অভিজিৎ’দার হত্যার পরে হঠাৎ করেই নতুন একটা উপলব্ধি হল,
এক শিক্ষিত মৌলবাদীর সাথে সমকামিতা নিয়ে তর্ক করছিলাম, রেফারেন্স দিতে গিয়ে মনে হল, অভি’দা কি সুন্দর করে সব গুছিয়ে রেখেছেন, চাইলেই তথ্যগুলো হাতের কাছে পেয়ে যাচ্ছি।এই প্রথম মনে হল অভি’দা আসলে আমাদের বটবৃক্ষ ছিল, আমরা শুধু ছায়া নিয়ে আরাম করেছি, সমস্ত খরতাপ , ঝড় ঝঞ্ঝা সহ্য করে আমাদের জানার পথটা সরল করে গেছেন। যখনি বিপদে পরেছি তার দ্বারস্থ হয়েছি, সময় অসময় বুঝতে চাইনি, তিনিও বুঝতে দেন নি দায়টা তার একার না, নীরবে কাজ করেছেন ।
প্রথম নভেল বিজয়ী বিজ্ঞানী মারি ক্যুরি, অ্যাপ্লাস্টিক আনেমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। দীর্ঘদিন তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে থাকার কারণে এই মরণ ব্যাধি তার জীবনী সুধাটুকু শুষে নিয়েছিল। তার আবিষ্কারের সুফল ভোগ করছে সারাবিশ্ব অথচ এই আবিষ্কারের জন্যই তাকে তার প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে।
অভিজিৎ রায় জানতেন এই পথে মৃত্যু ওঁত পেতে আছে, মৌলবাদের অন্ধ চোখে খুনের নেশা,তবুও লিখেছেন।সোচ্চার হয়েছেন ধর্মান্ধতা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। তার লেখার সুফল আমরা পাচ্ছি, তিনি শুধু আজ নেই।

প্রবাসী জীবন সম্পর্কে শুনে এবং পড়ে যে ধারণা জন্মেছিল সেটা যে মুদ্রার এপিট, নিজে যাযাবর না হলে বুঝতাম না। এখানে সেকেন্ড এর হিসেবে মানুষের প্রাত্যহিক জীবন শুরু হয় , দুদণ্ড আড্ডা তো আছেই নিতান্ত কুশল বিনিময়ের আগে ঘড়ি দেখে নিতে হয়, এমন কি বাচ্চা নেবার আগে হিসাব নিকাশ করতে হয় , বাচ্চা কে সময় দিতে পারব কিনা !
এটা যে অসামাজিকতা ,বিষয়টা তা নয়, কিন্তু সময়ের বড় অভাব প্রবাসে।
এই প্রচণ্ড ব্যস্ত জীবনে অভিজিৎ রায় ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে নয়টা বই লিখেছেন। মুক্তমনার মত অসাধারণ একটা জ্ঞানকোষ তৈরি করে ফেলেছেন।
হুমায়ুন আজাদ হত্যার পরে,মুক্তচিন্তার যে দ্বার বহুকাল অবরুদ্ধ ছিল।
জানো , ভাবো, এবং মত প্রকাশ কর, এই তিনটি চাবিকে কে বহুদিনের অন্ধকার কুঠুরি থেকে মুক্ত করে অভিজিৎ রায় মানুষের সেই উপলব্ধির দরজাটি উন্মুক্ত করে দিয়েছেন।
আজ বলতে কুণ্ঠা নেই, রাজীব হায়দার হত্যার পরে যখন সমস্ত মুক্তমনা ব্লগাররা মৌলবাদী মিডিয়ার প্রোপাগান্ডার শিকার হয়ে সম্পূর্ণ কোণঠাসা হয়ে পরেছিল, চার ব্লগার কে গ্রেফতার করে সরকার সেই মৌলবাদের পীঠ চাপড়ে দিচ্ছিল, সেই প্রতিকূল সময়ে ছত্রভঙ্গ ব্লগারদের কে একত্রিত করা এবং একটা শক্ত আন্দোলন করার সব চেয়ে কঠিন এবং গুরুদায়িত্বটা অভি দা-ই পালন করেছিলেন। এই বিষয়টির সাক্ষী আমি নিজে। দিনের পর দিন দাদার সাথে আমার আলাপ হয়েছে। কি হচ্ছে , কি দরকার , কীভাবে এগোলে ভাল হয় এসব তো ছিলই তার সাথে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল প্রোপাগান্ডাগুলোর জবাব দেয়া, আন্তর্জাতিক মিডিয়া কে সচেতন করা, মত প্রকাশের স্বাধীনতায় শেকল পড়ানোর বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া।

