যৌনতা মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, প্রায় প্রতিটি মানুষের জীবনের যৌনতা খুব বড় একটি ব্যাপার। বর্তমান পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের যৌনতা আমারা লক্ষ্য করি। এর মাঝে কিছু যৌনতাকে আমারা বৈধ বলি আবার কিছু যৌনতাকে অবৈধ বা প্রকৃতি বিরোধী বলে থাকি। আলোচনার মূল বিষয়বস্তু মূলত সমকামিতা কি প্রকৃত বিরোধী এবং এটি কোন রোগ কিনা। এছাড়াও আলোচনা হবে সমকামিতা যদি বৈধ হয় তবে পশু ও শিশুকাম বৈধ কিনা। ব্যাপারগুলো মানবিক দিক থেকে আলোচনার চেষ্টা করা হবে। তার আগে জেনেনি আমাদের পরিচিত কিছু যৌন আচরণ সম্পর্কে।
সমকামিতাঃ
সমকামিতার ইংরেজী প্রতিশব্দ হোমোসেক্সুয়ালিটি তৈরি হয়েছে গ্রীক ‘হোমো’ এবং ল্যাটিন ‘সেক্সাস’ শব্দের সমন্বয়ে। ল্যাটিন ভাষায়ও ‘হোমো’ শব্দটির অস্তিত্ব রয়েছে। তবে ‘ল্যাটিন হোমো’ আর ‘গ্রীক হোমো’ কিন্তু সমার্থক নয়। ল্যাটিনে হোমো অর্থ মানুষ। ওই যে আমরা নিজেদের হোমোস্যাপিয়েন্স ডাকি – তা এসেছে ল্যাটিন ভাষা থেকে। কিন্তু গ্রিক ভাষায় ‘হোমো’ বলতে বোঝায় ‘সমধর্মী’ বা ‘একই ধরণের’। আর সেক্সাস শব্দটির অর্থ হচ্ছে যৌনতা। কাজেই একই ধরনের অর্থাৎ, সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বোধ করার (যৌন)প্রবৃত্তিকে বলে হোমোসেক্সুয়ালিটি। আর যারা সমলিঙ্গের প্রতি এ ধরনের আকর্ষণ বোধ করেন, তাদের বলা হয় হোমোসেক্সুয়াল।
সমকামিতার ইতিহাস প্রাচীন হলেও ইংরেজীতে শব্দটির ব্যাবহার কিন্তু খুব প্রাচীন নয়। একশ বছরের কিছু বেশি হল শব্দটি চালু হয়েছে। শুধু ইংরেজী কেন, ইউরোপের বিভিন্ন ভাষাতেও সমকামিতা এবং সমকামিতার বিভিন্নরূপকে বোঝাতে কোন উপযুক্ত শব্দ প্রচলিত ছিল না। বাংলায় ‘সমকামিতা’ শব্দটি এসেছে বিশেষণ পদ -‘সমকামী’ থেকে। আবার সমকামী শব্দের উৎস নিহিত রয়েছে সংস্কৃত ‘সমকামিন’ শব্দটির মধ্যে। যে ব্যক্তি সমলৈঙ্গিক ব্যক্তির প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করে তাকে ‘সমকামিন’ বলা হত। সম এবং কাম শব্দের সাথে ইন প্রত্যয় যোগ করে ‘সমকামিন’ (সম + কাম + ইন্) শব্দটি সৃষ্টি করা হয়েছে। আমার ধারণা সমকামিতা নামের বাংলা শব্দটির ব্যাবহারও খুব একটা প্রাচীন নয়। প্রাচীনকালে সমকামীদের বোঝাতে ‘ঔপরিস্টক’ শব্দটি ব্যবহৃত হত। যেমন, বাৎসায়নের কামসূত্রের ষষ্ঠ অধিকরণের নবম অধ্যায়ে সমকামীকে চিহ্নিত করতে ‘ঔপরিস্টক’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। যদিও পরবর্তীকালে এ শব্দের বহুল ব্যবহার আর লক্ষ্য করা যায় নি, বরং ‘সমকাম’ এবং ‘সমকামী’ শব্দগুলোই কালের পরিক্রমায় বাংলাভাষায় স্থান করে নিয়েছে। কেউ কেউ সমকামিতাকে আরেকটু ‘শালীন’ রূপ দিতে ‘সমপ্রেম’ শব্দটির প্রচলন ঘটাতে চান।
