বাঙালির সনাতন ধর্মীয় উৎসব ‘দূর্গা পূজা’ শুরু হওয়ার সাথে সাথে প্রাসঙ্গিকতার কারণে ফেসবুকের নিউজ ফিড ভরে উঠলো বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর আলোকে “বাংলাদেশের মানুষের মনোভাব কি সাম্প্রদায়িক নাকি অসাম্প্রদায়িক”, তাদের আচার আচরন নিয়ে ব্যাখ্যা আর বিশ্লেষণে। রোজই সেসব পড়ি আর আমার সেই পুরাতন সমস্যা আবার জেগে উঠে, যার বিশ্লেষণ পড়ি তার কথাই আমার ঠিক বলে মনে হয়।
একদল লিখলো, “ধর্ম যার যার কিন্তু উৎসব সবার” … তাহলে গুগলে প্রতিমা ভাঙা কিংবা মণ্ডপ ভাঙা লিখে সার্চ দিলে, লাইন ধরে যা আসে তা কোন মনোভাবের পরিচয় বহন করে?
অভিনেত্রী মৌ, মিথিলা, নুসরাত ফারিয়া, ক্রিকেটার মুশফিক, লিটন দাশ দুর্গা পূজার মডেলিং করে কিংবা শারদীয়া শুভেচ্ছা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে চরমভাবে নিগৃহীত হয়েছে। তাদের পোস্ট গুলোতে যারা মন্তব্য করেছে তারা রাজনৈতিক কোন নেতা নয়, ক্যাডার নয়, ওলামা লীগের সদস্য নয়। তারা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, যারা সামাজিকভাবে দেশে অন্যদের থেকে বেশি সুবিধা ভোগ করে, কারণ ফেসবুকে কমেন্ট করার মতো সঙ্গতি তাদের আছে।
কেউ কেউ অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের উদাহরণ টানতে, একজন টুপি পরা ভ্যান চালকের ভ্যান গাড়িতে দুর্গা প্রতিমা নিয়ে যাওয়ার ছবিটিকে বারবার তুলে ধরেছে আবার কেউ কেউ পাজামা পাঞ্জাবিপরা ছোট শিশুটির মন্দিরের দরজায় দাঁড়িয়ে ঠাকুর দেখার ছবিটি টেনেছে। এ-ছবি দুটো যদি অসাম্প্রদায়িকতার প্রমাণ হয়, তাহলে শত শত মণ্ডপ তছনছ করা, প্রতিমা ভাঙার ছবি কিসের সাক্ষ্য বহন করে?
এবার একটু ইতিহাসের দিকে তাকাইঃ
বৃটিশরা ভারতবর্ষ ভাগ করেছিলো ধর্মের ভিত্তিতে।
একটা দেশ গঠনে চারটি উপাদান লাগে বলে আমরা জানি। সেখানে ভৌগোলিক অবস্থান, জাতীয়তা, ভাষা তিনটি মৌলিক উপাদান আমাদের বিপক্ষে থাকা সত্ত্বেও শুধু ধর্মীয় কারণে বাংলাদেশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান নাম দিয়ে ২২০৪ কিলোমিটার দূরে পাকিস্তানের লেজুড়ের সাথে জুড়ে দেয়া হয়। খাদ্য অভ্যাস, পোশাক, সংস্কৃতি ইত্যাদির পার্থক্যতো বাইরেই থাকলো। আকাশপথ ছাড়া সরাসরি একই দেশের দু প্রান্তে আসা যাওয়ার আর কোন সুযোগ ছিলো না। অন্য একদেশ মাঝখানে পেরিয়ে পাকিস্তানের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে হতো।
বৃটিশেরা আমাদের মধ্যে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে এমন আবোল তাবোল ভাবার কোন সুযোগ বা যুক্তি নেই। বৃটিশেরা দু’শ বছর ভারতবর্ষ শাসন করে জেনে গেছিলো, ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের দুর্বল স্থান কোনটি, কোথায় আমাদের লাগে। আমাদের কাতরতা কোনটি নিয়ে বেশি, কী করলে আজীবন আমাদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণার চর্চা কখনো শেষ হবে না। তারা উপযুক্ত স্পর্শকাতর স্থানটুকু চিহ্নিত করে ব্যবহার করেছে মাত্র। চিঙ্গারি গরমই ছিলো, শুধু আগুনটুকু ঠুকে দিয়েছে তারা।
