“ছেলেটা খুব ভুল করেছে শক্ত পাথর ভেঙে
    মানুষ ছিলো নরম, কেটে, ছড়িয়ে দিলে পারতো!
    অন্ধ ছেলে, বন্ধ ছেলে, জীবন আছে জানলায়
    পাথর কেটে পথ বানানো, তাই হয়েছে ব্যর্থ!”

আজ ২০১৬ এর চৌদ্দই ফেব্রুয়ারি সাথে বসন্তের আরম্ভ, কিন্তু আমি ভালবাসার নয়, আমি লিখবো বিষণ্ণতার গল্প। আমার জীবনের গল্প, আর এটা উৎসর্গ করবো আমার পরিচিত অপরিচিত বিষণ্ণতায় ভোগা মানুষদের।
লেখার উদ্দেশ্যঃ বিষণ্ণতায় ভোগা মানুষদের অবহেলার চোখে না দেখে, তাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মনভাব তৈরির জন্য সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে লেখা।

আমার বলতে দ্বিধা নেই আমি কয়েক বছর ধরেই বেশ হতাশ, নিরাশাবাদী, অনেক বেশি বিষণ্ণতায় ভুগি। জীবন কে বার বার গুছিয়ে নিতে যেয়েও আমি ব্যর্থ। কিন্তু আমি তো আমার বিষণ্ণতা গুলো নিয়েই বেশ আছি, কই আমি তো যেচে পড়ে কাউকে আমার বিষণ্ণতার গল্প শুনাতে যাই না। কাউকে তার কাজে নিরুৎসাহিত করতে যাই না, তারপরো কেন বিষণ্ণতায় ভুগা মানুষ গুলো কে সবাই একটু অদ্ভুত দৃষ্টি দিয়ে দেখে? সামনে যাই বলুক আড়ালে তাকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে। অবজ্ঞার চোখে দেখে। পারলে তাদের এড়িয়ে চলে, কেন চলে ঠিক জানি না, হয়তো বিষণ্ণতা ছোঁয়াচে বলে! কিন্তু কেউ তারা খুঁজে দেখে না কেন সে বিষণ্ণ!

কেন আমি বিষণ্ণ?

আমি নিজেও জানি না কেন আমি বিষণ্ণ। বিষণ্ণতা হয়ত বেড়ে ওঠার পরিবেশ, হঠাত ঘটে যাওয়া কোন ঘটনার শক, বা পারিবারিক বিষণ্ণতায় ভুগা জীনগত সমস্যা থেকেও হতে পারে। তবে হঠাত করে কেউ কখনো বিষন্ন হয়ে পড়ে না। বিষণ্ণতা কাউকে কখনোই হুট করে পেয়ে বসে না। এটাও অনেকটা দীর্ঘ সময় নিয়ে অর্জন করে নেওয়া লাগে। বিষণ্ণতার স্তরে নিজেকে টেনে নিতে মনের অনেক সময় লাগে। অনেক ধাপ পেরুতে হয়। শুরুতে কোন কিছুতে ব্যর্থ হলে কষ্ট লাগে। আপনজন কেউ হারিয়ে গেলে দুঃখ লাগে, কাউকে না পাওয়ায় বা কেউ ছেড়ে যাওয়ায় একটা যন্ত্রণার অনুভূতি হয়। এগুলোকে কাটিয়ে উঠতে পারে অনেকেই, তারা সফল। কিন্তু কেউ কেউ হয়ত হেরে যায়। তখন মনে আস্তে আস্তে ভর করে হতাশা, নিরাশা। সেটাও বেশ ভালো, একটা কষ্ট কষ্ট অনুভূতি থাকে, হেরে যাবার যন্ত্রণা থাকে। আবার হতাশার মাঝেও হঠাত আনন্দের কিছু ঘটলে খানিকটা সুখ খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু হতাশা বা নৈরাশ্যের স্তরে মানুষ বেশিদিন থাকে না। যারা এই স্তরে একবার যাত্রা শুরু করে তারা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারলে তো ভাল, নইলে পরবর্তী স্তরে আছে বিষণ্ণতা, অবসাদ। হতাশার স্তর যন্ত্রণা এবং কষ্টের বলেই মানুষের ব্রেইন তাকে এর থেকে বাঁচাতে তাকে টেনে নিয়ে যায় বিষণ্ণতায়। এখানে একবার ঢুকে পড়লে জগতের আর কোন কিছুতেই কোন কিছু যায় আসে না। সব কিছু তুচ্ছ মনে হয়। না আছে কোন আনন্দের অনুভূতি না আছে কষ্টের। সব কিছু মনে হয় রঙহীন ধূসর, একঘেয়ে, বিরক্তিকর। অনেকটা স্বাদ গন্ধহীন কাগজ চিবোনর মতন। জীবনের উদ্দেশ্য গুলো কেমন গুলিয়ে যায়। নিজেকে অনেকটা মনে হয় ঝর্না ধারায় পড়ে থাকা এক খন্ড নিষ্প্রাণ পাথর, যার জলের তৃষ্ণা আছে, কিন্তু জল তাকে ভেজাতে পারে না, শুধু ছুয়েই চলে যায়। গায়ে লাগে না।

