লেখকঃ পলাশ পাল
গত কয়েকদিন ধরেই ক্লাস নাইনের ছাত্র রফিকুলের খুব মন খারাপ। স্কুলে সরস্বতী পুজোর প্রস্তুতি চলছে। সকলেই নানা কাজে ব্যস্ত। কেউ প্যান্ডেলের দায়িত্ব নিয়েছে, কেউ নিমন্ত্রণ কার্ড বিলি করতে ব্যস্ত, কেউ করছে সাজসজ্জার পরিকল্পনা, আবার কেউ বা ব্যস্ত বাজারের ফর্দ তৈরিতে। সকলেই মিলেমিশে কাজ করছে। একটু আধটু ঝগড়া-বিবাদ যে হয়না, তা মোটেই নয়, তবে সেসব মিটে যেতেও সময় লাগে সামান্যই। এই আড়ি এই ভাব—এসব তো শিশু চরিত্রের একটা বিশেষ গুণ। কিন্তু যে ছেলেটি খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে স্কুলের যে কোনও ব্যাপারে সবার আগে ঝাপিয়ে পড়ে, সরস্বতী পুজোর মিটিং ডাকার ক্ষেত্রেও যার ভূমিকা ছিল সর্বাগ্রে, সে এমন মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কেন?
একটু খোঁজ-খবর নিয়ে যেটুকু জানা গেল তা হল, শুধুমাত্র ধর্ম আলাদা হওয়ার জন্য রফিকুলের পুজোয় অর্ন্তভূক্তি নিয়ে আপত্তি তুলেছে কেউ কেউ। সকলেই স্তম্ভিত। একটা হাড়হিম করা স্রোত মেরুদন্ডের ভিতর থেকে যেন তীর তীর নামতে লাগল। এরকম তো পূর্বে কখনও ঘটেছে বলে মনে পড়ছে না। শুধুমাত্র আলাদা ধর্মীয় পরিবারের সন্তান হবার জন্য একটি ছেলের প্রতি এই বৈষম্যমূলক আচরণ—একি মেনে নেওয়া সম্ভব? অল্প বয়সের এই সমস্ত ছেলেদের মধ্যে এমন ধ্বংসাত্মক মানসিকতা কীভাবে এল? নাকি, অসহিষ্ণুতার একটা চোরাস্রোত সব সময়ে ছিল, যা আমরা আগে উপলদ্ধি করিনি। আমাদের বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। তবে সমস্যা যে খুবই গভীর ও বিপজ্জনক তা বুঝতে বাকী থাকল না।
দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২১ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বাস। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে দেশের অধিকাংশ স্কুল-কলেজে প্রায় সমস্ত সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা মিলে মিশে একসঙ্গে পড়াশোনা করে। সকলেরই নানা রকম উৎসব-অনুষ্ঠান রয়েছে। অথচ সরস্বতী পুজো ছাড়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলির কোনো ধর্মীয় আচার স্কুলে বা কলেজে পালন করা হয় বলে তো শোনা যায় না। ভিন্ন সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি সত্ত্বেও হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে তবে এই ব্যতিক্রম কেন? শুধুমাত্র সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় ভাবাবেগকে লালন করা আর ধর্মীয় স্বাধীনতার জয়গান করা তো একজিনিস নয়। বরং এই প্রবণতা রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শকেও কলুশিত করে।
ভারতীয় সংবিধানের ১৫(১) নং ধারায় স্পষ্টতই বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্র কেবল মাত্র ধর্ম, বর্ণ, জাতি, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান ভেদে বা তাদের কোনো একটির ভিত্তিতে কোনো নাগরিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারবে না। আবার ২৫(১) ধারায় সকল ব্যক্তির বিবেকের স্বাধীনতা অনুসারে ধর্মাচরণ এবং ধর্মপ্রচারের অধিকারের পাশাপাশি কোনো ধর্মীয় বিষয় হস্তক্ষেপ না করার কথাও স্বীকার করা হয়েছে। একইসঙ্গে ২৮(১) নং ধারায় সরকারি বা সম্পূর্ণভাবে সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ধর্মাচরণ যদি ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার হয়, তবে স্কুলের মতো সর্বজনীন, সমাজিক প্রতিষ্ঠানে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন তো শুধুমাত্র সংবিধানের উলঙ্ঘন নয়, ধর্মীয় ভেদাভেদকেও একপ্রকার মান্যতা দেওয়ার প্রচ্ছন্ন বহিঃপ্রকাশ। এক দিকে ধর্মনিরপেক্ষার আদর্শকে প্রচার করা, আন্যদিকে সংখ্যগুরুর ধর্মকে পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসাবে অলিখিত মান্যতা দেবার ধ্বংসাত্মক প্রবণতা তো জেনেশুনে আগুনে আহুতি দেবার নামান্তর।
