লেখকঃ মিঠুন তলাপাত্র

২০১১-১২ সময়টা আমার আর চন্দ্রা’র (আমার অর্ধাঙ্গিনী) জন্য ছিল একটি দীর্ঘ বিমর্ষ সময়। দুই পরিবারের অমতে ভিন্নধর্মী দুইজন এর বিয়ে, ঢাকায় মাথা গোঁজার ঠায় খোজা, ছোট্ট একটি চিলেকোঠার ঘরে সংসার পাতানো, কখনো একজনের চাকুরী নেই, মাস শেষে বেতন না পাওয়া, পরিবারের লোকজনের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, হঠাত করে অসুস্থ হয়ে পরা এইসব মিলিয়ে দিনাতিপাত করছি। এইরকম কোন এক সময়ে চন্দ্রার মাথায় এক আজব প্রশ্ন উঁকি দিল। মৃত্যুর পরে পুরুষেরা বেহেস্তে গেলে ৭২ টি হুর পাবে আর নারী পাবে তার স্বামী সেবা করার সুযোগ, কেন এই বৈষম্য? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ইন্টারনেট এ বিভিন্ন আর্টিকেল- লেখা পড়ে মাথা খারাপ। বুঝতে পারলো সব ধোঁকাবাজি। কিন্তু এইটা মেনে নিতে পারছিল না যে মাথার উপর সত্যিই কেউ নেই যার কাছে বিপদে-আপদে অলৌকিক কিছু আশা করা যায়।
ঈশ্বরে বিশ্বাসের ব্যাপারে আমার কখনই আস্থা ছিল না। নিন্মবিত্ত পরিবারে বড় হয়েছি, সব কিছুতেই ঈশ্বরে প্রার্থনা করে না পাওয়াতে বিরক্ত লাগত ছোটবেলাতেই। বাংলায় মহাভারত, বাবার সংগ্রহে থাকা হুমায়ুন আজাদ, তসলিমা নাসরিন, চাচাতো বোনের কাছ থেকে আরজ আলী মাতব্বর পড়ে এইসব ভুংভাং এর মোহ স্কুল জীবনেই কেটে গিয়েছিল। পাড়ার বিভিন্ন পূজার আয়োজনে অনেক আগ্রহ ছিল, কারন এই সময়গুলোতে বাব-মার শাসনের আড়ালে থাকতে পারতাম। যাই হোক, নিজে অবিশ্বাসী হলেও, চন্দ্রাকে ঠিক মত বুঝাতে পারতাম না ব্যাপারগুলো। যেহেতু ধর্মীয় আচার-বিচারে ওর কোন বাড়াবাড়ি ছিল না, তাই বাঁধা দিতাম না।
একদিন বিকেলে আমাদের এক বন্ধু (পুরোদমে নাস্তিক) ওকে অনেক সুন্দর করে বুঝালো, ঈশ্বর বলে কিছু নেই, এই সত্যিটা মানতেই হবে। বন্ধুর কাছেই খোঁজ পেলাম মুক্তমনা ব্লগ ও অভিজিৎ রায় এর। নাগরিক ব্লগ, সচলায়তন, আমার ব্লগ সহ অন্যান্য ব্লগের লেখা পড়লেও মুক্তমনা ব্লগের লেখা কখনো পড়া হয় নি। বন্ধুর কথা শুনে ঢুঁ মারলাম মুক্তমনাতে, গোগ্রাসে গিলতাম প্রত্যেকটা লেখা, সারাদিন অফিসে বসে যখনি সময় পেতাম মুক্তমনাতে চলে যেতাম। অভিজিৎ রায়, বন্যা আহমেদ, ভবঘুরে, বিপ্লব রহমান, গীতা দাস সহ সবার লেখা পড়ার চেষ্টা করতাম। অফিস থেকে বাসায় ফিরে চিলেকোঠার ছাঁদে দুই কাপ চা হাতে নিয়ে বসতাম আর দুইজনের কে কি পড়লাম তাই নিয়ে গল্প করতাম। বলাই বাহুল্য অভিজিৎ দা আর বন্যা আপুর লেখা ও লেখার নিচে বিভিন্ন মন্তব্য-সমালোচনা-আলোচনা-প্রশ্ন-উত্তর নিয়ে মেতে থাকতাম। ফেসবুক এ যখনি কোন ইস্যু নিয়ে শোরগোল হত, অপেক্ষায় থাকতাম কখন অভিজিৎ দা এই নিয়ে কিছু লিখবে। তিনি লিখতেন একটু সময় নিয়ে, একটু গুছিয়ে, রেফারেন্স সহকারে। তখন যে কি খুশি হতাম ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। আমাদের দুই জনের যেই আগে দেখবে সাথে সাথে আরেকজনকে ফোন দিয়ে বলতাম দেখ দেখ অভিজিৎ দা কি লিখসে।
একদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে দেখি চন্দ্রা’র খুব মন খারাপ। কি হইসে? বন্যা আপার ক্যান্সার ধরা পরার সময়কালীন অভিজিৎ দা ও বন্যা আপার বিভিন্ন নোট লেখা পড়ে এই অবস্থা।
কেউ যদি আমার জিজ্ঞেস করে, কেন অভিজিৎ এর লেখা এত পছন্দ, বিজ্ঞান নিয়ে তো অনেকেই লিখেন? তাহলে আমি বলব প্রধানত তিনটি কারণ। এক, শুধু বিজ্ঞান নয়, যেকোন লেখাতেই রেফারেন্স এর উল্লেখ; দুই, সাবলীল ভাষায় অনেকটা হালকা মেজাজে অনেক ভারি-কঠিন বিষয় গুলোকে উপস্থাপন এবং তিন, বিজ্ঞান ও কবির (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) সাথে একটা ফিউশন তৈরি করা। শেষ কারণটা অনেক বেশী প্রভাবিত করে আমাকে।