সাম্প্রদায়িকতা ভারতবর্ষের মানুষের রক্তে রক্তে। বহু বছরের চর্চা আমাদের। আমাদের ইতিহাস এর সাক্ষী। ১৯৪২ এ বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে বৃটিশ সৈন্যরা যতো ভারতীয় মেরেছিলো তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ দেশভাগের সময় দাঙ্গায় মারা গিয়েছিলো। ১৯৭১ সালে ঝরেছে তিরিশ লক্ষ তাজা প্রাণ। ১৯৭১ সালের যুদ্ধেও ধর্ম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বাঙালির বিরুদ্ধে অবাঙালিরা ব্যবহার করেছিলো।
রবীন্দ্রনাথকে সাক্ষী রাখছি, “আজ আমরা সকলেই এই কথা বলিয়া আক্ষেপ করিতেছি যে, ইংরেজ মুসলমানদিগকে গোপনে হিন্দুর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করিয়া দিতেছে। কথাটা যদি সত্যই হয় তবে ইংরেজের বিরুদ্ধে রাগ করিব কেন। দেশের মধ্যে যতগুলি সুযোগ আছে ইংরেজ তাহা নিজের দিকে টানিবে না, ইংরেজকে আমরা এতবড়ো নির্বোধ বলিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া থাকিব এমন কী কারণ ঘটিয়াছে।
মুসলমানকে যে হিন্দুর বিরুদ্ধে লাগানো যাইতে পারে এই তথ্যটাই ভাবিয়া দেখিবার বিষয়, কে লাগাইল সেটা তত গুরুতর বিষয় নয়। শনি তো ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারে না; অতএব শনির চেয়ে ছিদ্র সম্বন্ধেই সাবধান হইতে হইবে। আমাদের মধ্যে যেখানে পাপ আছে শত্রু সেখানে জোর করিবেই– আজ যদি না করে তো কাল করিবে, এক শত্রু যদি না করে তো অন্য শত্রু করিবে– অতএব শত্রুকে দোষ না দিয়া পাপকেই ধিক্কার দিতে হইবে।
হিন্দু-মুসলমানের সম্বন্ধ লইয়া আমাদের দেশের একটা পাপ আছে; এ পাপ অনেক দিন হইতে চলিয়া আসিতেছে। ইহার যা ফল তাহা না ভোগ করিয়া আমাদের কোনোমতেই নিষ্কৃতি নাই। ”
শুধু ধর্ম কেন? ধোপা-নাপিত পেশা থেকে শুরু করে গায়ের কালো রঙ, চোখের কটা রঙ, নাক চ্যাপ্টা না থ্যাবড়া, বা হাতি কি ডান হাতি, বেঁটে, মোটা, হিজড়া, সমকামী কি নিয়ে ভারতবর্ষের মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা বা রেসিজম কাজ করে না? সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতেই ভারতবর্ষ ভেঙে তিন জাতির সৃষ্টি হয়েছে, আমাদের রক্তাক্ত ইতিহাস অন্তত তাই বলে। সেখানে “যা সত্যি নয়, তাই প্রমাণের চেষ্টা” কিছুটা বেদনার, বেশিটা শিশুসুলভ। বরং তারচেয়ে আমরা মেনে নেই, জাতিগতভাবে বংশানুক্রমে আমরা সাম্প্রদায়িক মনোভাব ধারণ করি, লালন করি। সমস্যাটা মেনে নেয়া বা চিহ্নিত করা সমাধানের পথ খোঁজার প্রথম ধাপ। অসুখ ধরা পড়লে চিকিৎসার পন্থা ঠিক করা যায় আর আরোগ্য লাভের পথে আগানো যায়।
২৪/১০/২০১৫
চমৎকার ছিলো লিখাটা, স্পেশালি রবীন্দ্রনাথের উক্তিটা.
