হ্যাঁ। অভিজিৎ রায়কে আমি কোন বিশেষণে বিশেষিত না করেই একজন, শুধুই একজন অভিজিৎ রায় বলেই বিবেচনা করলাম শিরোনামে। সেই একজন অভিজিৎ রায়কে মুক্তমনা, লিখক, গবেষক, প্রাবন্ধিক, বাংলাদেশে মুক্তচিন্তা আন্দোলনের পথিকৃত ও সংগঠক ইত্যকার পরিচয়ে পরিচিত না করলেও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মেধাবী ছাত্র এবং প্রভাষক, বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংএ স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি, তাঁর এই পরিচয়টুকুই তাকে রাষ্ট্রের সম্পদে পরিণত করে। উপরোন্ত, তিনি আমাদের কাছে একজন মুক্তমনা লেখক, মুক্তচিন্তা আন্দোলনের পথিকৃত এবং আইকন হিসেবেই আমাদের কাছে পরিচিত।

অভিজিৎ রায়, আমেরিকায় থাকা অবস্থায়ই হুমকী পাচ্ছিলেন যে দেশে ফিরলেই তাকে হত্যা করা হবে। একজন মানুষকে যখন হত্যার হুমকী দেয়া হয়, তখন তাকে রক্ষা করার উদোগ নেয়াটা রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যেই এসে পড়ে। আমি জানি না, অভিজিৎ রায় তাঁর নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন কি না ( চাইলেও সাহায্য পাওয়া যায় না), কিন্তু একজন গবেষক, লেখক, প্রকৌশলীকে নিরাপত্তার দায়িত্বের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে স্বপ্রনোদিত হওয়াটাই স্বাভাবিক নয় কি? হ্যাঁ, রাষ্ট্র কতজন লেখক, গবেষকের দায়িত্ব নেবে, এই প্রশ্নটা আসতে পারে। কিন্তু অভিজিৎ রায়ের ক্ষেত্রে গড়পড়তা হিসেব কতটুকু প্রযোজ্য? অভিজিৎ রায় কি আর দশজন লেখকের মতই ছিলেন? তিনি কি আর দশটা বুদ্ধিজীবীর মতই ছিলেন? দেশের আর দশজন বুদ্ধিজীবী যেখানে বুদ্ধি বিক্রির মাধ্যমে উদরপূর্তির ব্যবস্থায় ব্যস্ত, সেখানে অভিজিৎ রায় ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর ব্রত নিয়ে দেশকে এগিয়ে নেবার স্বপ্ন দেখতেন। এমন ব্রতী পুরুষটির অবদানগুলো তো রাষ্ট্রের অজানা থাকার কথা না! স্বপ্রনোদিত হয়ে তাঁকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা প্রদান কি রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়েনি?

সঠিক তথ্য আমার জানা নেই, স্বাধীনতা উত্তর কতজন বুদ্ধিজীবী গবেষক নিঃস্বার্থভাবে দেশকে কিছু দেবার জন্য, তরুণ প্রজন্মকে জ্ঞানের সিড়িতে আরোহণের ব্রত নিয়ে কাজ করেছেন। যে বা যারাই করে থাকুন না কেন, তাদের অবদানের কাছে, একজন অভিজিৎ রায়ের প্রচেষ্টাটুকুই নক্ষত্র সমান। কারণ, অভিজিৎ রায় দেশের মানুষকে শুধুই মানুষ পরিচয়ে পরিচিত করাতে চেয়েছিলেন। অভিজিৎ রায় একটা সুন্দর দেশের স্বপ্ন দেখতেন, তাঁর কাছে হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সকলে শুধুই মানুষ পরিচয়ে পরিচিত হতো। অভিজিৎ রায়ের স্বপ্ন ছিলো রাষ্ট্রের নাগরিকদেরকে ধর্মের ভিত্তিতে নয়, মানুষ পরিচয়ে প্রতিষ্ঠা করা। একটা সত্যিকার সেক্যুলার রাষ্ট্র বিনির্মানের ব্রত ছিলো তাঁর। এই স্বপ্নের পেছনে তাঁর কোন ব্যক্তিগত স্বার্থ কাজ করতো না, ছিলো না কোন খ্যাতির মোহ।

