লেখকঃ তারেক মাহমুদ
স্টিভেন স্পিলবার্গ পরিচালিত “সিন্ডলার্স লিস্ট” ও রোমান পোলান্সকি পরিচালিত “দ্য পিয়ানিস্ট” সিনেমা দেখেনি এমন চলচ্চিত্রপ্রেমী খুজে বের করা দুর্লভ। এই দুটি চলচ্চিত্রই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটের উপর নির্মিত দুই অনবদ্য কাব্য। ঐতিহাসিক সেই যুদ্ধের একই সময়(নাৎসিদের বহিরাক্রমন) ও অবস্থানকে(ঘেটো,ক্রাকো) কেন্দ্র করে গড়ে উঠে সিনেমা দুটির কাঠামো। হিটলারের নাৎসি বাহিনী অনধিকার স্বত্বেও পোল্যন্ড আক্রমন করে পোলিশ ইহুদিদের ক্র্যকোর ঘেটোতে সীমানা দিয়ে দেয় এবং ক্র্যকোর কন্সেন্ট্রেশন ক্যম্পে কিভাবে খুব যত্ন করে নাৎসিরা তাদের নির্মম হত্যাকান্ড চালায় সেই বিজ নিয়েই এই দুটি চলচ্চিত্রের প্রণয়ন।
সিন্ডলার্স লিস্টঃ অস্কার সিন্ডলার একজন জার্মান ব্যবসায়ী ও নাৎসি বাহিনীর সদস্য। ব্যবসার প্রসারের আশা নিয়ে যুদ্ধকালীন সময়ে সুযোগ খুজতে আসা এই জার্মান ক্র্যকোতে নাৎসি বাহিনীর সহায়তায় একটি ফ্যক্টরি চালু করেন যার শ্রমশক্তি হিসেবে কাজ করে পোলিশ ইহুদিরা। ইতজাক স্টার্ন একজন পোলিশ ইহুদি যার ব্লাক মারকেট ও ইহুদি ব্যবসায়ী সমিতির সাথে গোপনে যোগাযোগ ছিল যার ফলে স্টার্ন হয়ে উঠে সিন্ডলারের প্রধান সহকারি। এমন গোথ কিছুদিন পর ক্রাকোর কমান্ডেন্ট অফিসার হিসেবে আসে যার মুল উদ্দেশ্য ইহুদি নির্মুলিকরন। সকালে ঘুম থেকে উঠে যেন নাস্তা খাওয়ার উদ্দেশ্যে সে বাড়ির বারান্দা দিয়ে পশু শিকার করার মতন স্নাইপার রাইফেল দিয়ে ইহুদি শিকার করে। প্লাসো কনসেন্ট্রেশন ক্যম্পের কন্সট্রাকশন চলা সময়েই তার দায়িত্ব পরে। হেলেন হিরশ নামের এক ইহুদি মহিলাকে তার বাড়ির দাসী হিসেবে নিযুক্ত করে। হেলেনকে মারা ও নির্যাতন করা এমন গোথের ব্যক্তিগত বিনোদন। ক্যাম্পটি নির্মান সমাপ্তির পরই এমন গোথ হলোকাস্ট চালানোর নির্দেশ দেন। হলোকাস্টের এই নৃশংসতা অস্কার সিন্ডলারের চোখের সামনে দিয়ে হয়। নাৎসি বাহিনীর এই পশু বিত্তান্তের আয়োজন কোন গর্ভবতীর মাতৃজঠরে প্রবেশ করে কোন অভুমিষ্টকে সচকিত করতে সক্ষম। এই বর্বরতার একজন উপস্থিত সাক্ষী অস্কার সিন্ডলার, যেখানে নিস্ক্রিয় থাকার চেয়ে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া উত্তম। ইতিহাসের এই লজ্জা তার মনের ভেতর দিয়ে টুটিয়ে দিয়ে যায়। সে অত্যন্ত কৌশলের সাথে ইতযাক স্টার্নকে কাজে লাগিয়ে কয়েক দফায় বিভিন্ন প্রতিকুলতার সন্মুক্ষীন হয়েও একটি তালিকা বানায়। অস্কার সিন্ডলারের বানানো এই লিস্টের লিপিবদ্ধ হওয়া সব ইহুদি সেই হলোকাস্টের হাত থেকে রক্ষা পায়। (প্লট)
