সার্জেন্ট জহুরুল হক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী ও শহীদ।

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে চারটি মৃত্যু পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল।
১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ছাত্রনেতা আমানুল্লাহ আসাদুজ্জামান, ২৪ জানুয়ারি কিশোর মতিয়ুর রহমান, ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ১৮ ফেব্রুয়ারি ডঃ শহীদ শামসুজ্জোহার মৃত্যু বাঙালিকে স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে।

সার্জেন্ট জহুরুল হক ১৯৩৫ সালের ০৯ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালী জেলার সুধারামপুর থানার সোনাপুর জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম কাজী মজিবুল হক।

তিনি ১৯৫৩ সালে নোয়াখালী জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৫৬ সালে জগন্নাথ কলেজের (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) বাণিজ্য শাখা থেকে ইন্টার পাশ করেন।

১৯৫৬ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগদান করেন। এই সময় কোহাটে তাঁর পোস্টিং হয়। ১৯৬৫-৬৮ সালে তিনি ট্রেনিং ইন্সষ্ট্রাকটার হিসেবে করাচীতে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৬৮ সালের ২৬ জানুয়ারী বিমান বাহিনী থেকে তাঁর অবসর গ্রহণ করার কথা ছিল। এরই মাঝে, ১৯৬৮ সালের ০৬ জানুয়ারি দু্জন সিএসপি অফিসার সহ ২৮ জন বাঙালিকে গ্রেফতার করা হয়। সরকারীভাবে জানানো হয়, ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বরে অভিযুক্তরা ভারতীয় অর্থ ও অস্ত্রের সাহায্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ ঘটিয়ে কেন্দ্র থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিল।

এর আগে একই অভিযোগে ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে প্রধান আসামি করে সর্বমোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার “রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্যদের বিচার” নামে একটি মামলা দায়ের করে, যা ঐতিহাসিকভাবে”আগরতলা ষড়যন্ত্র” নামে পরিচিত।

১৯৬৮ সালের ২২ জানুয়ারি, সার্জেন্ট জহুরুল হককে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১৭ নং আসামী হিসেবে গ্রেফতার করা হয়। প্রথমে তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, পরে কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে আটকে রাখা হয়।

১৯৬৮ সালের ১৯ জুন মামলার শুনানি শুরু হয়। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে অবস্থিত ‘সিগন্যাল অফিসার মেসকে’ মামলার স্থান হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। ১৯৬৯ সালের ০৬ ফেব্রুয়ারি ছিল মামলার শেষ তারিখ।

এদিকে সারা বাঙলায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে কেন্দ্র করে গণআন্দোলন শুরু হয়, ঐতিহাসিকভাবে যা আমাদের কাছে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান বলে পরিচিত। বাঙালি জনতার দাবি ছিল একটাই, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্যদের মুক্তি প্রদান।

এই লক্ষ্যে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৯৬৯ সালের ০৪ জানুয়ারি ঐতিহাসিক ১১ দফা কর্মসূচী পেশ করে। ৭ ও ৮ জানুয়ারি, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে রাজনৈতিক ঐক্য ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি গঠন করা হয়। ২০ জানুয়ারি, ছাত্রদের মিছিলে গুলিবর্ষনের ঘটনায় নিহত হন ছাত্র আমানুল্লাহ আসাদুজ্জামান। ২৪ জানুয়ারি, পুলিশের গুলিতে নিহত হন কিশোর ছাত্র মতিয়ুর রহমান।

এসব ঘটনায় ফুঁসে উঠে সারা বাঙলা।
তুমুল আন্দোলনে কাঁপছিল আইয়ুব খানের মসনদ…

এরপর আসে সেই কালোদিন…

১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯।
কুর্মিটোলা ক্যান্টনম্যান্ট, ঢাকা।