উপরন্তু, অভিজিৎ আর দশজন নাস্তিকের মতও ছিলেন না। আমাদের দেশের অধিকাংশ নাস্তিক (আমিও) ধর্ম বিরুদ্ধতার পাশাপাশি ধার্মিকদের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনে কার্পন্য করেন না। এটা কজন নাস্তিক অস্বীকার করবেন জানি না, বিশ্বাসের ভাইরাসে আক্রান্তদেরকে আমরা অনেকটাই নিজেদের শত্রুভাবাপন্ন মনে করি। কিন্তু, অভিজিৎ রায় ছিলেন এমন এক ব্যক্তি যিনি ধর্মবর্ন নিঃশেষে সকলকেই মানুষ মনে করতেন। তিনি দীপ্ত কন্ঠে বলেছেন, “আমি নাস্তিক। কিন্তু আমার আশে পাশের বহু কাছের মানুষজন বন্ধু বান্ধবই মুসলিম। তাদের উপর আমার কোন রাগ নেই, নেই কোন ঘৃনা। তাদের আনন্দের দিনে আমিও আনন্দিত হই। তাদের উপর নিপীড়ন হলে আমিও বেদনার্ত হই। প্যালেস্টাইনে বা কাশ্মীরে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর অত্যাচার হলে তাদের পাশে দাঁড়াতে কার্পণ্য বোধ করি না। অতীতেও দাঁড়িয়েছি, ভবিষ্যতেও দাঁড়াবো। এটাই আমার মানবতার শিক্ষা”। হায় অকর্মন্য রাষ্ট্র, এমন একজন মানবতাবাদী অভিজিৎ রায়কে রক্ষা করার কোন উদ্যোগই গ্রহন করলে না! দেশের এমন একটা রত্নকে ধর্মান্ধ পশ্চাদপদ জঙ্গিদের হাত থেকে রক্ষা করার কোন ব্যবস্থাই নিলে না! দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো, নিরাপত্তা সংস্থাগুলো কাজীর গরু হয়েই থাকলো!

এটা দিনের আলোর মত পরিষ্কার যে অভিজিৎ রায়কে হারানোর ক্ষতি এদেশ, এদেশের প্রগতিশীল আন্দোলনের কর্মীগণ কখনোই পুষিয়ে নিতে পারবে না। তবু মনকে প্রবোধ দেয়া যেতো যদি অথর্ব রাষ্ট্র অভিজিৎ হত্যার বিচার করতে পারতো, হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে বিচার সম্পন করতো। আসছে ২৬ ফেব্রুয়ারী অভিজিৎ হত্যার এক বছর পূর্ণ হবে। আফসোস থাকতো না, যদি অন্তত একজন খুনীকেও সরকার গ্রেফতার করতে পারতো। গ্রেফতার দূরে থাক, এখনও হত্যাকান্ডের তদন্তই শেষ করতে পারেনি, কোন ক্ল্যু উদঘাটন করতে পারেনি পুলিশ, গোয়েন্দাগুলো এখনও নির্বিকার।

বিচার দূরে থাক, রাষ্ট্র নাস্তিক হত্যাকে বরং বৈধতাই দিয়ে যাচ্ছে। অভিজিৎ হত্যার পর পর বিবিসির সাথে স্বাক্ষাতকারে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা এবং একমাত্র ছেলে ( রাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের দেশে হয়ত ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রীও) স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে এটা হলো স্পর্শকাতর ইস্যু। রাষ্ট্রের এমন গুরুত্বপুর্ন ব্যক্তি যদি এমন মনোভাব পোষন করেন, তাহলে বুঝতে বাকী থাকে না যে অভিজিৎ হত্যা বিচারের আশায় গুড়েবালি হয়ে গেছে। তবুও আমরা মুক্তমনারা আশায় বুক বেধেছিলাম। কিন্তু যেই লাউ সেই কদু, দেশে একের পর এক ব্লগার হত্যা জঙ্গিদের রুটিনওয়ার্কে পরিনত হয়েছে। একেকজন ব্লগার হত্যা হয়েছে, রাষ্ট্র অকর্মন্য বেহায়ার মত, দাঁত কেলিয়ে তাঁর ব্যর্থতার কথা মিডিয়ার সামনে উচ্চারণ করেছে। তাও, মেনে নেবার মত ছিলো, কিন্তু যখন উলটো লিখালিখির জন্য সীমারেখা টেনে দিয়েছে, উস্কানীর সবক হাতে ধরিয়ে দিয়েছে, তখন আসলেই নিজের চুলকে নিজেই ছিড়ে ফেলা ছাড়া অন্য উপায় পাওয়া যায় না।

