সত্যকে স্বীকার করে রামমোহন তাঁহার দেশবাসীর নিকটে তখন যে নিন্দা ও অসম্মান পেয়েছিলেন, সেই নিন্দা ও অপমানই তাঁর মহত্ত্ব বিশেষ ভাবে প্রকাশ করে। তিনি যে নিন্দা লাভ করেছিলেন সেই নিন্দাই তাঁর গৌরবের মুকুট।”-রবীন্দ্রনাথ।

রাজা রামমোহন রায় (মে ২২, ১৭৭৪ – সেপ্টেম্বর ২৭, ১৮৩৩)ফরাসি বিপ্লবের ঝড়ের মুখে ভারত বর্ষে তাঁর জন্ম। ভারতের হুগলী জেলার অন্তর্গত খানাকুল-কৃষ্ণ নগরের কাছে রাধানগর গ্রামে রাজা রামমোহন রায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-রামকান্ত রায়, মাতা-তারিণী দেবী। রামমোহনের পূর্বপুরুষ রাজ সরকারের কাজ করে ‘রায়রায়ান’ উপাধি লাভ করে। তবে তাদের কৌলিক উপাধি ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’। পিতা রামকান্ত ও তারিণী দেবী দুইজনই ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। রামাকান্ত শেষ জীবনে বৈষ্ণব হোন এবং হরিনাম করে জীবনের শেষ দিনগুলো অতিবাহিত করেন। অন্যদিকে তারিণী দেবী’তো কোর্টে রামমোহনের বিরুদ্ধে মামলা-ই করে বসেন! বিচারের সময় সগর্বে উচ্চারণ করেছিলেন- ধর্মত্যাগী পুত্রের মস্তক যদি এখানে ছিন্ন করা হয় তাহলে আমি পুণ্য কাজ বলে মনে করব। ছেলে বিধর্মী, তাই পৈতৃক সম্পত্তির অধিকারী যেন না হয় তার জন্যে তিনি মামলা করেন। রামমোহন প্রথমে মায়ের বিরুদ্ধে মামলায় লড়তে চাননি। কিন্তু তিনি পরে ভাবেন- এতে তার আন্দোলন সম্পর্কে মানুষের ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হবে। এ জন্যে তিনি মামলায় লড়েন এবং জয়ী হন। মামলায় জয়ী হওয়ার পর তিনি তার প্রাপ্ত সম্পত্তি মাকে ফেরত দিয়ে দেন। কারণ, তাঁর যুদ্ধ তো মায়ের মামলার বিরুদ্ধে নয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে।

কলেজ গ্রিন, ব্রিস্টল, ইংল্যান্ড

রামমোহন বলিষ্ঠ পুরুষ ছিলেন। শরীরের দৈর্ঘ্য ছিল ছয় ফুট উচ্চ। মাথা ছিল অস্বাভাবিক বড়। এই জন্যে বিলেতের বিশেষজ্ঞগণ তাঁকে অসাধারণ পুরুষ বলত। রামমোহন প্রতিদিন ১২ সের দুধ পান করতেন। শোনা যায় একবারে একটি আস্ত পাঠার মাংস খেতে পারতেন। কলিকাতায় তিনি যখন ধর্মমত প্রচার যখন শুরু করেন তখন কিছু মানুষ তাকে একাধিকবার হত্যার পরিকল্পনা করে। এই কথা শুনে রামমোহন বললেন-আমাকে মারবে? কলকাতার লোক আমাকে মারবে? তারা কী খায়?’’ এই কথার মধ্যদিয়ে স্পষ্ট হয়, রামমোহনের নিজের শক্তি-সামর্থ্যের উপর যথেষ্ট আস্থা রাখতেন। রামমোহন শরীরের বিষয়ে বেশ যত্নবান ছিলেন। তিনি শরীরকে ভগবানের মন্দির মনে করতেন। সেই কালের অন্যদের মতন তাঁরও বাবরী চুল ছিল। রামমোহন যেমন খেতে জানতেন তেমনি পড়তে পারতেন। শোন যায়, রামায়ণ-এর মতন মহা-গ্রন্থ তিনি এক বসাতে শেষ করে ফেলতেন। রামমোহন মোট ১০টি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন-সংস্কৃত, পারসি, আরবি, উর্দু, বাংলা, ইংরেজি, ফরাসী, ল্যাটিন, গ্রিক ও হিব্রু। এসকল ভাষার প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্যের সঙ্গেও রামমোহন পরিচিত ছিলেন।

শৈশব ও চাকুরী জীবন:

তৎকালীন সমাজিক প্রথানুসারে বাবার নির্দেশে রামমোহনকে নয় বছর বয়সের মধ্যেই তিনবার বিয়ে করতে বাধ্য হোন। প্রথম স্ত্রী কিছুদিনের মধ্যে মারা যান। নিজের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই পরবর্তী জীবনে তিনি বহু বিবাহ প্রথার তীব্র নিন্দা এবং বিরোধিতা করেন। এমনকি তিনি তাঁর পুত্রদের ওপর শর্ত আরোপ করেন যে, স্ত্রী বেঁচে থাকতে যদি কেউ দ্বিতীয় বিয়ে করে তাহলে সে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে। কারণ পুরুষের একাধিক বিয়েকে স্ত্রী লোকদের জন্যে হীন ও অসম্মান হিসেবে তিনি দেখতেন।

