লেখকঃ পলাশ পাল

গত কয়েকদিন ধরেই ক্লাস নাইনের ছাত্র রফিকুলের খুব মন খারাপ। স্কুলে সরস্বতী পুজোর প্রস্তুতি চলছে। সকলেই নানা কাজে ব্যস্ত। কেউ প্যান্ডেলের দায়িত্ব নিয়েছে, কেউ নিমন্ত্রণ কার্ড বিলি করতে ব্যস্ত, কেউ করছে সাজসজ্জার পরিকল্পনা, আবার কেউ বা ব্যস্ত বাজারের ফর্দ তৈরিতে। সকলেই মিলেমিশে কাজ করছে। একটু আধটু ঝগড়া-বিবাদ যে হয়না, তা মোটেই নয়, তবে সেসব মিটে যেতেও সময় লাগে সামান্যই। এই আড়ি এই ভাব—এসব তো শিশু চরিত্রের একটা বিশেষ গুণ। কিন্তু যে ছেলেটি খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে স্কুলের যে কোনও ব্যাপারে সবার আগে ঝাপিয়ে পড়ে, সরস্বতী পুজোর মিটিং ডাকার ক্ষেত্রেও যার ভূমিকা ছিল সর্বাগ্রে, সে এমন মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কেন?
একটু খোঁজ-খবর নিয়ে যেটুকু জানা গেল তা হল, শুধুমাত্র ধর্ম আলাদা হওয়ার জন্য রফিকুলের পুজোয় অর্ন্তভূক্তি নিয়ে আপত্তি তুলেছে কেউ কেউ। সকলেই স্তম্ভিত। একটা হাড়হিম করা স্রোত মেরুদন্ডের ভিতর থেকে যেন তীর তীর নামতে লাগল। এরকম তো পূর্বে কখনও ঘটেছে বলে মনে পড়ছে না। শুধুমাত্র আলাদা ধর্মীয় পরিবারের সন্তান হবার জন্য একটি ছেলের প্রতি এই বৈষম্যমূলক আচরণ—একি মেনে নেওয়া সম্ভব? অল্প বয়সের এই সমস্ত ছেলেদের মধ্যে এমন ধ্বংসাত্মক মানসিকতা কীভাবে এল? নাকি, অসহিষ্ণুতার একটা চোরাস্রোত সব সময়ে ছিল, যা আমরা আগে উপলদ্ধি করিনি। আমাদের বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। তবে সমস্যা যে খুবই গভীর ও বিপজ্জনক তা বুঝতে বাকী থাকল না।
দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২১ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বাস। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে দেশের অধিকাংশ স্কুল-কলেজে প্রায় সমস্ত সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীরা মিলে মিশে একসঙ্গে পড়াশোনা করে। সকলেরই নানা রকম উৎসব-অনুষ্ঠান রয়েছে। অথচ সরস্বতী পুজো ছাড়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলির কোনো ধর্মীয় আচার স্কুলে বা কলেজে পালন করা হয় বলে তো শোনা যায় না। ভিন্ন সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি সত্ত্বেও হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে তবে এই ব্যতিক্রম কেন? শুধুমাত্র সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় ভাবাবেগকে লালন করা আর ধর্মীয় স্বাধীনতার জয়গান করা তো একজিনিস নয়। বরং এই প্রবণতা রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শকেও কলুশিত করে।
ভারতীয় সংবিধানের ১৫(১) নং ধারায় স্পষ্টতই বলা হয়েছে যে, রাষ্ট্র কেবল মাত্র ধর্ম, বর্ণ, জাতি, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান ভেদে বা তাদের কোনো একটির ভিত্তিতে কোনো নাগরিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারবে না। আবার ২৫(১) ধারায় সকল ব্যক্তির বিবেকের স্বাধীনতা অনুসারে ধর্মাচরণ এবং ধর্মপ্রচারের অধিকারের পাশাপাশি কোনো ধর্মীয় বিষয় হস্তক্ষেপ না করার কথাও স্বীকার করা হয়েছে। একইসঙ্গে ২৮(১) নং ধারায় সরকারি বা সম্পূর্ণভাবে সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ধর্মাচরণ যদি ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার হয়, তবে স্কুলের মতো সর্বজনীন, সমাজিক প্রতিষ্ঠানে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন তো শুধুমাত্র সংবিধানের উলঙ্ঘন নয়, ধর্মীয় ভেদাভেদকেও একপ্রকার মান্যতা দেওয়ার প্রচ্ছন্ন বহিঃপ্রকাশ। এক দিকে ধর্মনিরপেক্ষার আদর্শকে প্রচার করা, আন্যদিকে সংখ্যগুরুর ধর্মকে পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসাবে অলিখিত মান্যতা দেবার ধ্বংসাত্মক প্রবণতা তো জেনেশুনে আগুনে আহুতি দেবার নামান্তর।
