২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

খোলা চিঠি
অভিজিৎ দা – এর কাছে

প্রিয় অভিজিত দা,
আপনার সাথে সরাসরি কথা বলা বা দেখা হওয়ার সুযোগ হয়েছে হাতে গোণা মাত্র কয়েকবার। এর মধ্যে প্রথম দেখা আর শেষ দেখার কথাই বারবার মনে পড়ছে। আপনি, বন্যা আপা আর আপনাদের একমাত্র মেয়েকে নিয়ে আমাদের বাসায় এসেছিলেন। রাতে খেয়েছিলেন। বিজ্ঞান বিষয়ক এক আলোচনা ঘিরে রেখেছিল আমাদের – আপনি, বন্যা আপা, আসিফ (বিজ্ঞান বক্তা) এবং আমি। আপনাদের পারিবারিক বোঝাপড়া এবং মুক্তমনা ও দর্শন আমাকে অণুপ্রাণিত করেছিল! আজ আমাকে যা আলোড়িত করছে বারবার!

তারপর থেকে মুক্তমনায় আপনাদের লেখনী পড়ে আপনাদের সাথে যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। সেখানে কিছুদিন নিয়মিত লিখতে পারলেও পেশার প্রতি মনোযোগ দিতে গিয়ে বেশ কিছুদিন বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিলাম!

আপনার সাথে সবশেষ দেখা হয় ২০১২ সালের বইমেলাতে। মেলায় চা-এয় আড্ডার পাশাপাশি আমরা বিজ্ঞান বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘মহাবৃত্ত’ নিয়ে কথা বললাম ও কিছু ছবি তুললাম। যা আপনি ফেসবুক-এ পোস্ট করেছিলেন সেদিনই। আপনার বিজ্ঞান মনস্কতা ও লেখনী অণুপ্রাণিত করেছিল ভীষণভাবে। মুক্তমনা ব্লগে বন্যা আপার একটি লেখার মাধ্যমে একদিন জানতে পারলাম তিনি ক্যান্সার আক্রান্ত হয়েও কীভাবে লড়াই করে যাচ্ছেন! বন্যা আপা আর আপনার সহযোগিতা পেয়েছি মহাবৃত্ত প্রকাশে।

আপনার বাবা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞান লেখক ড. অজয় রায় স্যার-এর সাথে নারায়ণগঞ্জের সূধীজন পাঠাগারে গিয়েছিলাম। ফ্রিটজ কাপরার দ্য টাউ অব ফিজিক্স এর অনুবাদ প্রকাশনা উতসবে জন্য এই যাওয়া। যাওয়ার সময় দেখেছিলাম আপনার সম্পর্কে স্যারের দৃঢ় প্রত্যয় আর জেনেছিলাম তাঁর আত্মপ্রত্যাশার কথা!

বইমেলার সূত্র ধরে প্রতি বছর মেলায় আসলেও গত ২ বার আসেননি আপনি! এবার দেশের এই পরিস্থিতি জেনেও কেন যে এসেছিলেন আপনি? একবারও ভাবলেন না এ দেশ আপনার জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারবে না! আপনাকে যারা সেদিন নিমন্ত্রণ করে এনেছিল কেন তারা জোর করে হলেও আপনার সাথে মেলা থেকে বের হবার সময় সাথে থাকলেন না? আপনাকে যখন ওরা কাপুরুষের মতো পেছন থেকে আক্রমণ করল তখন কেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা এগিয়ে আসল না? আপনার রক্তাক্ত কাঁধে ছিল বন্যা আপার হাত ব্যাগ আর বন্যা আপার রক্তাক্ত হাতে ছিল আপনার রক্তাক্ত মাথা এ দৃশ্য ফেস বুকে আপলোড করা হলেও দেখার দু:সাহস হয়নি! এই দু:সময়ে সমমনাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা কাপুরুষতার পরিচায়ক! পত্রিকায় দেখলাম অজয় স্যারকে ওরা বলেছে: ‘তোর ছেলের পরিণতি দেখেছিস। তুইও ভালো হয়ে যা!’ উত্তরে স্যার বলেছেন: ‘তোরা আমার ছেলের আদর্শ কেড়ে নিতে পারিসনি!’

আপনাকে হত্যার পরপরই বেশকিছু গণমাধ্যমে আপনার পরিচয় শুধু ব্লগার লেখা হয়েছিল প্রতিবাদী কন্ঠে বলতে ইচ্ছে করছিল এদেশে ব্লগার এখন সভ্য একটি গালি! আপনার বিজ্ঞান লেখনীতে দক্ষতা ও আপনার মানবিকতা সব কিছুর উর্ধ্বে। শুধুমাত্র ব্লগার বলে আমজনতার কাছে আপনাকে হেয় প্রতিপন্ন করে কুতসিত রাজনীতি করা হবে! এইপক্ষ ঐ পক্ষ রাজনৈতিকভাবে বিষয়টিকে ঘোলাটে করার ফাঁকে অন্যপক্ষরা স্থান করে নিচ্ছে এই সুযোগে!

আপনার দেহ ঢাকা ম্যাডিকেলে দান করে অজয় স্যার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন মানবতাই সবচেয়ে বড় ধর্ম। ঢাকা ম্যাডিকেল থেকে বন্যা আপাকে স্কয়ার হাসপাতালে নেয়া হয়েছে সুচিকিতসার জন্য। একদিকে ক্যান্সারের সাথে বসবাস, অন্যদিকে আপনার মতো সহযোদ্ধাকে হারিয়ে মুমু্র্ষ অবস্থায় কেমন করে টিকে আছেন তিনি জানিনা! এখনও তার সাথে দেখা করা যাচ্ছে না। আপনাকে হত্যার জন্য থানায় মামলা করা হয়েছে। যথারীতি অগ্রগতি নেই। সমাবেশ আর সমবেদনার পাশাপাশি গণমাধ্যমে প্রচার চলবে। একসময় সব আবার স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু আপনার পরিবার আর প্রকৃত বন্ধুরা জানে এদেশের মানুষ-কী হারিয়েছি আমরা! ওরা একজন অভিজিতকে হত্যা করে মুক্তমনের বিকাশ রুদ্ধ করতে পারবে না! এ সংগ্রাম মানবিকতা রক্ষার সংগ্রাম! আমাদের ক্ষমা চাওয়ারও পথ খোলা নেই……কার কাছে যাবো? শুধুই কী নিন্দা আর ঘৃণা প্রকাশে সব ঘুঁচে যাবে?? কাকে সুধাবো এই আত্মপীড়নের কথা অভিজিr দা !!!!!

ইতি
খালেদা ইয়াসমিন ইতি
বিজ্ঞান লেখক