“জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে,
বন্ধু হে আমার, রয়েছ দাঁড়ায়ে।
এ মরুহৃদয়ের বিজন আকাশে
তোমার মহাসন আলোকে ঢাকা সে।। ”

প্রিয় দাদা,
আপনাকে চিঠি লিখতে বসলাম। আসলে বসলাম বলাটা ভুল হলো, বসতে রীতিমতো বাধ্য হলাম। গত এক সপ্তাহ ধরে, নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করছি, লিখব কি না? কি লিখব? কেন লিখবো?

বন্যাদি’র কাছ থেকে জানলাম, আপনার জন্মদিন ১২ সেপ্টেম্বর। আপনার নিজ হাতে গড়া যুক্তিবাদের প্ল্যাটফর্ম ‘মুক্তমনা’ সবাইকে লিখতে আহ্বান করেছে, আপনাকে নিয়ে, যুক্তি নিয়ে, আলোকিত হওয়া নিয়ে। প্রথমেই নিজের অজান্তে মনে হলো, আমি লিখব। আমার লেখতেই হবে। যদিও আমি কখনোই লিখি নি। কিছুই লিখি নি। তারপরও লিখব।

আপনার হত্যাকাণ্ডের খবরটা এসেছিল খুবই আকস্মিক ভাবে। ফেসবুকে ঢুকেই দেখি, কুঙ্গো থাঙ দাদার স্ট্যাটাস। বজ্রাহতের মতো বসে ছিলাম। এক দুইমিনিট না, অনেকক্ষণ । মনে হচ্ছিল সহস্রকাল পেরিয়ে যাক, এই আবর্জনার সমাজ ভেঙেচুরে অভ্যুদয় হোক নতুন যুগের, যে যুগের অনিঃশেষ প্রাণশক্তি ভাসিয়ে দিয়ে যাবে অভিজিৎ রায়ের রক্তের দাগ। ততক্ষণ না হয়, স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি।

মানুষ যা চায়, তা তো আর হয় না। নীরবতা ভাঙলো বোনের চিৎকারে, ‘এই ধীমান! অভিজিৎ রায়কে খুন করে ফেলছে,!! ‘ মা ঐদিনই মাথা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করালো, মুক্তমনা কেন, কোন ব্লগেই কোনদিনও যেন কিছু না লিখি।

আপনার জন্মদিনের জন্য লিখতে তাই এত দ্বিধা ছিল। মায়ের আদেশ নাকি আদর্শ? কোন দিকে যাব? লড়াইতে আপনার আদর্শ জিতে গেলো, দাদা। আমি আপনাকে স্মরণ না করে পারবো না, তাই রাত ৩:১৩ এ বসে বসে আপনার কথা ভাবছি।

দাদা, একটা ব্যাপার দেখেছেন, সারাজীবন স্কুল কলেজে ‘শ্রীহরি সহায়’ লেখা ছেলেটা আজ শ্রীহরিকে স্মরণ না করে, রবীবাবুর গান দিয়ে চিঠি শুরু করেছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আপনার লেখার স্ট্যাইল নকল করলাম, ঐযে ‘মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে’ বইয়ের সবগুলো লেখায় এভাবে শুরু করতেন, সেখান থেকেই মাথায় ঢুকে গেছে। এখন চাইলেও বের করতে পারি না।

দাদা, আপনার কি আমাকে মনে আছে? মনে আছে, সেই বিজয়দার গীতা নিয়ে প্রবন্ধটা পড়ে আপনাকে ইনবক্সে জ্বালাতন করেছিলাম? যেই গীতার ইতিউতি মাহাত্ম্য ছোটবেলা থেকেই পরিবার, আত্মীয়-স্বজন আর পাঠ্যবইয়ে পড়ে আসছি, সেই গীতার এমন ভ্রান্তি পড়ে আমার বিশ্বাসের ভীতটা টালমাটাল হয়ে গিয়েছিল। আপনি আরও ধরিয়ে দিলেন, ‘ধর্ম ও বিজ্ঞান : সংঘাত নাকি সমন্বয়? ‘ এর প্রবন্ধ গুলো। কি সাংঘাতিক রাত ছিল সে সময়, তাই না দাদা?