আধুনিক শিক্ষায় খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিতর্কসভা, বিজ্ঞান প্রদর্শনী সহ স্কুলের যাবতীয় কার্যক্রমকে সহ-পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভূক্ত বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এই সমস্ত কাজের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের সাংগঠনিক প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। সৌভ্রাতৃত্ব বোধ, জাতীয় সংহতি আত্মনির্ভরশীলতা সর্বোপরি স্বাধীন ও সৃজনশীল চিন্তাভাবনা বিকাশের ক্ষেত্রেও সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলীর গুরুত্ব অনেকখানি। কিন্তু সরস্বতী পুজোর মতো কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় উৎসব কী স্কুলের সহ-পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভূক্ত হতে পারে, নাকি হওয়া উচিত? যে অনুষ্ঠান শিশুদের মধ্যে ভেদাভেদের পরিচয় উসকে দেয়, সম্প্রীতিবোধকে কশাঘাত করে—তাকে জিইয়ে রাখা মানে কী সাম্প্রদায়িকতার ভ্রুণকে প্রতিপালন করা নয়? ঔপনিবেশিক শাসনামলে, জাতীয়তাবাদের উত্তোরণের জন্য ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহার কিংবা হিন্দু জাতীয়তাবাদকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সমার্থক হিসাবে প্রচার করার রক্তাক্ত পরিণতির ইতিহাস কী আমরা ভুলতে বসেছি?
যে-কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চরিত্র ধর্মনিরপেক্ষ হবে, সেটাই তো কাম্য। ধর্মের ভিত্তিতে শিশুদের পরিচয় নির্ধারণ করা, শিশুমনের সরলতার সুযোগ নিয়ে কোনও ধর্মীয় মতবাদ চাপিয়ে দেওয়া মানে তো শিশুর মৌলিক অধিকার খর্ব করা। স্কুল-কলেজে শুধুমাত্র সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় আচার পালন তাদের মনে যেমন আধিপত্যবাদের জন্ম দিতে পারে, তেমনি তৈরি হতে পারে ধর্মীয় অহংবোধ। পরিণতি হিসাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অনেক ক্ষেত্রে হীনমন্যতাবোধ ও নিরাপত্তাহীনতার শিকার হয়। এতে শিশুর সার্বিক বিকাশের পথ ব্যহত হয়, কখনও বা ভুল রাস্তা বেছে নেওয়ার অন্যতম কারণ হয়ে ওঠে। তাই রাষ্ট্রের কর্তব্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখতে তৎপর হওয়া। শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষ আনুষ্ঠান পালনেও উৎসাহিত করা। শিশু যাতে জীবনের শুরুতে কোনো ভেদনীতির শিকার না হয়, তা দেখাও রাষ্ট্রের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তার পরিবর্তে রাষ্ট্র নিজেই যদি ভেদাভেদকে প্রশ্রয় দেয়, নির্দিষ্ট একটি ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করে, তাকে আর যাই হোক, গণতন্ত্রের বলা যায় না।
ইদানীং ধর্মনিরপেক্ষতা, সহিষ্ণুতা নিয়ে নানা রকমের চর্চা, তর্ক-বিতর্ক শোনা যাচ্ছে। কিন্তু যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বোঝা প্রয়োজন, ধর্মনিরপেক্ষতা, সহিষ্ণুতা যাদুমন্ত্রবলে তৈরি হয় না। নিরন্তর অনুশীলন ও শিক্ষার মধ্য দিয়েই তা লাভ করা সম্ভব। তবেই তো আজকের শিশুরা প্রকৃত অর্থেই আগামী দিনের সুনাগরিক হয়ে উঠবে। কেবল মাত্র উপসর্গ নয়, উৎস জানাটাও রোগ নির্ণয়েয় জন্য সমান জরুরি। অন্যথায় রোগের নিরাময় কীভাবে সম্ভব! আমারা কবে এই সারমর্মটুকু বুঝে উঠতে পারব?