১৮৬৯ সালে কার্ল মারিয়া কার্টবেরি সডোমি আইনকে তিরষ্কার করে ইংরেজিতে প্রথম ‘হোমোসেক্সুয়াল’ শব্দটি ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে জীববিজ্ঞানী গুস্তভ জেগার এবং রিচার্ড ফ্রেইহার ভন ক্রাফট ইবিং ১৮৮০’র দশকে তাঁদের সাইকোপ্যাথিয়া সেক্সুয়ালিস গ্রন্থে হেটারোসক্সুয়াল ও হোমোসেক্সুয়াল শব্দ দুটো দ্বারা যৌন পরিচয়কে দুই ভাগে বিভক্ত করেন, যা পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী যৌন পরিচয়ের শ্রেণীবিভাজন হিসেবে ব্যাপক পরিসরে গৃহীত হয়।
বর্তমানে হোমোসেক্সুয়াল শব্দটি বিদ্বৎসমাজে এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যবহৃত হলেও ‘গে’ এবং ‘লেসবিয়ান’ শব্দদুটি অধিক জনপ্রিয়। গে শব্দটির দ্বারা পুরুষ সমকামীদের বোঝানো হয় এবং নারী সমকামীদেরকে বোঝানো হয় লেসবিয়ান শব্দটির দ্বারা। পশ্চিমে ‘গে’ শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হতে দেখা যায় ১৯২০ সালে। তবে সে সময় এটির ব্যবহার একেবারেই সমকামীদের নিজস্ব গোত্রভুক্ত ছিলো। মুদ্রিত প্রকাশনায় শব্দটি প্রথম ব্যবহৃত হতে দেখা যায় ১৯৪৭ সালে। লিসা বেন নামে এক হলিউড সেক্রেটারী ‘Vice Versa: America’s Gayest Magazine’ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশের সময় সমকামিতার প্রতিশব্দ হিসেবে ‘গে’ শব্দটি ব্যবহার করেন। আর ‘লেসবিয়ান’ শব্দটি এসেছে গ্রিস দেশের ‘লেসবো’ নামক দ্বীপমালা থেকে। কথিত আছে, খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে স্যাফো নামে সেখানকার এক কবি/শিক্ষিকা মেয়েদের সমকামী যৌন জীবন নিয়ে কাব্য রচনা করে ‘কবিতা উৎসব’ পালন করতেন। এইভাবে প্রথম দিকে লেসবিয়ান বলতে ‘লেসবো দ্বীপের অধিবাসী’ বোঝালেও, পরবর্তীতে নারীর সমকামিতার সাথে এটি যুক্ত হয়ে যায়।
জীববিজ্ঞানীরা সমকামিতাকে প্রানিজগতে সঙ্ঘটিত বহুমুখী যৌনতাসমূহের একটি অন্যতম অংশ বলে মনে করেন। জীববিজ্ঞানী ব্রুস ব্যাগমিল তার ‘বায়োলজিকাল এক্সুবারেন্স : অ্যানিমাল হোমোসেক্সুয়ালিটি অ্যান্ড ন্যাচারাল ডাইভার্সিটি’ বইয়ে প্রায় পাঁচশ’ প্রজাতিতে সমকামিতার অস্তিত্বের উদাহরণ লিপিবদ্ধ করেছেন । সামগ্রিকভাবে জীবজগতে ১৫০০ রও বেশী প্রজাতিতে সমকামিতার অস্তিত্ব প্রমাণিত । তালিকায় স্তন্যপায়ী প্রাণী থেকে শুরু করে পাখি, মাছ, সরীসৃপ, উভচর, কীটপতঙ্গ ইত্যাদি সকল প্রাণী বিদ্যমান।
