বাংলাদেশের অনলাইন জগতে বিজ্ঞানমনষ্ক ভিন্নদৃষ্টির প্রসার ঘটাতে যে মানুষটি পথিকৃৎ ,তিনি অভিজিৎ রায়।
সামনা-সামনি পরিচিত হবার সুযোগ ঘটেনি আমার।ফেসবুকে কয়েকবার মেসেজের আদান প্রদান ,কমেন্ট বিনিময় এই যা।তাঁর ব্লগ ও লেখা পড়ে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই, বিষয়গত দিকে যেমন বৈচিত্র্যময়, তেমনি সুখপাঠ্যও।পরবর্তীতে সে মুগ্ধতা চিরস্থায়ী হয় বই পড়ে,বিজ্ঞানকে সর্বজনপাঠ্য করে লেখার কঠিন কাজটি সুচারুভাবে করে গেছেন তিনি। কাদম্বরী দেবী থেকে কৃষ্ণগহ্বরের বিকিরণ, হার্ডকোর সাহিত্য থেকে বিজ্ঞান, প্রতিটি বিষয়েই তাঁর লেখনী শক্তিশালী। আন্তর্জালিক ক্ষেত্রে লেখালেখির পরিবেশটা বেশ বায়বীয়,খুব দ্রুত মন্তব্য বা আলোচনা করার সুবিধাটার নেতিবাচক দিকও কম নয়।বেশিরভাগ সময়ই পাঠক/লেখক অধৈর্যের শিকার হয়ে অগভীর আলোচনায় প্ররোচিত হন, কখনো কখনো এর থেকে জন্ম দেয় মনোমালিন্য।নিয়মিত ব্লগ ও লেখা পাঠের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি,খুব কম লেখককেই পেয়েছি,অভিজিতদার মতো; যিনি অন্যের যুক্তি শুনে নিজের কথাটিকে প্রশ্ন করার মতো সততা রাখেন।সবসময় এই বিনয়টুকু দেখছি বলে প্রিয় লেখক হিসেবে তিনি আমার কাছে অন্যরকম।দাদার মার্ক্সবাদ কি বিজ্ঞান ও রবীন্দ্রনাথের রাহাজানি শীর্ষক প্রবন্ধদুটো খুব সম্ভবত বাংলা ব্লগজগতের অন্যতম বহুলপঠিত লেখা। এই দুটো আমি বহুজনকেও পড়িয়েছি।ব্লগের লেখার কথা বললে, এখনো এই দুইটার মতো কোন ভিন্নচিন্তার লেখা আমাকে এতোটা নাড়া দিতে পারেনি।বেশ কিছু বিষয়ে দাদার চিন্তার সাথে নিজেকে মেলাতে পারিনি, এখনো কোন কোন ক্ষেত্রে না, কিন্তু ভিন্নমতে চিন্তার সৎসাহসটুকু অর্জনের পেছনে অন্যতম হয়ে আছেন এই মানুষটা।সুখপাঠ্য লেখা দিয়ে যুক্তির প্রভাব বিস্তার নয়, ভিন্নভাবে চিন্তা করার সামর্থ্যের বিকাশটাকেই আমার চিন্তার মুক্তি মনে হয়। অনলাইনে, এইচিন্তাধারার শুরুর শিক্ষা পেয়েছি অভিজিতদার কাছ থেকেই।

মুক্তমনার সাথে আমার পরিচয় ২০০৯ সালের শেষের দিকে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে তুমুল।ইন্টারনেট তখনো সুলভ্য হয়নি আমার মফস্বল শহরে, বাসায় কম্পিউটার না থাকার কারণে সাইবার ক্যাফেতে ‘আধঘন্টা প্রতি ২০ টাকা’ হারে ব্রাউজ করতে যেতাম।এখনো মনে আছে কীভাবে মুক্তমনা আবিষ্কার করি। প্রবীর ঘোষ সম্পাদিত অলৌকিক নয় ,লৌকিক নিয়ে মজে আছি; সুযোগ পেলেই ওখানে দেখা নতুন টার্মগুলো নোট করে গুগল সার্চ করে দেখতাম।ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির ওয়েবসাইটে প্রথম পাই মুক্তমনার ঠিকানা। তারপরের কথাগুলো কেমন হতে পারে আন্দাজ করে নেয়া যায়, নিয়মিত পাঠক হয়ে পড়ি মুক্তমনার।ইংরেজিতে পাঠ্যাভাস তখনো সড়গড় হয়নি। এ অবস্থায় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদ নিয়ে পড়াশোনা করার রত্ন-ভাণ্ডারের সন্ধান পাই মুক্তমনা দেখে, নিঃসন্দেহে সেখানে অভিজিতদার লেখা ও মন্তব্য ছিল মূল্যবান মুক্তোর মতোই!

আমার এখনো বিশ্বাস হয়না দাদা নেই।যেদিন তাঁর নির্মম হত্যার খবর পেয়েছিলাম, নিদ্রাহীন ঘোরের সে রাত মনে করতে চাইনা।অপ্রিয় হলেও সত্যি, অভিজিতদার মৃত্যু মানুষের ওপর থেকেই বিশ্বাস নষ্ট করে দিয়েছে। পরক্ষণে আবার মনে হয়, আলো হাতে অভিযাত্রীর এই যে দুর্গম পথের যাত্রা তা তো শেষ হয়ে যায়নি। যে আলো অভিজিৎ রায় জ্বেলেছেন, গহীন অন্ধকারে সে আলো ছড়ানোর অমোঘ দায়িত্ব থেকে আমরা মুক্ত কি? অভিজিৎ রায় হয়ে উঠুন এই দাহকালের অভিযত্রিকের অন্তরের শক্তি। মুক্তচিন্তার আলো ছড়িয়ে পড়ুক সবখানে!