পরেশ পাল মহাশয়কে উত্তর দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। মহাশয় বোধহয় বিদ্রূপাত্মক ও শ্লেষাত্মক কথা বলতে অভস্ত্য। এতে মনে কিছু করিনা। কারন যে যেভাবে বলতে অভ্যস্ত। আমাদের প্রত্যেকের মনে রাখা প্য্যোজন যে, সবাই সমান ভাবে বা একভাবে ভাবেনা। তাই বলে কাউকে অস্ম্মান করা ঠিক নয়। প্রত্যেকেরই সম্মান প্রাপ্য। যাক, মহাশয়কে অনুরোধ আমার বক্তব্যকে একটু বুঝার চেষ্ঠা করবেন। আমি বিদ্যালয়ে সরস্বতী পূজা পক্ষে বক্তব্য রেখেছি কি? না কি তার ক্রিয়া অয়া প্রতিক্রিয়ার ভাব বুঝাতে চেয়েছি। আমার বক্তব্যে আপনি ধর্ম ও বৈষ্ম্যের বিজ দেখলেন কি ভাবে বুঝে উঠতে পারলাম না। আমি আপনার লেখার সমালোচনা করিনি। ভালো হয় যদি আমার মন্তব্যকে আর একটু দেখেনেন।
আপনাকে অনুরোধ, এত অধৈর্য হবেন না। আপনারা মুক্তচিন্তার শ্রেণী হিসাবে গ্ণ্য। সমাজের প্রত্যেক শ্রেণীর মানুষের দিকে তাকিয়ে লিখবেন – তবে কোন শ্রেণীর মানুষ যেন নিজকে সার্বিক ভাবে খারপ না ভাবে বা মনে কষ্ট না পায়।
স্কুল/ বিদ্যালয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সেখানে ছাত্রদের অধিকারই স্বীকৃত, তবে তাদের কে ও বুঝাতে হবে ও বুঝতে দিতে হবে। স্নগবিধানে সংখ্যা গরিষ্ঠের মতামতের গুরুত্ব আছে। সেই দিক দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠরা নিজেদের মতকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করবে। তারজন্য জন্য সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তবে সন শ্রেণীর মানুষের সহমত থাকা উচিত। সরকারের উপর চাপ দিতে হবে।ধর্ম নিরপেক্ষতার সংজ্ঞা যা দিয়েছেন , তা ঠিক কি? আপনার লেখার মূল উদ্দেশ্য কিছুটা হলেও অনুধাবন করেছি।
সরস্বতী পূজা ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান যদিস্কুলে/ বিদ্যালয়ে হওয়া বাঞ্ছনীয় না হয়, তবে ধর্মীয় আইনগুলি কেন বাতিল হবেনা। কারন দেশটা ধর্ম নিরপেক্ষতার উপর দাঁড়িয়ে। আমার বক্তব্য এখানে। তারজন্য আন্দোলন করা জরুরী, গো-মাংস খাওয়াটা জরুরী নয়।
সবশেষে আপনার লেখের জন্য ধন্যবাদ জানাই।
“সরস্বতী পূজা ও ধর্মনিরপেক্ষতার স্বরূপ” লেখাটি পড়ে মনে হল, লেখকের একটা মনগড়া ঘটনা”
আপনার অনুমান ক্ষমতা তো দেখছি সংঘাতিক, জ্যোতিষিও হার মানবে। কী করে এতোটা নিশ্চিত হলেন? চারপাশের ঘটনার দিকে তাকান। চোখ-কান খোলা রাখুন। স্কুলগুলিতে ঘুরে দেখুন।
”সরস্বতী পুজাকে কোন ধর্মের ধর্মীয় অনুষ্ঠান না বলে – একে ছাত্রদের অনুষ্ঠান বলা যেতে পারে।”
তাই কী? ছাত্র বলতে শুধুমাত্র আমি তো জানি সকলেই বোঝায়—তার কিনো ধর্মীয় পরিচয় হয় না। হতে পারে ধর্মীয় দিক থেকে হিন্দু পরিবারের সন্তান , হতে পারে মুসলমান পরিবারের সন্তান, হতে পারে বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টান পরিবারের সন্তান, আবার হতেও পারে সে এমন একটি পরিবারের সন্তান যে পরিবার সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় পরিচয়ের উর্ধ্বে অবস্থান করছে। আপনার মন্তব্যের মধ্যেই তো বৈষম্যের বীজ লুকিয়ে রয়েছে। ‘ছাত্র’ শব্দটি কেনো নির্দষ্ট ধর্মের অর্ন্তভূক্ত কী করে হতে পারে?