আপনার লেখার সাথে পরিচয় কিন্তু দাদা আরও আগে। ঐ বিজয়দারই সম্পাদিত ‘ডারউইন : একুশ শতকের ভাবনা ও প্রাসঙ্গিকতা ‘ বইয়ে। খুব সম্ভবত হয়েলের ফ্যালাসী নিয়ে লিখেছিলেন। এরপর প্রায়ই মুক্তমনায় যেতাম। আপনার সম্পর্কে জেনেছিলাম ওখানেই। এরপর বন্ধু ইমনের নোটে আপনার উৎসাহ, কে বলবে এই লোক এতোবড় মানুষ? মনে হয়, আরে এতো আমার ঘরের লোক! আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, দাদা, অমন উৎসাহের ফল্গুধারাটাই আর কোথাও নাই!

দাদা, চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছিল, তাই একটু ঘুরে এলাম। বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। প্রকৃতিও মনে হয়, আমাদের দুঃখ বুঝতে পারে। নইলে, ছমাস পরে টিএসসিতে যে দিন গেলাম, ঐদিনও এমন বৃষ্টি হচ্ছিলো।

এতোক্ষণ ধরে একঘেয়ে কথা বলেই যাচ্ছি। বিরক্ত হচ্ছেন না তো? হলে হবেন। কাউকে বলতে পারি না, আবার বলতে ইচ্ছাও করে। আজ হাবিজাবি যা মনে আসবে, বলবো। বলার স্বাধীনতার জন্য যার এতো ত্যাগ, সেই লোক কি আমাকে থামিয়ে দিবে? দিবে না।


দাদা, সেদিন একটা উক্তি পড়লাম, ‘When writers die, they become books, which is, after all, not a bad incarnation’ খুব সম্ভবত Jorge Luis Borges এর। এটাই সত্যি দাদা। আপনার বইগুলো যখন দেখি, তখন মনে হয় আপনি আমাদের মাঝেই আছেন, থাকবেন। কোন চাতপাতি’র সাধ্য নেই, এই অভিজিৎকে মারার। এই অভিজিৎ আলো হাতে চলা নক্ষত্রের সন্তান, কোন বিজলি বাতি না যে চাইলেই নিভিয়ে ফেলবে।

দাদা, এখন কিছু আলোর কথা বলি। ছোটভাইকে নিয়ে ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান মেলায় গিয়েছিলাম। সেখানে অনেক ইভেন্টের মাঝে দেয়ালিকা প্রদর্শনী ছিল। অনেক প্রযুক্তি নির্ভর, চটকদার জনপ্রিয় বিজ্ঞানের দেয়ালিকার ভীড়ে একটা দেওয়ালিকা ছিল, বিশুদ্ধ তাত্ত্বিক বিজ্ঞান নিয়ে, পুরো প্রতিযোগিতার একমাত্র বাংলা নামের দেয়ালিকা ‘ত্রৈধবিন্দু’। মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চা হোক – এই স্বপ্ন তো আমাদের সবার। স্কুলের তিন বাচ্চা ছেলে রিয়াজুস সালেহীন জাওয়াদ, দীপু কুমার সরকার আর লাবীব খান যেন ভবিষ্যতে আমাদের ‘অভিজিৎ’ হয়ে উঠে এই শুভ কামনা করে দেখি, উৎসর্গপত্রে লেখা ‘ সদ্য প্রয়াত বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায়কে ‘।
দাদা, গর্বে বুকটা ভরে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল যে, আলোকবর্তিকা ওরা নিভিয়ে দিতে চেয়েছিল তা ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের রন্ধে-রক্তে-শ্রোণিতে। যে পাখির সুর ওরা স্তব্ধ করতে চেয়েছিল, সেই পাখির কণ্ঠ যেন আকাশে -বাতাসে বলে বেড়াচ্ছে,


তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে,

এ আগুন ছড়িয়ে গেল সব খানে॥

যত সব মরা গাছের ডালে ডালে

নাচে আগুন তালে তালে রে,

আকাশে হাত তোলে সে কার পানে ॥

আঁধারের তারা যত অবাক হয়ে রয় চেয়ে,

কোথাকার পাগল হাওয়া বয় ধেয়ে।

নিশীথের বুকের মাঝে এই-যে অমল
উঠল ফুটে স্বর্ণকমল
আগুনের কি গুণ আছে কে জানে।। ”

দাদা আর পারবো না। আজ থামি।

ইতি
ধীমান

পুনশ্চ ১: প্রিয়ন জিনিসটা যে এত অদ্ভুত, সেটা উপলব্ধি করেছিলাম আপনার লেখা পড়ে। এজন্য আপনি একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য

পুনশ্চ ২ : আমাকে তুমি করে বলবেন।