এখন আমি ২৩ বছরের তরুণ, এই স্বল্প সময়ের জীবনে এখনই প্রায়ই ভাবি যদি পালিয়ে যেতে পারতাম জীবন কে ফাঁকি দিয়ে। সবসময় এমন ছিলাম না আমি। এক সময় আমিও স্বপ্ন দেখতাম, প্রাণ চাঞ্চল্য আর উৎসাহে ভরপুর ছিলাম। নিজের সামনে একটু একটু করে নিজের পরিবর্তনটা দেখেছি। ২০০৯ এ এস.এস.সি এর পর থেকে আমি বুঝতাম আমি ডুবে যাচ্ছি। কিন্তু চেষ্টা করেও খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি সব কিছু। এখন মনে হয় আমি হারিয়ে গেছি। আগের সেই আমাকে আর কোথাও খুঁজে পাই না। দুঃখ, কষ্ট বা আনন্দ গুলো মনে হয় আমাকে আর খুব একটা ছুঁয়ে যায় না। মনে হয় এক সময় খুব জোরে ঝংকার তুলে বাজতে থাকা আমার জীবনের সুরের কোথাও ছন্দ পতন হয়েছে, যেন একটু একটু করে একটা তানপুরা পুরনো হতে হতে তাল কেটে যেয়ে বেসুরো হয়ে গেছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারি এটা হঠাত করে কখনোই হয়নি। খুব আস্তে আস্তে অনেক সময় নিয়ে আমি এই স্তরে এসে পৌঁছেছি। নিজেকে যখন বিষণ্ণ হিসাবে আবিষ্কার করতে শুরু করি তখন থেকেই আমি ভাবতে থাকি কেন আমি এমন হলাম, আমার শুরুটা মুটামুটি এরকম ছিল, জন্মেছিলাম মধ্যবিত্ত পরিবারে। চাকরীর সুবাদে মাকে নিয়ে বাবা থাকতেন তার আত্মীয়-স্বজন থেকে অনেক বেশি দূরে। তাই বেড়ে ওঠার পরিবেশে ছোট বেলায়ই মা-বাবা ছাড়া আর পারিবারিক আত্মীয়দের তেমন সান্নিধ্য পাইনি। ছোট পরিবার সুখি পরিবার এই কথাটা হয়তো সব সময় ঠিক না। বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক, মা করতেন ঘরকন্যার কাজ, বাবা স্কুল শেষে ব্যাচেও পড়াতেন, তাই রাতের বেলায় তিনি থাকতেন ক্লান্ত, খুব ছোট বেলায় যখন ২য় বা ৩য় শ্রেণীতে পড়ি তখন থেকেই বাবার কাছে রাতে পড়তাম। বাবা বেশ কঠোর ছিলেন, তবে পড়া না পারার জন্য খুব একটা মার খেতে হয়নি। কারণ আমি পারতাম। তবে কখনো কখনো অমনোযোগী হওয়ায় ভুল করে বসলে বা পড়তে না চাইলে বাবা মারতেন। বাবার হাতের চড় গুলোর কথা এখনো মনে পড়ে। এছাড়াও একটু বড় হয়ে আমি প্রায়ই একা এদিক সেদিক ঘুরতে যেতাম, সকাল বা দুপুরের খাবার সময় ও বাড়ি ফেরা হত না অনেক দিন, আমাকে খুঁজে নিয়ে আসতে যেয়ে বাবা সারা রাস্তাও মারতে মারতে নিয়ে এসেছেন এমনও হয়েছে অনেক বার, আমাকে যে মারতেন সেটা নিয়ে খুব একটা দুঃখ ছিল না আমার। কিন্তু আমাকে বাঁচাতে এসে মাকেও মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে চড় খেতে হত, এছাড়াও পারিবারিক ছোটখাটো কথা কাটাকাটি, ঝগড়া থেকে মাকে চড় খেতে দেখেছি। মা কাঁদতেন, এ ধরণের ব্যাপার ঘটার পর মা আমাকে বলতেন, “তার বাবা বেঁচে থাকলে তিনি বাবার বাড়িতে চলে যেতেন”। মায়ের কান্নার ব্যাপারটা বেশ কষ্ট দিত, কারণ মাসে দুমাসে এমন ঘটনা প্রায়ই হত। সেখান থেকেই বাবার প্রতি একটা ক্ষোভ জন্মে যায়, এ ধরণের পারিবারিক অপ্রীতিকর ঘটনা বাংলাদেশে প্রায় সব পরিবারেই কম বেশি ঘটে, বাবা-মায়ের ভিতরে সমঝোতাও ছিলো। কিন্তু তখন তা ভালো বুঝতাম না, কারণ ভালোবাসা দেখার মতন চোখ আমার সেই কচি বয়সে ছিল না, কিন্তু চোখের সামনে মাকে মার খেয়ে কাঁদতে দেখা, তার কষ্ট গুলো সরাসরি আমাকে বলতে শোনাটা আমার মনের জন্য যন্ত্রণার ছিলো। বাবা-মায়ের ভিতরের ভালবাসাটা তখন আমি সত্যি ভাল বুঝতাম না, কারন সেগুলো কেউ আমার সাথে শেয়ার করেনি, বরং তাদের ঝগড়া গুলোই আমি দেখেছি। আমাদের সমাজে বাচ্চার সামনে কোন বাবা-মা ই বলে না আমি তোমায় ভালোবাসি, হাত ধরে রাস্তায় চলে না বা তাদের প্রেমের ক্ষুদ্র অনুভূতির প্রকাশ করেনা, করলেও সেটা একটা বাচ্চার পক্ষে বুঝতে পারাটা যতটা সহজ হয়, তার চেয়ে নগ্ন ভাবে সে বুঝতে পারে তাদের ঝগড়া গুলো। হয়তো আমার ক্ষেত্রেও তেমনই হয়েছিল, তাই বাবাকে তখন ভুল বুঝতাম, তার প্রতি ক্ষোভটা বেড়েই চলে। ডানপিটে আর নিওম ভাঙ্গার প্রবণতার দরুন তাই আমি আস্তে আস্তে প্রতিবাদী হয়ে উঠি। ক্লাস সেভেন এইটে উঠার পর তাই বাবার সাথে প্রায়ই অহেতুক তর্কে জড়িয়ে পড়তাম। ফলাফল মার খেয়েই শেষ হত। পরে বাবা হয়তো যত্ন করার চেষ্টা করতেন কিন্তু আমি প্রায়ই তখন ভাবতাম বাবা “এমন” কেন। এছাড়া আমার অন্য আত্মীয় স্বজনরা কেউ বেড়াতে এলে তারা যতদিন আমাদের বাড়িতে থাকতো তাদের পিছু ছাড়তাম না, এক সময় তারা চলে যেত, আমি তাদের যাবার সময় হলে খুব কাঁদতাম, কারণ আমাদের থাকার জায়গা বাবার পৈতৃক ভিটা থেকে খুব বেশি দূরে হওয়ায় বছরে দুই এক জনের বেশি কেউ আমাদের বাড়িতে আসতো না। বছর শেষে ডিসেম্বরে দশ-পনেরো দিনের ছুটিতে বেড়াতে যাওয়া ছাড়া তাই তাদের সাথে দেখাও হত না। যখন সিক্স-সেভেনে উঠলাম তখন বুঝতে শিখলাম কেঁদে কিছু হয় না, কেউ থাকে না। যার যাবার সময় হয় সে চলে যায়। মন শক্ত হতে শুরু করলো। ক্লাস নাইনে উঠে এক দিন ক্লাসে সবার সামনে অঙ্কে সামান্য ভুল করার কারণে আমার বাবা আমাকে ধুমছে পেটালেন, কারণ তিনিই অঙ্কের শিক্ষক ছিলেন। অংক ভুলের কারণে যতটা মার আমার ভাগে পাবার কথা ছিল, তার চেয়ে অন্তত দশ গুণ বেশি পেটালেন কারণ তখন তার সাথে আমার মানসিক সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিলো না। তিনি মনের ক্ষোভ ঝেড়ে পেটালেন, কিন্তু আমিও যে তার ছেলে, আমি বা কম যাই কেন! অংক ক্লাস শেষে আমিও সোজা বাড়ি চলে এলাম, পনেরো মিনিটে ব্যাগ গুছিয়েই আমার ক্লাস টু এর ছোট বোন কে ফাঁকি দিয়ে কেটে পড়লাম। অবশ্য আসার সময় বাবার পকেট থেকেই হাজার খানেক টাকা ঝেড়েছিলাম, সোজা দুশো কিলোমিটার পথ পেরিয়ে আমার দাদুর বাড়িতে এসে উঠলাম, যেখানে কাকারা সহ পরিবারের অন্যন্যরা থাকেন। এভাবে আসায় তারা আমার এই আচরণে অবাক হলেন, সাথে আমার সাথেও ফরমাল আচরণ করেছিলেন বেশ কিছুক্ষণ। যাইহোক দশ পনেরো দিন পর আমাকে তারা বুঝিয়ে সুজিয়ে বাড়ি ফেরত পাঠালেন। ফিরে গেলাম। তারপর থেকে আর বাবা কোন দিন গায়ে হাত তোলেনি। বরং আমি অবাক হই এটা ভেবে, “যে বাবা আমাকে প্রায়ই ধরে পেটাতেন তিনি আস্তে আস্তে আমাকে আমার মতন করে চলতে দিলেন”। তখন থেকেই তার সাথে বেশ দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল হয়তো! কে জানে! বরং আমি বড় হয়ে গেছি ভেবে আমার উপরে একটু বেশিই ভরসা করতে লাগলেন। সেটাও আমার জন্য বিশেষ ভালো ছিলো না। এজন্যই বলছি যে, এস.