ভয়ঙ্কর সব মৌলবাদী সঙ্গী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা আমাদের কাররই ছিল না, আর যাদের ছিল তার সবাই সরকার তোষামোদে এতই মগ্ন ছিল , তাদের প্রতিবাদ করার ফুরসৎ মেলেনি।
অভি’দা তখন রাত দিন এক করে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় লেখালিখি শুরু করে দিলেন, তার লেখালিখির কারণেই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এবং মুক্তচিন্তার জন্য কাজ করা সংস্থা এবং মিডিয়াগুলোর সমর্থন পেতে শুরু করলাম। পৃথিবীবাসী জানতে শুরু করল বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে মুক্তচিন্তার উপরে কি ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তারা জানল , পৃথিবী যেখানে আলোর গতির সাথে এগোবার চিন্তা করছে,সেখানে বাংলাদেশ হাঁটছে হাজার হাজার বছর পেছনে।

ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, সক্রেটিসের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল বিষের পেয়ালা, ইবনে সিনার বিরুদ্ধে নাস্তিকতার অভিযোগ এনে তার লেখা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল,ইসলাম না মানায় তরবারির কোপে দ্বিখণ্ডিত হয়েছে বহু মাথা, বিখ্যাত চিত্রকর রাজা রাভি বর্মা কলি থাপুরান কে ধর্ম অবমাননার দায়ে তিলে তিলে মানসিক যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে, জাত পাতের দোহাই দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। শয়তান,ডাইনি অপবাদ দিয়ে ধর্ম যাজকরা পুড়িয়ে মেরেছে লক্ষ লক্ষ মানুষ, ……এমন অসংখ্য উদাহরণ আছে।
যদি ভাবি এ তো বহু আগের কথা ,বর্তমানে কি হচ্ছে ?
হিন্ধু ধর্মে জাত পাতের দোহাই দিয়ে এখনো হত্যা হয়, ডাইনি ডাকিনী অপবাদ দিয়ে বিধবা হত্যা হয়, ধর্ম বাবাদের পদতলে নারীর সম্ভ্রম লুটায় এবং সেটা মেনে নেয়া গাধাদের সংখ্যাটা নেহায়েত কম না।
টুইনটাওয়ার হামলা কে বহু ইসলাম ধর্মান্ধরা সমর্থন করেছে, কারণ বিধর্মী মরেছে! এর চেয়ে অদ্ভুত কথা,হজ্বের সময় যদি পদতলে পিষ্ট হয়ে কিংবা অন্য কোন কারণে মক্কায় কেউ মারা যায়, সেখানেই এই অন্ধরা খুশি হয় এই ভেবে,
আহা ! লোকটার পবিত্র মৃত্যু হয়েছে !
মসজিদে বোমা হামলা হলে, সেটারও কোন না কোন ব্যাখ্যা বের করে ফেলে !
চুল মোবারক, দাড়ি মোবারক , বদনা মোবারক দেখে আত্মসন্তুষ্টি তে ভোগা এই অন্ধরা বদলায় নি।

অভিজিৎ’দা সবই জানতেন, তিনি জানতেন বিশ্বাসের ভাইরাসে আক্রান্ত এই গোষ্ঠীর সাথে লড়াইটা মৃত্যুকে হাতে নিয়েই লড়তে হবে। তিনি তাই করেছেন,আপোষের পথ বেঁচে নেননি।

