এক.
অভিজিৎ রায়কে নিয়ে লিখতে বসে বারবার উঠে যেতে হয়। এক বছর ধরে এভাবে পালিয়েই বেড়াচ্ছি। কি করবো? দুই লাইনের পর তিন লাইনে এসেই চোখ জ্বালা করে, ঝাপসা হয়ে আসে। নিজেকে অপরাধী মনে হয়। হাত কাঁপে। অসহ্য যন্ত্রণা হয় নিজের ভেতরে। গত একটা বছর ধরে অনেক পাতা ভরে ভরে লিখেছি। আবার পুরোটাই ট্রাশ বক্সে ফেলে দিয়ে এসেছি। আজকের একজন আরিফের “আরিফ রহমান” হয়ে ওঠার পেছনে যে নামটা সবার আগে উচ্চারিত হওয়া উচিত সেই নামটা অভিজিৎ রায়ের। আমার গুরুজি। আমাকে রাস্তা থেকে তুলে আনা আমার ভাই।
অনলাইনে গত ৪-৫ বছরে আমি যদি সত্যিকার অর্থে কোন কিছু করে থাকি তাহলে সেই জায়গাটা এক কথায় যে মানুষটি আমাকে করে দিয়েছেন তাঁর নাম অভিজিৎ রায়। আমার বড় সৌভাগ্য তাঁর সাথে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বড় বড় দুটো পাঠক নন্দিত প্রবন্ধ লেখার সুযোগ হয়েছিলো আমার। আমার বড় গর্ব হয়, আমি ছিলাম তাঁর সর্বকনিষ্ঠ সহ-লেখক। দাদার সাথে আমার প্রথম লেখার নাম ছিলো- “কাদের মোল্লার আসল নকলঃ একটি নির্মোহ অনুসন্ধান”।
২০১৩ সালের ১২ই ডিসেম্বর মিরপুরের কসাই কুখ্যাত রাজাকার কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। সেই ফাঁসির রায় কার্যকর হবার পর থেকেই জামাত-শিবির-বাঁশেরকেল্লা তাদের নির্লজ্জ মিথ্যাচারে নেমে পড়ে। এই কাদের মোল্লা নাকি আসলে কসাই কাদের না, কত রকম তাদের যুক্তি। কিছু মানুষ এইসব অসত্যকে বিশ্বাস করতে শুরু করে দেয়।
কাদের মোল্লার আসল নকল: একটি নির্মোহ অনুসন্ধান
সেদিন আমি আর অভিজিৎ’দা মিলে একটা উপসম্পাদকীয় লিখেছিলাম বিডিনিউজের জন্য। জামাত-শিবির-বাঁশেরকেল্লার সমস্ত বিভ্রান্তি, ফুট থিওরি, রনির চিরকুট আর মোল্লার স্ত্রীকে লেখা প্রেম পত্রের বিপরীতে যেমন আমরা খুঁজে বের করেছিলাম কাদের মোল্লার সহপাঠীর মোজাম্মেল চাচার ফেসবুক স্ট্যাটাস- যিনি এখনও জীবিত আছেন, ফেসবুকেই তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। আমরা পড়ে দেখেছিলাম কাদের মোল্লার জাজমেন্ট সেখান থেকে প্রচুর যুক্তি পেয়েছিলাম। নিঝুম মজুমদার খুঁজে দিয়েছিলেন কাদের মোল্লার সাথে নিয়াজীর ছবির সাথে তুলনামূলক ছবিটি। আমরা খুঁজে বের করেছিলাম কাদের মোল্লার হাতে ধর্ষণের শিকার মোমেনা বেগমের ভিডিও সাক্ষ্য। শাহবাগের ফটোশপ ক্যারিকেচার উন্মুক্ত করে দেয়া দিগন্ত বাহারের ব্লগ পোষ্ট জুড়ে দেয়া হয়েছিলো। সব মিলিয়ে সে এক এলাহি কারবার।