আধুনিক শিক্ষায় খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিতর্কসভা, বিজ্ঞান প্রদর্শনী সহ স্কুলের যাবতীয় কার্যক্রমকে সহ-পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভূক্ত বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এই সমস্ত কাজের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের সাংগঠনিক প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। সৌভ্রাতৃত্ব বোধ, জাতীয় সংহতি আত্মনির্ভরশীলতা সর্বোপরি স্বাধীন ও সৃজনশীল চিন্তাভাবনা বিকাশের ক্ষেত্রেও সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলীর গুরুত্ব অনেকখানি। কিন্তু সরস্বতী পুজোর মতো কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় উৎসব কী স্কুলের সহ-পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভূক্ত হতে পারে, নাকি হওয়া উচিত? যে অনুষ্ঠান শিশুদের মধ্যে ভেদাভেদের পরিচয় উসকে দেয়, সম্প্রীতিবোধকে কশাঘাত করে—তাকে জিইয়ে রাখা মানে কী সাম্প্রদায়িকতার ভ্রুণকে প্রতিপালন করা নয়? ঔপনিবেশিক শাসনামলে, জাতীয়তাবাদের উত্তোরণের জন্য ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহার কিংবা হিন্দু জাতীয়তাবাদকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সমার্থক হিসাবে প্রচার করার রক্তাক্ত পরিণতির ইতিহাস কী আমরা ভুলতে বসেছি?
যে-কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চরিত্র ধর্মনিরপেক্ষ হবে, সেটাই তো কাম্য। ধর্মের ভিত্তিতে শিশুদের পরিচয় নির্ধারণ করা, শিশুমনের সরলতার সুযোগ নিয়ে কোনও ধর্মীয় মতবাদ চাপিয়ে দেওয়া মানে তো শিশুর মৌলিক অধিকার খর্ব করা। স্কুল-কলেজে শুধুমাত্র সংখ্যাগুরুর ধর্মীয় আচার পালন তাদের মনে যেমন আধিপত্যবাদের জন্ম দিতে পারে, তেমনি তৈরি হতে পারে ধর্মীয় অহংবোধ। পরিণতি হিসাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অনেক ক্ষেত্রে হীনমন্যতাবোধ ও নিরাপত্তাহীনতার শিকার হয়। এতে শিশুর সার্বিক বিকাশের পথ ব্যহত হয়, কখনও বা ভুল রাস্তা বেছে নেওয়ার অন্যতম কারণ হয়ে ওঠে। তাই রাষ্ট্রের কর্তব্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখতে তৎপর হওয়া। শিক্ষার্থীদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষ আনুষ্ঠান পালনেও উৎসাহিত করা। শিশু যাতে জীবনের শুরুতে কোনো ভেদনীতির শিকার না হয়, তা দেখাও রাষ্ট্রের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তার পরিবর্তে রাষ্ট্র নিজেই যদি ভেদাভেদকে প্রশ্রয় দেয়, নির্দিষ্ট একটি ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করে, তাকে আর যাই হোক, গণতন্ত্রের বলা যায় না।
ইদানীং ধর্মনিরপেক্ষতা, সহিষ্ণুতা নিয়ে নানা রকমের চর্চা, তর্ক-বিতর্ক শোনা যাচ্ছে। কিন্তু যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বোঝা প্রয়োজন, ধর্মনিরপেক্ষতা, সহিষ্ণুতা যাদুমন্ত্রবলে তৈরি হয় না। নিরন্তর অনুশীলন ও শিক্ষার মধ্য দিয়েই তা লাভ করা সম্ভব। তবেই তো আজকের শিশুরা প্রকৃত অর্থেই আগামী দিনের সুনাগরিক হয়ে উঠবে। কেবল মাত্র উপসর্গ নয়, উৎস জানাটাও রোগ নির্ণয়েয় জন্য সমান জরুরি। অন্যথায় রোগের নিরাময় কীভাবে সম্ভব! আমারা কবে এই সারমর্মটুকু বুঝে উঠতে পারব?