানের কথা বলেন, কিন্তু শাস্ত্র সম্পর্কে, বাইবেল সম্পর্কে আপনার অনুসন্ধান নিশ্চয় সত্য অনুসন্ধানের আবশ্যক শর্ত হতে পারে না। কারণ, ওগুলো আপনার তথাকথিত যুক্তি-তর্কের ঊর্দ্ধে। আপনি নিশ্চয় অবিশ্বাস দিয়ে বিশ্বাস মাপতে পারেন না…

“আপনি কি ঈশ্বরকে অস্বীকার করেননি? আপনি কি বাইবেলকে ভ্রান্ত বলেননি?

“আমি জানি, কোন ধরনের পরীক্ষা করে ঈশ্বরকে-ধর্মগ্রন্থকে প্রমাণ করা যায় না। কারণ তারা সব রকম পরীক্ষার ঊর্দ্ধে। আর আপনি সত্য সন্ধানের নাম করে চার্চের ন্যায়-বিচারকে নানা সময়ে অশ্রদ্ধা করেছেন, নিন্দা করেছেন।”

তুলে দেয় সে শিক্ষক, গুরু, জ্ঞানদাতাকে চার্চের সেনাদের হাতে।

বাকিটা, আমরা জানি, ইতিহাস।

সক্রেটিসের মতন ব্রুনোরও লোকদেখানো বিচার হয় এবং যথারীতি মৃত্যুদণ্ড বর্ষিত হয় তাঁর শিরে। তার আগে অবশ্য তাঁকে দীর্ঘ আটটি বছর রাখা হয় একটি সিসের ঘরে অন্তরীণ করে, যা গরমের সময় তপ্ত খোলা, শীতের সময় জমাট বরফ।

বিচারকদের পূর্বগৃহীত রায় উচ্চারণ করা হয়।

“জিওরদানো ব্রুনো, আপনি দীর্ঘদিন ধরে ধর্মশাস্ত্রবিরোধী, গির্জা বিরোধী বক্তব্য রেখে আমাদের পবিত্র খ্রিস্টধর্ম ও গির্জাকে অপমান করে যাচ্ছেন। আপনার শয়তানি কাজ-কারবারে আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ঈশ্বর বিশ্বাস উবে যাচ্ছে। তাই আপনার মত শয়তানকে মহান ঈ্শ্বরের এ পবিত্র পৃথিবীতে প্রয়োজন নেই। আপনার মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো।”

আতঙ্কে, প্রাণাশঙ্কায় জবুথবু, করুণ না-হয়ে ব্রুনো ইতিহাসের সাহসী পাহাড়ের মতন হাসিতে ফেটে পড়েন সব অগ্রাহ্য করে, সব তুচ্ছ করার দুঃসাহসে।

“আমাকে দণ্ডদানের কথা শুনে আমি যতো ভয় পেয়েছি, আগামী দিনে যে সত্য প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেই কথা ভেবে তোমরা অনেক বেশি ভয় পেয়েছো। এ দেখে আমার বড্ড হাসি পাচ্ছে। হা! হা! হা!”

এই সরল ভবিষ্যদ্বাণী যে কতবড় মর্মাঘাত হয়ে ফিরে এসেছে তা জেনেছিল এথেন্স, তা জেনেছে জেনোয়া, তা জেনেছে কোপেনহাগেন, তা জেনেছে লন্ডন, তা জেনেছে ইউরোপ, তা জেনেছে আমেরিকা, তা জেনেছে এশিয়া, তা জেনেছে ও জানবে আবিশ্ব।

সত্য তো আলো, আগুন, শিখা! একে শস্ত্র দিয়ে ছেঁড়া যায় না, একে অগ্নি দিয়ে দাহ করা যায় না, একে জল দিয়ে ভেজানো যায় না, যায় না বাতাস দিয়ে ভেজানো। একের পর এক তরুণপ্রাণ, যারা সত্যের জন্যে, সত্যের লক্ষ্যে অবিচল, ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, বন্ধঘরের অন্ধকারে থাকবে না বলে উল্লসিত ও বন্ধনমুক্ত, তাদের রক্তে ধর্মশকুনশেয়ালেরা চাপাতি রাঙালেই কি সত্য মরে যাবে, মুছে যাবে, হেরে যাবে?

সোক্রাতেস হারেননি, হারেননি ব্রুনো, হারবে না অভিজিৎ, অনন্ত, বাবুরাও।

যতই হেফাজত ইসলামের হেফাজতের নামে তাণ্ডব করতে আসুক, যতই আইএসআইএল এসব নারকীয় হত্যার পর দায় স্বীকার করুক, যতই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের দায়িত্ব অস্বীকার করে ধর্মান্ধদের উল্লসিত করার ও হত্যাকারীদের ক্লিন চিট লিখে দেওয়ার কাজ করুক, যতই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ গর্বিত পদক্ষেপে আওয়ামী মুসলিম লীগের দিকে যাত্রা করার মহান কর্মটি সারুক, যতই ধর্মের নামে হিংস্রতা, সহিংসতা, নিপীড়ন অব্যাহত থাকুক, যতই জ্ঞানান্ধদের আস্ফালন ও অনুভূতিপ্রবণদের আক্রমণের রাস্তা খোলা থাকুক, যতই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও মতপ্রকাশের দায়ে রাষ্ট্রীয় নিবর্তনমূলক আইন দিয়ে মুক্তমনা, মুক্তচিন্তক, মুক্তবুদ্ধির ধারকদের জেলজরিমানা করা হোক, যতই অবিশ্বাস প্রচারের দায়ে সারসত্য এই যে ইতিহাসের চাকা অন্ধকারে যাবে না, গেলেও তা সাময়িক সরণমাত্র।

আগুনের পরশমণি ছোঁবেই প্রাণে।