অনেকদিন পর তানবীরার লেখা পড়লাম। এই লেখাটি খুব উচ্চ প্রয্যায়ে জেছে মনে করি। লেখাটিকে নিয়ে অনেক মন্তব্য, পালটা মন্তব্য হয়েছে। সেইদিকে না গিয়ে সহজ কথায় বলব ‘প্রতিবাদ করার সহজ লেখনি’ । টীকাটিপ্পনী করার সুযোগ থাকলেও, এই লেখা পড়ে মন ভ্রে যায়। ধন্যবাদ, তানবীরা।
ইংরেজরা মুসলমানদের হাত থেকে ভারতের শাসনভার ছিনিয়ে নেয় । তারফলে মুসলমানরা তাদেরকে
ঘৃনার চোখে দেখতে থাকে এবং তাদের সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধ করে দেয় । তাদের দেওয়া শিক্ষা ব্যবস্হা
থেকে বিরত থাকে । বৃটিশের দেওয়া শিক্ষা গ্রহন না করায় তারা চাকুরীর ক্ষেত্রেও অযোগ। হয়ে পরে । অপর
পক্ষে হিন্দুরা মুসলমানদের কাছে হারানো রাজ। ফিরিয়ে পাবার আশায় ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতা করে
এবং তাদের শিক্ষা ব্যবস্হা গ্রহন করে চাকুরীর ক্ষেত্রে ঊন্নতি লাভ করে । তার ফলে হিন্দু ও মুসলমানেরর
মধ্যে একটা ভারসাম্যতার বিভেদ ঘটে এবং পরে সাম্প্রদায়িকতায় রূপ নেয় ।
একটু ভুল হলো নিখিলবাবু | মুসলিমরা ইংরেজদের ঘৃণার চোখে দেখত না | মুসলিম লীগ ইংরেজদের সাথে সহযোগিতাই করত | ইংরেজরাও মুসলিম লীগকে এসেম্বলিতে জায়গা দিয়েছিল | সুতরাং এই থিওরিটা সর্বাংশে ভুল | খুব সম্ভব বামপন্থী থিওরি |
এছাড়া মুসলিমরা ইংরেজ প্রশাহনে বেশি বেশি ছেলেদের ঢোকাবার ব্যবস্থা করেছিল | মুসলিম লীগ এবিষয়ে সবচেয়ে আগে ছিল | দুদুটো বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজদের সৈন্যবাহিনীতে মুসলিম সেনাও ছিল | এইসব দেখেই হিন্দু মহাসভার সৃষ্টি হয় | হিন্দু মহাসভা ভয় পেয়ে হিন্দু ছেলে সাপ্লাই দিতে থাকে | সুতরাং বামপন্থী থিওরি সত্যি হলে ভারতের চেহারাই অন্য রকম হত |
অসংখ্য ধন্যবাদ সবাইকে। লেখাটা যেমন মূল্যবান তেমনি মন্তব্যগুলোও। :rose: :rose:
গত দু’দিন ধরে তানবীরার লেখাটার দিকে আগ্রহ ভরে তাকিয়ে ছিলাম। মূল্যবান এই লেখার প্রসঙ্গ ধরে অনেকেই তাদের ততধিক মূল্যবান মন্তব্য করেছেন। কিন্তু ধীরে ধীরে আলোচনা, বিতর্ক কিংবা মন্তব্য এমন দিকে বাঁক নিচ্ছে যা একরকম অতিকথনে পরিনত হচ্ছে বলেই আমার মনে হয়েছে।
ভারতের ইতিহাসে অনেক আগে থেকেই সাম্প্রদায়িক বিভেদের উপাদান যেমন ছিল একথা যেমন সত্যি, তেমন সত্যি এই বিভেদের মধ্যে ঐক্যের সুরও ছিল। পাশাপাশি ঔপনিবেশিক শাসকদের Divide and Rule নীতিও সত্যি। একে অস্বীকার করলে ইতিহাসের মধ্যই অনৈতিহাসিক ত্রুটি থেকে যায়।
মধ্যযুগে ‘জিজিয়া’ কর কিংবা ‘তুরস্কদন্ড’ যেমন সত্যি তেমন সত্যি ভক্তিবাদী বা সুফিবাদী আন্দোলন। তবে সাম্প্রদায়িকতার যে রূপটি আমরা বর্তমানে দেখি তার সঙ্গে মধ্যযুগে ঐ বিভেদ বা দন্দ্বকে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়। এই সাম্প্রদায়িকতার উত্থানের পেছনে হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন যতটা দায়ি ঠিক ততটাই আলিগড় আন্দোলন। একই ভাবে দায়ী ঔপনিবেশিক শাসকরা। শেষের বিষয়টিকেই আপাতত আমার বক্তব্য সীমাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করব।