আজকাল একটা টার্ম অনেকেই ব্যবহার করছে, অভিজিৎ’ দার মত হও, মডারেটরাও বলছে অভিজিৎ রায় ভাল নাস্তিক। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগছে কেন অভিজিৎ রায় কে মানুষ
বেঞ্চ-মার্ক ভাবছে, কেন তাকে নাস্তিকদের আদর্শ হিসেবে ধরা হচ্ছে ?
এই প্রশ্নের উত্তর অভিজিৎ দা নিজেই দিয়েছেন,

আমি নাস্তিক। কিন্তু আমার আশে পাশের বহু কাছের মানুষজন বন্ধু বান্ধবই মুসলিম। তাদের উপর আমার কোন রাগ নেই, নেই কোন ঘৃণা। তাদের আনন্দের দিনে আমিও আনন্দিত হই। তাদের উপর নিপীড়ন হলে আমিও বেদনার্ত হই। প্যালেস্টাইনে বা কাশ্মীরে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর অত্যাচার হলে তাদের পাশে দাঁড়াতে কার্পণ্য বোধ করি না। অতীতেও দাঁড়িয়েছি, ভবিষ্যতেও দাঁড়াবো। এটাই আমার মানবতার শিক্ষা

অভিজিৎ রায় বাকি নাস্তিকের মতই ধর্মের ক্ষতিকর দিকগুলো কে উপলব্ধি করে ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করতেন। কিন্তু সেই সাথে যে গুণাবলিটি তার ছিল , তিনি মানবিক বোধে উজ্জীবিত একজন মানুষ ছিলেন। ইসলাম ধর্মের গোঁড়ামি কে তিনি মুসলিমদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য মনে করতেন না , বরং একজন মানুষ কে তার মানবিক গুণাবলি দিয়েই বিচার করতেন।
নাস্তিকদের মধ্যে অসংখ্য মত দ্বিমত আছে, এবং সেটা থাকাটাই স্বাভাবিক। নাস্তিক্যবাদ কোন ধর্ম না যে তাকে চুপচাপ মেনে নিতে হবে কিংবা যুক্তি তর্কের কোন স্থান দেয়া যাবে না। আবার নাস্তিক হলেই যে সে মানুষ হিসেবে ভাল হবে, এমন কথাও বলা সম্ভব না ।
নাস্তিকদের প্রতি ধার্মিকদের বিদ্বেষ , নির্যাতন, হত্যা এসব দেখে, জেনে বুঝে এবং ধার্মিকদের একাংশের নীরবতায় ক্ষুধ হয়ে এই গোষ্ঠীর প্রতি তীব্র ঘৃণা অনেক নাস্তিকই লালন করেন। এবং সেটা প্রচণ্ড আক্রোশ নিয়েই প্রচার করেন ।
অভিজিৎ দাও ক্ষুদ্ধ হতেন ,তবে ক্ষোভের প্রকাশভঙ্গী ছিল ভিন্ন, তিনি প্রকাশ করতেন এই ভাবে,
আরও বেশি জ্ঞান অর্জন কর এবং তা ছড়িয়ে দাও । সত্যটা কে উন্মোচিত করে অন্ধকার কে নিশ্চিহ্ন কর।এটাই ছিল তার মূলমন্ত্র।
এই কারণেই তাকে আদর্শ মেনে পথ চলা মানুষের সংখ্যাটা এত বেশি। তাকে ভালবাসা সহজ বরং ঘৃণা করা কঠিন । যারা তাকে ঘৃণা করতে চাইবে, তার লেখা পড়ে তাকে জেনে নিতান্ত অমানুষ না হলে সেটা সম্ভব না।