সেই লেখাটি ছিলো এখন পর্যন্ত আমার জীবনে সবচেয়ে ইনফরমেটিভ কোন লেখা। লেখাটা পঞ্চাশ হাজারের বেশী শেয়ার হয়েছিলো শুধু ফেসবুকেই। বিডি নিউজের সম্পাদিকা আমাকে জানিয়েছিলেন এটা ছিলো সর্বকালের সর্বাধিক পঠিত রচনাগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। লেখাটি মুক্তমনায় দেয়ার পর সেটা এত জনপ্রিয়তা পায় যে তখনকার মুক্তমনার সর্বাধিক পঠিত দশটা ব্লগের একেবারে প্রথম স্থান দখল করে নেয় অনেকদিন ধরে।
এরপর ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি আসলো। দাদার আগের লেখার সূত্র ধরে আমার কাছে বিডি নিউজ থেকে লেখা চাওয়া হয়, নিয়মিতই লিখছি। ফেব্রুয়ারি আসতেই চিন্তা করলাম ‘এই কাদের মোল্লা সেই কাদের মোল্লা না’- এই মিথ আমরা যে বলিষ্ঠ ভাবে খণ্ডন করেছি সেরকম ভাবে আরেকটি মিথ চিরকালের জন্য মীমাংসা করা উচিত। ফেব্রুয়ারি আসলেই দেখা যায় জামাত-শিবির-বাঁশেরকেল্লা প্রচারণা শুরু করে গোলাম আযম নাকি ভাষা সৈনিক। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতেও একই কায়দায় জামাত-শিবির-বাঁশেরকেল্লা একই কায়দায় তাদের প্রচারণা শুরু করে। এদিকে আমি তখন পড়ছি গোলামের আত্মজীবনী “জীবনে যা দেখলাম”। সেই বই পড়ে দেখি পাতায় পাতায় বাংলা ভাষাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কথা বার্তা লেখা। অভিদাকে বললাম- “দাদা এইটাও স্যাটেল করে দেয়া দরকার”। দাদা রাজি হলেন। যেই ভাবা সেই কাজ। লেখা হয়ে গেলো গোলামের ভন্ডামির উপযুক্ত জবাব দিয়ে- “ভাষা সৈনিক গোলাম আযমঃ একটি গোয়েবলসীয় প্রচারণার ব্যাবচ্ছেদ”। ছাপা হলো বিডি নিউজে। অসংখ্য মানুষের ভালো লাগা আর ভালোবাসায় সিক্ত হলাম। আমি সাহসি হয়ে উঠতে লাগলাম।
‘ভাষাসৈনিক গোলাম আযম’: একটি গোয়েবলসীয় প্রচারণার ব্যবচ্ছেদ
…এরপর সাহস বেড়ে গেলো। গনহত্যা নিয়ে মুক্তমনায় সিরিজ ব্লগের শুরু করে দিলাম, শিরোনাম “তিরিশ লক্ষ শহিদঃ বাহুল্য নাকি বাস্তবতা”। ছবি, তথ্য, প্রমাণ আর রেফারেন্সের সংকলন করতে গিয়ে আমার জান যায় যায় অবস্থা। প্রায়ই ভুল-ভাল পোষ্ট করি। ছবির সাইজ ঠিক থাকে না, এলাইনমেন্ট ঠিক থাকে না, লেখায় ভুল করি, রেফারেন্স দিতে ভুল করি, এক পর্বের শেষে আরেক পর্ব যুক্ত করতে পারি না। সেভাবেই ব্লগ পোষ্ট করে দিয়ে চলে আসি। কিছুদিন পরে ঢুকে দেখি কে যেন খুব যত্ন করে ভুল গুলো সংশোধন করে দিয়েছে।
সেই উষ্ণ বড় ভাইটার শূন্যতাকে বড় অনুভব করি…
দুই.