আধুনিক পাশ্চাত্য জগতে বিভিন্ন প্রধান গবেষণার ফলে অনুমিত হয় সমকামী বা সমলৈঙ্গিক অভিজ্ঞতাসম্পন্নরা মোট জনসংখ্যার ২% থেকে ১৩% । ২০০৬ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, জনসংখ্যার ২০% নাম প্রকাশ না করে নিজেদের মধ্যে সমকামী অনুভূতির কথা স্বীকার করেছেন; যদিও এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে খুব অল্পজনই নিজেদের সরাসরি সমকামীরূপে চিহ্নিত করেন। অর্থাৎ এটি প্রকৃতি বিরোধী না কোন রোগ নয়, অন্যান্য যৌনতার মত স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা।
মানব ইতিহাসের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন রুপে সমকামিতার অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যায়। কোন কোন জায়গায় সমকামী যৌনাচরণের চর্চা হত গুপ্ত বিনোদন হিসেবে, আবার কোন কোন জায়গায় সমকামিতা উদযাপন করা হত সংস্কৃতির অংশ হিসেবে। প্রাচীন গ্রীসে পাইদেরাস্ত্রিয়া, কিংবা এরাস্তেস এবং এরোমেনোস-এর সম্পর্কগুলো উল্লেখযোগ্য। সমকামিতার প্রছন্ন উল্লেখ আছে প্রাচীন বহু সাহিত্যে। হোমারের বর্ণিত আকিলিস এবং পেট্রোক্লুসের সম্পর্ক, প্লেটোর দার্শনিক গ্রন্থ সিম্পোজিয়ামে ফায়াডেরাস, পসানিয়াস, এগাথন, অ্যারিস্টোফেনেস, এরিক্সিমাচুসের নানা বক্তব্য এবং সক্রেটিসের সাথে আলকিবিয়াডসের প্লেটোনিক সম্পর্ককে বহু বিশেষজ্ঞ সমকামিতার দৃষ্টান্ত হিসেবে হাজির করেন। খ্রীস্টপূর্ব ছয় শতকের গ্রিসের লেসবো দ্বীপের উল্লেখযোগ্য বাসিন্দা স্যাপো নারীদের নিয়ে, তাদের সৌন্দর্য নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন । এই লেসবো থেকেই লেসবিয়ান (নারী সমকামিতা) শব্দটি এসেছে। বহু রোমান সম্রাট – যেমন জুলিয়াস সিজার, হাড্রিয়ান, কমোডাস, এলাগাবালাস, ফিলিপ দ্য এরাবিয়ান সহ অনেক সম্রাটেরই সমকামের প্রতি আসক্তি ছিলো বলে ইতিহাসে উল্লিখিত আছে । রেনেসাঁর সময় বহু খ্যাতনামা ইউরোপীয় শিল্পী যেমন, দোনাতেল্লো, বত্তিচেল্লী, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি এবং মাইকেলেঞ্জেলোর সমকাম প্রবণতার উল্লেখ আছে। চৈনিক সভ্যতা এবং ভারতীয় সংস্কৃতিতেও সমকামিতার উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন বিষ্ণুর মোহিনী অবতাররূপে ধরাধামে এসে শিবকে আকর্ষিত করার কাহিনী এর একটি দৃষ্টান্ত। বিষ্ণু (হরি) এবং শিবের (হর) মিলনের ফসল অয়াপ্পানকে হরিহরপুত্র নামেও সম্বোধন করা হয়। এ ছাড়া অষ্টাবক্র, শিখন্ডী এবং বৃহন্নলার উদাহরণগুলো সমকামিতা এবং রূপান্তরকামিতার দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে উঠে এসেছে। এছাড়া আব্রাহামীয় ধর্মসমূহের ইতিহাসেও লূত নবীর সম্প্রদায় সডোম ও গোমোরাহ নামক জাতির নেতিবাচক যৌনাচার হিসেবে ইঙ্গিত করে সমকামিতার কথা খুজে পাওয়া যায়, যেখানে সমকামিতা ও অজাচার ত্যাগ না করার অপরাধে ঐশী বিপর্যয় কর্তৃক তাদেরকে ধ্বংস করার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।