মানুষ হিসেবে দেখলে অভিজিৎ রায়কে কখনো মুক্তচিন্তা-মানবিকতা কোন ইস্যুতেই আপোষ করতে দেখিনি। দেখেছি যখনই মুক্তচিন্তায় আঘাত হেনেছে কলম তুলে নিয়েছেন। মৃত্যু ভয় তো তার লেখার মধ্যে ছিলই না।
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী রাত এ যখন খবর পাই, কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। পরদিন সকালে রাজু ভাস্কর্যের সামনে প্রতিবাদ সভায় যাই, গিয়ে দেখলাম বিভিন্ন সময়ে নাস্তিক হত্যা ইস্যুতে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকতো কিংবা ইনিয়ে বিনিয়ে নাস্তিকদের লেখালেখিকে দায়ী করত, সালাফি নাস্তিক ট্যাগ দিত তাদের নেতৃত্বেই এইসব আন্দোলন হচ্ছে। অস্থির লাগতে থাকে, পাগলের মতন এদিক-সেদিক একা একা ঘুরে বাসায় ফিরে আসি। যেইদিন তার দেহ বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রদ্ধা অর্পণের জন্য নিয়ে আসা হল, আশা করেছিলাম হয়ত ২০-২৫ জন মানুষ হয়তো আসবেন সেখানে। প্রায় শ’দুয়েক মানুষ জমায়েত হয়েছিল ঠিকই কিন্তু অগ্রভাবে তারাই ছিল যারা থাবা বাবা’র মৃত্যুর পরে নিজেদের আস্তিক প্রমাণে উঠে পরে লেগেছিল। গত একটা বছর কি যে অস্থিরতা আর হাহাকার এর মধ্যে পার করেছি বিশ্বাস করতে পারি না নিজেও। একদিন স্বপ্নে দেখলাম, আমাদের বাসার সামনের উঠান বিশাল খানাপিনার আয়োজন হচ্ছে, অনেক মন্ত্রী-এমপি এসেছেন সেখানে। আদিখ্যেতার বাড়াবাড়ি দেখে বিরক্ত হয়ে একটু আড়ালে গিয়ে সিগারেট ধরাতে যেয়ে দেখি কয়েকজন ব্যক্তি একজন বয়স্ক ভদ্রলোককে সান্তনা দিচ্ছেন “দাদা, এইখানে কেন এলেন, শুধুশুধুই এইসব লোকের কাছে মাথা নিচু করা”। উত্তরে বয়স্ক লোকটি কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন, “ভেবেছিলাম সবাই যেহেতু এখানে আছে, বিচারের আশ্বাস হয়তো পাব। আমার ছেলেটাকে সবার সামনে কুপিয়ে মেরে ফেললো!” দেখতে পেলাম ইনি আর কেউ না অজয় রায়। ঘুম ভেঙ্গে ধড়ফড় করে উঠে বসি, শূন্য লাগতে থাকে চারপাশ।
প্রিয় অভিজিৎ দা, আপনি যে আলো আমাদের মাঝে ছড়িয়ে গেছেন, সেই আলোতে আমরা এখন সাদা আর কালোর মাঝখানে যে ধূসর রঙ থাকে তা বুঝতে পারি। কিন্তু কোথা থেকে কি হয়ে গেল, সবার মাঝে আলো ছড়াতে এসে নিজেই আঁধারে হারিয়ে গেলেন। অনেক ইচ্ছে ছিল একদিন আপনার আর বন্যা আপার সাথে দেখা করব। জানতাম বাংলাদেশে হয়তো দেখা হবে না, যদি কোনদিন আমেরিকা যেতে পারি তাহলে অবশ্যই দেখা করব। আপনার রক্তের উপর দিয়ে হেঁটে বইমেলায় যেতে মন চায় না, প্রতিবাদহীনতা- বিচারহীনতায় বার বার মুখ গুজে থাকা ছাড়া কিছুই করার পাই না। চাকুরী-ঘরে ফেরা-আড্ডা-ঘুরাঘুরি সব কিছুর পরে নিজেকে নিষ্প্রাণ লাগে, আপনার শূন্যতা ক্ষনে ক্ষনে মনে হাহাকার জাগিয়ে তোলে। আপনার ছড়ানো আলোর কারণেই মন কে বুঝ দিতে পারি না, আপনি হয়তো আকাশের কোন স্থানে ভালোই আছেন কিংবা কল্পনাও করতে পারি না টাইম ট্রাভেল এর কথা অথবা আশা করতে পারছি না আমি কোন দুঃস্বপ্ন দেখেছি। আমাকে এই শূন্যতা মেনে নিতে হচ্ছে, এইটাই সবচাইতে কষ্টের। তবে হ্যাঁ, আপনি নেই বলে আবার সেই অন্ধকার কুসংসকারাচ্ছন্ন অন্ধকূপে ফিরে যাবো না। আরো জানবো, এই আলোর পথেই হেঁটে যাবো আর অপেক্ষায় থাকবো আরো এক নক্ষত্রের। আপনাকে ওরা থামিয়ে দিয়েছে, কিন্তু আমাদের মত যারা আনাচে-কানাচে জেগে বসে আছি, তাদের কিভাবে থামাবে, কতজন কে থামাবে? একদিন এইসব অন্ধকারেরা হার মানবে, সেইদিন আমরা আপনার আলোর প্রদীপ তাদের হাতে তুলে দিব, আলোর ফোয়ারা ছুটবে চারিদিকে।

মিঠুন তলাপাত্র