২০১৫ সাল।
সাহস আরও বেড়েছে।
এবারে বই বের করার পালা।
তারিখটা ২৬-১-২০১৫
অবশেষে সেই মেইলটা আসলো [email protected] থেকে।
আমার বইয়ের ভূমিকা চলে এসেছে…
তারও হপ্তা খানেক আগের কথা। আমার ইয়ার ফাইনাল পরিক্ষা চলছে দুর্দান্ত প্রতাপে, আমি পরীক্ষা দিচ্ছি দেয়ার জন্য- কিন্তু মন পড়ে আছে কাঁটাবনে নান্দনিকের প্রেসে। আমার স্বপ্নপূরণের কাজ চলছে ওখানে। শুভ’দা মাঝে মাঝে সাবধানে (পাছে পরীক্ষা খারাপ হয়) ফোন করে বিভিন্ন তথ্যের ভুলত্রুটির কথা বলেন। আমরা ফোনে ফোনেই উত্তর খুঁজি- আমাকে একটা বারও কাঁটাবনে আসতে হয় না। শুধু ফেসবুকের ইনবক্সের ভেতর দিয়েই এত্তবড় একটা বইয়ের কাজকর্ম কিভাবে শেষ হয়ে গেলো সেটা এক মহা বিস্ময়। একদিন শুভ’দার সাথে আমার সেই সময়ের ইনবক্স নিয়ে লিখতে হবে। একবছর আগে থেকে ধীরে ধীরে লেখা ব্লগগুলো বই হয়ে ওঠা সেই ব্লগগুলো গড়ে ওঠার গল্প তার পেছনের আরেক গল্প- সব গল্পের পেছনের একজন শুভ’দার নামটা মনে হয় একেবারে অনুচ্চারিত রয়ে গেলো।
আমার কম্ম পাণ্ডুলিপিতে রুপান্তরিত হবার পর আরও কিছু ব্যাপার এসে গেলো। একটা ভূমিকা দরকার- এইদিকে মেলাও শুরু হবে হবে করছে। শুভ’দা বললেন “তোর সাথে বিখ্যাত কার পরিচয় আছে… কারে দিয়া লেখানো যায়…?” অনেক আলাপ আলোচনা চিন্তা-ভাবনা করে দেখলাম সেরকম একজনই আছেন যিনি আগ্রহ নিয়ে কাজটা করে দেবেন এবং যিনি কাজের মাত্রাটা বুঝতে পারবেন এক পলকে। সেই মানুষটা অভিজিৎ রায়।
দাদাকে পান্ডুলিপি ফেসবুকের ভেতর দিয়েই পাঠিয়ে দিলাম। উনি একটা একটা করে বানান ভুল ইনবক্স করা শুরু করলেন। তারপর অত্যাধিক বানান ভুলের মাত্রা দেখে সেই কাজ ছাড়লেন, যদিও শেষ পর্যন্ত বইটা মোটামুটি নির্ভুলই বের হয়েছিলো।
রিভিউ দিলেন জানুয়ারির ২৬ তারিখ, সেদিন কথা বলতে বলতে বললেন-
“ভালো হইব বইটা…
পারলে শাহরিয়ার কবির কিংবা আনিসুজ্জামান
বা এধরণের কাউরে দিয়া রিভিউ করাইয়ো।”
আমি বললাম-
“ধুর কাউরে লাগবো না।
আপনে একটা রিভিউ কইরেন বের হওয়ার পর…
তাইলেই হিট…
দাদা বললেন-
“ধুর মিয়া;
ভূমিকা লিখমু রিভিউও করমু…
সব আমি করলে পিটাইবো পাবলিক…
এটলিস্ট পিয়াল বা নিঝুমরে বইল…”
এরপর বই নিয়ে আরও অনেক আলোচনা হয়েছিলো। বইটা তাঁর হাতে তুলে দেয়ার সৌভাগ্যও হয়েছিলো। আমাকে রিভিউটা দেয়ার ঠিক এক মাস পর যখন তাঁকে মেরে ফ্যালা হলো বই মেলার সামনে- তখনো তাঁর ব্যাগের ভেতর আমার বইটা পাওয়া গিয়েছিলো।
দাদার সেই রিভিউটা তুলে দিলাম-
“বাঙালি বড় বিস্মৃতি পরায়ণ জাতি। নিজেদের ইতিহাস ভুলে বসে থাকে। কখনো বিকৃতও করে অহর্নিশি। বাঙালি বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে, স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে, শেখ মুজিবের অবদান নিয়ে, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি নিয়ে … এমন কোন বিষয় নেই যা নিয়ে বাঙালি বিতর্ক করে না। বিষয়টা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যের, এবং অস্বস্তিরও।
বাঙালি জাতির এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি, সবচেয়ে বড় গর্বের ফসল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। তাই মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার ইতিহাস জানা আমাদের জন্য প্রয়োজন। প্রয়োজন বিবিধ অপপ্রচারের সঠিক জবাব দেয়ার। সেই প্রেরণা থেকেই কলম তুলে নিয়েছেন তরুণ মেধাবী লেখক আরিফ রহমান।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক বোধ করি শহীদের সংখ্যা নিয়ে। বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধে নাকি ত্রিশ লক্ষ মানুষ মারা যায়নি, শেখ মুজিব নাকি মিলিয়ন এবং লক্ষের পার্থক্য না বুঝে গুলিয়ে ফেলেছিলেন, তাই স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে সাংবাদিকদের কাছে নাকি শহীদের সংখ্যা ভুলক্রমে ‘থ্রি মিলিয়ন’ বলে ফেলেছিলেন। এটাই প্রচলিত মিথ হিসেবে, অপপ্রচার হিসেবে বহুদিন অনলাইনে রাজত্ব করেছে। অনেকে আবার মনে করে নয় মাসের যুদ্ধে পাকবাহিনীর পক্ষে এতো মানুষ মেরে ফেলা সম্ভব ছিল না। দীর্ঘদিন ধরে অনলাইনে লেখালিখির কারণে এ ধরণের নানা অপপ্রচারের সাথে কিছুটা পরিচয় আছে আমার।