আপাতদৃষ্টিতে ব্রিটিশ শাসকরা এদেশে একটি ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থার সূচনা করেছিল। সরকারি চাকরি, সেনাবাহিনীতে নিয়োগ কিংবা শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগের ক্ষেত্রে তারা ধর্ম নয়, যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন—একথা মেনে নিতে হবে। এইসঙ্গে একথাও স্বীকার করতে হবে যে, এই ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থার আড়ালে divide and Rule নীতিও তাদেরই উর্বর মস্তিস্কের ফসল।
ব্রিটিশ সরকার আসার আগে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষদের আঞ্চলিক পরিচয় ছিল প্রধান, ধর্ম নয়। উনিশ শতকের শেষের দিকেও উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায় বলতে কোনো নির্দিষ্ট বিষয় বোঝাত না। অঞ্চলভেদে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে অর্থনৈতিক ও জীবনযাপনের পার্থক্য ছিল। কিন্তু ঔপনিবেশিক সরকার ধীরে ধীরে এই বৈচিত্র ও তারতম্যকে মুছে দিয়ে ভারতের সমস্ত মুসলমানদের একটি ধর্মসম্প্রদায় হিসাবে চিহ্নিত করতে থাকে। শিখদের ক্ষেত্রেও একথা খাটে। আবার হিন্দুদের বেলাতেও খাটে।
এক্ষেত্রে আদমশুমারির কথা বলা যেতে পারে। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে সরকার প্রথম জনগণনা করে। এতে ধর্মের ভিত্তিতে উন্নয়নের খতিয়ান রাখা হত। ফলে ভারতের ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়টি পরিস্কার হয়ে যায়। পাঞ্জাব ও বাংলার মোট জনসংখ্যার অর্ধেক মুসলমান তা সামনে এসে যায়। সম্প্রদায়গুলিও ধীরে ধীরে ধর্মীয় ও জাতিগত পরিচয়কে প্রধান করে দেখতে থাকে। যার পরিনতিতে ধর্মসম্প্রদায়গুলির মধ্যে সুযোগ সুবিধা পাওয়ার ক্ষত্রে প্রতিযোগীতা শুরু হয়। প্রশাসনের তরফ থেকে প্রচার করা হতে থাকে মুসলমান হিন্দু বা শিখ সম্প্রদায়গুলির সবাই আলাদা রকম এবং পৃথক ধর্মীয়-রাজনৈতিক সম্প্রদায়।
আর এই বিভাজনের হাত ধরেই হিন্দু মহাসভা, অকালি দল ও মুসলিম লীগের মতো সাম্প্রদায়িক দলগুলির আর্বিভাব হয়। এরা ভেদনীতির সুযোগ কাজে লাগাতে তৎপর হয়ে ওঠে। এরা প্রচার করতে থাকে, যে সম্প্রদায় হিসাবে তাদের স্বার্থ সম্পূর্ণ আলাদা।
যুক্তবাদী যা বলেছেন তার সঙ্গে একটু দ্বিমত পোষণ করে বলব, গান্ধিজী বা কংগ্রেস শুধুমাত্র দ্বিতীয় গোল টেবিল বৈঠকে যোগদান করেছিল এবং আলোচনা ফলপ্রসু না হওয়ায় সভার মাঝখানেই তিনি বেরিয়ে আসেন। এই যোগদানের পেছনে ব্রিটিশের তাগিত ছিল বেশি। ১৯৩২খ্রি. রামসে ম্যাকডোনাল্ড কিন্তু এই গোলটেবিল বৈঠকে তার কুখ্যাত ‘সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা’ নীতি ঘোষণা করেন। যেখানে ধর্মের ভিত্তিতে নির্বাচনকে স্বীকৃত দেওয়া হয়েছিল।
মাউন্টব্যটেন দেশভাগ এড়াতে চেয়েছিলেন সত্যি। কিন্তু ততদিনে বল আর তার কোর্টে ছিল না। যে বিষ ভারতবর্ষ গলধগরণ করেছে তাকে উগরানোর মতো ঔষধ তিনি দিতে পারেন নি। তার সে সমর্থ-ও ছিল না। বস্তুত কারো পক্ষেই তা সম্ভব ছিল না। না গান্ধিজী না জিন্নার। কারণ বল তখন রাজনীতির ময়দানে তীব্র লড়াইয়ে মত্ত।