দ্য পিয়ানিস্টঃ ভ্লাদিসভ স্পিলম্যন পোল্যন্ডের ওয়ারসোর একটি রেডিও স্টেশনে পিয়ানো(চপিন) বাজায়। একদিন রেডিও স্টেশনে পিয়ানো্ বাজানোর সময় নাৎসি বাহিনীর বোম্ব এসে পড়ে(যুদ্ধ শুরু)। চারিদিকে ছুটাছুটি কোলাহল কিন্তু তবুও যেন তার পিয়ানো বাজানো থামে না। স্পিলম্যনের পরিবার বাবা মা ভাই বোন দুঃস্বপ্নে রাত পার করে। শহরে নেমে আসে ঘোর আধার। নাৎসিরা পোল্যন্ড দখল করে। পোলিশ ইহুদিদেরকে অপমানের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। কখনও বয়স্ক কোন লোককে বিনা অপরাধে চপাটাঘাত করে আবার কখনও তাদেরকে রাস্তায় নাচ গান করিয়ে। ক্রমান্বয়ে নাৎসিরা ইহুদিদের বাড়ি সম্পত্তি কেড়ে নেয়। স্বাধীনতা বলে তাদের আর কিছু থাকেনা। শহরের সকল ইহুদিকে ঘেটোতে স্থানান্তর করে সীমানায় দেয়াল দিয়ে আটকিয়ে দেয়। প্রায়ই কোন কারন ছাড়া ইহুদিদের ঘর থেকে ধরে এনে মারা হয়। রাস্তায় পড়ে থাকে এক একটি লাশ। একদিন স্পিলম্যনের পরিবার খবর পায় তাদেরকে এখান থেকে সরিয়ে নেয়া হবে। আতঙ্কের গোলা ছড়িরে পড়ে ইহুদিপাড়ায়। সবাই জানে যে কাজের বাহানা দিয়ে তাদেরকে নাৎসিরা নির্মমভাবে হত্যা করার জন্যেই নিয়ে যাচ্ছে তাদেরকে কনসেন্ট্রেশন ক্যম্পে। কিন্তু তবুও যেন মনকে তারা সান্তনা দেয়। ট্রেনে উঠানোর ঠিক আগ মুহুর্তে স্পিলম্যনের পরিচিত একজন ইহুদি পুলিশ যে কিনা নাৎসি বাহিনীর সাথে কাজ করছে এসে তাকে থামায় এবং ট্রেনে যাওয়া থেকে বিরত রাখে। এটি কোন সাধারণ ট্রেন নয়, এটি ছিল পরপারের ট্রেন। পরিবারহারা স্পিলম্যন নাৎসিদের তত্বাবধানে সাধারন শ্রমিকের কাজ নেন প্রায় ইহুদিশুন্যে শহরে। ইহুদি শ্রমিকদের মাঝে সে বিদ্রোহের ঘ্রাণ পায়। সেখানে সে সম্পৃক্ত হয়। কিছুদিন পর সে তার এক বন্ধুর তদারকিতে ঘেটো থেকে পালাতে সক্ষম হয়। তার জন্য মরনের ঘন্টা শহরের প্রতিটি যায়গায় বাজতে থাকে। কিছু মানুষ সেই পরিস্থিতেও তাকে সাহায্যে করার জন্যে এগিয়ে আসে।বিদ্রোহ,অপমান আর স্বজনহারা দুঃখের ভেতর দিয়ে যেয়েও কোন কিছুই যেন তাকে আর ভাবাতে পারে না। তার মাথায় শুধু একটাই চিন্তা, তাকে এই বর্বরতা থেকে বাঁচতে হবে। খাদ্য হয়ে উঠে তার চিন্তার মুল বিষয়বস্তু।পালিয়ে বেড়াতে হয় যুদ্ধবিধ্যস্ত এই শহরে আরও একটি দিন বেশি বাচার তাগিদে। নাৎসিদের বোম্ব,বিধ্যস্ত শহর,লাশের স্তুপ প্রতিটি মুহুর্ত তাকে স্মরণ করিয়ে দেয় শুধু একটা কথাই “মৃত্যু অনিবার্য”। (প্লট)