সেদিন সন্ধ্যায় ক্যান্টনম্যান্টে সৈনিকদের খাবারের উচ্ছিষ্ট সংগ্রহের জন্য বাঙালি শিশুরা ভিড় করে। এতে অবাঙালি সৈনিকেরা কয়েকজন অভুক্ত শিশুকে ধরে এনে বন্দী শিবিরের সামনে অমানবিকভাবে প্রহার শুরু করে। কয়েকজন বন্দী এ ঘটনায় প্রতিবাদ জানালে অবাঙালি হাবিলদার মনজুর শাহ বন্দীদের নিজ নিজ কামরায় ফিরে যেতে বলে। এসময় সার্জেন্ট জহুরুল হক হাবিলদার মনজুর শাহকে বলেন যে, তাঁরা বাঙালি বাচ্চাদের উপর নির্যাতন বন্ধ না করলে তিনি কামরায় যাবেন না। এই কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে হাবিলদার মনজুর শাহ রাইফেলে বেয়োনেট লাগিয়ে সার্জেন্টের দিকে ধেঁয়ে আসে। কিন্তু সার্জেন্ট জহুরুল হক দ্রুত পাশ কাটিয়ে মনজুরের হাত থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নেন এবং নিজের কামরার দরজায় গিয়ে তাকে রাইফেল ফেরত দেন।

পরদিন।
১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯।

ভোরবেলা সার্জেন্ট জহুরুল হক নিজের কামরা বের হলে মনজুর শাহ তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে। সার্জেন্টের পেটে গুলি লাগে। ইচ্ছে করে সময় লাগিয়ে পাকিরা তাঁকে সিএমএইচে নিয়ে যায়। সেখানে রাত ০৯টা ৫৫ মিনিটে এই মহান দেশপ্রেমিক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

সার্জেন্টের মৃত্যু বাঙালির গণঅভ্যুত্থানের আগুনকে আরো উসকে দেয়। বাঙালীরা রাস্তায় নেমে আসে।
১৮ ফেব্রুয়ারি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মৌন মিছিলে পুলিশের চালানো গুলিতে নিহত হন শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা।

বাঙালির সহ্যের সীমা অতিক্রম হয়।
বাঙালিরা দুমড়ে মুচড়ে দেয় আইয়ুব খানের মসনদ।

প্রচন্ড গআন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে। ১৯৬৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি, আলোচনার জন্য বিরোধী নেতৃবৃন্দের সাথে আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক আহবান করে কিন্তু বৈঠক ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে, আইয়ুব খান বাঙালির প্রচন্ড আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ পদত্যাগ করে।বাঙালি এগিয়ে যায় তার স্বাধীনতা অর্জনের সিঁড়ির চুড়ান্ত ধাপগুলোর একটিতে।

সার্জেন্ট জহুরুল হককে তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তার জন্য সহকর্মীরা “মার্শাল” বলে ডাকতো। তাঁর হৃদয়ে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য ছিল পরম মমতা। ব্যাক্তিজীবনে খুব অমায়িক ছিলেন সার্জেন্ট। খুব ভালো সাঁতারু ছিলেন; বিমানবাহিনী সাঁতার প্রতিযোগীতায় বেশ কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। খুব ভালো ছবিও আঁকতেন; তাঁর বিখ্যাত যে পোট্রেটটি আমরা দেখি, তা তাঁর নিজেরই আঁকা। ভালো হস্তশিল্পের কাজ করতে পারতেন; জাতীয় জাদুঘর ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে তাঁর বেশ কিছু শিল্পকর্ম নিদর্শন রক্ষিত আছে।

সার্জেন্টের সৃত্মির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের আবাসিক হল ইকবাল হলের নাম পরিবর্তন করে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল নামকরণ করা হয়, ২০১৩ তে নাম সংশোধন করে “শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল” করা হয় এবং বিমান বাহিনীর চট্রগ্রাম ঘাঁটিতে সার্জেন্ট জহুরুল হকের নামাংকন করা হয়।

বাঙালি-জাতীয়তাবাদের আন্দোলনে সার্জেন্ট জহুরুল হকের নাম চিরকাল জ্বলজ্বল করে ভাস্বর থাকবে।

…..পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মহানায়কদের একজন সার্জেন্ট জহুরুল হককে স্মরণ করছি…..

তথ্য সহায়িকা:
চরিতাভিধান, সম্পাদনা: সেলিনা হোসেন ও নূরুল ইসলাম, বাংলা একাডেমী।
আসাদ থেকে গণঅভ্যুত্থান, মোস্তফা কামাল, এশিয়া পাবলিকেশন্স।