বিপরীতকামিতাঃ
লৈঙ্গিক শ্রেণীবিন্যাসের অন্তর্গত একই প্রজাতির পরস্পর বিপরীত লিঙ্গের দু’টি প্রাণী বা বিপরীত লিঙ্গের দু’টি মানুষের মধ্যে রোমান্টিক আকর্ষণ, যৌন আকর্ষণ অথবা যৌন আচরণ। ইংরেজিতে একে Heterosexuality বলা হয়ে থাকে। এছাড়াও একে বিষমকামিতা বা ভিন্নকামিতা নামে অভিভূত করা হয়ে থাকে।
বেশীরভাগ মানুষই নিজেদেকে বিপরীতকামী বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন। এছাড়াও বহু সমাজবিজ্ঞানী মানব সমাজকে “বিপরীতকামিতা-স্বাভাবিক সমাজ” (heteronormative society) বলে চিহ্নিত করেছেন। এর সম্পর্কে আমারা প্রায় সবাই কম বেশী অবগত। কারণ আমারা সিংহভাগ মানুষ বিপরীতকামী।
উভকামিতাঃ
উভকামিতা বলতে বিশেষ একটি যৌন প্রবণতা বোঝায় যখন একজন মানুষ, নারী ও পুরুষ, উভয় লিঙ্গের প্রতিই যৌন আকর্ষণ অনুভব করে। এরূপ মানুষ সমলিঙ্গ ও বিপরীত লিঙ্গ উভয়ের সঙ্গে যৌনক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক হলে এবং এরূপ যৌনমিলনের মাধ্যমে যৌনানন্দ লাভে সক্ষম হলে তাকে বলা হয় উভকামী। কার্যতঃ উভকামিতা মানুষের দুটি প্রধান যৌনপ্রবৃত্তি বিপরীতকামিতা ও সমকামিতার উভয়ের সমন্বয়। যে সকল ব্যক্তির মধ্যে উভকামী যৌনপ্রবৃত্তি লক্ষিত হয়, তাঁরা “তাঁদের স্বলিঙ্গ এবং একই সঙ্গে বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তিদের প্রতি যৌন, আবেগ ও স্নেহজাত আকর্ষণ অনুভব করেন”; “এছাড়াও এই প্রবৃত্তি এই ধরনের আকর্ষণের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত ও সামাজিক পরিচিতি, এই জাতীয় আচরণ এবং সমজাতীয় ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত সম্প্রদায়ের সদস্যতাটিও নির্দেশ করে।
মানবসভ্যতার বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় এবং প্রাণীরাজ্যের অন্যত্রও লিখিত ইতিহাসের সমগ্র সময়কাল জুড়ে উভকামিতার উপস্থিতি লক্ষিত হয়। বাইসেক্সুয়ালিটি শব্দটি যদিও ঊনবিংশ শতাব্দীতে হেটেরোসেক্সুয়ালিটি ও হোমোসেক্সুয়ালিটি শব্দদুটির আদলে ব্যুৎপন্ন হয়।
শিশুকামিতাঃ
অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুদের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা কে মূলত শিশুকামিতা বলা হয়ে থাকে। এখানে ছেলে মেয়ে উভয় ই হতে পারেন। ধর্মী আইন ছাড়া প্রায় সব দেশে শিশুকামিতা একটি অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হয়। কারণ একটি শিশুর পক্ষে সুস্থ্য যৌনতা সম্পর্কে বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। অ্যামেরিকা সহ পশ্চিমা বিশ্বে এটি মারাত্মক অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। একে সরাসরি ধর্ষণ হিসেবে ধরা হয় এবং ধর্ষণের আওতায় এনে শাস্তি প্রদান করা হয় (শিশুটি কে নয়)।