এস.সি পাশের পর কলেজে ভর্তির ব্যাপারে আমাকেই বললেন আমি কোথায় পড়তে চাই? আমি জগতের বিশেষ কিছু না জানলেও আমার সিদ্ধান্তটাই মুখ্য হয়ে গেল। নিজের ইচ্ছেতে ভর্তি হলাম খুলনার পাব্লিক কলেজে, বাবার ব্যস্ততা থাকায় তিনি খুব একটা সময় দিতে পারেন নি। এক ইমিডিয়েট সিনিয়র এর সহযোগিতায় ভর্তি, মেস ঠিক করা, সব নিজেকেই করতে হল। ক্লাস ফাইভে স্কলারশিপ, এইটে থানায় ৩য় হয়ে ট্যালেন্টপুল স্কলারশিপ, এস.এস.সি তে এ-প্লাস নিয়ে এসেও শহরের এডভান্স জেনারেশনের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারিনি। যখন আমি শুরু করতে যাচ্ছি, তাদের বইয়ের অর্ধেক শেষ। বড়ভাইরা বলতে লাগলো এইস.এস.সি খুবই কঠিন। ক্লাসেও ভালো বুঝতাম না। একসময় উপলব্ধি করতে পারলাম যে ক্লাসের স্যাররা অনেকদিন থেকে পরিচিত থাকার কারণে এক্স-পাব্লিক স্টুডেন্ট দের দিকে বেশি মনযোগী। আমার মতন উদ্বাস্তু দের খুব একটা পাত্তা নেই। খোঁজ নিয়ে জানলাম প্র্যাক্টিক্যাল মার্ক্স নিয়েও নাকি অতীতের উদ্বাস্তুরা সন্তুষ্ট না। আমি প্রতিযোগিতায় হেরে যেয়ে হতাশ হয়ে যেতে থাকি। একসময় নিজের উপরে, নিজের কনফিডেন্ট লেভেল, নিজের ব্রেইনের উপরে সন্দেহ হতে শুরু করে, মনে হতে থাকে আসলে কি আমি এগুলো পারার যোগ্য? আমার এমন মনে হওয়ারও একটা কারণ আছে। আমার জীবনের বয়ঃসন্ধিতে আমার সব থেকে বড় ক্ষতিটা করে দুই থেকে তিনটি ব্যাপার। এক, পারিবারিক বয়ঃসন্ধিকালীন মনমালিন্য যেটা আগেই বলেছি। তবে বড় ক্ষতি করে এক “কবিরাজ” যিনি ছিলেন জন্ডিসের চিকিৎসক। তিনি কবিরাজ হিসাবে গাছের শিকড় ব্যবহার করতেন, এবং কবিরাজ হিসাবে তিনি সত্যি খুবই ভালো ছিলেন, বেশিরভাগেরই জন্ডিস সেরে যেত খুব দ্রুত। কিন্তু তিনি শুধু কবিরাজই ছিলেন না, তিনি ‘মন’ ও পড়তে পারতেন। অর্থাৎ তার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিলো অসাধারণ রকমের ভালো। কেন বলছি এ কথা? কারণ ক্লাস টেনে পড়াকালীন জন্ডিস হওয়ায়, আমি তাকে দেখিয়েছিলাম প্রায় ৫০ জনেরও পরে, আমার আগের ৫০ জন সম্পর্কে তিনি বিভিন্ন ব্যক্তিগত মন্তব্য করেন যার সব গুলই রোগিরা স্বীকার করে নেয়। আমার সিরিয়াল এলে তিনি আমার সম্পর্কেও মন্ত্যব্য করে বসেন, যে মন্তব্যের কারণে তিনি হয়ত না জেনেই মারাত্মক ভুল করে বসেন। তিনি আমাকে বলেন “তুই খুবই মেধাবী, কিন্তু তোর ব্রেইন এখন ঠিক ঠাক কাজ করে না। কারণ তুই বেশি বেশি মাস্টারবেট করিস, তুই সারাদিন স্রষ্টাকে স্মরন করিস কিন্তু তুই তার অস্তিত্ব নিয়েও সন্দেহে ভুগিস, এবং তুই এগুলোর ফলে পড়ালেখায় মন দিতে পারিস না, তুই হতাশায় ভুগিস আর এজন্য তোর চুল ও উঠে যাচ্ছে” কিন্তু উনি ছিলেন স্রষ্টায় বিশ্বাসী এবং উনার এই ক্ষমতাকে উনি পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বলতেন না। উনি পায়ের আঙ্গুলে একটা “কড়ি (ঝিনুক এর মতন)” ধরতেন এবং মিনিট খানেক ধরে থাকার পর সেটা নিজের কানে লাগাতেন আর বলতেন যে তিনি নাকি শুনতে পান কড়ি তাকে রুগির সম্পর্কে বলছে। বলা বাহুল্য তার ওষুধে আমার জন্ডিসও দ্রুত সেরে গেছিলো। কিন্তু ৪০/৫০ জন মানুষ এবং বাবার সামনে ক্লাস ১০ এর একটা ছেলের যে অপমান সেদিন হয়েছিল তা আমি আজও ভুলিনি। এখন আর দৈহিক বিষয় নিয়ে কথা বলায় আমার কোথাও বাধে না। কিন্তু তখন আমি ছোট ছিলাম। আর অপমান থেকে বেশি যেটা হয়েছিল তা হল, আমার বাবা ভাবতেন আমি বোধয় নষ্ট হয়ে যাচ্ছি, খারাপ ছেলে দের সাথে মিশি। কিন্তু তা আমি করতাম না, হ্যা আমি সব ধরণের ছেলেদের সাথেই মিশতাম, কিন্তু কেউ আমাকে কিছু সেখায়নি, আমি নিজেই ওদের থেকে অনেক বেশি বুঝতাম। নিজেকে আমি নিজেই আবিষ্কার করি, কিন্তু কবিরাজের কথা গুলো আমার খুব করে মনে দাগ কাটে। আমার মনে হতে থাকে আমার ব্রেইন কি সত্য কমে যাচ্ছে নাকি! আমি খুব বেশি দুশ্চিন্তায় ভুগতে শুরু করি। আর এই দুশ্চিন্তাই আমার জন্য সব থেকে বেশি বড় “বাঁশ” হয়ে দাঁড়ায়। এমনিতেই আমার শরীর স্বাস্থ্য যথেষ্ট ভালো ছিল না বা সুদর্শন ও ছিলাম না, লেখাপড়ায় যা একটু ভালো ছিলাম, কিন্তু সেটাও যদি হারিয়ে ফেলি তাহলে আমি কোথায় গিয়ে দাড়াবো? এই চিন্তা আমাকে তাড়া করে বেড়াতো। যতটা না সত্যি তার চেয়ে মনের ‘জুজুর’ ভয় ছিল আমার ভিতরে বেশি, “যে আমার ব্রেইন বোধয় আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে”। কারণ এইস.এস.সি এর পড়া এমনিতেই বেশ কম সময়ের আর কঠিন, আর তার পর কিছু একটা না পারলেই এই ভয় কাজ করত। এক দিকে ব্রেইন এর কি হচ্ছে সেই ভয় আরেক দিকে উদ্বাস্তু হউয়ার কারণে প্রাক্টিক্যাল মার্ক্স স্যাররা কত দিবে এই চিন্তা, হতাশায় ভুগতাম। খুব বেশি। সিধান্ত নিলাম পাব্লিক কলেজ ছেড়ে দেব, ট্রান্সফার হয়ে চলে যাব আমার ইমিডিয়েট সিনিয়র কাজিন যেখানে পড়ে, খুলনার একটা থানা শহরে। বাড়িতে জানালাম, মজার ব্যাপার হল বাড়ি থেকে আমার সকল আত্মীয় স্বজন এবং আমার বাবা বলল “ঠিক আছে যা ভালো বুঝো করো, তোমার লাইফ, কিভাবে চললে ভাল হয় তুমি বুঝো” কিন্তু আমি মাত্র ১৬ বছরের কিশোর, কিভাবে ভালো হয় সেটা বুঝার মতন মানসিকতা আমার খানিকটা হলেও আমি চাইতাম আমার সিধান্ত গুলো তারা যেন একটু ভালোবাসার সাথে সহানুভূতির সাথে দেখে। তারা যেন আমার পেছনে সত্যি থাকে। তারা পেছনে ঠিকই ছিল কিন্তু আমার কাছে মনে হত তাদের মনভাবটা অনেকটা এমন যে, সিদ্ধান্ত যখন তোমার, এর দায়ভারো তোমার। কারণ আমার এই সিদ্ধান্তের কেউ বিরোধিতা জোরালো ভাবে না করলেও তারা সম্পূর্ণ দায় দায়িত্ব আমার উপরেই চাপিয়েছিল এবং এই সিদ্ধান্তে বিশেষ খুশি হতে পারেনি। অর্থাৎ এক কথায় বললে আমি একা ছিলাম, আমার পেছনে একটা দাঁড়কাকও ছিল না। আমার পরিবার আমাকে বাধা দেয়নি ঠিকই কিন্তু তাদের পূর্ণ সতঃস্ফুরত সমর্থন ছিলো না। বেশ ট্রান্সফার হলাম এবং কলেজ ট্রান্সফারের সমস্ত হ্যাপা