রামমোহনের চৌদ্দ বছর পর্যন্ত বাড়িতেই পড়াশুনা করেন। গ্রাম্য পাঠশালায় বাংলা শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে তিনি এক মৌলভীর কাছ থেকে পারস্য ভাষা শিখতে আরম্ভ করেন। সেই সময় পারস্য ভাষা রাজদরবারের ভাষা ছিল। তাই ধনী বংশের ছেলেরা পারস্য ভাষায় শিক্ষা লাভ করত। পারস্য ভাষার সাথে সাথে তিনি আরবি ভাষাও শিখে ফেলেন। তিনি আরবি ভাষায় এরিস্টটল ও ইউক্লিড পড়েন। এতো কম বয়সেই তিনি ‘কোরান শরিফ’ অধ্যয়ন করেন। এছাড়া পারস্যের সুফিবাদী বইপত্রও অধ্যয়ন করেন। বলা হয় সুফিবাদ পাঠ করার ফলেই তার মনে ধর্মবিশ্বাস শিথিল হয়ে পড়ে। এছাড়া তাঁর প্রিয় কবিরা ছিল-মাওলানা রুমি, শামীজ তাব্রিজ প্রমুখ। তিনি প্রতিদিন গোসল করার সময় কবিতা আবৃত্তি করতেন। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কার নামে একজন সংস্কৃতি অধ্যাপকের সাথে রামমোহনের পরিচয় হয়। পরবর্তীতে তার সংস্পর্শে রামমোহন সংস্কৃত শাস্ত্রে অধিকার লাভ করেন এবং তান্ত্রিক মতে আকৃষ্ট হন।

রামমোহনের বয়স যখন ষোল কি সতের, সেই সময় তিনি পৃথিবীর সুদূর প্রদেশ পার্বত্য ও সমতল ভূমিতে ভ্রমণ করেন। এতো কম বয়সে তিনি তিব্বতও ভ্রমণ করেন। তিব্বত গমন সম্পর্কে তিনি লেখেন-“পরিশেষে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অত্যন্ত ঘৃণাবশত: আমি ভারতবর্ষের বহির্ভূত কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করলাম। তার মধ্যে তিব্বত অন্যতম।” তিব্বত যাওয়ার আরেকটি বিশেষ কারণ ছিল-বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। যদিও তিব্বতে গিয়ে একবার তিনি বেশ ভাল বিপদেই পড়েন। তিব্বতের সর্বপ্রধান বৌদ্ধ পুরোহিতকে বলা হয় ‘লামা’। তিব্বতিরা লামাকে আবার ঈশ্বর জ্ঞান করে। তারা বলে, লামা জগতের সৃষ্টি ও স্থিতির কর্তা। কিন্তু রামমোহন এইসব কথাবার্তা সহ্য করতে পারলেন না। তিনি সেখানে তীব্র প্রতিবাদ করেন। এতেই বাঁধে বিপদ। তিব্বতিরা তাকে মারার জন্যে ক্ষেপে উঠল। সে সময় তিব্বতের মেয়েরা রামমোহনকে রক্ষা করে। এই জন্যে সারা জীবন তিনি নারী জাতির কাছে কৃতজ্ঞতা অনুভব করতেন। তিব্বতি মেয়েদের এই কৃতজ্ঞতা তিনি বহুবার বহু লোকের কাছে গর্ব করে বলেছেন। এর পর তিনি কিছুদিন কাশীতে থেকে হিন্দু শাস্ত্রগ্রন্থগুলো অধ্যয়ন করেন। এবং কাশীতে থাকার সময় তিনি ইংরেজি শিখতে আরম্ভ করেন।

১৮০৩ সালে পিতা রামকান্ত রায়ের মৃত্যু হয়। পিতার মৃত্যুর পর রামমোহন মুর্শিদাবাদে অবস্থান করেন এবং তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘তুহ ফাতুল-মুয়াহীদিন’ পারস্য ভাষায় প্রকাশ করেন। ‘তুহ ফাতুল-মুয়াহীদিন’ এর অর্থ-একেশ্বরবাদীদের প্রতি উপহার। বইটির ভূমিকা আরবি ভাষায় লেখা। বইটিতে তিনি অনেক আরবি নৈয়ায়িক ও দার্শনিক মতের অবতারণা করেন। রামমোহন রচিত আরেকটি পারস্য ভাষায় লেখা গ্রন্থ-‘মনাজারাতুল আদিইয়ান’ বা বিভিন্ন ধর্মসম্ভদ্ধীয় আলোচনা।

রামমোহন প্রথম জীবনে নিজেদের বিষয়-সম্পত্তি দেখা শোনা করতেন। পরে কলকাতায় কোম্পানি কাগজের ব্যবসা, সিভিলিয়ানদের টাকা কর্জ দেওয়াসহ বিভিন্ন ব্যবসা করতেন। রামমোহন নয় বছর চাকরি করেন। তার মধ্যে মাত্র ১ বছর ৯ মাস বিভিন্ন স্থানে ইস্ট ইন্ডিয়ার অধীনে কাজ করেন। বাকি কয় বছর তিনি ডিগবী সাহেবের খাস মুন্সির কাজ করেন। এজন্যে লোকে তাঁকে ডিগবীর দেওয়ান বলতো। একবার এক ইংরেজ কালেক্টরের সামনে দিয়ে রামমোহন পাল্কিতে চড়ে যাচ্ছিলেন এতে কালেক্টর স্যার ফ্রেডারিক খেপে গেলেন। কারণ ইংরেজ সাহেব দাঁড়িয়ে আছে আর একজন দেশী কিনা পাল্কীতে চড়ে যাচ্ছে! তিনি চিৎকার করে রামমোহনকে পাল্কী হইতে নামতে বলেন কিন্তু রামমোহনও ছাড়বার পাত্র ছিলেন না। তিনি ইংরেজ সাহেবকে বুঝানোর চেষ্টা করেন কিন্তু কালেক্টর সাহেব যখন বুঝতে চাইলেন না। তখন রামমোহন পাল্কীতে চড়ে দ্রুত চলে গেলেন। এবং এই অপমানের প্রতিকারের জন্যে রামমোহন বড়লাটকে প্রতিবাদ জানান। ধারণা করা হয়, এই প্রতিবাদ চিঠি ছিল রামমোহনের প্রথম ইংরেজি রচনা। এতে অবশ্য কাজও হয়েছিল। কালেক্টর স্যার ফ্রেডারিকের উপর আদেশ হয়েছিল-দেশীয় লোকদের সাথে ভবিষ্যতে যেন এমন বচসা না করেন।