রাষ্ট্রের কথা না হয় বাদ, রাষ্ট্র তাঁর পশ্চাৎ দেশ হয়ত মৌলবাদীদের কাছে ভাড়া দিয়ে রেখেছে। রাষ্ট্রের কাছ থেকে অভিজিৎ রায় ও অন্যান্য ব্লগার হত্যার বিচার আশা করাটা হয়ত দুরাশা, কিন্তু আমাদের কি কিছুই করণীয় ছিলো না? নেই? আমরা কি করতে পেরেছি? আমাদের কি কোন দায়ই নেই? আমরা দুয়েকদিন গদবাধা প্রতিবাদ আর শুধু দুয়েকটা সমাবেশ মিছিল করেই ক্ষান্ত দিয়েছি। বিচার প্রাপ্তির আগেই ঘুমিয়ে গিয়েছি আবার। যেখানে প্রতিবাদের ফুলকি দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে দেবার কথা ছিলো, সেখানে আমরা নিজেরাই ঝিমিয়ে গিয়েছি। উপরন্তু, নিজেদের নিরাপত্তার জন্য ব্যস্ত হয়ে গিয়ছি। হ্যাঁ, অস্বীকার করার উপায় নেই যে আমাদের নিরাপত্তার দিকটাও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, আমরা যদি নিজেরা সংগবদ্ধ হতে পারতাম, সংগবদ্ধ থাকতাম তাহলে আজকে বিচারহীন সংস্কৃতি আমাদেরকে গ্রাস করতো না। এবং এটা আমার বিশ্বাস সংবদ্ধ থাকলে হত্যাকান্ডগুলো ঘটানোর মত সাহসও জঙ্গিরা পেতো না, অন্তত সিরিয়াল কিলিং এর মত হত্যাকান্ডগুলো হতো না।

যাই হোক, অভিজিৎ দা সহ অন্যান্য সহযাত্রী খুনের বিচারের আশা যতটুকু পারি জিইয়ে রাখতে চাই এবং সাথে সাথে আমি মনে করি শহীদদের অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পাদনের জন্য আমাদেরকেও দায়িত্ব নিতে হবে। তাদের অসমাপ্ত কাজকে এগিয়ে নিতে গেলে (আমি আগেও একটা পোস্টে মুক্তমনায় লিখেছি) আমাদেরকে সংগবদ্ধ হতে হবে সবার আগে। প্রথম কাজ হবে নিজেরা সংগবদ্ধ হয়ে দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সমমনাদেরকে একটা ছাতার নিচে নিয়ে আসা। আমরা যদি আগে থেকেই সংগবদ্ধ থাকতাম, দেশের প্রতিটা স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তমনাদের একটা করে সংগঠন থাকতো, তাহলে আজকের এই বিচারবিহীন সংস্কৃতি আমাদেরকে গ্রাস করতে পারতো না, হয়ত হত্যাকাণ্ডগুলোই হতো না।

আবারও বলবো সংগবদ্ধ হওয়া ছাড়া আমাদের কোন বিকল্প নেই। এবং সংগবদ্ধ হবার পথে বাঁধাও আসবে এবং সেই বাঁধাকে ডিঙিয়েও যেতে হবে। শেষ করছি অভিজিৎ দার কথা দিয়ে, “ যারা ভাবে বিনা রক্তে বিজয় অর্যিত হয়ে যাবে তাঁরা বোকার স্বর্পে বাস করছেন। ধর্মান্ধতা, মৌলবাদের মত জিনিস নিয়ে যখন আমরা যখন লিখা শুরু করেছি, জেনেছি জীবন হাতে নিয়েই লিখালিখি করছি…”। অভিজিৎ দার কথা তাঁর নিজের জীবনের বিনিময়ে প্রমাণিত হয়েছে, আমরা নিজেদের জীবন উতসর্গ করার জন্য প্রস্তুত তো?