সদ্য গ্রাম থেকে বিভাগীয় শহরে উঠে আসা এক কিশোরকেই পোহাতে হল। তিন মাস ক্লাস শেষ হয়ে গেছে আর আমি নিজের ব্রেইন কমে যাচ্ছে কিনা সেই সন্দেহে ভুগার পাশাপাশি এই গুলোই করে বেড়াচ্ছি। নতুন যে কলেজে গেলাম, সব বন্ধু বান্ধব নতুন। একজন স্যার ছিলেন যিনি খুবই আন্তরিক কিন্তু খুব কড়া ছিলেন। বাকি স্যার গুলো আমাকে এবং আমার মতন ট্রান্সফার হয়ে আসা আরও দুজন কে অবহেলার সাথে দেখতেন, আমাদের ক্লাসে বলতেন “সেই অছাত্র গুলো কোথায়?” কারণ তখন আমরা ভর্তি হতে পারিনি, ট্রান্সফারে সময় লাগে, প্রিন্সিপ্যাল স্যার নিতেন বায়োলোজি, একদিন তিনি আমাদের কে একটা সামান্য ব্যাপারে কলেজ থেকে বের করে দিলেন, বলেছিলেন যে তিনি আমাদের তার কলেজে নিবেন না। এক সময় এসব ঝামেলা শেষ হয় ঠিকই। কিন্তু আমি তখন মানসিক ভাবে যথেষ্ট ক্লান্ত। কারণ সেই কবিরাজের “বানীর” পর আমি মাস্টারবেশন প্রায় ছেড়েই দেই, কিন্তু শুরু হয় নতুন সমস্যা “স্বপ্ন-দোষ” কারণ শরীরের তো ব্যালান্স রাখার দরকার আছে। সঠিক ইনফরমেশন কারো কাছেই পাইনি। খুলনা মেডিকেলের ডাক্তার থেকে হামদর্দ, হোমিওপ্যাথি সবই দেখিয়েছি। ডাক্তাররাও ঠিক ভাবে কিছু বলতেন না, খোলাখুলি কোন কথা না বলে শুধু ওষুধ দিতেন। গ্যালন গ্যালন খেয়েছি, কোন কাজই হয়নি। সেই ইমিডিয়েট সিনিওর কাজিন যে ছিল, তার সাথে শেয়ার করতাম, কিন্তু সেও স্বল্প মাত্রায় হতাশ ছিল, এক বছর পর সেও পরীক্ষায় পাশ করে চলে যায়, পরের এক বছর শুধু বিকাল গুলো রাস্তা ধরে একাই হেঁটেছি, আর কী হবে জীবনে তাই ভেবেছি। শুধু হতাশাই বেড়েছে। অতছ পরে বড় হয়ে কিছুদিন আগে জেনেছি যে আমার ব্যাপারগুলো বা আমার পরিমাণটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিল, যা ক্ষতিকর পর্যায়ের না, যার জন্য হতাশায় ভুগা লাগে বা ডাক্তার দেখানো লাগে। কিন্তু তত দিনে ‘মারা’ খেয়ে গেছি। এছাড়াও ৩য় একটা কারণ ছিল, প্রেম। এক বালিকার প্রেমে পড়ি ক্লাস এইট থেকেই। আমি ক্লাস টেন এ উঠার পর সে ইন্ডিয়ায় চলে যায়। তাকে তখন পর্যন্ত কখনো বলা হয়নি ভালবাসি। আমি তাকে ভুলতে তো পারিইনি বরং এইস.এস.সি এর সময়ে অনেক মিস করতাম। সব মিলিয়ে বাঁশ খাবার জন্য আমার পরিস্তিতি ছিল আদর্শ। এইস.এস.সি দিলাম, দিয়ে পুনরায় এডমিশন কোচিং এর জন্য খুলনায় এলাম। ইঙ্গিনিয়ারিং কোচিং এ ভর্তি হলাম, মাত্র একবার সাধারণ জ্বর আর একবার প্যারা-টাইফয়েড হল কোচিং এর তিন মাস সময়ের ভিতরেই। এছাড়া পুরানো সঙ্গী স্বপ্ন দোষ আর এর জন্য ভুল করে তৈরি হওয়া হতাশার সাথে যুক্ত হয়েছিল চাঞ্চ পাওয়া নিয়ে মানসিক চাপ। কারণ আমার কাজিন তখন কুয়েটে পড়ে, আমার পরিবার চায় আমি যেন তার ফুটপ্রিন্ট ফলো করতে পারি। অতছ আমি এইস.এস.সি এর রেজাল্ট কি হবে সেটা নিয়েই টেনশানে থাকতাম, চাঞ্চ পাওয়া তো পরের কথা। রেজাল্ট এর দিন পালিয়েছিলাম, ইচ্ছে ছিল ভালো না হলে ফিরব না, বরাবরের মতন এবারো বংশের মুখ উজ্জ্বল করে(!) এ-প্লাস পেয়েছিলাম। এই এ-প্লাসই কাল হবে ভাবিনি কখনো। কারণ এ-প্লাসের বদৌলতে আমার উপরে পরিবারের চাহিদা বেড়ে গেল, কুয়েট রুয়েটে সিরিয়াল এল পঁচিশশো এর কাছাকাছি, লজ্জায় মুখ দেখানোর অবস্থা নেই তখন আমার। কারণ সবাই আমার দিকে চেয়ে বসেছিল। বাবা বলেছিল কোথাও না পেলে প্রাইভেটে ভর্তি করে দেবেন, কিন্তু তার সেই কথায় যে কষ্ট লুকিয়ে ছিল সেটা স্পষ্ট বুঝতাম। হলনা চাঞ্চ তেমন কোথাও। লেখা পড়া ছেড়ে দিয়ে কি করা যায় তাই ভাবছি তখন, এক বিকেলে বাল্যবন্ধু ফোন দিল, আমার একতরফা ভালোবাসার তরুণী নাকি ইন্ডিয়া থেকে ভ্রমনে এসেছে, বাড়িতে গেলাম। তারপর তাকে দু তিন বছর পর দুচোখ ভরে দেখলাম। মোট ৪/৫ দিন বাড়িতে ছিলাম, এক সন্ধ্যায় তার হাতে একটা চিরকুট দিয়েছিলাম, ও তখন ক্লাস নাইনে পড়তো ইন্ডিয়াতে, ইচ্ছে ছিল পরদিন একটা উত্তর পাব, কিন্তু ভাগ্য আমায় আবারও প্রতারণা করে, পারিবারিক ঝামেলায় সেদিন ভোরেই ওর মা ওকে নিয়ে চলে যায়, আমার ফোন নাম্বার ফেইসবুক আইডি দেওয়া ছিল চিরকুটে, অনেক দিন অপেক্ষা করেছি, কিন্তু কোন উত্তর আসেনি। ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে লাগে, ও অনেক আগে থেকেই জানতো আমি ওকে পছন্দ করি। কতটা করি ও কখনোই তা জানেনি, কিন্তু ও যদি আমায় অবহেলা করত, এড়িয়ে যেত তাহলেও আমি ওকে অনেক আগেই হয়ত ভুলে যেতাম, কিন্তু আমার সেই ক্লাস ৮/৯ এ পড়া বয়স থেকে তখন পর্যন্ত ও সেটা কখনোই করেনি। ও ধরা না দিলেও আমায় দেখলে চঞ্চলা হরিণী হয়ে যেত, এই ব্যাপারটাই ও বারবার চলে গেলেও ওকে আমায় ভুলে যেতে দেয়নি। ভুলে যেতে দেয়নি বললে ভুল হবে, আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি ভুলে যাবার কিন্তু যতবার চেষ্টা করেছি ততই শিকড় গভীরে ঢুকে গেছে। ওকে সম্ভবত আমি ক্লাস নাইন থেকে এখন অবধি শেষ আট বছরে একদিনও ভুলিনি। মজার ব্যাপার হল, আমি ওর চেহারা কখনোই মনে রাখতে পারতাম না। ও সামনে থাকলে মনে থাকতো, চোখের আড়াল হলেই আর ওকে কখনো মনে করতে পারতাম না। হয়ত আমার মস্তিষ্কের সচেতন অংশ চায়না বলেই। কি জানি। আমি সত্যি চাই ওকে ভুলতে। প্রতিদিন ওকে মনে পড়াও এখন আমার কাছে বিরক্তিকর লাগে। যাকে পাবার কোন সম্ভাবনাই নেই তাকে কেন প্রতিদিন মনে পড়ে এটা একটা গভীর রহস্য। যাই হোক, ও চলে গেল। আমিও তার চার দিন পর পাবনায় এলাম ভর্তি পরীক্ষা দিতে, চাঞ্চ পাবার কোন ইচ্চে আমার ছিল না, ফর্ম কিনা ছিল তাই পরীক্ষা দিতে আসা। সারা রাত তাস খেলে আর সিগারেট খেয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলাম অন্যের কলম ধার করে, বলা বাহুল্য এডমিশন এর হতাশা থেকেই আমি স্মোকিং শুরু করি। শালা কপালো এমন যে এখানেই চাঞ্চ পেয়ে গেলাম। এখন তো ভর্তি হতেই হয়, এছাড়াও মাওলানা ভাসানি তে খুব অল্প কয়েকজনের পরেই ওয়েটিং ছিলাম কিন্তু টানেনি, আর এই দুই যায়গায় এক্সাম এর আগে এক মাস লেখা পড়া ছেড়ে দিলেও ওকে দেখে মন ভাল হয়ে যায়, যদিও ওর হঠাত চলে যাওয়ায় দুঃখও ছিল অনেক। ওকে দেখার পরই এক্সাম দিয়েছিলাম এই দুই যায়গায়।