ডিগবী সাহেব রামমোহনকে পছন্দ করতেন তাই তিনি যেখানে বদলি হতেন রামমোহনকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। ডিগবী সাহেব তাঁকে ইংরেজি ভাষা শিখতে সাহায্য করেন। রামমোহনের ইংরেজি লেখার তারিফ ডিগবী সাহেব সবসময় করতেন। এমনকি বিলেত থেকে আসা ইংরেজি পত্রিকাগুলো রামমোহনকে তিনি পড়ার জন্যে দিতেন। পত্রিকার মাধ্যমে রামমোহন ইউরোপের রাষ্ট্রনীতি সম্বন্ধে পরিচিতি লাভ করেন। এছাড়া ফ্রান্সের রাজনৈতিক ঘটনা, বিশেষ করে নেপোলিয়নের অভ্যুত্থান ও বীরত্বে রামমোহনকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করতো। ইংরেজি শিক্ষার ফলে পরবর্তী কালে রামমোহন ইংরেজি ভাষায় ‘কেন উপনিষদ’ ও ‘বেদান্তের চূর্ণক’ নামে গ্রন্থ রচনা করেন। এবং তাতে ভূমিকা লিখেন ডিগবী সাহেব। ডিগবী সাহেব বিলেত গিয়ে বইগুলোর পুনর্মুদ্রণ করেন। ১৮১৪ সালে ডিগবী সাহেব বিলেত চলে যান এবং রামমোহন চাকরি হতে অবসর নিয়ে নেন। পরবর্তীতে শুরু করেন এক বিচিত্র কর্ম-বহুল অধ্যায়।

সামাজিক নির্যাতন, উৎপীড়ন ও সংগ্রাম:

‘মহাপুরুষ যখন আসেন তখন বিরোধ নিয়েই আসেন, নইলে তাঁর আসার কোন সার্থকতা নেই। ভেসে-চলার দল মানুষের ভাসার স্রোতকেই মানে। যিনি উজিরে নিয়ে তরীকে ঘেঁটে পৌঁছিয়ে দিবেন, তাঁর দুঃখের অন্ত নেই, স্রোতের সঙ্গে প্রতিকূলতা তাঁর প্রত্যেক পদেই।’-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১৮১৪ সালে তিনি কলকাতায় আসেন ও ধর্ম সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেন। কলকাতায় ১৬ বছরের সংগ্রাম ও সংস্কার রামমোহনের কর্মযুগ বলা যেতে পারে। নবযুগের অগ্রদূত রামমোহন সামাজিক কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে হাতে তুলে নেন রণ-শৃঙ্গ।ফলে স্বাভাবিকভাবে তার অনেক শক্রর সৃষ্টি হয়। একবার তিনি মধু দিয়ে রুটি খেতে খেতে বালক মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বলছিলেন-বেরাদর (পারস্য শব্দ ভাই), আমি মধু ও রুটি খাচ্ছি, কিন্তু লোকে বলে আমি গরুর মাংস ভোজন করে থাকি। সামাজিক কুৎসা, জীবনের উপর আক্রমণ সবকিছুই সইতে হয়েছে রামমোহনকে।

সমাজ সংস্কার, প্রচলিত সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি-নীতির অবস্থান নেওয়ার ফলে রামমোহন কম যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় নাই। সমাজের মানুষের পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধেও তাঁকে সংগ্রাম করতে হয়। রামমোহনের পুত্র রাধাপ্রসাদের বিয়ের সময় তার বিরুদ্ধ দল বিয়ে ভাঙার অনেক চেষ্টা করে। এমনকি রামমোহনকে এক ঘরে করে রাখার আয়োজন করা হয়। যদিও তারা ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু তার বিরোধী পক্ষরাও দমিবার পাত্র ছিল না। তার বিরোধী পক্ষরা রামমোহনের বাড়ির কাছে এসে সকালে মুরগির ডাক ডাকত, বাড়ির ভেতরে গরুর হাড় ফেলে যেত। এমনকি তার বিরুদ্ধে গানও রচনা করে সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল শক্ররা।

‘সুরাই মেলের কুল

(বেটার) বাড়ি খানাকুল,

বেটা সর্বনাশের মূল।

ওঁ তৎসৎ বলে বেটা

বানিয়েছে স্কুল।

ও সে জেতের দফা

করলে রফা, মজালে তিন কুল।।’

প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনের এতো অত্যাচার সহ্য করার পরও রামমোহনের কোন লেখায় কারো প্রতি কোন বিদ্বেষ দেখা যায়নি। কারণ তিনি ছিলেন খুবই ধৈর্যশীল একজন মানুষ। ছেলেরা দল বেঁধে রামমোহনকে খেপাইত। কলকাতায় যখন ব্রাহ্মসভায় উপাসনা করতে যেতেন তখন লোকে তার গাড়িতে ঢিল ছুড়ত। তাই বেশির ভাগ সময় গাড়ির জানালা বন্ধ করে রাখতে বাধ্য হতেন। শুধু তাই নয়; তার বিরোধী পক্ষ তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা পর্যন্ত করছে। এই জন্যে রামমোহন তাঁর সঙ্গে কিরিচ ও পিস্তল সঙ্গে নিয়ে বের হতেন। কিন্তু এর পরও কারো বিরুদ্ধে তার কোন অভিযোগ ছিল না। অসহিঞ্চু নীতিতে ছিল তাঁর আস্থা।

রামমোহন কলকাতায় চিন্তাশীল ও সংস্কার প্রয়াসী বিশিষ্ট জনদের নিয়ে একটি সমমনা-সভা গঠন করলেন। সেখানে বেদান্ত শাস্ত্র ও ধর্মের ব্যাখ্যা ও বিচার সম্পর্কে আলোচনা হতো এবং একেশ্বরবাদের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন হতো। শহরের শিক্ষিত গণ্য-মান্য ব্যক্তিরা সভায় উপস্থিত হতো। তাদের মধ্যে ছিলেন জোড়াসাঁকোর প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, পাথুরিয়াঘাটার  প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, টাকীর কালীনাথ ও বৈকুণ্ঠনাথ মুন্সী, বৃন্দাবন মিত্র, কাশীনাথ মল্লিক, ভূকৈলাসের রাজা কালীশঙ্কর ঘোষাল, তেলিনিপাড়ায় অন্নদাপ্রসাদ ব্যানার্জি, হরিনারায়ণ তীর্থস্বামী এবং বৈদ্যনাথ ব্যানার্জি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া  ব্রজমোহন মজুমদার, হলধর বসু, রাজনারায়ণ সেন, চন্দ্রশেখর দেব, তারাচাঁদ চক্রবর্তী প্রমুখ তাঁর সাহচর্য লাভ করেন।