”সরস্বতী পূজা সহ-পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে? তার প্রমান তার কাছে আছে কি?”
এতো ভারী অদ্ভুত কথা বললেন। স্কুলের যাবতীয় কার্যক্রম সহ-পাঠক্রম বলেই গন্য হয়। এটা আবার প্রমান করার কী আছে, এতো আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞান পড়লেই জানা যায়। সরস্বতী পুজো তো আর স্কুলের বাইরে হচ্ছে না, আর বাইরের ছেলেরাও করছে না।
”ভারতে নাগরিক সংখ্যায় মুসলমান জনসংখ্যা ৩৫% ভাগের উপর। তারচেয়েও অনেক অনেক অল্প সংখ্যার জাতি আছে। তাদের সংখ্যা লঘু আখ্যা দেওয়া হবে নাকি তাদের সাথে মুসলমানদেরও দেওয়া হবে?”
আপনি ভারতের জনসংখ্যার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যাকে মিলিয়ে ফেলছেন বলে মনে হচ্ছে। ওয়েবসাইট খুলে আর একবার দেখে নিন, নিজেই নিজের ভুলটা বুঝতে পারবেন। ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করলে সংখ্যালঘু বললে শুধু মুসলমানদের বোঝাবে কেন? হিন্দু সম্প্রদায় বাদ দিয়ে সকলেই সংখ্যালঘু—যেমন—শিখ, বৌদ্ধ,খ্রিস্টান, পার্সি…।
সবশেষে বলি, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মের সঙ্গে গলাগলি করা নয়, প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্ম সম্পর্কে রাষ্টের উদাসীনতাকে বোঝায়। ধর্ম চিন্তার মুক্তিতেই আসে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা। আর ধর্মাচারন যখন ব্যক্তির নিজস্ব ব্যপার, সাংবিধানিক অধিকার তখন তা বাড়িতে না হয়ে স্কুলে কেন। স্কুল তো ধর্মাচারনের জায়গা নয়, ওটা একটি সমাজিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যার কোনো ধর্ম নেই।
আর ধর্ম আছে বলেই হিন্দু আইন মুসলমান আইন আছে। ওই পরগাছাটা না থাকলে সকলের জন্য সমান, একই আইন হওয়া সম্ভব। দেখছেন না গোরু আর শুয়ের মাংস খাওয়া নিয়ে ঝগড়াটা কোন পর্যায়ে চলে যেতে পারে।
আরো একটি কথা আপনার জন্য, আমার লেখাটির মূল উদ্দেশ্য আপনি বোধহয় বুঝতে পারেননি। শুধুমাত্র সরস্বতী পুজো কেন, স্কুল-কলেজের মতো সমাজিক প্রতিষ্ঠান কোনো ধর্মাচারণের জায়গা হতে পারে না, আমার বলার উদ্দেশ্য এটাই।
“সরস্বতী পূজা ও ধর্মনিরপেক্ষতার স্বরূপ” লেখাটি পড়ে মনে হল, লেখকের একটা মনগড়া ঘটনা তুলে ধরে অশান্তির আগুন উচকানোর চেষ্ঠা। যে ঘটনা ঘটেনি তাকে জনসমক্ষে তুলে ধরা ঠিক নয়। দেশের, সমাজের সব মানুষ সমান নয়। এই নিয়ে অনেক কিছু অনর্থ হতে পারে। লেখক এই রকম মন গড়া ঘটনা না লিখে, সরাসরি বলতে পারতো যে, সরস্বতী পূজা স্কুলে করা উচিত কি অনুচিত।