গল্পের এই পর্যায়ে এসে অনেকে হয়ত ভাবছে যে, “লেখক হতাশার গল্প লিখতে বসে খালি ইনিয়ে বিনিয়ে নিজের সাফল্যের গল্প কেনো বলে যাচ্ছে?”

তাদের কেই বলছি, একজন মানুষের হতাশা বুঝতে গেলে তার অতীত জানা লাগে। এটা ছিল অতীত, যেখানে হতাশা ছিল কিন্তু সাথে কিছু সাফল্যও ছিল। বিষণ্ণতায় তখনো আমায় পুরোপুরি ধরেনি। এর পরই আপনাদেরকে কাঙ্ক্ষিত বিষণ্ণতার গল্প শুনাবো।

ভর্তি হলাম পাবনায়। ইঞ্জিনিয়ারিং। কিন্তু নতুন পরিবেশ নতুন শহরে এসে মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছিল, থাকার জায়গার পর সব থেকে বড় সমস্যা ছিল ভার্সিটি ক্যাম্পাস। ভার্সিটির বয়স তখন চার বছর হলেও ক্যাম্পাসের কোন দেখা নেই। পাবনার মানুষ ভার্সিটি তখন চিনতো না। তারা বলতো টিটি কলেজ, কারণ মেইন ক্যাম্পাসের পাশে ছিল টিচার্স ট্রেইনিং কলেজ। অটো বা ইজি বাইক এর চালকেরা বলতো টিটি কলেজে পড়েন? আর পাবনার স্থানীয়রা বলতো যে “এডওয়ার্ড কলেজে চাঞ্চ পান নাই মামা?” (উল্লেখ্য যে এখানে আমি এডওয়ার্ড কলেজ কে কখনোই ছোট করে দেখছি না, এই কলেজ টা বাংলাদেশের সব গুলো পুরানো জাতীও ভার্সিটির মধ্যে একটি, এবং উত্তর অঞ্চলে খুবই নামকরা, বৃহত্তর প্রতিষ্ঠান)
ভাড়া করা ক্যাম্পাসে ক্লাস নিত। স্যাররা ক্লাসে দাড় করিয়ে শুনতো “আর কোথাও চাঞ্চ পেয়েছি কিনা। কেন পাবনায় ভর্তি হলাম?” কারণ হটাত গড়ে ওঠা ঢাল তলোয়ার ক্যাম্পাস বিহিন ভার্সিটি এবং তার শিক্ষক দেরকেই পাবনার মানুষ মূল্যায়নই করতো না তখন, স্টুডেন্ট তো অনেক পরের বিষয়। স্যাররা শেষ পর্যন্ত সান্ত্বনা দিত এই বলে যে “কি আর করবা পড়তে থাকো, একদিন ক্যাম্পাস হবে”

আমার পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ফোন দিয়ে শুনতো হলে/হোস্টেল উঠেছি কিনা!?