এছাড়া নিজের মত প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করার জন্যে ১৮১৫ সালে তিনি ‘আত্মীয় সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন। সপ্তাহে একদিন আত্মীয় সভা অনুষ্ঠিত হতে তাতে বেদান্তানুযায়ী এক ব্রহ্মের উপাসনা এবং পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কথা বলা হতো। সভায় বেদ পাঠের পর ব্রহ্ম সঙ্গীত গাওয়া হতো। সভা সকলের জন্যে উন্মুক্ত ছিল না। শুধু রামমোহনের কয়েক জন বন্ধু তাতে যোগদান করতে পারতেন। সে সময় নিন্দুকেরা আত্মীয় সভার বিরুদ্ধে গুজব রটায় যে, আত্মীয় সভায় গো মাংস খাওয়া হয়। ফলে অনেক বন্ধু রামমোহনকে ত্যাগ করে। পরবর্তীতে ১৮১৯ সালে আত্মীয় সভা বিহারীলাল চৌবের বাড়িতে স্থানান্তরিত করা হয়।

১৮১৫ সালে রামমোহনের সকল বিচারের ভিত্তিস্বরূপ সর্বপ্রথম বেদান্ত গ্রন্থ বা বেদান্তসূত্র  বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়। বেদান্তসূত্র অতি বিস্তৃত ও কঠিন গ্রন্থ ছিল তাই বাধ্য হয়ে সার সংকলন বেদান্তসার নামে আরেকটি গ্রন্থ তিনি রচনা করেন। সময়টা ছিল বাংলা গদ্যরচনার শৈশবকাল। যদিও বেদান্ত ১৮০১ সালে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপিত হয়। সেখানে ইংরেজ সিবিলিয়ানদের বাংলা শেখানোর জন্যে কলেজের কয়েকজন পণ্ডিত কয়েকটি বাংলা গ্রন্থ রচনা করেন। যা একেবারে সংস্কৃত-ঘেঁষা সন্ধি সমাজ বিবর্জিত সংস্কৃত বই বলা যায়। রামমোহনের পূর্বে এটাই ছিল বাংলা গদ্য রচনা। রামমোহন সংস্কৃত বহুল বাংলাকে সহজ-সরল করলেন। লোকে যাতে বাংলা পড়তে পারে তার জন্যে তিনি বেদান্ত-গ্রন্থে গদ্য পঠনের একটা নিয়ম লিখে দেন। ১৮১৬ সালে রামমোহন ঈশোপনিষৎ, ১৮১৭ সালে কঠোপনিষৎ, মান্ডূক্যোপনিষৎ, ১৮১৮ সালে মুন্ডকোপনিষৎ প্রকাশ করেন। মুন্ডকোপনিষৎ ছাড়া সবগুলো বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ ছাপা হয়। সে সময় বই কিনে পড়ার মতন মনোবৃত্তি মানুষের ছিল না সুতরাং বিনে পয়সা তিনি মানুষের মধ্যে বইগুলো বিলি করতেন। কিছু বই একাধিকবার ছাপা হয়েছিল। ৯ বছর চাকুরী করে বেশ অর্থ উপার্জন করার ফলে অর্থনৈতিকভাবে তিনি বেশ সমৃদ্ধশালী ছিলেন।

১৮১৬ সালে রামমোহনের গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ দেখে ইংরেজ পাদ্রীরা অবাক হোন। তারা রামমোহনের পরিচয় সেসময় ইউরোপে প্রচার করেন। যে বেদ শূদ্র সম্প্রদায় উচ্চারণ করলে জিহ্বা কেটে দেওয়ার রীতি ছিল সেই বেদ-কে সাধারণ মানুষের কাছে উন্মুক্ত করে দেন রামমোহন। আমরা এই ক্ষেত্রে স্মরণ করতে পারি-রাজা রবি ভার্মার কথা। দেবতার মন্দিরে শূদ্রদের জায়গা ছিল না। মন্দিরের দেবতাকে ছবির মাধ্যমে সকল মানুষের কাছে পৌঁছে দেন রাজা রবি ভার্মা। সর্বসাধারণের জন্যে বেদ ছড়িয়ে দেওয়ার ফলে রামমোহনের বিরুদ্ধে হিন্দু সমাজে চাঞ্চল্য ও উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন মাধ্যমে শুরু হয় নির্যাতন। তাই তো ইংরেজি বেদান্ত গ্রন্থের ভূমিকায় রামমোহন রায় লিখেন- ‘’আমি ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করে বিবেক ও সরলতার আদেশে যে পথ অবলম্বন করেছি তাতে আমার প্রবল কুসংস্কারাচ্ছন্ন আত্মীয়গণের তিরস্কার ও নিন্দার পাত্র হতে হল। কিন্তু ইহা যতোই হোক না কেন, আমি এই বিশ্বাসে ধীরভাবে সমস্ত সহ্য করতে পারি যে, একদিন আসবে, যখন আমার এই সামান্য চেষ্টা লোকে ন্যায় দৃষ্টিতে দেখবে। হয়তো কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করবেন। লোকে যাই বলুক না কেন, অন্তত: এই সুখ হতে আমাকে কেউ বঞ্চিত করতে পারবে না। আমার আন্তরিক অভিপ্রায় সেই পুরুষের নিকট গ্রাহ্য, যিনি গোপনে দর্শন করে প্রকাশ্যে পুরস্কৃত করবেন।” রামমোহনের ভবিষ্যৎ বাণী ব্যর্থ হয় নাই।