আমার পরিচালিত মুক্তমনা ব্লগে ব্লগার আবুল কাশেম ‘The Mathematics of a Genocide’ নামের একটি প্রবন্ধে এ সমস্ত অপপ্রচারের একটি বলিষ্ঠ উত্তর দিয়েছিলেন সেই ২০০২ সালের দিকেই। বাংলায় লেখাটির একটি ভাবানুবাদ করেছিলেন ব্লগার যুঞ্চিক্ত; তার ‘ত্রিশ লক্ষ শহীদ – মিথ নাকি বাস্তবতা?’ শিরোনামের লেখাটি প্রথমে সামহোয়্যারইন ব্লগে এবং পরবর্তীতে মুক্তমনা এবং শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চের মুখপত্র মুক্তান্বেষা ম্যাগাজিনে (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা) প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে। দীর্ঘদিন ধরে এ লেখাগুলোই মূলত এ ধরণের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হত।
তবে এর মধ্যে জামানা বদলেছে অনেকে। অপপ্রচারের তালিকায় যুক্ত হয়েছে নানা কুযুক্তি। রঙ্গমঞ্চে এসেছে শর্মিলা বোসের মত কিছু জ্ঞানপাপী যারা মনে করেন একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালী, পাকিস্তানী, বিহারী সব মিলিয়ে পঞ্চাশ হাজারের বেশি মানুষ নাকি মারা যায়নি। শর্মিলার মতে, বাংলাদেশ নাকি ধর্ষিতাদের সংখ্যা নিয়েও প্রবল রাজনীতি হচ্ছে। পাকিস্তানের ডেইলি টাইমস এবং ডন পত্রিকায় এই ‘বিশেষজ্ঞের’ বরাত দিয়ে একসময় বলা হয়েছিল ‘বাংলাদেশের যুদ্ধে কোন ধর্ষণের ঘটনা ঘটে নি’, কিংবা হলেও দু চারটি হয়তো হয়েছে – হাজার হাজার কিংবা লক্ষ লক্ষ নয় (রেফারেন্স – Losing the Victims: Problems of Using Women as Weapons in Recounting the Bangladesh War, P-3870)।
আরিফ বিস্তর সাক্ষ্য প্রমাণ হাজির করে দেখিয়েছেন কিভাবে এবং কতরকম ভাবে শর্মিলা বসু মিথ্যাচার করেছেন। তিনি হাজির করেছেন কম্বোডিয়া, নাইজেরিয়া, রুয়ান্ডা, চীন সহ বিভিন্ন দেশের গণহত্যার পরিসংখ্যান এবং তার সাথে উপস্থাপন করেছেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের তুলনামূলক খতিয়ান, ডেমোগ্রাফির ডেটা থেকে পাওয়া চার্ট, শরণার্থী শিবিরের তথ্য থেকে শুরু করে বীরাঙ্গনাদের জবানবন্দি পর্যন্ত অসংখ্য তথ্য এবং রেফারেন্স সহযোগে দেখিয়েছেন এ সমস্ত অপপ্রচার এবং কুযুক্তির ভিত্তি আসলে একেবারেই অন্তঃসারশূন্য।
এ গ্রন্থটি কেবল শহীদের সংখ্যা নিয়ে অপপ্রচারেরই শক্ত জবাব নয়, সেই সাথে অন্য অনেক প্রচলিত কুযুক্তির যৌক্তিক খণ্ডনের সন্নিবেশ। যেমন, গ্রন্থটির শেষ দিকে আরিফ দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ সন্নিবেশিত করেছেন, একটি হচ্ছে ‘কাদের মোল্লার আসল নকল: একটি নির্মোহ অনুসন্ধান’ এবং অন্যটি ‘ভাষাসৈনিক গোলাম আযম’: একটি গোয়েবলসীয় প্রচারণার ব্যবচ্ছেদ’। লেখা দুটো প্রকাশিত হয়েছিল জনপ্রিয় অনলাইন বাংলা পত্রিকা বিডিনিউজ২৪ ডট কমে, এবং ঘটনাক্রমে আমি ছিলাম প্রবন্ধ দুটোর সহলেখক।
এ প্রবন্ধ দুটো লেখার সময় আমি কাছ থেকে দেখেছি আরিফের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি নিষ্ঠা, মমতা, আবেগ এবং বিশ্বস্ততা। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে তার মতো প্রজন্মের হাত দিয়েই যেন রচিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় অধ্যায়। তরুন লেখক আরিফের এ বইটি ঘোর অমানিশায় আলোকবর্তিকা হয়ে বিরাজ করবে, এই আশা মোটেই বাতুলতা নয়।”
তিন.