পশুকামিতাঃ
একজন মানুষ যখন মানুষ ব্যাতিত অন্য কোন প্রাণীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন তবে তাকে পশুকামিতা বলা হয়। এটি প্রায় সব দেশে অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সাধারণত গৃহপালিত পশুদের সাথে পশুকামিরা যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে থাকেন সহজলভ্যতার কারনে। এই পশুকামিতা পশুদের মাঝেও বিদ্যমান আছে। তবে সাধারণ ভাবে একটি পশুর সাথে জোরপূর্বক ও ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা হয় বলে একে ধর্ষণের আওতায় দেখা হয়।
উপরোক্ত বিভিন্ন যৌন আচরণের সম্পর্কে তথ্য ও সংজ্ঞা থেকে আমারা দেখতে পারছি, একটি যৌন আচরণ থেকে অন্যটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বা বিপরীত অথবা প্রায় ভিন্ন। তাই সমকামিতার সাথে পশুকামিতা ও শিশুকামতার কোন সম্পর্ক নাই ও থাকতে পারে না। তিনটি যৌন আচরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। তবে উভকামির সাথে সমকামিতার যেমন সম্পর্ক আছে তেমনি আছে বিপরীতকামিতার নিবিড় সম্পর্ক। কেউ যদি উভকামিতা কে সমকামিতাকে দায়ী করেন তবে সেই একি যুক্তিতে বিপরীতকামিতাকে দায়ী করা সম্ভব। তিনটি যৌনতাই প্রাকৃতিক।
“সমকামিতার পক্ষে আজ কথা বলছেন কাল তো পশু ও শিশুকামিতার পক্ষে কথা বলবেন” এমন তির্যক কথা প্রায় শোনা যায় বিভিন্ন মানুষদের কাছ থেকে। না সেই সব যৌন আচরণের পক্ষে কথা বলা হবে না বিভিন্ন কারনে। একটি পশু প্রায় কখনোই একজন মানুষের সাথে ইচ্ছাকৃত ভাবে যৌন সম্পর্ক স্থান করবে না। সেই ক্ষেত্রে মানুষটি জোর খাটিয়ে ও পশুটির ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করবেন, যা এক কথায় ধর্ষণ। আমারা উভয়ের সম্মতিতে যৌনতাকে সমর্থন করবো কিন্তু ধর্ষণ কে নয়। তাই পশুকামিতাকে সমর্থন করার প্রশ্ন আসে না। কেউ যদি বলেন পশুটি ইচ্ছাকৃত ভাবে করেছে, তবে বলবো সেই পশুটির ইচ্ছা অনিচ্ছা বুঝতে পাড়ার ব্যবস্থা আগে করুন। হে পশুদের মাঝে এই প্রবৃত্তি থাকতে পারে কিন্তু তা আগে নির্ণয়ের ব্যবস্থা করা আবশ্যক। শিশুকামিতার ব্যাপারে পশ্চিমা বিশ্ব বেশ কঠোর অবস্থানে থাকলেও প্রায় শিশু নির্যাতনের খবর পাওয়া যাও। এর অন্যতম কারণ পশ্চিমা মিডিয়া বেশ স্বাধীন। একজন শিশু বা অপ্রাপ্ত বয়স্কা মানুষের বিচার বুদ্ধি পুরনাঙ্গ মানুষের থেকে কম। যৌনতা সম্পর্কে তাদের ধারণা, চিন্তা বেশ সীমিত। তাই বেশীরভাগ সময় তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের যৌনতায় ব্যাবহার করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে তারা বুঝতেও পারেন না তারা কারো যৌন লিপ্সার শিকার হচ্ছেন। সেই সব বিবেচনা করে শিশুকামিতাকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে না। তবে শিশুটি সম্মতি থাকলে কিছুটা ভিন্ন ব্যাপার বৈকি। আর সেই ক্ষেত্রে শিশুটি তো আর আইনের আশ্রয় চাইবে না।