ঘেটোর সেই নির্মম পরিস্থিতি পৃথিবীর সকল মানুষকেই নাড়া দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অসংখ্য ঘটনার মধ্যে নাৎসিদের পোল্যন্ড দখল ও বিপুল পরিমানে গণহত্যা ছিল সবচেয়ে আলোচিত ও তাৎপর্যপুর্ন ঘটনা। কারন নাৎসিদের পোল্যন্ড দখলের মধ্যে দিয়েই এই যুদ্ধের শুরু হয়। নাৎসিরা পোল্যন্ড আক্রমন করার দুইদিন পরই ইংল্যন্ড ও ফ্রান্স একইদিনে জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে। বলা যায় মূল যুদ্ধের সূত্রপাত এখানেই। এই প্রেক্ষাপট নিয়ে অনেক ডকুমেন্টারি থাকলেও খুব ভাল সিনেমা ও তার ডিটেইল চলচ্চিত্রের ইতিহাসে কমই আছে। ক্লড লেনজম্যনের ‘সোহা’ নামের লম্বা ডকুমেন্টারিতে অনেক ডিটেইল থাকলেও অনুসন্ধিৎসু দর্শক আরও কিছু যেন চেয়ে যাচ্ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এই ঘটনার মধ্যে থেকে বেচে আসা এক ইহুদি লিউপদ পেফারবার্গ একজন অস্টেলিয়ার লেখক থোমাস কেনেলির সাথে দেখা হয়। থোমাস কেনেলি সেই বেচে আসা লোকটির মুখে নির্মম সেই কাহিনী শোনার পর একটি বই লেখে যার নাম ‘সিন্ডলার্স আর্ক’। বইটি বের হওয়ার পর পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ ইউনিভার্সেল কে বইটির রাইট কিনে নেয়ার জন্যে অনুরোধ করেছিল। স্পিলবার্গ থোমাস কেনেলির এই বইকে এডাপ্ট করে চিত্রনাট্য করার জন্য স্টিভেন জাইলেনকে বললেন। চিত্রনাট্য শেষ হওয়ার পর চলচ্চিত্র নির্মানের কথা ভাবতে লাগলেন কিন্তু তার পরিচালক সে নিজে হতে ইচ্ছুক নয়। কারন গল্পটি সত্য ও এতই স্পর্শকাতর যা বানাতে গেলে তাকে একটি সতিকারের জেনোসাইড নির্মানের প্রাকটিসের ভেতর দিয়ে তাকে যেতে হবে। যেটা নির্মান করা কোন পরিচালকের কাছে সুররিয়ালিস্টিক।
স্পিলবার্গ প্রথমে বিখ্যাত পরিচালক মার্টিন স্করসিসের কাছে যায় কিন্তু স্করসিস তাকে অভিভাবন করে যে এই চিত্রনাট্য কোন পোলিশ ইহুদি নির্মাতার কাছে নিয়ে গেলে ভাল হয়। স্পিলবার্গ এই গল্পের মর্ম বুঝতে পারে এমন একজন পরিচালকের কাছে যান চলচ্চিত্রটি নির্মান করার জন্য। তিনি আর কেউ নন বিখ্যাত পোলিশ নির্মাতা ‘রোমান পোলান্সকি’। পোলান্সকি ছিলেন একজন পোলিশ ইহুদি। যুদ্ধের সেই সময়কালে তার বয়স ছিল ছয় বছর বয়স। যুদ্ধে তার মাকে সেই কন্সেন্ট্রেশন ক্যম্পে ধরে নিয়ে মারা হয়। সেই হলোকাস্টের মধ্যে সে পালিয়ে এসেছিল। স্পিলবার্গ তাকে প্রস্তাব করে চিত্রনাট্যটির ভিজুয়াল দেয়ার জন্য। কিন্তু, রোমান পোলান্সকি তার এই প্রস্তাব নিতে রাজি হননি। কারন চিত্রনাট্যটি তার শৈশবের সাথে ঘটে যাওয়া সময়ের সেই নির্মম পরিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। যা তার জন্য খুবই ব্যক্তিগত বিষয়। এরপর স্পিলবার্গ আরও