যার কথা এতক্ষন ধরে লিখছি আজ থেকে এক বছর আগে এই মানুষটাকে- হ্যাঁ যতদূর জানি একজন মানুষকেই চাপাতির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে কুপিয়ে কুপিয়ে মেরে ফ্যালা হয়েছিলো। আমি বড় সৌভাগ্যবানদের ভেতরে একজন ছিলাম কারণ এই মানুষটা আমাকে নামে চিনতেন, কাজে চিনতেন। তাঁর উষ্ণতা আমাকে স্পর্শ করেছিলো, তাঁর ব্যাক্তিত্ব আমাকে আলোড়িত করেছিলো। আমি বড় সৌভাগ্যবান আমি অভিজিৎ রায়ের আমলের লোক…
আমার ভাবতে ভালো লাগে আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার মস্তিষ্কের পেছন দিক থেকে দাদার যে ছবিটা চোখের সামনে ভেসে আসবে সেটা তাঁর সাথে হাস্যজ্জল একটা মুহূর্তের।
আমি মেরুদণ্ডহীন একজন মানুষ,
তবু আমার আজীবনের অহংকার;
এই মানুষটা আমাকে চিনতেন..
চার.
আমি খুব সতর্ক ভাবে আমার ব্যাক্তিগত জীবনকে ব্লগ কিংবা ফেসবুকের মত জায়গা গুলো থেকে আলাদা করে রাখার চেষ্টা করি। পারতপক্ষে ব্যাক্তিগত জীবন ফেসবুকে প্রকাশ করি না; তারপরেও মানুষ তো- ঠিকই মাঝে মাঝে অনেক কিছু প্রকাশ হয়ে যায়। আমার পরিবার নিয়ে দুটো কথা বলি…
আমার একমাত্র ছোট বোনটা অটিস্টিক…
এক বছরের মধ্যে বাবার চাকরির মেয়াদ শেষ হবে, বাবার বয়স ষাট ছুইছুই। আমাদের পরিবারটা একেবারেই ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবার। সেই ছোট পরিবারের একমাত্র আশা-ভরসার জায়গাটা আমাকে নিয়ে। অনেক কষ্ট করে আমাকে পড়ানো হয়। আমার ছোট বোনকে আজীবন আমার দেখতে হবে। আমি জানি আমি দায়িত্বহীনের মত হঠাৎ মরে যেতে পারবো না।
এবার সেই ক্ষুদ্র জীবনের আরেকটু কাছ থেকে দেখি…
২০১৫ সালের একুশে বই মেলায় আমার একটা বই প্রকাশিত হল। আমি চুপিচুপি আমার সমস্ত মা’য়েদের উৎসর্গ করে দিলাম। আমার মা কাঁদলেন, বাবারা কাঁদেন না তবে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়েন। চোখাচোখি হলে এদিকে সেদিকে তাকান। একদিন সেই বইয়ের প্রকাশনা উৎসব হয়। আমার বাবা “জীবনে কখনো ফাস্ট হইতে না পারা…” কিংবা “বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার অযোগ্য…” পুত্রের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এলেন বুক উঁচু করে। বীরাঙ্গনা, মুক্তিযোদ্ধা, কিংবদন্তী “ফেরদৌসি প্রিয়ভাষিণী” বইটার মোড়ক উন্মোচন করলেন। আমাদের মধ্যবিত্ত ছোট পরিবারের ছোট ছোট বড় দিন গুলোর ভেতর সেই দিনটা পাকাপাকি শ্রেষ্ঠ দিনের আসনটা নিয়ে গেলো। আমার বাবা তাঁর বসকে একটা কপি দেন, মা দেন বোনের স্কুলের প্রিন্সিপ্যালকে। আবার আমাকে বলেন অটোগ্রাফ দিয়ে দিতে। ক্ষণে ক্ষণে হাসি-কান্নার সেই সময়গুলোর কথা মাঝে মাঝে মনে পড়ে।
আরও একজন মানুষের কথা মনে পড়ে…