যার ক্যাম্পাসই নেই তাকে যদি বলা হয় হল আছে কিনা! লজ্জায় বলতে পারতাম না, বলতাম সিট পাই নাই। এদিকে আমার এই চান্স পাওয়ায়ও পরিবারের সবাই সন্তুষ্ট ছিল না। অনেকটা নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো টাইপ বলে তারা কিছু বলত না। ছুটিতে বাড়ি গেলে দেখতাম, সামনা সামনি না হলেও পরোক্ষ ভাবে আমার কুয়েটে পড়া কাজিন এর সাথে আমাকে সবাই তুলনা করত। খারাপ লাগতো, ছিলো কুয়েটে পড়ার স্বপ্ন, সেখানে একটা ক্লাস করতে হত শহরের এক মাথায়, তো আরেকটা ক্লাস অন্য মাথার অস্থায়ী ক্যাম্পাসে, সেই সাথে ছিলো ভার্সিটি তে রেজাল্ট কেমন করতে হবে বা করা উচিৎ পরবর্তীতে চাকরীর বাজারে যাবার জন্য তার একটা জল্পনা কল্পনা। সিনিওর বড় ভাইরা বলতো রেজাল্ট ৩.৫ না হইলে চাকরী নাই। এইস.এস.সি তে ভাবতাম ভার্সিটি লাইফ মনে হয় কিছুটা শান্তির হবে, এটলিস্ট নিজের মতন করে পড়তে পারবো, নিজের ভালোলাগার ক্ষেত্র গুলো নিয়ে কাজ করতে পারবো। কোথায় কি! এটা প্রেশার কুকার মনে হতে লাগলো। স্যাররা যা পড়াতেন মাথার ১০ হাত উপর দিয়ে চলে যেত, বিরক্তিকর লাগতো ক্লাস গুলো, বুঝে গেলাম যে ৩.৫ সম্ভব না আমার দ্বারা, যখন ভাবতাম টেনেটুনে ৩ হয়তো পারি কিন্তু তাতে তো আবার কাজিন এর সাথে তুলনার দণ্ডে নামতে হবে, কারণ সে কুয়েট থেকেই ৩.৫ হাঁকিয়ে চলেছে। সেই সাথে ভর্তির আগে ইন্ডিয়া প্রবাসী প্রেমিকার দেখা পাওয়ায় নতুন করে যেন পেট্রোলে জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি পড়েছে, বলার অপেক্ষা রাখে না। একে পাবনার বৈরি পরিবেশ (তখন তাই মনে হত) আরেক দিকে ক্যারিয়ার অনিশ্চিত, সাথে ওকে না পাওয়ার যন্ত্রণা, মন ভারী হতে হতে লেখা পড়া মাথায় উঠলো, ফার্স্ট সেমিস্টার ফর্ম ফিলাপ করলাম, বন্ধুর পিড়াপিড়িতে দেব না বলেও এক্সাম হল পর্যন্ত গেলাম, শুধু বেসিকের জোরেই ৩.২৫ আপ রেখে পাশ করেছিলাম প্রায় সব গুলতে, কিন্তু ম্যাথে ফেইল খাই। কারণ ম্যাথে আমি দুর্বল ছিলাম, ভালো বুঝতাম না, প্র্যাকটিস ও করা হয়নি, একটা অলিক ভয় ছিলো আমার ভিতরে, ম্যাথ ভিতি, পারি আর না পারি চেষ্টার আগেই আমার মনে হত আমি পারবো না, জীবনের প্রথম কোন এক্সাম এ ফেইল খাইলাম। আমি যে তখন যথেষ্ট বিধ্বস্ত তা আর বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। কি মনে হল জানি না, ভাবলাম ছেড়ে দিয়ে নতুন করে শুরু করা যায় না! কিন্তু সেকেন্ড টাইম এডমিশন টেস্টের মানসিকতা আমার তখন সত্যি ছিলো না। ভাবলাম ছেড়ে দিয়ে ইন্ডিয়া চলে যাই, তার দেখা পাবার একটা সুপ্ত বাসনা মনে ছিলো কিনা জানি না, তবে সেটা মুখ্য উদ্দেশ্য কখনোই ছিলো না। আসলে আমি পালাতে চেয়েছিলাম। কারণ পাবনা আমার তখন একদমই ভালো লাগতো না। আমি পালালাম। বাংলাদেশ থেকে সিলেক্ট হওয়ার পরো আই.সি.সি.আর এর স্কলারশিপ আমি মিস করি, তারপর শান্তিনিকেতনে গিয়ে বিশ্বভারতীতে যেয়ে কম্পিউটার সায়েন্সে ভর্তি হই। কিন্তু ভিসা এডমিশন সব মিলিয়ে আমি দেরি করে ফেলি, যেয়ে ক্লাস শুরু করতে হয় আমাকে ২মাস ক্লাস হয়ে গেলে, ফলাফল আমার পালিয়ে যেয়ে আর খুব একটা লাভ হয়নি, নতুন করে শুরু করতে পারিনি আমি। বুঝলাম এখানেও রিটেক খাবো। আর কালচারাল ভার্সিটি হওয়ায় ইঞ্জিনিয়ার দের জন্য সেটা ভালো পরিবেশ নয়। তবে আমি আর্ট, কবিতা ছোট বেলা থেকেই পছন্দ করতাম, জুটে যায় অনেক বন্ধু, আর্টিস্ট, স্কাল্পচারিস্ট, গিটারিস্ট সহ অনেকে। তাদের সাথেই সময় কাটাতাম। রাতে হোস্টেলের ছাদে, গান কবিতা আর মদের বোতলে দুঃখ ভাগাভাগি করে নিতাম আমরা। এমনো দিন গেছে মদ খেয়ে রাস্তায়ও পড়েছিলাম সারারাত। পাশ যখন করা সম্ভব না তখন ভেবেছিলাম যতদিন আছি জীবনকে একটু ওদের মতন করে দেখি। ৬ মাস পরে আমি দেশে ফেরত আসি। পুরানো পাবনায়, কারণ আমি এখানকার ভর্তি বাতিল করিনি। কিন্তু যে আশা নিয়ে গেছিলাম তা তো হোলই না মাঝখান থেকে ১.৫ বছর লস করলাম, এবং পরিবারের সবার অমতেই ইন্ডিয়া গিয়েছিলাম, তাই বিপ্লবটা আর করা হয়নি। এমনকি ঠিকানা থাকলেও আমার সেই প্রেমিকার সাথে দেখা করার ইচ্ছে আমার আর অবশিষ্ট ছিলো না, নিজেকে তখন বড্ড বেশি ওর অযোগ্য মনে হত, কারণ শুধু ভালবাসা দিয়ে ঝালমুড়ি খাওয়া চললেও জীবন চলে না এটা বুঝতাম। ফিরে এসে আগে যেটুকু সম্মান ছিল, মনে হতে লাগলো তাও হারালাম। সবার অমতে শুধু নিজের সিদ্ধান্তে যাওয়া আবার চলে আসা, নতুন করে ছোট ভাই বোনদের সাথে ক্লাস করা, সব মিলিয়ে খুব হতাশায় ভুগতাম। কাউকে মুখ দেখাবো সেরকম পরিস্থিতিও আমার ছিলো না। পরিবার আর আমার মাঝে একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরি হয়ে গেল, আমি নিজেই নিজের ব্যর্থতার কারণে বাবা-মা ছাড়া আর সবাই কে এড়িয়ে চলতাম, কারণ তারা শুধু আমায় বিরক্তিকর প্রশ্ন করতো, কেন গেলাম, কেন ফিরে আসলাম যার উত্তর দেওয়া আদৌ আমার জন্য সম্ভব ছিল না বা কঠিন ছিল। সবাই কে এড়িয়ে চলতে চলতে একদমই একা হয়ে যাই, আমার আগের পাবনার বন্ধুরাও তখন আমার সিনিয়র, আমি ক্লাস করি নিচের ব্যাচে, সবাই কেমন অবজ্ঞার দৃষ্টি নিয়ে তাকায়, অন্তত তারা কেউ সেভাবে না তাকালেও আমার অনুভূতিটা ছিল সেরকম, কারণ নিজেকে তখন আমার ব্যর্থ বলেই মনে হত। আর অনেক দিন স্টাডি গ্যাপ হওয়ায় সব প্রায় ভুলতে বসেছি ততদিনে, ক্লাসে ভালো বুঝতাম না। লাস্ট বেঞ্চে যেয়ে চুপচাপ বসে থাকতাম। নিজেদেরকে ব্যর্থ মনে করে, রিটেক খাওয়া আরও অন্যন্য দের সাথে সিগারেট ফুঁকতাম টঙের দোকানে আর নিজেকেই ইচ্ছে মতন গালি দিতাম। বাবা-মা সপ্তাহে দু একবার ফোনে খোঁজ নিতেন বেঁচে আছি কিনা! তাদের সংগেও যেন দূরত্বটা বেশি হয়ে যায়। এরপর পরীক্ষা এলো, ৩টা পরীক্ষার পর ১০ দিনের ছুটি থাকায় মন খারাপ কাটাতে গেলাম বন্ধুর বাসায়, সেখানে করলাম বাইক এক্সিডেন্ট। রাইট কলার বোনের একরোমিও ক্লাভিকুলার জয়েন্টের সব কয়টা বন্ড (রগ, মোট ৩ টা থাকে) পারমানেন্টলি ছিড়ে গেল। বাম পাঁজরে ব্যথা পেলাম যা আজো আছে, বাম হাটুতেও পেয়েছিলাম। কিন্তু মনে পড়লে মজা লাগে, এক্সিডেন্ট এর পর হাত ঝুলে যাওয়া অবস্থায় পানি থেকে উঠে এসে অন্য দুই বন্ধুকে বলেছিলাম “সিগারেট দে মামা, আগে দুইটা টান দিয়ে নেই, তারপর দেখি হাতের কি অবস্থা”। বাকি পরীক্ষা আর দেওয়া হয়নি। হস্পিটাল, ডাক্তার সবাই বলল এর আর জোড়া লাগানোর ভালো ব্যবস্থা নেই, লাখ খানেক খরচ করে ৬০% রিকোভারি করা যাবে কিন্তু পরে যদি আবার ডাইভ টাইপের কিছু দিতে যাই ছিড়ে যেতে পারে, আর প্রোসেস টা হবে আমার পায়ের পেশি কেটে নিয়ে। আমি বললাম থাক। দরকার নেই। সুস্থ হলাম। কিন্তু প্রথম প্রথম লিখতে বেশ কষ্ট হত। ডান হাতে জোরালো কাজ করতে পারতাম না শুরুতে। আমি ব্যাডমিন্টন ভালবাসতাম, প্রতি শীতে খেলতামও, নদীতে সুযোগ পেলেই কত সাতার কেটেছি, গ্রামের ছেলে হওয়ায় প্রায়ই বিশাল নদীর চরে যেতাম সাতার কেটে, সেটার কি হবে ভেবে সিগারেট ফুঁকতাম আর নিজের দিকে তাকিয়ে হাসতাম। এরপর লেখাপড়ায়ও আগের চেয়ে হতাশ হয়ে যাই। এর পরের সেমিস্টার শুরু হল, এবারে শেষ বেঞ্চেরো কোনার দিকে যায়গা করে নিলাম। সেমিস্টারের মাঝে শীতের ভিতরে বাড়িতে গেলাম, ২৫ দিনের ছুটি ছিল, বইপত্র কিছু নিয়েছিলাম সাথে, ভেবেছিলাম অনেকদিন তো পড়া হয়না, দেখি যদি ছুটিতে নিজের কিছুটা উন্নতি করে অন্তত পাশটা কোনমতে করতে পারি কিনা। কিন্তু ভাগ্যটা হয়ত আসলেই ঘোলা জলের ডোবা ছিল। ৩/৪ দিন পরই এক সকালে উঠে আমার মনে হতে থাকে আমি বাম চোখ বন্ধ করতে পারছিনা, বাম দিকের ঠোঁটের পেশি নাড়াতে পারছিনা, ভাবলাম বোধয় স্ট্রোক করেছি, ভাবলাম যে অসম্ভব না, যে পরিমাণ টেনশনে থাকি হতেও পারে। দেখালাম ডাক্তার, তিনি বললেন স্ট্রোক না, বেলস-পালসি নামের এক দুর্লভ সমস্যা। সারতে সময় লাগবে। কথা বলতে পারতাম না ঠিক মতন, চোখ বন্ধ করতে পারতাম না, ভবিষ্যতে কি হবে তাই ভাবতে থাকি, পড়ালেখা সিকায় তোলা। ২০/২৫ দিনে বেলস-পালসি ঠিক হল। এরপর আর মনোযোগী হতে পারিনি, ফর্ম ফিলাপ করেও এক্সাম দিতে যাইনি। ফলাফল এগেইন রিটেক খাওয়া। সব মিলিয়ে আমার এইস.এস.সি এর পরের ৪ বছরের অর্জনের খাতা শুন্য, ৩/৪ টা সেমিস্টার শেষ হয়েছে মাত্র, অথচ তাতেই রিটেক আছে এখনো ১০ টা। অথচ আমার কোন বন্ধু ফাইনাল ইয়ারে পড়ে, কেউ কেউ শেষ করে ফেলেছে। এসব দেখে আরও হতাশ থাকতাম।