অনেকের কাছেই যান এর মধ্যে বিলি ওয়াইল্ডার ছিলেন সেই হলোকাস্টের আরেকজন ভুক্তভোগি। সে তার পরিবার এই হলোকাস্টেই হারায়। তিনি স্পিলবার্গকে জানালেন এই সিনেমা বানালে এটিই হবে তার বানানো শেষ সিনেমা। পরবর্তীতে বিলি ওয়াল্ডার স্পিলবার্গকেই অনুরোধ করলেন যে সে নিজেই যেন এই সিনেমা বানায়। তারপর স্পিলবার্গ দৃঢ় হলেন যে সেই ভিজুয়াল দিবেন এবং এই সিনেমার জন্য কোন অর্থ নিলে সেটি হবে ‘ব্লাড মানি’। তার সিনেমার নাম ‘সিন্ডলার্স লিস্ট’।
সিন্ডলার্স লিস্ট সিনেমাটির মূলভাব একজন ব্যক্তি যার নাম অস্কার সিন্ডলার যিনি নাৎসি বাহিনীর সদস্য হয়েও কিভাবে তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা ভালত্বকে কাজে লাগালেন অসংখ্য ইহুদি বাচানোর তাগিদে। আর তার বিপরীতে একজন নাৎসি অফিসার এমন গোথ যার কাছে ইহুদি হত্যা করা ছিল মামুলী ব্যপার। হাজার হাজার ইহুদি হত্যার মধ্যে যে পৈশাচিক বিনোদন যে পায় তাকেই অস্কার সিন্ডলার বশ করতে চেয়েছিলেন কৌশলে। সক্রেটিসের একটি বচন আছে ‘ভালোত্বই জ্ঞান’। খারাপত্ব কখনও জ্ঞান হতে পারে না। কিন্তু, খারাপত্ব একটি নেশা। এমন গোথ বশ হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু যে খারাপত্বের বীজ তার ভেতরে রয়েছে তা সে এই সিনেমায় আবারও প্রকাশ করে দেয়। সিন্ডলারের ভালত্ব কিছু সময় তাকেও ভাবায় এবং সে এক ইহুদি কিশোরকে ভুল করা সঃত্বেও মাফ করে দেয় যেখানে এমন গোথ ভুল ছারাই ইহুদি হত্যা করে। কিন্তু তার খারাপত্ব এতই গভীর যে তা কিছুক্ষণ পর জানান দেয়। সে সেই কিশোরকে পরবর্তিতে হত্যা করে। যদিও বাস্তবে সেই কিশোরকে এমন গোথ হত্যা করেনি এবং মাফ করে দিয়েছিল কিন্তু সিনেমার থিম ঠিক রাখার জন্য স্পিলবার্গ কান্ডটি ঘটায়। সিন্ডলার্স লিস্টে ক্রাকো শহরের সেই অন্ধকার দিনগুলো অনেকগুলো কোণ থেকে দৃষ্টিপাত হয়। নাৎসি বাহিনীর গণহত্যা চালানোর যেই আয়োজন এই সিনেমাতে দেখানো হয় তা যেন এলেম ক্লিনভের ‘কাম এন্ড সি’ সিনেমার সেই নৃশংস দৃশ্যগুলোকেও ছাড়িয়ে যায়। অস্কার সিন্ডলার যে ব্যক্তি ধনী হতে এসেছিলেন ক্র্যকোতে সে কিনা অর্থ দিয়ে কিনে নিলেন এক একটি ইহুদিদের প্রান। ধনী হতে এসে মহান হয়ে ফিরে গেলেন। যে নিয়ে গেলেন অজস্র মানুষের ভালোবাসা এবং পৃথিবীর ইতিহাসে একজন এমনই কীর্তিমান যে মানুষের মাঝে বেচে থাকবেন আজীবন। যেখানে একজন এমন গোথের একটি মাত্র খারাপ দিক সেখানে একজন অস্কার সিন্ডলার তার ভেতরে লুকিয়ে রাখে অনেকগুলো ভালো দিক। ভালোবেসে ইহুদিদের পক্ষ থেকে একটি উপহার তাকে দেয় স্টার্ন এবং টালমুড জিউস ‘ল’ থেকে একটি উদ্ধৃত শোনায় তাকে ‘Whoever saves one life saves the world entire’।