দ্বিতীয়তঃ লেখক বৈষম্য মূলক আচরনের কথা এমন ভাবে তুলে ধরেছেন যে, মনে হয় ইসলাম ধর্মালম্বী ছাত্র-ছাত্রীরা সব-ইচ্ছায় সরস্বতী পূজায় অংশ গ্রহণ চায় বা তাদের অভিভাবকেরা অনুমতি দেয়। ছাত্রাবস্থায় ও পরবর্তী সময়েও দেখিনি যে, বেশীর ভাগ মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীরা সরস্বতী পূজায় অংশ গ্রহণ করছে এবং তাদের অভিভাবকেরা এই ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছে। তবে কিছু মুক্তমনা ছাত্র-ছাত্রী অংশ গ্রহণ করতে পারে। তাদের সংখ্যা খুবই কম। যদি স্ব-ইচ্ছায় অংশ গ্রহণ না করে তবে বৈষম্য মূলক আচরণের মধ্যে পড়েনা।
তৃতীয়তঃ লেখক ভারতীয় সংবিধানের কয়েকটি ধারা যেমন ১৫(১), ২৫(১) এবং ২৮(১) লেখায় তুলে ধরেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বলতে চাই যে, সরস্বতী পূজার সাথে বৈষম্য মূলক আচরণের প্রশ্ন আসে কেন? বৈষম্য মূলক আচরণ তখনি হবে যখন ইচ্ছাকৃত ভাবে কাউকে কোন অনুষ্ঠানে যোগদানে বাঁধা দেওয়া বা যোগদান করতে না দেওয়া। সরস্বতী পূজাকে কোন ধর্মের ধর্মীয় অনুষ্ঠান না বলে – একে ছাত্রদের অনুষ্ঠান বলা যেতে পারে। গল্পের নায়ক রফিকুল পূজার করার জন্য মিটিং ডেকেছিল, কিন্তু কেউ কেউ আপত্তি করার জন্য সে পূজায় অংশ গ্রহণ করেনি। তাই বলে এখানে বৈষম্য মূলক আচরণের প্রশ্ন আসে বলে মনে হয়না। যে কোন কাজে যে কেউ কোন প্রশ্ন তুলতেই পারে, তারজন্য তাকে প্রাধ্যান্য দেওয়া উচিত হবেনা। এখানে রফিকুল কে কেউ জোর করে অনুষ্ঠানে যোগদান করতে দেয়নি, এমন ঘটনা ঘটেনি। সে সব-ইচ্ছায় যোগদান করেনি। সুতরাং বৈষম্য মূলক আচরণের প্রশ্ন আসে না। রফিকুল মুক্তমনা, ধর্মীয় ব্যপারে গোঁড়ামী ছিলনা। কিন্তু লেখক এখানে তার অভিবাবকদের মতামত প্রকাশ করেনি। তারা কতখানি মুক্তমনা তা জানতে পারা যায়না। যদি সে সব-ইচ্ছায় পূজায় অংশ গ্রহণ না করে থাকে, তবে সে বৈষম্য মূলক আচরণের মধ্যে কি ভাবে পড়লো? তার ধর্ম আচারনের এবং ধর্ম প্রচারের অধিকারে বাধাদান বা বঞ্চিত করা বা হস্তক্ষেপ করা হয়েছে কি? তারপর স্কুলে (সরকারী সাহায্য প্রাপ্ত) কোন ধর্মের ধর্মীয়-শিক্ষা দেওয়া হয় কি বা হচ্ছে কি? যদি এইসব না হয় তবে ভারতীয় সংবিধান অনুসারে তার অধিকার ভঙ্গ হয়েছে কি?
