একঃ

হৃদয়ের রক্তক্ষরণ থামাতে পারছি না। এত বিষাদময় সময় জীবনে খুব কম এসেছে।

মুক্তমনা ওয়েবসাইট এর প্রতিষ্ঠাতা, আমাদের সময়ে যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনষ্কতা ও মানবতাবাদ বিকাশ আন্দোলনের সেরা কর্মী, সমকালীন সময়ের অন্যতম সেরা ব্লগার এবং আমার প্রিয় বন্ধু অভিজিৎ রায়কে কতিপয় মৌলবাদী কাপুরুষ রাতের অন্ধকারে হত্যা করেছে। মারাত্নক আহত হয়েছেন অভিজিৎ রায়ের জীবনসাথী এবং সহযোদ্ধা রাফিদা আহমেদ বন্যা। বই মেলা থেকে বাসায় ফিরছিলেন তাঁরা।

অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদকে ঘাতকরা একই কায়দায় ২০০৪ সালে কুপিয়ে জখম করেছিল। অভিজিৎ হুমায়ূন আজাদ নয়; বয়স তার মাত্র চল্লিশ পেরিয়েছে। কিন্তু এরই মাঝে সে অভাবনীয় কিছু ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে। সমকালীন সময়ের যুক্তিবাদ, বিজ্ঞান মনষ্কতা, মানবতাবাদ বিকাশ আন্দোলনের ইতিহাস কেউ লিখতে গেলে অভিজিৎ রায়কে নিয়ে অন্ততঃ একটা অধ্যায় ব্যয় করতে হবে।

অভিজিৎ ছিল প্রিয় বন্ধু। তুই-তোকারি পর্যায়ের সম্পর্ক ছিল আমাদের (আহা! অতীতকালে লিখতে হচ্ছে আমার বন্ধুকে নিয়ে)।

মুক্তমনা সৃষ্টি পর্ব থেকে আমি ওকে চিনি। মুক্তমনাতে এক সাথে কাজ করেছি। সে কী উৎসাহ আমাদের সবার যখন ওর সর্বপ্রথম বই ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ প্রকাশ হতে যাচ্ছিল। সে বইয়ের ‘লেখক পরিচিতি’ আমি লিখেছিলাম।

নিউ ইয়র্কের মুক্তধারার একুশে বই মেলায় আনন্দ, উচ্ছাস আর চেঁচামেচিতে পরিচিত সবাইকে জানিয়েছিলাম সে বইয়ের কথা। দেশ থেকে অনন্ত বিজয়দাশকে দিয়ে মুক্তমনার ব্যানার বানিয়ে এনেছিলাম। বন্ধু হাসানআল আব্দুল্লাহের শব্দগুচ্ছ স্টলের পাশে সেই বইয়ের স্তূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। জোর করে ধরিয়ে দিয়েছিলাম অনেকের হাতে বইটি।

মুক্তমনার তখন ও হাঁটি হাঁটি পা পা। অভিজিৎ রায়ের নাম সবাই শুনেননি। রেফারেন্সের জন্য বলতে হচ্ছিল কীর্তিমান বিজ্ঞানী অধ্যাপক অজয় রায়ের ছেলে। পরে বইটি পড়ে অনেকে আমাকে খুঁজে বের করেছেন অভিনন্দন জানাতে। কী যে আনন্দ হচ্ছিল! যেন আমি নিজে লিখেছিলাম সেই বই।

দুইঃ

অভিজিৎ এর সাথে পরিচয় দু’হাজার সালে।

ব্লগিং তখন ও চালু হয়নি। ইন্টারনেটে প্রগ্রেসিভ বাংগালীদের আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের প্লাটফর্ম হাতে গুনা দু-চারটা। তার মধ্যে অন্যতম ছিল এনএফবি (News From Bangladesh)। ধর্ম-বিজ্ঞান-যুক্তিবাদ বিষয়ে লেখা, তর্কবিতর্ক ছাপানোর সাহস সে সময় এককভাবে দেখিয়েছে এনএফবি।