রামমোহনের বই ও বইয়ের অনুবাদের ফলে দেশে বিদেশে রামমোহনের নাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে। লন্ডন, ফ্রান্স, আমেরিকায়ও রামমোহন খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। সেই সাথে ভারতে রামমোহনের বিরুদ্ধে দেশে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়। ১৮১৩ সালে মাদ্রাজ গভর্নমেন্ট কলেজের প্রধান ইংরেজি শিক্ষক শঙ্কর শাস্ত্রী মাদ্রাজ কুরিয়ার পত্রিকায় রামমোহনের বিরুদ্ধে প্রতিমা পূজার সমর্থন করে একটি চিঠি লেখেন। তার উত্তরে রামমোহন A Defence of Hiduism বা হিন্দুধর্মের সমর্থন নামে একটি প্রতিবাদ গ্রন্থ রচনা করেন। সেই বইতে শঙ্কর শাস্ত্রী’র চিঠিরা পুনর্মুদ্রণ করা হয়। এছাড়া রামমোহনের বিরুদ্ধে আরো বহু গ্রন্থ রচনা করে তাঁর বিপরীত পক্ষ। যেমন: পণ্ডিত মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার রচিত- বেদান্তচন্দ্রিকা। রামমোহন প্রতিটি বই কিংবা লেখার বিপরীতে গ্রন্থ রচনা করেন এবং বিপক্ষের যুক্তি খণ্ডন করেন। এমনকি বিদ্যালঙ্কার যখন কদর্য ভাষায় রামমোহনকে আক্রমণ করেন তখনও রামমোহন তাঁর লেখার উদারতা ও মহানুভবতার পরিচয় দেন।

১৮২০ সালে রামমোহন প্রকাশ করেন তাঁর আরেক আলোচিত গ্রন্থ: জিশু খ্রিস্টের উপদেশ-শান্তি সুখের পথ (Precepts of Jesus-Guide to Peace and Happiness) এই নামে তিনি একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এতো দিন তিনি হিন্দু সমাজ ও ধার্মিকদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন এবার লিপ্ত হলেন খ্রিস্টান পাদ্রীদের বিরুদ্ধে। ইংরেজি শাসনে থেকে গ্রন্থ লিখে চ্যালেঞ্জ করার মাধ্যমে রামমোহন নিজের সাহসিকতা ও জ্ঞানের উচ্চতা সবার সামনে হাজির করলেন। তিনি শুধু বাইবেল কিংবা ওল্ডট্যাস্টামেন্টের ইংরেজি পড়েই ক্ষান্ত হয়নি তিনি গ্রিক ও হিব্রু ভাষাও আয়ত্ত করেন। হিন্দু সমাজ ইংরেজ শেখার প্রতি যতোটা আগ্রহী ছিল ততটা আবার ঘৃণা করতো খ্রিস্টান সমাজকে। ইংরেজদের সাথে খাবার খেয়ে অতীতে জাত নষ্ট করে সামাজিক বদনামের ভাগীদার তো অনেকেই হয়েছিলেন। বই প্রকাশের পর রামমোহনের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ঘৃণা ও বিদ্বেষ বাড়তে লাগল। অন্যদিকে মিশনারি কেরি ও মার্শম্যান সাহেবরাও বইয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকায় “ফেন্ড অব ইন্ডিয়া”য় তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ জানায়। তাদের বক্তব্য, রামমোহন জিশুর উপদেশ মান্য করেছে বটে কিন্তু জিশুর অলৌকিক ঘটনাগুলোকে অস্বীকার করেছেন। গোঁড়া খ্রিস্টানরা এতে খেপবে এটাই ছিল স্বাভাবিক। মার্শম্যানের লেখার প্রতিবাদে রামমোহন ১৮২০ সালে ‘সত্যের বন্ধু’ (A Friend of Truth) নাম নিয়ে An Appeal to the Christian Public নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। মার্শম্যান সাহেব আবার লিখলেন। তার জবাবে রামমোহন Second Appeal to the Christian Public লিখলেন। মার্শম্যান আবার লিখলেন। রামমোহনও এর পাল্টা লেখা লিখলেন কিন্তু ছাপাতে গিয়ে ঝামেলা বাঁধল। এতদিন ধরে ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস রামমোহনের সকল বই ছাপিয়ে আসলেও এবার তারা বইটি ছাপাতে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু রামমোহনও দমিবার পাত্র ছিলেন না। তিনি ‘ইউনিটেরিয়ান প্রেস’ নামে একটি প্রেস দিয়ে বসলেন। সেই প্রেস হতে ১৮২৩ সালে তাঁর Final Appeal (শেষ নিবেদন) ছাপা হল। শেষ গ্রন্থ তার মেধা ও পাণ্ডিত্য দেখে সবাই অবাক হল। রামমোহন স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিলেন মার্শম্যানের ভুল কোথায়। এরপর মার্শম্যান নীরব হলেন। এই তর্ক-বিতর্ক সম্পর্কে ‘ইন্ডিয়া গেজেট’এর ইংরেজি সম্পাদক লেখেন-“এই বিচারে এটি প্রতিপন্ন হল যে, রামমোহন রায় এদেশে এখনও তাঁহার সমতুল্য লোক প্রাপ্ত হয় নাই।”

সতীদাহ প্রথার শুরু ও পৌরাণিক আদর্শ:

গুপ্ত সাম্রাজ্যের (খৃষ্টাব্দ ৪০০) পূর্ব হতেই এ প্রথার প্রচলন সম্পর্কে ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যায়। গ্রিক দিগ্বিজয়ী সম্রাট আলেকজান্ডারের সাথে ভারতে এসেছিলেন ক্যাসান্ড্রিয়ার ঐতিহাসিক এরিস্টোবুলুস। তিনি টাক্সিলা (তক্ষশীলা) শহরে সতীদাহ প্রথার ঘটনা তার লেখনীতে সংরক্ষণ করেছিলেন। গ্রিক জেনারেল ইউমেনেস এর এক ভারতীয় সৈন্যের মৃত্যুতে তার দুই স্ত্রীই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সহমরণে যায়; এ ঘটনা ঘটে খৃষ্ট পূর্বাব্দ ৩১৬ সালে। মূলত: স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই পতির মৃত্যুতে স্ত্রী অগ্নিতে আত্মাহুতি দিত। পৌরাণিক কাহিনীতে এ আত্মাহুতি অতিমাত্রায় শোকের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই দেখা হত। মহাভারত অনুসারে পাণ্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রী সহমরণে যান কারণ মাদ্রী মনে করেছিলেন পাণ্ডুর মৃত্যুর জন্য তিনি দায়ী যেহেতু পাণ্ডুকে যৌন-সহবাসে মৃত্যুদণ্ডের অভিশাপ দেওয়া হয়েছিল। রাজপুতানায় “জহর ব্রত” প্রচলিত যাতে কোন শহর দখল হবার পূর্বেই পুরনারীরা আত্মসম্মান রক্ষার্থে আগুনে ঝাঁপ (বা জহর বা বিষ) দিয়ে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করতেন, যা সতীদাহের অনুরূপ। কিন্তু কালক্রমে বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে হিন্দু স্ত্রীকে সহমরণে বাধ্য করা হত। বিশেষ করে কোন ধনী লোকের মৃত্যুর সম্পত্তি অধিকার করার লোভে তার আত্মীয়রা তার সদ্যবিধবা স্ত্রীকে ধরে বেঁধে, ঢাক-ঢোলের শব্দ দ্বারা তার কান্নার আওয়াজকে চাপা দিয়ে তার স্বামীর সাথে চিতায় শুইয়ে পুড়িয়ে মারত।

সতীদাহ প্রথা রোধ আন্দোলন:

শুরুতে ইংরেজ শাসকরা এই প্রথা বিলুপ্তির জন্যে খুব বেশি আগ্রহী ছিল না। লর্ড কর্নওয়ালিস সতীদাহ প্রথা নিয়ে বলেন-হিন্দুশাস্ত্রের বিরুদ্ধাচরণ করে জোর-জবরদস্তি করে এটা বন্ধ করা সমীচীন হবে না। সতীদাহের মতন নৃশংস নারী-হত্যাকাণ্ড রামমোহন বাল্যকালে নিজের চোখের সামনেই দেখেন। ফলে এমন নিষ্ঠুর ধর্মীয় প্রথা তার হৃদয়ে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। বিধবা নারীকে ভাঙ্গ, চরস, ধুতুরা খাইয়ে জ্ঞান শূন্য করে চিতায় তোলা হতো। আর নারীর আর্তনাদ যাতে কেউ শুনতে না পায় তার জন্যে ঢোল বাজানো হতে। এমনও ঘটনা ঘটেছে আগুনের চিতায় থেকে কোন নারী উঠে গিয়ে নদীদের ঝাঁপ দিয়েছে। এমন কাণ্ডে চারদিকে হায় হায় ধ্বনি উঠত; হিন্দু ধর্ম রসাতলে গেল, কুলে কলঙ্ক পড়ল, শাস্ত্র অশুচি হল। তাই সবাই মিলে জোর করে আবার নদী থেকে সেই অর্ধ-পোড়া নারীকে তুলে এনে চিতায় তুলে দিত। ফলে ধর্ম রক্ষা পেত, কুলের সম্মান অক্ষুণ্ণ থাকত। এই ছিল সেই সময়কার সামাজিক ধর্মীয় প্রথা। ফলে রামমোহন এমন অনাচার প্রথার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। একবার কাশীম বাজার কুঠির সামনে রামচাঁদ পণ্ডিত নামের এক মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণের ১৮ বছরের বিধবা স্ত্রীকে সহমরণ দেয়া হয়। তখন ফ্রান্সিস রাসেল ছিলেন কুঠির অধ্যক্ষ। যুবতি বিধবা স্ত্রীকে জোর করে চিতায় ওঠানোর সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন, পলাশী যুদ্ধের সময়ের ব্রিটিশ সেনানায়ক হলওয়েল এবং তার স্ত্রী। তারা স্বচক্ষে এই করুণ দৃশ্য দেখে ব্যথিত হন। নিষ্ঠুর ধর্মানুরাগীদের প্রতি ইংরেজরা এরপর বিরক্ত হয়। এতে রামমোহনের আন্দোলন আরো বেগবান হয়। সতীদাহ প্রথার কথা রামমোহনের বন্ধু অ্যাডাম বিলেতের এক বক্তৃতায় উল্লেখ করেছিলেন-“আমি নিশ্চিত করে বলছি যে, ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় ইংরেজদের রাজ্য সংস্থাপনের শুরু হতে, গর্ভমেন্ট ও তার কর্মচারীদের চোখের সামনে প্রতিদিন অন্তত: সতীদাহ প্রথার সামে এমন দুইটি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতো এবং প্রতিবছর অন্তত: ৫-৬’শ অনাথ নারীকে এমনভাবে খুন করা হতো।” বাংলার গভর্নর লর্ড হামহাস্ট এর আমলে সতীদাহ করার ক্ষেত্রে তিনি কিছু শর্তযুক্ত নিয়ম চালু করেন। সেগুলো হচ্ছে : কোনো সহগমনার্থীনি বিধবাকে স্বামীর দেহের সঙ্গে ছাড়া অন্য কোনোভাবে দগ্ধ করা যাবে না। সহগমনার্থীনি বিধবাদের স্বয়ং ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে এসে অনুমতি নিতে হবে সহমরণের জন্য। অন্যের দ্বারা দরখাস্ত দিয়ে অনুমতি নিলে চলবে না। সতীর সহমরণে সহায়তাকারী কোনো ব্যক্তি সরকারি চাকরি পাবে না। সহমৃতার কোনো সম্পত্তি থাকলে সরকার তা বাজেয়াপ্ত করে সরকারি সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করবে।

