নীরবে চলে যাওয়া এক ডাক্তারকে প্রায় স্মরণ করি। নাম তার কার্তিক বাবু। তিনি প্রতিষ্ঠানিক লেখাপড়া জানা ডাক্তার ছিলেন না। তিনি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে লেখাপড়া করে একজন জনদরদী মানব সেবক ডাক্তারে পরিণত হয়েছিলেন। খুলনার পুরাতন মানুষগুলোর অনেকেই হয়তো এই ডাক্তারের নাম শুনেছেন। খুব ছোট বেলায় আমার সুযোগ হয়েছিল তাকে কাছ থেকে দেখার। তিনি আমাদের প্রতিবেশীও ছিলেন।
প্রথম জীবনে তিনি ব্রিটিশ আর্মিতে চাকুরীরত এম বি (Bachelor of Medicine) সুধীর দাসের কাছে থেকে মেডিসিন বিষয়ে লেখাপড়ার সুযোগ পান। সুধীর বাবু ছিলেন সেই সময়ের নামকরা ডাক্তার। তার কাছ থেকে সমস্ত ডাক্তারী বিদ্যা রপ্ত করে সারা জীবন এই কার্তিক বাবু মানব সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। তার পরের ঘটনাগুলো খুবই করুণ। দেশ স্বাধীন হলেও তিনি আর ওপারে, মানে কলকাতায় না যেয়ে নিজের পৈতৃক বসত ভিটায় খুলনায় থেকে যান। আমি তাকে দেখেছি তার বৃদ্ধ বয়সে, স্বাধীনতার অনেক পরে।
অসুখ-বিসুখে তিনি রুগীর বাসায় বাসায় গিয়ে সেবা দিতেন একপ্রকার বিনা মুল্যেই। তার বড় মেয়েটি ছিল আমার বড় বোনের বান্ধবী। সেই হিসাবে তাদের সাথে আমাদের পারিবারিক একটা যোগাযোগ ছিল। আমার ঐ বার-তের বছর বয়সে প্রায়ই শুনতাম তিনি কলকাতায় চলে যাবেন। কিন্তু তার আর যাওয়া হলো না। যখনি তিনি যাবার প্রস্তুতি নিতেন তখনি তার বাসায় ডাকাতি হতো। এইভাবে তিন-তিন বার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন।
বড় হয়ে জানতে পেরেছি ডাক্তার বাবুর যে মেয়েটি আমার বোনের বান্ধবী ছিল সে স্থানীয় এক রাজাকার দ্বারা ধর্ষিত হয়ে পরে আত্মহত্যা করে। সেই রাজাকারকেও কার্তিক বাবু সেবা দিয়েছিলেন। তারপরেও তার মেয়েটি রক্ষা পাননি। যে গ্রামে তিনি থাকতেন সেই গ্রামের এমন কেউ নেই যে তার চিকিৎসা সেবা পায়নি। অথচ সেই গ্রামের মুসলমান দ্বারাই সব ধরনের নির্যাতনের শিকার হন তিনি। তার সমস্ত জ্ঞাতি গোষ্ঠি সবাই কলকাতায় চলে গেলেও তিনি আর যেতে পারেননি। সেই সময়ে ঐ অল্প বয়সে ঠিকমত বুঝতে না পারলেও এখন বুঝি- কেন গভীর রাতে আমাদের বাসায় বৃদ্ধ দিদিমার যাতায়াত চলতো, কেন তাদের মধ্যে এত আতঙ্ক ছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার অনেক পরেও।
স্বাধীনতার পর নব্য রাজাকার দ্বারা তার পরিবারের শেষ সম্মানটুকু ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া হয়। তারপরে চলে সম্পদ লুটের তাণ্ডব। এইভাবে তিনি স্বাধীন বাংলার নব্য রাজাকার দ্বারা নিঃশেষ হয়ে গেলেন। অবশেষে সম্ভবত ৮৫/৮৬ সালে মারা যান কার্তিক বাবু। আমি তখন খুলনা মন্নুজান স্কুলের সেভেন কিংবা এইটের ছাত্রী। ক্লাসে এক শিক্ষক আমাদের জানালেন- তোমরা হয়তো কার্তিক বাবুর নাম শুনেছো। তিনি মারা গেছেন, এটি আমাদের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। তোমাদের মধ্যে যারা এই ডাক্তারি পেশাটি গ্রহণ করবে তারা কার্তিক বাবুর মত মানুষের সেবাটুকু দেবার চেষ্টা করবে। এই ছিল সেই দিনের উপদেশ।