আশাকরি আমার দৃষ্টিভঙ্গীর ত্রুটিগুলি আপনারা শুধরে দেবেন।
এর অর্থ হলো যে ব্রিটিশের আসার আগে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ছোঁয়া ছুই , জল অচল , স্পর্শ দোষ ইত্যাদি কোনো ব্যাপার ছিল না | হিন্দুর বাড়িতে মুসলমান জল খেতে পেত না বা মুসলমানের বাড়ি হিন্দু জল খেতে পেত না : ইত্যাদি ব্যাপারগুলি সবই মিথ্যা | নারায়ণ সান্যালের রূপমঞ্জরী বলে বঙ্কিম পুরস্কারপ্রাপ্ত একটা উপন্যাস আছে | তাতে উনি দেখিয়েছেন কিভাবে ১৮ শতকে একজন মুসলিম মৌলবী যখন এক হিন্দু ব্রাহ্মণের কাছে সংস্কৃত পড়তে আসে তখন তাকে নিজস্ব মাদুর সঙ্গে করে আনতে হয় নাহলে ব্রাহ্মণের উঠোন অপবিত্র হয়ে যাবে | এইসব কুসংস্কারগুলি কিভাবে ইংরেজ আসার আগে এদেশে থাকে যদি হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ই না থাকে ?
কেনই বা মুসলিমরা হিন্দুদের ওপর জিজিয়া আদি কর বসিয়েছিল যদি সম্প্রদায়গত ভেদ না থাকে ? কেনই বা হিন্দু রাজপূত রমনীরা জহরব্রত পালন করে আত্মহত্যা করবেন যদি হিন্দু মুসলমান বলে কিছু না থাকে ?
এছাড়া আপনার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে অবাধে বিয়েসাদি হতে পারত ১৭শ বা ১৬শ শতকে | কিন্তু আমরা তেমন ঐতিহাসিক দলিল পাই কি ?
এছাড়া কেনই বা মুসলিমরা হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস করবে যদি হিন্দু-মুসলমান ভেদ না থাকে ? লুটপাট তো ধ্বংস না করেও অনেক সময় করা যায় | কেনই বা হিন্দুর মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ বানানো ?
আপনার থিওরি মেনে নিলে সমগ্র ইতিহাস পাল্টাতে হবে |
আপনি আমার বক্তব্যটাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। হিন্দু মুসলমানদে মধ্যে যে ভেদাভেদের কথা বলেছেন সেগুলি ছিল, তীব্রভাবেই ছিল। অস্বীকার করার কোনো প্রশ্নই আসে না।
অঞ্চলিক পরিচয় বলতে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের ভিন্ন পরিচয়ের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ উত্তর প্রদেশের মুসলমানদের সঙ্গে বাঙালি মুসলমানদের আচার আচরণের, জীবনযাপনের পার্থক্যের কথা বলা হয়েছে। হিন্দুদের বেলাতেও একথা সত্যি।
ঔপনিবেশিক শাসনকালে এই পরিচয়টা পাল্টে যায়। সমগ্র মুসলানদেরকে একটা সম্পূর্ণ ধর্মীয়-রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিসাবে চিহ্নিত করা হতে থাকে। বলা হল সমগ্র মুসলমানদের পরিচয় অভিন্ন, তাদের স্বার্থ এক। রাজনৈতিক দাবিও অভিন্ন। এই মতবাদ ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে থাকে। যা দ্বিজাতি তত্বের ভাবনাকে উসকে দিয়েছিল।
আর আমি কখ
আমার মনে হয় ব্রিটিশেরা সর্বপ্রথম হিন্দু আর মুসলমানকে এক ছাতার তলায় আনার চেষ্টা করেছিল | ব্রিটিশরা হিন্দু মহাসভা আর মুসলিম লীগ , দুই দলকেই এসেম্বলিতে জায়গা দিয়েছিল | যদি ওরা বিভেদ আর শাসন নীতিই চাইবে তাহলে এমনটা করবে কেন ?