ততদিনে একটা জিনিস বুঝে ফেলেছি যে, সংশয়বাদ, যুক্তিবাদ, ধর্মের ইতিহাস, অসারতা, প্রভৃতি বিষয়ে উৎসাহী লোকদের সংখ্যা সব সমাজেই কম। বাংলাদেশী বা বাঙ্গালী মুসলমানের মধ্যে সেটি অতি নগণ্য। মুসলমান পরিবারে জন্ম নিয়েছে, বাপ-দাদা চৌদ্দ গোষ্ঠী যার মুসলমান, তার আবার নিজস্ব চিন্তাচেতনা কি! সে তো অটোমেটিক মুসলমান; আল্লাহ-রাসুল বিষয়ে প্রশ্ন তোলা তার ভয়াবহ পাপ।

এনএফবিতে প্রথা বিরোধী লেখক হাতেগুনা দু-চারজন মাত্র। একদিকে তখন ফতেমোল্লা, কামরান মির্জা, ডক্টর সাব্বির আহমদ, জামাল হাসান, নারায়ন গুপ্তা আর অন্যদিকে ইসলামী জোশে বলিয়ান বিরাট গ্রুপ (এখন আর অবাক হই না যে এদের মধ্যে পিএইচডি ধারী ও ছিল কয়েকজন)।

সেখানে অভিজিৎ আর আমি নবাগত।

অভিজিৎ এরই মধ্যে ধর্ম এবং ধর্মগ্রন্থের ইতিহাস, ধর্মের গোঁজামিলের উপর বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখে ফেলেছে। অনেক মূর্খ মোল্লা তাঁকে ‘মুসলমান বিরোধী’ ভাবত; অনেক হিন্দু কূপমন্ডূক তাকে অভিসম্পাত দিত ‘হিন্দু বিরোধী’ বলে। অথচ সে ছিল আপাদমস্তক সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী । মৌলবাদীরা মানবতার জন্য ক্ষতিকারক, সে যে ধর্মের হোক না কেন – হিন্দু, মুসলমান বা খৃষ্টান। অভিজিৎ মনে প্রাণে এ কথা বিশ্বাস করত।

অনেকে ভাবত, অভিজিৎ ‘কমিউনিস্ট’ অথচ সে কমিউনিস্টদের অনেক ধ্যান-ধারণার কড়া সমালোচক ছিল। অনেকে আমাকে ও ভাবত ‘কমিউনিস্ট।‘ কমিউনিজমের অনেক কনসেপ্টের আমরা বিরোধী ছিলাম। আদর্শগত দিক থেকে ওঁর সাথে আমার মনের মিল ছিল; বন্ধুত্ব সে জন্য হয়েছিল সহজে।

প্রিয় বন্ধুকে নিয়ে গুছিয়ে লেখার মত মনের অবস্থা নেই এই মুহুর্তে। তবু কিছু না লিখে থাকতে পারছি না।

তিনঃ

ইন্টারনেটে মুক্তমনার আবির্ভাব অসাধারণ একটি ঘটনা।

ইন্টারনেটে ধর্ম বিশ্বাসী হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান এদের হাজারো ওয়েবসাইট থাকলে ও যুক্তিবাদী, মানবতাবাদী এবং সংশয়বাদীদের ফোরাম বা ওয়েবসাইটের সংখ্যা ছিল খুব নগণ্য। বাঙলা ভাষায় তো সে রকম কোন ওয়েবসাইট ছিলই না।
মুক্তমনা সে ঘাটতি পূরন করে।

মুক্তমনা গঠন করে অভিজিৎ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থেকে বাঙালী যুক্তিবাদীদের এক প্লাটফর্মে নিয়ে আসে। উৎসুক, চিন্তাশীল শত শত বাঙালী তরুণ তরুনী, যারা এতদিন একেকজন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা ছিল, মুক্তমনাতে কেন্দ্র করে জড়ো হতে শুরু করে। এই প্রথম অনেকে জীবনের গভীর প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা মন খুলে বলার এবং শেয়ার করার একটা জায়গা পায়।
অভিজিৎ আগ্রহী ছিল এবং বিশেষভাবে উৎসাহ দেখাত যুক্তিবাদ, বিজ্ঞান এবং মানবতাবাদে নবাগতদের নিয়ে। নতুন লেখকদের সে খুব উৎসাহ যোগাত। তাঁর বহু সমালোচকের ও লেখার অভিজিৎ প্রশংসা করেছে, লেখা চালিয়ে যেতে অনুরোধ করেছে।

