লিখেছেনঃ সালমান রহমান

আধুনিক মুসলিম সমাজে অনেক প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ও দার্শনিকের অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও, বিজ্ঞানের কিছু বিষয়ের প্রতি এখনো সাধারণ মুসলমানদের মাঝে গোঁড়া দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হয় যা আধুনিকতার সাথে একদমই বেমানান। এরকম একটি বৈজ্ঞানিক বিষয় হলো জৈব বিবর্তন। এ নিয়ে অনেক বাঙালি লেখালেখি করেছেন এবং করছেন। কোনো এক কারণে, বাংলাদেশী মুসলিম পাঠক-পাঠিকারা সেগুলো সম্পূর্ণরুপে এড়িয়ে যান। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা পর্যন্ত একে “কেবল একটি তত্ত্ব” হিসেবেই দেখেন। পরিণতিতে, জীববিজ্ঞানের ক্লাসেই জীববিজ্ঞানের মূল তত্ত্বটাকে উহ্য রাখা হয়। কোন কোন শিক্ষক এটি সম্পূর্ণ অজ্ঞতা থেকে করেন, আবার কেউ কেউ এই কাজটা ইচ্ছাকৃতভাবেই করে থাকেন। অথচ, মুসলিম বিশ্বের অনেক প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব একে বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন।

বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক সাময়িকী নেচার-এর এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহের সংস্করণের “বিশ্ব অভিমত” কলামে কয়েক দিন আগে জর্দানের হাশামাইত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা, যিনি সবসময় হিজাব পরিধান করেন এবং আল্লাহর উপর আস্থা রাখেন, শিক্ষার্থীদেরকে বিবর্তনবিদ্যা পড়ানোর পক্ষে চমৎকার যুক্তি তুলে ধরে তাঁর নিজস্ব অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বিবর্তনবিদ্যাকে নিয়ে মুসলিম সমাজের গোঁড়ামি যে একেবারেই অজ্ঞতাপ্রসূত, রানা দাজানি নামের এই মুসলিম মহিলা বিজ্ঞানীর লেখায় তা উঠে এসেছে। বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্বের কিছু বিষয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে বিতর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করলেও লেখাটির গুরুত্ব বিবেচনা করে বাংলাভাষী পাঠক-পাঠিকাদের উদ্দেশ্যে একে ভাষান্তর করার চেষ্টা করলাম।

উৎসর্গঃ গেল মঙ্গলবার ঘাতকদের চাপাতির আঘাতে নিহত অনন্ত বিজয় দাস। বিজ্ঞানের প্রতি, বিশেষ করে জীববিজ্ঞানের প্রতি তাঁর আগ্রহ এবং অগাধ পান্ডিত্য আমাকে মুগ্ধ করতো। বিজ্ঞানশিক্ষা প্রচারের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল আমাদের। একজন চমৎকার শিক্ষককে হারালাম আমরা।
==============================================================

আধুনিকতার এই যুগে মুসলমানরা যখন জৈব বিবর্তনকে অস্বীকার করেন, সেটা যেমন একটি সমস্যাকে ইঙ্গিত করে, অন্যদিকে তেমনি, বিষয়টি খানিকটা সুযোগও সৃষ্টি করে দেয়। আমি জর্দানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদেরকে বিবর্তন পড়াই। পাঠদানের প্রথম পর্যায়ে প্রায় সবাইকেই দেখি বৈজ্ঞানিক এই সত্যটির প্রতিকূলে মতামত দেন। খুব সম্ভবত, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এ নিয়ে তাঁদেরকে কিছুই পড়ানো হয়নি। এরপরেও অনেক শিক্ষার্থী বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন যাদের অধিকাংশই কোর্স শেষে বিবর্তনের ধারণাকে গ্রহণ করে নেন। এরকম একটি আলোচিত বিষয়কে যদি মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীরা মেনে নিতে পারেন, তবে দৈনন্দিন জীবনের অনেক বিষয়ই তাঁরা অন্ধভাবে বিশ্বাস না করে প্রশ্নের মাধ্যমে সমাধান করতে সক্ষম হবেন। প্রশ্নের কষ্টিপাথরে ঘষে নানান বিষয়কে পরীক্ষা করার এই দক্ষতাটি শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্ব গঠন করে এবং সমাজের একজন দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে।

আমাকে হিজাব পড়তে দেখে শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারে যে আমি নিয়মমাফিক ধর্মকর্ম করে থাকি। অন্যদিকে যখন দেখে পৃথিবীর জীববৈচিত্র আর প্রজাতির বিকাশের কারণ হিসেবে আমি বিবর্তনের পদ্ধতিকে সমর্থন এবং চার্লস ডারউইনকে এসব বিষয়ের প্রবক্তা হিসেবে আখ্যায়িত করি, তাঁরা বেশ বড় একটা ধাক্কা খায়। আমিই সম্ভবত তাঁদের দেখা প্রথম মুসলিম যে এ বিষয়ে এমনভাবে কথা বলে।