ব্রিটিশরা হিন্দু মুসলমান উভয়কেই নাইট উপাধি দিয়েছিল | উদাহরণ রবীন্দ্রনাথ আর স্যার সৈয়দ আহমেদ , যিনি স্পিরিট অফ ইসলাম লিখেছিলেন |
ব্রিটিশরা গান্ধী আর জিন্না উভয়কেই গোল টেবিল বৈঠকে আসতে দিয়েছিল |
ব্রিটিশরা হিন্দু আর মুসলমান উভয়ের জন্য শিক্ষা আর চাকুরীর ব্যবস্থা করেছিল | দেশীয় পুলিস ও প্রশাসনে হিন্দু আর মুসলমান উভয় ধর্মের লোকেরাই কাজ করত | যদি সাম্প্রদায়িক ভেদকে কাজে লাগাবার ইচ্ছা তাদের থাকত , তাহলে কি তারা এমনটা করত ?
লর্ড মাউন্টব্যাটেন দেশভাগ চাননি | তিনি নিজের ডায়রিতে এবিষয়ে লিখে গেছেন যে তিনি চেয়েছিলেন আসমুদ্র হিমাচল ভারতবর্ষ এক ও অখন্ড থাকুক | তাহলে ব্রিটিশের দোষ কি ?
দুটো মহাযুদ্ধে হিন্দু আর মুসলিম সেনা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কাজ করেছিল | এটা কি ব্রিটিশের ডিভাইড এন্ড রুল নীতির বহিপ্রকাশ ?
কেমব্রিজ আর অক্সফোর্ড-এ হিন্দু ও মুসলমান দুজনেই পড়তে পারত | ডিভাইড এন্ড রুল নীতি হলে এমনটা হত না |
মুসলিম শাসনে কি হিন্দুরা এত সুবিধা পেয়েছিল ? গুটিকয় মুঘল বাদশা ছাড়া কে তাদের সুবিধা দিয়েছিল ?
আমার মতে ব্রিটিশরা সাম্প্রদায়িক ঘৃণার চিঙ্গারিতে আগুন দেয়নি | ওরা বরং আগুন নেভাবার চেষ্টা করেছিল | কিন্তু আমরাই আমাদের সাম্প্রদায়িক ঘৃণার আগুনকে দাবানল বানিয়েছিলাম | আর তারই ফল দেশভাগ | ব্রিটিশকে অযথা দোষ দিয়ে লাভ নেই |
১০০% খাটি কথা,
আসলেই বাংগালিদের নিয়ে একদম খাঁটি কথার বর্ননা আপনার লেখায় ফুঁটে উঠেছে।
সংস্কৃতিমনা ও সাংস্কৃতিকবান হওয়ার জন্য যে যে উপাদানগুলি একটা জাতির জন্য অতীব জরুরী সেগুলিতো অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে গেছে বা ঠান্ডা মাথায় বিনষ্ট করা হয়েছে।
সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্তি পেতে হলে একেবারে গোড়া থেকে শুরু করা জরুরী তাহলো সেক্যুলার বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা স্কুলের প্রথম শেনী থেকে শুরু করতে হবে যে শিক্ষাব্যবস্থা সব শিশুদের জন্য প্রযোজ্য যেখানে থাকবে না ১৪ রকম উচু-নীচু শ্রেনীভেদে শিক্ষাব্যবস্থা।
কলম চলুক দূর্বার গতিতে,ছিন্নভিন্ন হউক সকল চিন্তার জড়তা………...