মুক্তমনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে যুক্তিবাদ আর বিজ্ঞান মনষ্কতার আলোয় উদ্ভাসিত প্রতিশ্রুতিশীল এক ঝাঁক তরুণ বাঙালী লেখক গড়ে ওঠেছে। এরা একেকজন একেকটা মশালের মত, যে মশাল চলে সৌর শক্তিতে। একে চাপাতির আঘাতে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না।

অভিজিৎ নিজে নয়টি বই লিখেছে। ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ থেকে শুরু করে ‘বিশ্বাসের ভাইরাস’। মহাবিশ্ব, বিবর্তন তত্ত্ব, সমকামিতা, ধর্ম গ্রন্থের অসঙ্গতি, মার্ক্সবাদের বৈজ্ঞানিক ভিত্তির অসারতা এসকল বিষয়ে দুই বাংলাতে এত তথ্য সমৃদ্ধ, মননশীল পুস্তক পাওয়া দুষ্কর।

মুক্তমনা বাঙলা ভাষায় ডারউইন এবং বিবর্তন তত্ত্বের উপর সবচেয়ে বিস্তারিত, তথ্য সমৃদ্ধ এবং প্রানবন্ত রচনাবলি উপহার দেয়।

শুধু বাঙলা ভাষা কেন, মুক্তমনার মত ইন্টারনেটে এত উৎসবমুখর আবহে প্রতিবছর ‘ডারউইন দিবস’, ‘যুক্তিবাদী দিবস’ কেউ পালন করে নি।

অভিজিৎ রায় আর তাঁর দল তা সম্ভব করেছে।

ধর্ম-দর্শন-বিজ্ঞান নিয়ে বুদ্ধিদীপ্ত তর্কবিতর্কে অভিজিতের আগ্রহ ছিল সীমাহীন কিন্তু সে কিছু নিয়মনীতি মেনে চলত ।

অনেক মৌলবাদী (হিন্দু-মুসলমান উভয় দলের) আমাদের লেখার সমালোচনা করতে গিয়ে ব্যাক্তিগত আক্রমনে চলে যেত। গালিগালাজ করত ‘মুরতাদ,’ ‘কাফির,’ ‘মালাউন,‘‘ইসলামের শত্রু’ এগুলি শুনে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম।

তবু ও অভিজিৎ কাউকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আক্রমন করত না। সে সমসময় বিশ্বাস করেছে যে, সবারই রয়েছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা।

আমি যখন অভিজিতের সাথে মুক্তমনা মডারেট টিমে কাজ করতাম, তখন ও মুক্তমনা বিরোধী অনেক কড়া সমালোচনা আমরা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে প্রকাশ করতাম।

অনেক সমমনা বন্ধু অভিযোগ করতেন, মুক্তমনা মোল্লাদের লেখা ছাপাচ্ছে। এটি ‘অতি উদারতা’। এ ব্যাপারে অভিজিৎ কখনও সংশয়ে ভোগেনি।

চারঃ

সংবাদপত্রে অভিজিৎ রায়কে একজন ‘ব্লগার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু অভিজিৎ রায় এর বাইরে ও অনেক কিছু।

অভিজিৎ রায় একটি চেতনার নাম। একটি শিখা চিরন্তন। একটি আলোকিত ইতিহাস যেটি চিন্তাশীল, মুক্তমনা বাঙালীর মনে দোলা দিবে সবকালে, সব জায়গায়।

অভিজিৎ রায়দের জখম করা যায়, হত্যা করা যায়, কিন্তু নিশ্চিহ্ন করা যায় না।

———-
নিউ ইয়র্ক
ফেব্রুয়ারী ২৭, ২০১৫