যেই মানুষটা বাচ্চাদের মত খুশি হয়েছিলেন আমার বই প্রকাশে। আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে আসার মাঝপথে পর্যন্ত যতজনকে পেয়েছেন এই বইয়ের কথা বলেছেন। বইটার ভূমিকা পর্যন্ত লিখে দিয়েছেন। রিভিউ করেছেন। ব্লগে-ফেসবুকে-আলোচনায় বলেছেন।
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ মানুষটাকে যখন মেরে ফ্যালা হয়…
তাঁর ব্যাগের ভেতর অনেক বইয়ের মাঝে আমার বইটা পাওয়া গিয়েছিলো…
অভিজিৎ রায়ের কথা বলছি…
দাদার হাতে যখন প্রথম বইটা তুলে দেই তিনি বলেছিলেন কিছু লিখে দিতে।
লিখেছিলাম-
“গুরুজি;
আপনি ছিলেন…
আমরা আসলাম…
সব সময় থাইকেন…”
আমি একটা মিনিটের জন্য ভুলে থাকতে পারি না-
এই এখানটায় লেখালেখি করতে এসে আমার ভাই খুন হয়ে রাস্তায় পড়ে ছিলেন!
আমি যেমন ছোট বোনের প্রতি আমার দায়িত্ববোধকে অস্বীকার করতে পারি না…
ঠিক তেমনি আমার ভাইয়ের রক্তের সাথে বেঈমানিও করতে পারি না…
আমার আদর্শ আমি পরিস্কার দেখতে পাই…
আমার নীতির কাছে আমি শতভাগ সৎ…
ব্লগ থাকুক আর নাই থাকুক লিখবো…
লিখবো…
লিখবো…
লিখবো…
কেবল মৃত্যুই এ-কলমকে স্তব্ধ করতে পারে…
চেতনার মৃত্যু নাই,মৃত্যু নাই বইয়েরও।ওরা অভিজিৎ কে মেরে ফেলেছে,কিন্তু শত শত মুক্তমনা লেখক পাঠকের মাঝে অভিজিৎ বেঁচে আছে আজো;থাকবে তার চেতনা তার আদর্শ আরো হাজার বছর।
এক নিশ্বাসে লেখাটি পড়লাম।
আমি স্তম্বিত, থমকে আছে আমার অনুভূতি।।
শূণ্যস্থান বড় বেশি কষ্ট দেয়…
অভি দা বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে, আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে।
মুক্তচিন্তা, বিজ্ঞানকে ধারণ, কুসংস্কার ও অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অভি দা বেঁচে থাকবেন।
শুধু চোখ ভিজে যায় জলে।
বোকার দল ও তার পান্ডারা অভিজিৎদাকে হত্যা করেই মনে করেছিল খুব জিতে গেল!
তাদের ঘটে এটুকু বোঝার বুদ্ধিও নাই যে কখনো কখনো মৃত মানুষও জীবিত মানুষের চেয়ে অনেকগুন শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসে।
অবশ্য যদি বুঝত তাহলে ত দুনিয়া শুধু এক বইয়ের পাঠক দ্বারাই ভরা থাকত।
সেই বহু পুরনো কথাটাই তাই বলতে হয়, এক অভিজিৎ গিয়ে হাজার অভিজিৎের জন্ম দিয়ে গেছে; খেলাত মাত্র শুরু।
অভিজিৎ রায়’র অভাব বাঙালী আজীবন অনুভব করবে। এই স্বল্পসময়ে অভিজিৎ রায় যতটুকু কাজ করে গেছেন ততটুকু হজম করার পরিপাকতন্ত্র বাঙালীর নাই।
অনলাইনে অনেক বড় বড় লেখক আছেন কিন্তু লেখক বানানোর কারিগর খুব কমই আছেন। অভিজিৎ রায় ছিলেন লেখক গড়ার কারিগর। নতুন কেউ লেখা শুরু করলে আমাদের সিনিয়ররা খুব একটা উৎসাহ দিতে চান না, সেক্ষেত্রে অভিজিৎ রায় ছিলেন ব্যতিক্রম।