দেশে ফেরার আগে শেষ বার যখন অভি দার সাথে কথা হল, তখন ফারাবীর বিরুদ্ধে মামলা করার পরিকল্পনা করেছিলাম আমরা। অনেকটা কাজ এগিয়েও নিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই ভয়ঙ্কর গোষ্ঠীটার বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্ত সমর্থন এবং যোগ্য একজন আইনজ্ঞ যোগাড় করতে পারিনি।
যুক্তি মানলে বিষয়টার দায় এড়াতে পারি কিন্তু আবেগের কাছে বার বার পরাস্ত হয়ে ভেবেছি, হয়ত আর একটু চেষ্টা করলে হত, হয়ত অভি’দা আজ থাকতেন।
অভিজিৎ রায়, অন্তত বিজয়, ওয়াশিকুর , রাজীব হায়দার কিংবা নিলয় কোন একক ব্যক্তি ছিল না, বরং এরা এক একটা ভিন্ন চিন্তার ধারা ছিল। প্রত্যেক এর লেখার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে , তাদের চিন্তা তাদের মতামত তাদের প্রকাশ ভঙ্গী আলাদা, বিশ্লেষণ আলাদা, এই কারণেই তারা সাধারণ কোন মানুষের চেয়ে সমাজ পরিবর্তনে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে।মেধার সংজ্ঞা আসলে এখানেই। সাধারণ আর অসাধারণের মধ্যে পার্থক্যটা এখানেই।
যে কারণেই মৌলবাদীরা তাদের টার্গেট করেছে। এই ধর্মান্ধ, কুচক্রীর দল জানে তাদের শত বছরের মিথ্যার স্তম্ভ যুক্তির আঘাতে গুড়িয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে এই ব্লগাররা। তাই তাদের খুন করে স্তব্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করেছে এরা। কিন্তু অন্ধকার যতই শক্তিশালী হোক সূর্য তার বুক চিড়ে আলো ছড়াবেই ।

শেষ কথা বলি , অভিজিৎর হত্যাটা বিশ্ববাসিকে যতোটা নাড়া দিয়েছে অন্য কোন ব্লগার খুন হলে হয়ত সেটা হত না, অভিজিৎ দা প্রাণ দিয়ে আমাদের বাঁচিয়ে গেল। যতবার এই কথাটা ভেবেছি ততবার মনে হয়েছে অনেক কাজ বাকি, অনেক বড় দায়িত্ব নিয়ে আমরা দেশ ছেড়েছি, এখানে আবেগের যায়গাটা খুব সামান্য। অন্ধকারের বিরুদ্ধে লড়তে হবে, যাদের হারিয়েছি তাদের অসমাপ্ত কাজগুলো আমাদেরই করতে হবে।
রাজীব হায়দারের হত্যা মামলার রায় মোটেও সন্তোষজনক নয়, সরকারের নির্লিপ্ত আচরণ, সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্রহসনমূলক বক্তব্য,মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য এবং ৫৭ ধারার প্রকোপ দেখে অনুমান করা কঠিন না,অভিজিৎ রায় হত্যা এবং বন্যা আহামেদের উপরে হামলার বিচার পাওয়া দুরূহ। বরং ভবিষ্যতের দিনগুলো, মুক্তচিন্তার ব্লগাদের জন্য আরও প্রতিকূল হবে।
তবুও আমরা থামব না, যুক্তির আলো হাতে যে মশাল অভিদা জ্বালিয়ে ছিলেন , চার ব্লগার এবং অসংখ্য মুক্তচিন্তার মানুষের রক্ত , শ্রম , ত্যাগের বিনিময়ে প্রাপ্তিটার বিস্তার ঘটানোর যুদ্ধটা চালিয়ে নিতে হবে। চাপাতির বিরুদ্ধে কলম , অতীতে জিতেছে এখন কিবোর্ড জিতবে। মানুষ কে মেরে ফেলা যায় , তার আদর্শ কে না , তার চিন্তা কে তার সৃষ্টি কে না , আমাদের অলীক কোন স্রষ্টা নেই যে তার উপড়ে দায় বর্তাব। দায়টা আমাদের , কাজ আমাদেরই করতে হবে ।
এটাই হবে অতীত হয়ে যাওয়া যোদ্ধাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।