সমকামিতা ও বিপরীতকামিতা উভয় অবৈধ ও অপরাধ হয়ে উঠে তখনি যখন তা ইচ্ছার বিরুদ্ধে করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ ধর্ষণ। ধর্ষণ ছাড়া উভয় সঙ্গী বা সঙ্গিনীর ইচ্ছায় যৌন সম্পর্ক স্থাপন অবৈধ হবার কোন কারণ নাই।
সমকাম তখন বৈধ ও সুস্থ্য হবে কখন উভয় সঙ্গী বা সঙ্গিনীর মাঝে সম্মতি থাকবে, তা প্রকৃতি বিরোধী কিছু হবে না। আর যদি না থাকে তবে তা ধর্ষণ হয়ে উঠবে।
রিচার্ড ফ্রেইহার ইবিং ১৮৮৬ সালে তার “সাইকোপ্যাথিয়া সেক্সিয়ালিস” বইয়ে সমকামীদের গায়ে ‘মানসিক রোগের’ তকমা লাগিয়ে দেন, যা পরবর্তী একশো বছর মন বিজ্ঞানদের কাছে মানসিক রোগ হিসেবে থেকে গেছে। সেই সময় সমকামীদের উপর তারা চালিয়েছেন ব্যাপক নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ড। সেই শোন কর্মকাণ্ডের মূল বিষয়বস্তু ছিল এই রোগ হতে মুক্তি। কিন্তু সমকামিতা কোন রোগ নয়। সমকাম দেহের কোন ব্যাথা ঘটাচ্ছে না বা শারীরিক কোন কর্মকাণ্ডে বাঁধা সৃষ্টি করছে না।
আপনি সমকামী নন তাই নিজের অবস্থানে বসে সমকামের কথা চিন্তা করলে আপনার শরীল রি রি করে উঠতে পারে, কিন্তু নিজের যৌন চিন্তা ও জীবন নিয়ে চিন্তা করুন সেখানে আপনি সুখ বোধ করছেন। ঠিক তেমন ভাবে একজন সমকামি নিজের যৌন জীবন নিয়ে সুখানুভুতি অনুভব করবেন। একটু নিজের চিন্তা থেকে বেড়িয়ে একজন সমকামী মানুষের মনের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করুন। হয়তো আপনি কিছুটা অনুভব করতে পারবেন।
শেষ করি অ্যামেরিকার অ্যামেরিকার সাইকোলজিকাল এ্যাসোসিয়েশন স্বীকারোক্তির মাধ্যমে। এছাড়াও ১৯৭৩ সালে অ্যামেরিকার সাইকিয়াট্রিক এ্যাসোসিয়েশণ স্বীকার করে নেন সমকামিতা কোন রোগ নয়। ১৯৯৪ সালে অ্যামেরিকার সাইকোলজিকাল এ্যাসোসিয়েশন ” ষ্টেটমেন্ট অন হোমোসেক্সুইয়ালিটি” শিরোনামে অ্যামেরিকার সাইকোলজিকাল এ্যাসোসিয়েশন বিবৃতি দেন যে,
“সমকামিতা নিয়ে গবেষণা ফলাফল খুব পরিষ্কার। সমকামিতা কোন মানসিক রোগ নয়, নয় কোন নৈতিক অধঃপতন। মোটা দাগে এটি হচ্ছে আমাদের জনপুঞ্জের সংখ্যালঘু একটি অংশের মানবিক ভালবাসা এবং যৌনতা প্রকাশের একটি স্বাভাবিক মাধ্যম। একজন গে এবং লেসবিয়ানের মানসিক স্বাস্থ্য বহু গবেষণায় নথিবদ্ধ করা হয়েছে। গবেষণার বিচার, দৃঢ়তা, নির্ভরযোগ্যতা, সামাজিক এবং জীবিকাগত দিক থেকে অভিযোজিত হবার ক্ষমতা সব কিছু প্রমান করে যে, সমকামীরা আর দশটা বিষমকামীদের মতই স্বাভাবিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতে পারে।