ক্র্যকোর ঘেটোর সেই ইতিহাসের সাক্ষী পোলান্সকি। স্পিলবার্গের প্রস্তাবকে অসম্নতি জানানোর ব্যপারটি ইতিবাচক হিসেবেই সবাই নিয়েছিল। যেই ভয়ানক শৈশব থেকে পোলান্সকি ফিরে এসেছিল ও যে ঘটনার জন্য তার মাকে সে হারিয়েছে। সেই ঘটনার উপর চলচ্চিত্র নির্মান করা কোন সাধারণ ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তবুও মানুষের চাহিদার তো শেষ নেই। রোমান পোলান্সকি যে কিনা দর্শকদের ভালো কিছু চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন, যার জীবন হলোকাস্টের সাথে খচিত, সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে সিনেমা বানাবেন না ভাবতেই কেমন জানি খাঁকতি লাগে। প্রায় এক দশক পর বরফ গলা শুরু করল। তার মূল কারন ছিল ভ্লাদিসভ স্পিলম্যন। যে একজন হলোকাস্ট সারভাইভার। স্পিলম্যন একটি মেমোয়ার বের করেছিলেন তার নিজের উদ্বর্তন ঘটনার উপর যার নাম ‘ Śmierć miasta’ । তার এই বইটি পোলান্সকিকে তার মনের গহিনে লুকিয়ে রাখা কোন এক বিষাদ মেশানো সৃতিকে আন্দোলিত করে। কারন তিনি নিজেও একজন সারভাইভার। তিনি যেন স্পিলম্যনের মাঝে নিজেকে সেই প্রতিকুলতার খুজে পেয়েছিলেন। যে মৃত্যুজাল শহরের প্রতিটি ইঞ্চিতে বেছানো ছিল, সেখান বেচে আজ তিনি রোমান পোলান্সকি। স্পিলম্যনের কাহিনীও একটি অসাধারন কাহিনী। দুঃখভরা ও দুঃস্বপ্নের সেই সৃতি থেকে মাত্র একটি ব্যপারই পোলান্সকিকে আরাম দেয়, যে সে বেচে এসেছিল। যুদ্ধের পর তার বাবাকে খুজে পেয়েছিল। উদ্দ্যেগ নিলেন স্পিলম্যনের কাহিণীর উপর সিনেমা বানাবেন। রোনাল্ড হারুউড চিত্রনাট্য লিখলেন। পোল্যন্ড,ইংল্যন্ড,ফ্রান্স ও জার্মানি থেকে প্রযোজকরা আসলেন সামিল হতে। স্পিলম্যনের চরিত্রের জন্য প্রায় ১৪০০ অভিনেতা অডিশন দিতে এসেছিলেন। সেখান থেকে আদ্রিয়ান ব্রডিকে পছন্দ করলেন যাকে আমরা একজন পিয়ানিস্ট হিসেবে পর্দায় দেখব। শুরু হয় আরেকটি যুদ্ধ জার্মানির ব্যবেলসবার্গের স্টুডিও্তে ইউরোপের সবচেয়ে বড় স্টুডিও।
স্পিলবার্গ প্রথমে বিখ্যাত পরিচালক মার্টিন স্করসিসের কাছে যায় কিন্তু স্করসিস তাকে অভিভাবন করে যে এই চিত্রনাট্য কোন পোলিশ ইহুদি নির্মাতার কাছে নিয়ে গেলে ভাল হয়। স্পিলবার্গ এই গল্পের মর্ম বুঝতে পারে এমন একজন পরিচালকের কাছে যান চলচ্চিত্রটি নির্মান করার জন্য। তিনি আর কেউ নন বিখ্যাত পোলিশ নির্মাতা ‘রোমান পোলান্সকি’। পোলান্সকি ছিলেন একজন পোলিশ ইহুদি। যুদ্ধের সেই সময়কালে তার বয়স ছিল ছয় বছর বয়স। যুদ্ধে