শেষ পর্যন্ত সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত করার জন্যে এগিয়ে আসেন লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক। ১৮২৮ সালে জুলাই মাসে তিনি ভারতের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হোন। রামমোহন ১৮১৮ সালে সতীদাহের বিরুদ্ধে প্রথম গ্রন্থ রচনা করেন। এবং এর ইংরেজি অনুবাদ বাহির করেন। তিনি প্রমাণ করে দেখান যে এই প্রথা শাস্ত্র বিরোধী। রামমোহনের এসব কর্মকাণ্ডের ফলে হিন্দু গোঁড়া সমাজ আবার তার বিরুদ্ধে খড়গহস্ত হল। রামমোহন শুধু বই লেখা কিংবা ইংরেজদের এই প্রথার বিরুদ্ধে আইন করার জন্যে কাজ করেননি। তিনি নিজের বন্ধুদের নিয়ে একটি দল গঠন করলেন। তারা সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার জন্যে শ্মশানে ছুটে যেতেন। মানুষকে এই প্রথার বিরুদ্ধে বোঝাতে চেষ্টা করতেন। আর এই কাজ করতে গিয়ে তাঁকে অনেক লাঞ্ছনা, অপমান ভোগ করতে হয়েছে। তারপরও তিনি থেমে থাকেননি।

লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক পূর্বেই রামমোহন ও তাঁর দলের সমর্থন লাভ করলেন এবার তিনি সতীদাহ প্রথা চিরতরে বন্ধ করার আগে তার অধীনে থাকা সেনাপতিদের মনোভাব জানতে চাইলেন। কারণ এমন প্রথা বন্ধ করার জন্যে তলোয়ারের উপরও নির্ভর করতে হবে। ৪৯ জন সেনাপতি অভিমত প্রকাশ করলেন যে, সতীদাহ প্রথা বন্ধ হলে সেনাদলের মধ্যে কোন রকম চাঞ্চল্য উপস্থিত হবে না। তাদের মধ্যে ২৪ জন অবিলম্বে সতীদাহ প্রথা বন্ধের পক্ষে মতপ্রকাশ করলেন। মাত্র ৫ জোন কোন পরিবর্তনের ইচ্ছা পোষণ করলেন না। বিচার বিভাগের মধ্যে ৪ জন সতীদাহ প্রথা বন্ধের পক্ষে মতামত দিলেন। পুলিশও এই প্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নিল। এরপর বেন্টিক আর দেরি না করে ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর সতীদাহ প্রথা নিষেধ করে আইন জারী করলেন। এর ফলে হিন্দু সমাজে যেন একটা বোমা বিস্ফোরিত হল। চারদিকে তোলপাড় শুরু হল। গোঁড়া হিন্দুরা এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাল। কলকাতায় বিশিষ্ট পণ্ডিতসহ মোট ৮০০ অধিবাসীর নাম স্বাক্ষরসহ এক আবেদন গভর্নর জেনারেলের কাছে হাজির করে সতীদাহ রদ আইন প্রত্যাহারের আবেদন জানানো হল। অন্যদিকে ৮০০ জন খ্রিস্টান ও ৩০০ জন অধিবাসীর স্বাক্ষরযুক্ত অভিনন্দন-পত্র রামমোহন ও তাঁর গ্রুপ বেন্টিঙ্ক সাহেবকে পাঠালেন এবং প্রকাশ্য সভায় অভিনন্দিত করলেন। গোঁড়া হিন্দু সমাজ সতীদাহ রদ আইনে বাতিল করার জন্যে সবাই একজোট হল। রাতারাতি তারা ‘ধর্মসভা’ প্রতিষ্ঠা করল। প্রথম দিনের মিটিংয়ে তাদের চাঁদা উঠল ১১, ২৬০ টাকা! তাদের পত্রিকা ‘সমাচার চন্দ্রিকা’য় রামমোহনের বিরুদ্ধে লেখালেখি বাড়িয়ে দিল। এর প্রতিবাদস্বরূপ রামমোহন ১২৮ জন পণ্ডিতের মত খণ্ডন করে সহমরণ বিষয়ক তৃতীয় প্রস্তাব প্রকাশ করলেন। গোঁড়া হিন্দুরা যখন বুঝল ভারতবর্ষে এই আইন রদ হওয়ার আর কোন সুযোগ নাই তাই তারা বিলেতের পার্লামেন্টে আপিল করে বসলেন। রামমোহনের বিলেত যাওয়ার একমাত্র কারণ পার্লামেন্টে যাতে এই রদ না করা হয় সেই চেষ্টা করা। ১৮৩৩ সালে বিল পাশ হল, ধর্মসভার আপীল অগ্রাহ্য হল। বাংলার বুক হতে মর্মভেদী করুণ আর্তনাদ চিরদিনের জন্যে অতল গর্ভে লীন হয়ে গেল।

বহু বিবাহ রোধ ও নারীর সম্পত্তি লাভের জন্যে সংগ্রাম:

পূর্বেই উল্লেখ করেছি রামমোহন নারীদের সবসময় সম্মানের চোখে দেখতেন। বহুবিবাহকে নারীর কলঙ্ক হিসেবে তিনি দেখতেন। তাই তিনি ভারতীয় নারীদের রক্ষার জন্যে শুধু সতীদাহ পথা রদ করেননি, নারীদের সম্মান রক্ষার জন্যে বহু বিবাহের বিরুদ্ধেও সংগ্রাম করেন। বহু বিবাহ বন্ধের জন্যে তিনি রাজবিধির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। কারণ ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ সমাজ বেশি অর্থ পেয়ে নিজেদের কন্যাকে রূগ্ন, বৃদ্ধ, বিকলাঙ্গের নিকট বিয়ে দিত। ফলে ঐ মেয়েদের দুর্দশার সীমা থাকত না। এছাড়া হিন্দু নারীরা সমাজে আরো বেশি অসহায় হওয়ার কারণ ছিল সম্পত্তির অধিকারী না হওয়া। রামমোহন নারীর সম্পত্তি লাভের জন্যে আন্দোলন শুরু করেন। তিনি শাস্ত্র ঘেঁটে বলেন- প্রাচীন ঋষিগণ ব্যবস্থা করেছিলেন যে, মৃত-স্বামীর সম্পত্তিতে পুত্রের সাথে স্ত্রীও সমান অধিকারী। একাধিক পত্নী থাকলেও তারা সবাই সমানভাবে সম্পত্তির অংশীদার। সম্পত্তির অধিকারহীন বিধবার নারীর জীবনকে তিনি মৃত্যুর চেয়ে আরো বেশি যন্ত্রণাদায়ক হিসেবে উল্লেখ করেন। পুরুষের সম্পত্তির অধিকার তার ছেলে কিংবা ছেলে মারা গেলে পুত্র বধূ পেলেও নিহতের স্ত্রী’র জন্যে কোন সম্পত্তির অধিকার ছিল না। যদি নিহতের স্ত্রী’র জন্যে সম্পত্তির অধিকার থাকে তাহলে পুরুষ বহু বিবাহ ইচ্ছাটা অনেকখানি হ্রাস হতো। হিন্দু নারীদের জ্বলন্ত চিতা থেকে উদ্ধার, বহু বিবাহ থেকে মুক্তি ও সম্পত্তি লাভের জন্যে রামমোহন যে সংগ্রাম করেছেন তার জন্যে হিন্দু সমাজের নারীরা বিশেষভাবে রামমোহনের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা আবশ্যক।