এখানে প্রশ্ন, যারা মুক্তমনা নয়, যারা সরস্বতী পুজাকে মানেনা বলে পুজো বন্ধ করার জন্য বলেন, তারা কি অন্যের প্রতি অবিচার করছে না? সংবিধান অনুসারে ভারতের প্রত্যেক নাগরিকেরই তার নিজ নিজ ধর্ম আচারন করতে পারবে। সুতরাং রফিকুল কে কাউকে জোর করে পূজা করাছেনা বা বারন করছেনা। তাহলে ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রশ্ন আসে কোথা থেকে? লেখক বলেছেন যে, “সরস্বতী পুজার মতো কোন নিরদিষ্ট ধর্মীয় উৎসব কি স্কুলের সহ-পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, নাকি হওয়া উচিত?” এখানে লেখক কি যুক্তিতে বললেন যে, সরস্বতী পূজা সহ-পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে? তার প্রমান তার কাছে আছে কি? নাকি মন গড়া কথা বলছেন। যদি তর্কের খাতিরে মেনেনি যে, সরস্বতী পূজা কোন ধর্মের অংশ বিশেষ। তাই বলে ঐ ধর্মের ছেলেরা কি পুজা করতে পারবেনা? তাহলে কি নাগরিক অধিকারের বাধা দান হয়না। তারপর সংখ্যা লঘুদের ধর্মে এই রকম পুজা বলে কিছু নেই। সুতরাং তাদের পূজা করার প্রয়োজন হয়না। এখানে সংখ্যা লঘু বলতে কাদের বুঝায়, ভারতে নাগরিক সংখ্যায় মুসলমান জনসংখ্যা ৩৫% ভাগের উপর। তারচেয়েও অনেক অনেক অল্প সংখ্যার জাতি আছে। তাদের সংখ্যা লঘু আখ্যা দেওয়া হবে নাকি তাদের সাথে মুসলমানদেরও দেওয়া হবে?
ভারত ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র, এখানে সব ধর্মের মানুষ ই সমান, প্রত্যেকের সমান অধিকার। সুতরাং দেশের আইন ও এক হওয়া উচিত। সেখানে হিন্দু আইন, মুসলিম আইন কেন হবে?
পলাশ বাবু, খুব-ই প্রয়োজনীয় লেখা। আমি পেশায় স্কুল মাস্টার। ফলে শিশুদের ইনডক্ট্রাইনেশান টা যে কি সুচতুর ভাবে হচ্ছে তা চোখের ‘পরে দেখছি প্রতিদিন। সেক্যুলার স্কুল নামক একটি প্রবন্ধ কদিন আগেই লিখেছি। দেখি পোস্ত করবো। মুক্তমনার সম্পাদকের অনুমতি নিয়ে আমার ই মেইল আই ডি দিচ্ছি আপনি যদি একটা জবাবী মেইল করেন তবে বাধিত হব। পড়া শুনো এবং লেখা লেখি বিষয়ে আপনার সাথে কথা হওয়া টা জরুরী।
[email protected]
এ তো নব জাগরণের কথা। এদিন যে কবে আসবে!
শাখের করাত। রফিকুলকে পুজোয় অর্ন্তভূক্তি করলে কিন্তু ইসলাম গেল ইসলাম গেল বলে রব উঠতো।
আপনার সাথে পুরপুরি সহমত .আধুনিক রাষ্ট্রের ধারনার সাথে ধর্ম এখন আর কোনভাবেই মানানসই নয়। রাষ্ট্র এখন কোন ধর্মীয় রাজা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় না, ধর্ম প্রতিষ্ঠার নিমিত্ত কোন রাষ্ট্র এবং এর শাসক চালিত হন না। বর্তমান সভ্য সমাজে রাষ্ট্র মানুষের কল্যানার্থে মানুষের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠান। এর লক্ষ্য বিশেষ কোন ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা নয়, বরং ধর্মীয় পরিচয়ের উর্দ্ধে থেকে এর অভ্যন্তরস্থ সার্বজনীন মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ, উন্নয়ন ও কল্যাণ সাধনই রাষ্ট্রের লক্ষ্য। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ও কিছু মুসলমান অধ্যুষিত দেশ ব্যতিত এখন বিশ্বের আর কোন দেশ সংবিধানে ঘোষনা দিয়ে ধর্মকে রাষ্ট্রীয় অধিকার প্রদান হয় না, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ধর্মকে ধারন করা হয় না। রাষ্ট্রের কাছে মানুষের পরিচয় শুধুই তাঁর নাগরিকতায়, ধর্মে নয়। আধুনিক বিশ্বে ধর্ম একটি লজ্জাজনক মধ্যযুগীয় বিষয়। কিন্তু পুঁজিবাদের দ্বারা পরিচালিত নামক গণতন্ত্রে সেটাত পরিলক্ষিত হবে না । লেখাটির জন্য ধন্যবাদ , ভালো থাকবেন।