তার মাকে সেই কন্সেন্ট্রেশন ক্যম্পে ধরে নিয়ে মারা হয়। সেই হলোকাস্টের মধ্যে সে পালিয়ে এসেছিল। স্পিলবার্গ তাকে প্রস্তাব করে চিত্রনাট্যটির ভিজুয়াল দেয়ার জন্য। কিন্তু, রোমান পোলান্সকি তার এই প্রস্তাব নিতে রাজি হননি। কারন চিত্রনাট্যটি তার শৈশবের সাথে ঘটে যাওয়া সময়ের সেই নির্মম পরিহাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। যা তার জন্য খুবই ব্যক্তিগত বিষয়। এরপর স্পিলবার্গ আরও অনেকের কাছেই যান এর মধ্যে বিলি ওয়াইল্ডার ছিলেন সেই হলোকাস্টের আরেকজন ভুক্তভোগি। সে তার পরিবার এই হলোকাস্টেই হারায়। তিনি স্পিলবার্গকে জানালেন এই সিনেমা বানালে এটিই হবে তার বানানো শেষ সিনেমা। পরবর্তীতে বিলি ওয়াল্ডার স্পিলবার্গকেই অনুরোধ করলেন যে সে নিজেই যেন এই সিনেমা বানায়। তারপর স্পিলবার্গ দৃঢ় হলেন যে সেই ভিজুয়াল দিবেন এবং এই সিনেমার জন্য কোন অর্থ নিলে সেটি হবে ‘ব্লাড মানি’। তার সিনেমার নাম ‘সিন্ডলার্স লিস্ট’।
সিন্ডলার্স লিস্ট সিনেমাটির মূলভাব একজন ব্যক্তি যার নাম অস্কার সিন্ডলার যিনি নাৎসি বাহিনীর সদস্য হয়েও কিভাবে তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা ভালত্বকে কাজে লাগালেন অসংখ্য ইহুদি বাচানোর তাগিদে। আর তার বিপরীতে একজন নাৎসি অফিসার এমন গোথ যার কাছে ইহুদি হত্যা করা ছিল মামুলী ব্যপার। হাজার হাজার ইহুদি হত্যার মধ্যে যে পৈশাচিক বিনোদন যে পায় তাকেই অস্কার সিন্ডলার বশ করতে চেয়েছিলেন কৌশলে। সক্রেটিসের একটি বচন আছে ‘ভালোত্বই জ্ঞান’। খারাপত্ব কখনও জ্ঞান হতে পারে না। কিন্তু, খারাপত্ব একটি নেশা। এমন গোথ বশ হয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু যে খারাপত্বের বীজ তার ভেতরে রয়েছে তা সে এই সিনেমায় আবারও প্রকাশ করে দেয়। সিন্ডলারের ভালত্ব কিছু সময় তাকেও ভাবায় এবং সে এক ইহুদি কিশোরকে ভুল করা সঃত্বেও মাফ করে দেয় যেখানে এমন গোথ ভুল ছারাই ইহুদি হত্যা করে। কিন্তু তার খারাপত্ব এতই গভীর যে তা কিছুক্ষণ পর জানান দেয়। সে সেই কিশোরকে পরবর্তিতে হত্যা করে। যদিও বাস্তবে সেই কিশোরকে এমন গোথ হত্যা করেনি এবং মাফ করে দিয়েছিল কিন্তু সিনেমার থিম ঠিক রাখার জন্য স্পিলবার্গ কান্ডটি ঘটায়। সিন্ডলার্স লিস্টে ক্রাকো শহরের সেই অন্ধকার দিনগুলো অনেকগুলো কোণ থেকে দৃষ্টিপাত হয়। নাৎসি বাহিনীর গণহত্যা চালানোর যেই আয়োজন এই সিনেমাতে দেখানো হয় তা যেন এলেম ক্লিনভের ‘কাম এন্ড সি’ সিনেমার সেই নৃশংস দৃশ্যগুলোকেও ছাড়িয়ে যায়। অস্কার সিন্ডলার যে ব্যক্তি ধনী হতে এসেছিলেন ক্র্যকোতে