জীবনে অনেক কিছু করেছি, ডানপিটেপনা, উন্মত্ত ঢেউয়ে মধুমতীর বুকে সাতার কাটা, বিশাল মাঠে নিজের হাতে বানানো ঢাউস সাইজের ঘুড়ি উড়ানো, মার্বেল, লাটিম, ডাঙ্গুলি খেলা, বর্ষায় ভিজে বঁড়শিতে মাছ ধরে বেড়ানো, বন্ধুরা মিলে চড়ুইভাতি করা, নবম-দশম শ্রেণীতে স্কুল পলাতকের তালিকায় বছরের শীর্ষ দশে নিজের নাম গর্বের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা। ভোরে নাস্তা করে সাইকেল নিয়ে ২/৩ বন্ধু মিলে সারাদিন ঘুরে সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা। অন্যের বাসায় ফ্রিতে ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রীর কাজ করা। নদীতে নৌকা চালানো। স্কুলের কবিতা আবৃতিতে অনেক বছর ধরে প্রথম হওয়া, বড় আপুর উপরে ক্রাশ খাওয়া, ভালবাসার মানুষের চোখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা। সেই দিন গুলি সত্যি ভালো ছিলো।
ইন্ডিয়ার সেই তরুণীর পরো বিভিন্ন সময়ে ২/৩ টা মেয়েকে ভালো লাগে, কথা হয়। কিন্তু কখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি নতুন করে কোন রিলেশনে জড়াবো কিনা! কারণ আমার নিজের পায়ের তলার মাটিই খুব নড়বড়ে, আরেকজনের জীবন কে এই অভিশপ্ততায় কেন জড়াবো! তাই ভালো লাগলেও ভালবাসাটা আর হয়ে ওঠেনি।

কিন্তু এছাড়াও অনেক কিছু দেখেছি, যেটা কম মানুষই করে। ক্লাস ফোরে পড়া অবস্থায়, সদ্য গুলি খেয়ে পড়ে থাকা যুবকের লাশের পিঠ বেয়ে রক্ত গড়াতে দেখেছি। বন্ধুর বাবা কে গুলি করে মেরে ফেলতে শুনেছি, যে বন্ধুর সাথে এরপরো অনেক বছর স্কুলে কাটিয়েছি, এখনো আমার ভালো বন্ধু। তার চোখে নগ্ন ঘৃণা দেখেছি। একের পর এক ঘর হিন্দু পরিবারকে দেশ ছেড়ে রাত্রে ভারতে পাড়ি জমাতে দেখেছি। অন্যায় সহ্য করেও মুখ বুজে থাকতে দেখেছি শুধু হিন্দু হওয়ার অপরাধে। শান্তিনেকেতনে পাহাড়ি আদিবাসী বন্ধুদের চোখে নগ্ন ক্ষোভ আর তীব্র ঘৃণা দেখেছি বাঙ্গালীদের প্রতি। মদ খেতে খেতে তাদের কষ্টের গল্প শুনেছি। রাতের শহরের রঙ চেনার জন্য অনেক রাতই সারারাত একা একা ঘুরেছি পথে পথে। রেল ষ্টেশনের অপরিচিত মানুষের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা গাঁজা টেনেছি আর তাদের জীবন কে দেখেছি, তাদের সাথে খেয়েছি, ঘুমিয়েছি। লালনের আখড়ায় সঙ্গীতে আর ধোঁয়ায় বিভোর হয়েছি। আইলার বানে ভেসে যাওয়া মানুষের কষ্ট গুলো দেখেছি একমাস ওই এলাকায় ওই সময় থাকার কারণে। কলেজ লাইফের কাছের বন্ধুকে ফাঁকি দিয়ে চলে যেতে দেখেছি, যার সাথে মাত্র ৮/৯ মাস আগেও একসাথে টং দোকানে আড্ডা দিয়েছি, রাতে তার সাথে ঘুরেছি। আমায় বরং সে শান্তনা দিয়েছিলো, আজ সে নেই!