একদম যাকে বলে বুলস আই। চমৎকার লেখা। :good: দেখা যাক ভদ্র নাস্তিকেরা, বিজ্ঞানবাদিতাহীন সুশীলেরা, সহীহ মুসলমানেরা এবার কোন ত্যানা নিয়ে আসেন।
চমৎকার বলেছেন। ভারতীয় সভ্যতা আলোচনা প্রসঙ্গে ভিনসেন্ট স্মিথ বলেছিলেন– ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’। বরীন্দ্রনাথের মুখেও ওই একই কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পাই– ‘বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান’। বাস্তবে এই কথাগুলিরর মূল্য কতটুকু? ভারতবর্ষে ঐক্য কোথায়, যা দেখি সে তো বৈচিত্র। মিলন নয়, দেখি শুধু বিভেদ। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গুচ্ছ গুচ্ছ গোলাপ নয় ইতিহাসের গায়ে লেগে আছে সাম্প্রদায়িক হানাহানির দুষিত রক্ত। এই বিভেদের সুযোগ নিয়েছে সম্রাট আলেকজান্দার থেকে ইংরেজ। এই বিভেদকে কাজে লাগিয়েই হিন্দু মহাসভা কিংবা মুসলিম লিগের রাজনীতি। এই বিভেদের ফল ভারত পাকিস্তান বাংলাদেশ। এই বিভেদের ফল মন্দির পোড়ানো আর মসজিদ ভাঙা।
সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ভারতবর্ষ উত্তরাধিকার সূত্রেই বহন করেছে। আজ সে অসুখ এতো গভীরে পৌছে গেছে যে তা নিরাময়ের সম্ভাবনা একটা সুদূর পরাহত।
সঠিক জায়গায় আঘাত হেনেছেন , ধন্যবাদ লেখিকাকে।
বৃটিশরা ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে নি আমরা প্রথম থেকেই ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়েই ছিলাম | বৃটিশরা কি মুসলিম লীগ বানিয়েছিল না হিন্দু মহাসভা বানিয়েছিল ?
হিন্দু মহাসভাকে কি বৃটিশরা হিটলার মুসোলিনির কপি করে ভারতে আর্য রক্তের পবিত্রতা রক্ষা করার ডাক দিতে বলেছিল ? না ব্রিটিশরা আর এস এস বানিয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছিল ? ব্রিটিশরা এসব কিচ্ছু করেনি |
হিন্দু মহাসভা আর আর এস এসের হিংসাত্মক কার্যকলাপ দেখে মুসলিম লীগ ভয় পেয়েছিল | ওরা এটাও বুঝতে পারছিল যে ক্ষমতা হিন্দুদের হাতেই যাবে | আর সেই হিন্দুরাজ্যে মুসলিমদের অবস্থাটা কেমন হবে সেটাও মুসলিম লীগ বুঝেছিল | তাই তারা একটা আলাদা রাষ্ট্র চেয়েছিল | এর মধ্যে ব্রিটিশদের কোনো গল্প নেই |
আমাদের ১৮৫৭ সালের মহাবিপ্লবও ধর্ম দ্বারাই অনুপ্রাণিত ছিল | কোনো স্বাধীনতা , স্বদেশপ্রেমের গপ্প ছিল না |
নির্ভুল ও অব্যর্থ নিশানায় নিহিত স্থানটিতে লক্ষভেদ করেছেন। গোপন ক্ষতটিকে উন্মুক্ত করেছেন। আপনাকে অসংখ্য সাধুবাদ তানভীরা। লেখাটি ফেসবুকে শেয়ার করতে খুব-ই ইচ্ছা করছি… কিন্তু ভাবছি দিলে আমার দেশের সঙ্খাগুরুরা না হাইমাই করে বলে ওঠে যে দেখেছ…সব দোষ মুসলমানদের।
রবীন্দ্রনাথ চমৎকার বলে গেছেন। এখনো দেখা যায় ইংরেজের বিরূদ্ধে রাগ করা গ্রুপটা রয়ে গেছে। এখন তারা রাগ করে আমেরিকার বিরূদ্ধে। সব দোষ আমেরিকার। আইসিস- আমেরিকা বানাইছে। শিয়া সুন্নি সমস্যা- আমেরিকা লাগাইছে। আর আমরা সব আলাভোলা মাসুম বাচ্চা।
অনেক ধন্যবাদ লেখাটার জন্য।