আজ এতটা বছর পরে এসে এই টরোন্টো শহরে বসে তাকে স্মরণ করি। সারা জীবন তিনি সেবা দিয়ে গেছেন, বিনিময়ে যা পেয়েছিলেন তা স্মরণে এলে চোখের জল ছাড়া কিছুই পাই না।
আমরা কি এজন্যই স্বাধীন হয়েছিলাম? শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে কার্তিক বাবুর মত এক মহান ডাক্তারকে কুরে কুরে মরতে হয়? নব্য স্বাধীন বাংলার মাটিতে তার পৈতৃক শিকড়কে উপড়িয়ে ফেলতে বুক কাঁপে না কেন মানুষের? তার চোখে তো হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ ছিল না। তারপরেও তিনি এর শিকার হন।
আজ যখন সেই পুরাতন মাটিতে যাই তখন সেই মহান ডাক্তার বাবুর কোন চিহ্ন দেখতে পাই না। চারিদিকে তাকাই যদি তার নামে কোন স্কুল কিংবা কোন প্রতিষ্ঠান চোখে পড়ে এই আশায়। কিন্তু কিছুই দেখতে পাই না। সেই কার্তিক বাবু তো একেবারেই নিশ্চিহ্ন হওয়ার মত মানব ছিলেন না। তাহলে কেন আজ তার কোন চিহ্ন সেই মাটিতে নেই? এর উত্তর আমার জানা নেই।
যদি কোন দিন আমার সুযোগ আসে তাহলে তার মুছে যাওয়া নামটি সামনে এনে সবাইকে জানিয়ে দিতে চাই- ডাক্তার হলে কার্তিক বাবুর মত হওয়া চাই।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময়ও বাংলার মুসলমানেরা শিক্ষা দীক্ষায় অনেক অনগ্রসর ছিল। এই অনগ্রসর মুসলমানদের শিক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিল হিন্দু শিক্ষকেরা। তাদের হাত ধরেই বাংলার মুসলমানেরা শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রসর হয়েছিল যা বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছিল। পরবর্তিতে এই সব বুদ্ধিজীবির সহায়তায় বাংলাদেশ স্বাধীন সংগ্রামে এগিয়ে যায়। এই সংগ্রাম ছিল সংস্কৃতির মুক্তির সংগ্রাম, নিজস্ব জাতিস্বত্তা রক্ষার সংগ্রাম। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এই সংগ্রামে শরীক হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর সেই হিন্দু মুসলমানের অভিন্ন লক্ষ্য আরেক দিকে ধাবিত হয়। ধর্মের ভিত্তিতে একে অপরের প্রতি শত্রু ভাবাপন্ন করে তোলা হলো। রাজনীতিকে ধর্মের সাথে মিশ্রন ঘটিয়ে ইসলামীকরন প্রক্রিয়া শুরু হলো তা এখন পর্বত চুড়ায়। এর প্রমান মেলে অধুনা কিছু নাম করণের মধ্য দিয়ে। যেমন ব্রাম্মান বাড়ীয়াকে বলা হচ্ছে বি-বাড়ীয়া, নারায়নগঞ্জকে বলা হচ্ছে না-গঞ্জ। নামের সংক্ষিপ্তকরণ যদি এর উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে অনেক সংখ্যাগুরু ধর্মীয় নাম ও সংক্ষিপ্ত হয়ে যাবার কথা কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। যেমন হযরত শাহাজাল বিমান বন্দর যা উচ্চারণ করতে দেশ বিদেশের লোকদের খুব শ্রম দিতে হয়। এই গুলোর পিছনে যে উদ্দেশ্য কাজ করে তাহলো ধর্মীয় বিদ্বেষের মাধ্যমে বর্তমানে সংখ্যালঘু শ্রেনীর ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ক্রমন্নয়ে মুছে ফেলা যাতে তারা অতীতের সাথে ছিন্ন করে একটি অথর্ব জাতিতে পরিনত হয়। কিন্তু বাস্তবতা তা বলে না। ইতিহাসের সাথে যদি সম্পর্ক ছিন্নই হয়ে যায় তা শুধু হিন্দুদের হবে না হবে সবার গোটা বদ্বীপের মানুষ সহ সবার। এই বিশ্বজনিন উক্তি কে না জানে- Every human action at present is the result of his past event.