বিলেত গমন ও শেষ শেষ জীবন:

ভারতীয় সমাজে শিক্ষা বিস্তার, বাংলা গদ্যের বিস্তার ও সমাজে ধর্মের নামে যেসব অনাচার হতো সবকিছুর বিরুদ্ধে রামমোহন আজীবন সংগ্রাম করে যান। রাজা রামমোহনের জীবনের শেষ তিন বছর কেটেছিল ইংল্যান্ডে। বিলেত যাওয়ার আগে ১৮২৯ সালে তিনি দিল্লীর বাদশাহ থেকে রাজা উপাধি লাভ করেন। বিলেত যাওয়ার আগে তাঁর আত্মীয়-স্বজন তাকে বাঁধা দেয় কারণ সেই যুগে দেশের শাস্ত্র অনুযায়ী সমুদ্রযাত্রা চিরতরে নিষিদ্ধ ছিল।রামমোহন প্রথম ব্যক্তি যিনি এসব অযৌক্তিক প্রথাকে উপেক্ষা করে বিলেত গমন করেন। সে সময় তাঁর সঙ্গী ছিলেন তাঁর পালিত পুত্র,  রামরত্ন মুখোপাধ্যায় নামে পাচক ব্রাহ্মণ এবং রামহরি নামে ভৃত্য। ১৮৩৩-এর ২৭ সেপ্টেম্বর ব্রিস্টলে তাঁর মহাপ্রয়াণ হয়। তখন তার বয়স হয়েছিল ৫৯ বছর। মৃত্যুর আগে খ্রিস্টান সমাধিস্থলে তাকে সমাহিত না করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। পরে তাকে স্টাপেল গ্রোভ-এর নির্মাণ স্থানে সমাহিত করা হয়। দশ বছর পর প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর বিলেতে গিয়ে আরনস ভেল নামক স্থানে পুনঃ-সমাধিস্থ করে সেখানে একটি ব্রাহ্ম মন্দির স্থাপন করে দেন। তবে এটা সত্য যে, রামমোহনের ‘ব্রাহ্ম সমাজ’ তাঁর মৃত্যুর পর হিন্দু ধর্মের বাইরে যাওয়ার ঘোষণা না দিলেও হিন্দু ধর্মের মধ্যেও থাকেনি।

রাজা রামমোহন রায়ের একটি ব্রহ্ম সংগীত:

সাহানা। ধামার

ভয় করিলে যাঁরে না থাকে অন্যে ভয়।

যাঁহাতে করিলে প্রীতি জগতের প্রিয় হয়।।

জড় মাত্র ছিলে, জ্ঞান যে দিল তোমায়,

সকল ইন্দ্রিয় দিল, তোমার সহায়;

কিন্তু তুমি ভোল তাঁরে, এ তো ভালো নয়।।

 

রামমোহনের গ্রস্থ সমূহ:

বেদান্ত গ্রন্থ (১৮১৫), বেদান্তসার (১৮১৫), তলবকার উপনিষৎ (১৮১৬), ঈশোপনিষৎ (১৮১৬), উৎসবানন্দ বিদ্যাবাগীশের সহিত বিচার (১৮১৬), ভট্টাচার্য্যের সহিত বিচার (১৮১৭), কঠোপনিষৎ (১৮১৭), মান্ডূক্যোপনিষৎ (১৮১৭), গোস্বামীর সহিত বিচার (১৮১৮), সহমরণ বিষয় প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের সম্বাদ (১৮১৮), গায়ত্রীর অর্থ (১৮১৮), মুন্ডকোপনিষৎ (১৮১৮), সহমরণ বিষয়ে প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের দ্বিতীয় সম্বাদ (১৮১৮), আত্মানাত্মবিবেক (১৮১৯), কবিতাকারের সহিত বিচার (১৮২০), সুব্রহ্মণ্য শাস্ত্রীর সহিত বিচার (১৮২০), ব্রাহ্মণ সেবধি (১৮২১), চারি প্রশ্নের উত্তর (১৮২২), প্রার্থনাপত্র (১৮২৩), পাদরি ও শিষ্য সম্বাদ (১৮২৩), পথ্য প্রদান (১৮২৩), ব্রহ্মনিষ্ঠ গৃহস্থের লক্ষণ (১৮২৬), কায়স্থের সহিত মদ্যপান বিষয়ক বিচার (১৮২৬), বজ্রসূচী (১৮২৭), গায়ত্র্যা ব্রহ্মোপাসনাবিধানং (১৮২৭), ব্রহ্মোপাসনা (১৮২৮), ব্রহ্মসঙ্গীত (১৮২৮), অনুষ্ঠান (১৮২৯), সহমরণ বিষয় (১৮২৯), গৌড়ীয় ব্যাকরণ (১৮৩৩)

(জীবনী ও রচনা -রাজা রামমোহন রায় বই থেকে)