কিছু শিক্ষার্থী আবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আমার বিপক্ষে কোরান-বিরোধীতার অভিযোগ দায়ের করে। কিন্তু যখন আমি কর্তৃপক্ষকে বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদিত পাঠ্যবইয়ে বিবর্তনের বিষয়টি দেখাই, তখন তাঁরা সন্তুষ্ট হয়ে যান। ঐসব অভিযোগ দায়েরকারি শিক্ষার্থীকে আমি বরং প্রশংসাই করি এই কারণে যে, তাঁরা তাঁদের বিশ্বাসকে সমর্থন করে সাহসের পরিচয় দেয়। এছাড়াও আমি তাঁদের সাথে এ নিয়ে বসি এবং আলোচনা করি।

ক্লাস নিতে গিয়ে ওদের সাথে আমি উদ্ভিদের প্রাকৃতিক বিবর্তন আর কৃত্রিম প্রজননের বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করি। এরপর বলি — কীভাবে অ্যান্টিবায়োটিকগুলো দিন দিন অকেজো হয়ে যাচ্ছে, কেমন করে ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা কাজ করে আর এইচআইভি’র ওষুধ বানানো হয়। এসব আলোচনা শেষে দেখা যায়, অধিকাংশ শিক্ষার্থীই বিবর্তনকে জীবপ্রজাতিগুলোর বিকাশের উপায় হিসেবে মেনে নিয়েছে, কেবল মানুষের বিবর্তনের বিষয়টিই তাঁদেরকে মানানো সম্ভব হয় না। অনেকে আবার কোরানকে উদ্ধৃত করে বলে যে আদমের পথ ধরেই মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে সৃষ্টি হয়েছে। মানুষের বিবর্তনের বিষয়টি তাঁদের কাছে একটি ট্যাবু বা অলঙ্ঘনীয় বিষয় হয়ে থেকে যায়, কারণ শিক্ষার্থীরা মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব আর ব্যতিক্রমভাবে সৃষ্টির ধারণাটি সহজে ত্যাগ করতে পারে না। আমি তাঁদের স্মরণ করিয়ে দেই যে মুসলিমদেরকে ঔদ্ধত্বপূর্ণ আচরণ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে এবং মানুষও সৃষ্টির একটি ক্ষুদ্র অংশ।

হুসেইন আল-জিসর এবং আহমেদ মেদহাত-এর মতো মুসলিম পণ্ডিতরা ১৮০০ শতকে বিবর্তনকে সমর্থন দিয়েছিলেন। নবম শতকের দিকে, ডারউইনের আগেই, আল-জাহিজ ও অন্যান্য কতিপয় ব্যক্তিত্ব অপূর্ণাঙ্গ বিবর্তন তত্ত্বের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আমার মতে, বিবর্তন আর ইসলাম নিয়ে বাদানুবাদ বিংশ শতকের দিকেই প্রথম শুরু হতে থাকে যখন ডারউইনের ধারণাটির সাথে ঔপনিবেশিকতাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, পশ্চিম, নাস্তিক্যবাদ, বস্তুবাদ, ও বর্ণবাদের মতো বিষয়গুলো সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে। মুসলিম ধর্মীয় পণ্ডিতেরা ধীরে ধীরে তত্ত্বটির বিপরীতে দাঁড়িয়ে যান যা পরবর্তীতে সাধারণ জনগণ আঁকড়ে ধরে। ঐসব পণ্ডিত তাঁদের অবস্থানকে দৃঢ় করতে ক্রিস্টান সৃষ্টিবাদিদের যুক্তিগুলো গ্রহণ করেন, যা পরবর্তীতে পশ্চিমাদের বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যকার লড়াইকে ইসলামের দিকে ঠেলে দেয়।

আমার কিছু শিক্ষার্থী তর্কের খাতিরে বলে, বিবর্তনের ধারণাকে গ্রহণ করা মানে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। আমি বলি, বিবর্তনবিদ্যা মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে মাথা ঘামায় না। এখন পর্যন্ত কেউ এই শুরুর ঘটনাটি সম্পূর্ণভাবে বুঝে উঠতে পারেননি। আমার মতে, ঈশ্বরই আদি কারণ। এই আদি কারণটির ফলস্রুতিতেই যুক্তি আর বিজ্ঞানের বিধানগুলো মহাবিশ্ব ও এর বাইরের জগতের বিকাশ ঘটায়।

আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, মুসলিমরা এই বিষয়টি চিন্তা করে সুখী হন। অনেক মুসলিম বিজ্ঞানী আমার মতের সাথে সহমত প্রকাশ করেন, কিন্তু বিশৃঙ্খলা-সৃষ্টিকারি হিসেবে আখ্যায়িত হবার ভয়ে তা প্রকাশ্যে বলে বেড়ান না। কতিপয় ধর্মীয় পণ্ডিতও এ বিষয়ে একমত, কিন্তু তাঁরা চান কোন ধরণের প্রতিরোধের সম্মুখীন না হয়ে এসব মত ধীরে ধীরে পরিবর্তন হোক।

মুসলিম বিজ্ঞানী হিসেবে আমার অভিমত হচ্ছে, কোরান মানুষকে জ্ঞান-সাধনার আরাধনা করার পাশাপাশি, জগৎকে পর্যবেক্ষণ ও এ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার কথা বলে। বৈজ্ঞানিক কোনো আবিষ্কারের বৈধতা দেয়া কোরানের কাজ নয়। জগৎ কেমন করে চলে, এ নিয়ে প্রশ্ন ও আবিষ্কার করার বিষয়টি যেমন বিজ্ঞান আমাদেরকে শেখায়, অন্যদিকে ঐসব আবিষ্কার কতটুকু বা কীভাবে ব্যবহার করতে হবে সেসব বিষয়ে নৈতিক দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে কোরান। এমন যদি হয়, কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও কোরানের ব্যাখ্যার মধ্যে সুস্পষ্ট পরষ্পরবিরোধীতা দেখা দিয়েছে, সেক্ষেত্রে বিরোধ মেটানোর জন্য বিজ্ঞান (যা পরিবর্তনশীল) এবং কোরানের ব্যাখ্যা (যা নানান জনের কাছে নানান রকম হবার ফলে নিরপেক্ষভাবে এক হয় না), উভয়ের দ্বারস্থই আমরা হতে পারি। এই চর্চাটি শুধুমাত্র একটি নিরন্তর এবং নমনীয় প্রক্রিয়াই নয়, পাশাপাশি মুসলমানদের জীবনের উদ্দেশ্য সাধনের অপরিহার্য অংশও বটে।

একজন শিক্ষার্থী মানব বিবর্তনের বিষয়টি গ্রহণ না করলেও তাঁর পরীক্ষার খাতার নম্বরে আমি গরমিল করি না। শিক্ষক হিসেবে আমাদের কাজ হলো শিক্ষার্থীকে মুক্ত চিন্তাশীল হতে সাহায্য করা। আমি চাই না আমার ছাত্র-ছাত্রীরা কেবল পরীক্ষায় পাশ করার জন্য বিবর্তনকে সত্য বলে স্বীকার করুক। তাঁদের উপসংহার যদি মানব-বিবর্তনের বিপক্ষেও যাও, তবুও আমি চাইবো, তাঁরা যেন তাঁদের অবস্থানের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে। মুক্তচিন্তার দুয়ার না খুলে আমি যদি তাঁদের উপর কোনো আহরিত জ্ঞান চাপিয়ে দেই, তাহলে বিবর্তনকে হেয় প্রতিপন্ন করা লোকদের সাথে আমার কোনো তফাৎ রইবে না। বিবর্তনবিরোধী লোকদের কাজ হলো নিজস্ব মতামত অন্যের উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া।

আমার লক্ষ্য তাই শিক্ষার্থীদেরকে এমনভাবে শিক্ষা দেয়া, যাতে করে প্রাকৃতিক জগৎকে জানাশোনার জন্য তাঁরা একটি যৌক্তিক পদ্ধতি গড়ে তুলে এবং পাশাপাশি অন্যকে নকল না করে নিজের মতামত, অনুকল্প ও তত্ত্ব প্রদান করতে পারে। নতুন ধারার যৌক্তিক চিন্তাপদ্ধতি ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি শিক্ষা — জ্ঞান অণ্বেষণের অভিযাত্রাকে — অপরিহার্য করে তুলে তাতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। এই প্রচেষ্টায় সফলকাম হলে মুসলিম বিজ্ঞানীদের এমন একটি প্রজন্ম গঠনে আমরা অবদান রাখতে পারবো যারা সকলেই হবে মুক্তমনা।

=সমাপ্ত=

তথ্যসূত্রঃ
দাজানি, রানা (২০১৫), “হোয়াই আই টিচ ইভোল্যুশন টু মুসলিম স্টুডেন্টস”, নেচার ৫২০ঃ ৪০৯ ডিওআইঃ 10.1038/520409a