“এক সময় মাসের পর মাস একটা ছোট রুমে দিনের বেলায় নিজেকে দরজা জানালা বন্ধ করে আবদ্ধ করে রেখেছি আমি”। কারণ বাইরের জগত অসহ্য লাগতো। এক শ্রেণীর মানুষ খেটে মরছে অথচ সামান্য অধিকার টুকুও পাচ্ছে না। খুব কাছ থেকে দেখেছি আমি এদের। কিন্তু এটা ভেবেও খারাপ লেগেছে এদের থেকে আমি অনেক ভাল আছি এখনো, কিন্তু তারপরো আমি হতাশ কেনো! এর কারণ খুঁজে পাইনি। হয়ত এই ব্যাপার গুলো বুঝতে পারাটাও ক্ষোভের জন্ম দেয়, আর সেই ক্ষোভ থেকে কিছু করতে না পারাটাও হয়ত হতাশার জন্ম দেয়, কি জানি!!

ছোট বেলা থেকেই অনেক ব্যাপার গুলো নিয়ে মন খুত খুত করতো। আমার হিন্দু মুসলিম, ধনী গরীব, ভাল খারাপ, সব ধরনেরই ফ্রেন্ড ছিল অনেক বেশি। আমি ক্লাসের সবার সাথেই দু-দশ দিন করে আলাদা ভাবে মিশতাম। এটা আমার একটা অবচেতন স্টাডি ছিল, সবাই কে চেনার চেষ্টা করা। আমি এক সময় ট্রাফিক ক্রস সেকশনে যেয়েও দাঁড়িয়ে থাকতাম ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের শহর দেখার জন্য। সবার বাসায় সব ধরণের অনুষ্ঠানেই যেতাম, খেতাম। তেমন কোন বাছ বিচার কোনদিনই ছিলো না আমার, হিন্দু মুসলিম দের পারস্পারিক বিদ্বেষ বেশ উপলব্ধি করেছি আমি ছোটবেলাতেই (ব্যক্তি পর্যায়ে না, কিন্তু একই ব্যক্তি যে তার অন্য ধর্মের বন্ধুকে অনেক বেশি পছন্দ করে সেই একই ব্যক্তি আবার সেই অন্য বন্ধুর ধর্ম সম্পর্কে বিদ্বেষ পোষণ করে)। সেখান থেকেই একরকম ধর্ম সম্পর্কে নেগেটিভ মনোভাব জন্মাতে থাকে, এর পর স্রষ্টার কাছে বারবার চাওয়া, না পাওয়া, আর তারপর ভার্সিটিতে উঠে নেটের বদৌলতে ব্লগ জগত দেখতে পাওয়া সব মিলিয়ে আমি স্কেপ্টিক হয়ে যাই। বাবার সাথে মাঝে মাঝেই এ নিয়ে কথা হত, তিনি বলতেন আমি যেন লেখালিখি না করি। আমি বলতাম আমি শুধু পড়ি, করি না (মনে মনে বলতাম আমার সেই যোগ্যতা বা সাহস কোথায়! নিজের অক্ষমতা গুলো নিয়েও খারাপ লাগতো এই ভেবে যে এই পরিবর্তনের আন্দোলনের আমিও অংশীদার না) স্কেপ্টিক হওয়ার শুরুতে একাকীত্ব বোধও অনেক বেড়ে যায়। মনে হয় কেউ নেই! কিন্তু এখন আর কিছু মনে হয় না, কেউ থাকলেই বা কি! আর না থাকলেই বা কি!
নিজের জীবনের উপলব্ধি থেকে কিছুটা দায়বদ্ধতা অনুভব করায় এক সময় সাধারণ অ-স্পর্শকাতর বিষয়ের প্রতি লেখার ইচ্ছে জাগে। খুব বেশিদুর এগুতে পারিনি, কারণ এগুলো সম্প্রতি ঘটনা। নিজের জীবনের কিছু ব্যর্থতার খানিকটা অংশ যৌনতার প্রতি ভ্রান্ত ধারণা থাকার ফলে হওয়ায় ওটাই শুরুতে বেছে নেই। “যৌনতা ও জীবনঃ একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা” সিরিজে দুটি লেখা আছে আমার, ‘মুক্তমনা’ আর ‘বিজ্ঞানযাত্রায়’।

“একসময় বাবার প্রতি অনেক ক্ষোভ ছিলো। এখন একটুও নেই। আমি তাকে এখন চিনি। কিন্তু সে আমায় হয়ত চেনে না, সে হয়ত ভাবে আমি আগের মতনই আছি। ছোটবেলায় বুঝতাম না, বড় হয়ে বুঝি বাবা কি জিনিষ। আমাকে নিয়ে তার স্বপ্ন গুলো আমি পুরন করতে না পারায় মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয়। নিজের জন্য নিজের ব্যর্থতা নিয়ে আমার কোন কিছুই মনে হয় না, কিন্তু বাবার দিকে আমি এখন চোখ তুলে তাকাতে পারি না। নিজেকে খুব ক্ষুদ্র লাগে। তার সামনে পড়লে মনে হয় পালিয়ে বাঁচি। বোনটাও বড় হয়ে গেছে এখন। তাকেও কিছু দিতে পারিনি। দাদার কর্তব্য গুলোর একটাও পালন করা হয়নি। মায়ের কথা আর নাই বা বললাম, তিনি তো মা-ই। কিন্তু কখনো বলা হয়নি ‘তোমায় অনেক ভালোবাসি মা’ শুধু হয়তো খারাপ ব্যবহারই করেছি।

বন্ধ রুমে সারাদিন থাকা। উস্কো খুস্কো চুল দাড়ি নিয়ে একই টিশার্ট-প্যান্টে ১০/১২ দিন একটানা চালিয়ে দেওয়া, সময় মতন খাওয়া, ঘুমে না যাওয়া, সিগারেটের ধোঁয়ায় রুম অন্ধকার করে ফেলা, এগুলো অনেক করেছি। এখন চাই নিজেকে বদলাতে। জানি না আমার রিটেকের/ফেলের পাহাড় ঠেলে আমি নুন্যতম রেজাল্ট নিয়েও এখান থেকে পাশ করতে পারবো কিনা! জানি না পরে কি হবে! শুধু জানি আমি থেমে যাব না। আর কখনো পালাবো না আমি। অনেক পালিয়েছি। সাফল্য আসুক বা না আসুক,


    “The woods are lovely, dark and deep,
    But I have promises to keep,
    And miles to go before I sleep,
    And miles to go before I sleep… ”

অনেকদিন থেকে ভাবছিলাম নিজেকে নিয়ে লিখব কিনা! অনুবাদকের আড্ডায় দেখলাম ওরা বিষণ্ণতায় ভুগা মানুষদের কিছুটা হলেও সহযোগিতা করতে একটা বই বের করেছে। তাই ভাবলাম লিখে ফেলি। ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা হলেও ইতিহাসে জমা থাকুক। শুরুতে অনেক দ্বিধা দন্দে ভুগছিলাম, কেন লিখবো নিজের ব্যক্তি জীবনের কথা! নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপার কেন জানাবো সবাইকে! কিন্তু দ্বিধা-দন্দ ঝেড়ে লিখে ফেললাম। যে যা মনে করে করুক, “Because I Don’t Give a Shit” । এটা আমার জীবন, বিষণ্ণতায় ভুগা মানুষ গুলোর এক একটা না বলা হেরে যাওয়ার গল্প আছে। কেন মানুষ গুলো একটু একটু করে মরবে!

সে যতই খারাপ হোক, ভুল করুক বা খারাপ কাজ করুক, তার কি বেঁচে থাকার কোন অধিকারই নেই?