এমনকি সমকামিতা কারো ব্যাক্তি পছন্দ বা স্বেচ্ছাচারিতার ব্যাপারও নয়। গবেষণায় থেকে বেড়িয়ে এসেছে, সমকামী প্রবৃত্তিটি জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে তৈরি হয়ে যায়, এবং সম্ভবত তৈরি হয় জন্মের আগেই। জনসংখ্যার প্রায় দশভাগ অংশ সমকামী রবং এটি সংস্কৃতি নির্বিশেষে একই রকম থাকে, এমনকি নৈতিকতার ভিন্নতা এবং মাপকাঠিতে বিস্তর পার্থক্য থাকা সত্তেও। কেউ কেউ অন্যথা ভাবলেও, নতুন নৈতিকতা আরোপ করে জনসমষ্টির সমকামী প্রবৃত্তি পরিবর্তন করা যায় না। গবেষণা থেকে আরও বেড়িয়ে এসেছে যে, সমকামিতাকে ‘সংশোধন’ এর চেষ্টা আসলে সামাজিক ও মনস্তাত্বিক কুসংস্কার ভিন্ন আর কিছু নয়।”
সুত্রঃ
১) একটি বৈজ্ঞানিক এবং সমাজ- মনস্তাত্বিক অনুসন্ধান ” সমকামিতা” অভিজিৎ রায়
২) সমকামিতা অভিজিৎ রায় মুক্তমনা বাংলা ব্লগ
৩) উইকিপিডিয়া
৪) এছাড়াও বিভিন্ন ব্লগ
যথাযথ তথসূত্র উল্লেখ না করায় লেখাটি প্রথম পাতা থেকে সরিয়ে দেয়া হলো, লেখককে এ ব্যাপারে যত্নবান হতে অনুরোধ করা হচ্ছে।
মুক্তমনা মডারেটর,
মুক্তমনা দীর্ঘদিন ধরে যথাযথ ভাবে রেফারেন্স সহকারে বিজ্ঞান নিয়ে লিখছে বলেই এখন মুক্তমনায় প্রকাশিত বিজ্ঞানের ব্লগগুলো অন্যদের কাছে রেফারেন্স হিসেবে কাজ করে। অভিজিৎ দা নিজেই এই ধারাটা দেখিয়ে গেছেন। তাই আপনাদের অনুরোধ করব, বিজ্ঞানকে উপজীব্য করে যেই লেখা গুলো মডারেশন পার করে আসবে তার রেফারেন্সগুলো একটু ঠিকঠাক মত আছে কিনা, বা না থাকলে লেখককে সেগুলো ঠিক করে যোগ করে দিতে অনুরোধ করার জন্য। মুক্তমনায় প্রকাশিত বিজ্ঞানের ব্লগগুলো সঠিক রেফারেন্সের অভাবে তার নির্ভরযোগ্যতা হারালে অভিজিৎদার তৈরী করে যাওয়া বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার একটা ধারা হারিয়ে যাবে। আশা করি আপনারা বিষয়টা নিয়ে যত্নশীল হবেন।
ধন্যবাদ।
“গবেষণায় থেকে বেড়িয়ে এসেছে, সমকামী প্রবৃত্তিটি জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে তৈরি হয়ে যায়, এবং সম্ভবত তৈরি হয় জন্মের আগেই। জনসংখ্যার প্রায় দশভাগ অংশ সমকামী রবং এটি সংস্কৃতি নির্বিশেষে একই রকম থাকে, এমনকি নৈতিকতার ভিন্নতা এবং মাপকাঠিতে বিস্তর পার্থক্য থাকা সত্তেও। কেউ কেউ অন্যথা ভাবলেও, নতুন নৈতিকতা আরোপ করে জনসমষ্টির সমকামী প্রবৃত্তি পরিবর্তন করা যায় না। গবেষণা থেকে আরও বেড়িয়ে এসেছে যে, সমকামিতাকে ‘সংশোধন’ এর চেষ্টা আসলে সামাজিক ও মনস্তাত্বিক কুসংস্কার ভিন্ন আর কিছু নয়।”