সে কিনা অর্থ দিয়ে কিনে নিলেন এক একটি ইহুদিদের প্রান। ধনী হতে এসে মহান হয়ে ফিরে গেলেন। যে নিয়ে গেলেন অজস্র মানুষের ভালোবাসা এবং পৃথিবীর ইতিহাসে একজন এমনই কীর্তিমান যে মানুষের মাঝে বেচে থাকবেন আজীবন। যেখানে একজন এমন গোথের একটি মাত্র খারাপ দিক সেখানে একজন অস্কার সিন্ডলার তার ভেতরে লুকিয়ে রাখে অনেকগুলো ভালো দিক। ভালোবেসে ইহুদিদের পক্ষ থেকে একটি উপহার তাকে দেয় স্টার্ন এবং টালমুড জিউস ‘ল’ থেকে একটি উদ্ধৃত শোনায় তাকে ‘Whoever saves one life saves the world entire’।
ক্র্যকোর ঘেটোর সেই ইতিহাসের সাক্ষী পোলান্সকি। স্পিলবার্গের প্রস্তাবকে অসম্নতি জানানোর ব্যপারটি ইতিবাচক হিসেবেই সবাই নিয়েছিল। যেই ভয়ানক শৈশব থেকে পোলান্সকি ফিরে এসেছিল ও যে ঘটনার জন্য তার মাকে সে হারিয়েছে। সেই ঘটনার উপর চলচ্চিত্র নির্মান করা কোন সাধারণ ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তবুও মানুষের চাহিদার তো শেষ নেই। রোমান পোলান্সকি যে কিনা দর্শকদের ভালো কিছু চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন, যার জীবন হলোকাস্টের সাথে খচিত, সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে সিনেমা বানাবেন না ভাবতেই কেমন জানি খাঁকতি লাগে। প্রায় এক দশক পর বরফ গলা শুরু করল। তার মূল কারন ছিল ভ্লাদিসভ স্পিলম্যন। যে একজন হলোকাস্ট সারভাইভার। স্পিলম্যন একটি মেমোয়ার বের করেছিলেন তার নিজের উদ্বর্তন ঘটনার উপর যার নাম ‘ Śmierć miasta’ । তার এই বইটি পোলান্সকিকে তার মনের গহিনে লুকিয়ে রাখা কোন এক বিষাদ মেশানো সৃতিকে আন্দোলিত করে। কারন তিনি নিজেও একজন সারভাইভার। তিনি যেন স্পিলম্যনের মাঝে নিজেকে সেই প্রতিকুলতার খুজে পেয়েছিলেন। যে মৃত্যুজাল শহরের প্রতিটি ইঞ্চিতে বেছানো ছিল, সেখান বেচে আজ তিনি রোমান পোলান্সকি। স্পিলম্যনের কাহিনীও একটি অসাধারন কাহিনী। দুঃখভরা ও দুঃস্বপ্নের সেই সৃতি থেকে মাত্র একটি ব্যপারই পোলান্সকিকে আরাম দেয়, যে সে বেচে এসেছিল। যুদ্ধের পর তার বাবাকে খুজে পেয়েছিল। উদ্দ্যেগ নিলেন স্পিলম্যনের কাহিণীর উপর সিনেমা বানাবেন। রোনাল্ড হারুউড চিত্রনাট্য লিখলেন। পোল্যন্ড,ইংল্যন্ড,ফ্রান্স ও জার্মানি থেকে প্রযোজকরা আসলেন সামিল হতে। স্পিলম্যনের চরিত্রের জন্য প্রায় ১৪০০ অভিনেতা অডিশন দিতে এসেছিলেন। সেখান থেকে আদ্রিয়ান ব্রডিকে পছন্দ করলেন যাকে আমরা একজন পিয়ানিস্ট হিসেবে পর্দায় দেখব। শুরু হয় আরেকটি যুদ্ধ জার্মানির ব্যবেলসবার্গের স্টুডিও্তে ইউরোপের সবচেয়ে বড় স্টুডিও।
Leave A Comment