এইভাবে গবেষনায় বেরিয়ে এসেছে বলে একটা কিছু লিখে ফেলা্টা ভালো প্রাকটিস হিসেবে দেখতে পারছি না বলে দুঃখিত। আপনি যখন অন্য কাউকে রেফার করছেন, তখন দয়া করে ঠিক কাকে রেফার করছেন, কোন বই তে তিনি তা বলেছেন, বা কোন প্রবন্ধে তা বলেছেন তা উল্লেখ করুন, যাতে আপনার দেয়া তথ্য অন্যরা যাচাই করে দেখতে পারে। জনৈক ফেসবুকব্যবহারকারী কোন একটা তথ্য সে ফেসবুকে পেয়েছে বলে চালিয়ে দিলে সেই কথার যেমন কোন মূল্য থাকে না, আপনার গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে এই কথারও কোন মূল্য নেই। মুক্তমনায় আমরা বস্তুনিষ্ঠ বৈজ্ঞানিক তথ্য ভিত্তিক প্রবন্ধ উতসাহিত করি। এইভাবে বায়বীয় রেফারেন্স দিয়ে লিখলে এই লেখার সাথে প্রথম আলোর চটকদার বিজ্ঞানের খবরগুলি, যা তারা নিজেরাই বুঝে না তার কোন পার্থক্য থাকে না।
আপনি অভিজিৎদার লেখা পড়ে উতসাহিত বুঝতে পারছি। আপনি যদি তার লেখা গুলো আরেকবার কষ্ট করে ঘেটে দেখেন, বুঝতে পারবেন অভিজিৎ দা কত কষ্ট করে রেফারেন্স উল্লেখ করে লিখেছেন। সেভাবে একটু চেষ্টা করুন, তাতে লেখার গ্রহনযোগ্যতা বাড়বে। না হয় আগামীকাল রহিম একটা বায়বীয় বিজ্ঞান ব্লগ লিখে নীচে লিখে দেবে করিমের কাছ থেকে শোনা কথার ভিত্তিতে লেখা। আশা করি আপনি তা চান না।
আপনি লেখাটায় বিজ্ঞান ট্যাগ করেছেন বলে এই কথা গুলো বললাম। কেবল ব্লগাড্ডা বা মানবাধিকার বলে লিখে ফেললে হয়ত বলতাম না। বিজ্ঞানে লোকে আস্থা রাখে তার নির্ভরযোগ্যতা রেফারেন্সিং, পরীক্ষিত ফলের কারণেই। উপযুক্ত রেফারেন্স ছাড়া লিখতে সেই লেখার নিরভরযোগ্যতা থাকে না।
আপনাকে ধন্যবাদ ভুল ধরিয়ে দেবার জন্য। কিছু জায়গায় আমি রেফারেন্স উল্লেখ করিনি বলে দুঃখিত। পরিবর্তীতে এই ব্যাপারগুলোতে খেয়াল রাখার চেষ্টা করবো এবং ট্যাগ করার ব্যাপারে সতর্ক থাকবো।
আমি নতুন লেখক এবং আমার লেখার সমালোচনা ও ভুল ধরিয়ে আমাকে উত্সাহিত করার জন্য আপনাকে আবারও অসংখ্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
আপনি যে সমালোচনা সহজ ভাবে নিলেন, তাতেই আমি আনন্দিত। আমি তো ভয়ে ছিলাম, আপনি আবার কিছু মনে না করেন। আসলে আমিও যখন এখানে প্রথম লেখা শুরু করেছিলাম, অন্যরা নির্দেশনা দিত কিভাবে লেখার প্রতি, যুক্তির প্রতি যত্নশীল হতে হবে। এই জায়গাটায় মুক্তমনা সবসময় অনন্য, কেবল পিঠ চাপড়ে নয়, আলোচনা, সমালোচনা, উৎসাহ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করে।
আপনার জন্য শুভ কামনা, পরবর্তী লেখা গুলো আরো দারুণ হবে বলেই আমার বিশ্বাস!
তবে কয়েকটি জায়গায় রেফারেন্স উল্লেখ না থাকায় লেখাটি প্রথম পাতা থেকে সরিয়ে ফেলার জন্য কষ্ট পেলাম এবং অনুতসাহিত বোধ করলাম.