প্রতিটা ধর্মেই কমবেশী উদ্ভট গালগল্প রয়েছে, যুক্তিবাদী ধর্ম হিসেবে পরিচিত বৌদ্ধধর্মের শাস্ত্রেও রয়েছে এই ধরণের বেশকিছু গল্প। যেহেতু আমাদের আলোচনার বিষয় নারীর প্রতি বৌদ্ধশাস্ত্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি তাই উদ্ভট গল্পে না যেয়ে নারী প্রসঙ্গেই আসি যদিও সেখানেও আমরা উদ্ভট গালগল্প পাবো। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, বৌদ্ধধর্ম হিন্দুধর্মের প্রভাবকে অস্বীকার করতে পারে নি, সম্ভবত সেজন্যই এই ধরণের অযৌক্তিক গল্পগুলো বৌদ্ধশাস্ত্রের পাতায় স্থান করে নিয়েছে।

আজকে এই বিষয়ে আমরা আলোচনা করবো সমুদগ জাতক নিয়ে। ৪৩৬ নম্বর এই জাতকের বর্তমানবস্তুতে বোধিসত্ত্ব কোন এক উৎকণ্ঠিত ভিক্ষুর উদ্দেশ্যে বলেন,

“দেখো তুমি রমণী লাভের জন্য এতো ব্যগ্র কেন? রমণীরা পাপাসক্ত ও অকৃতজ্ঞা। পূর্বে ব্রহ্মদৈত্য কোন রমণীকে গিলিয়া নিজের কুক্ষির মধ্যে রাখিয়া বিচরণ করিতো, তথাপি সে তাহার চরিত্র রক্ষা করিতে ও তাহাকে একমাত্র পুরুষে আসক্ত রাখিতে পারে নাই। সে যাহা না পারিয়াছে তুমি তাহা পারিবে কেন?”

এই জাতকের অতীতবস্তুতে জানা যায়, বোধিসত্ত্ব প্রবজ্জা নিয়ে হিমালয়ে বসবাস করেছিলেন। সেসময় ব্রহ্মদৈত্য এক কুলকন্যাকে আহারের নিমিত্তে ধরে আনিলেও তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নিজ গুহায় দাম্পত্য জীবন শুরু করেন। কিন্তু দানব কন্যাটির চরিত্রের উপর আস্থা রাখতে পারেননি। এজন্য তিনি নারীটিকে একটি বাক্সের মধ্যে বন্দি করে নিজেরই উদরে গোপন রাখতেন।

একদা বাক্সটি খুলে নারীটিকে কিছু সময়ের জন্য বাতাস লাগাতে বলে নিজে স্নানের জন্য গেলে নারীটি কৌশলে বায়ুপুত্রকে বাক্সের ভিতর গ্রহণ করে নেয় এবং সেখানে উভয়ে কামলীলায় মত্ত হয়। বাক্সসহ ব্রহ্মদৈত্য বোধিসত্ত্বের নিকট ধর্মকথা শুনতে গেলে তিনি তিনজনকে স্বাগতম জানান। তিনজন শুনে ব্রহ্মদৈত্য অবাক হলে বোধিসত্ত্ব বায়ুপুত্রের সাথে নারীটির যৌনতার সবকিছু খুলে বলেন।

এরপর ব্রহ্মদৈত্যকে বোধিসত্ত্ব কিছু উপদেশ দেন যার মধ্যে অন্যতম –

@ ছলনাময়ী নারীদের চরিত্রে কখনোই বিশ্বাস করতে নেই।
@ যত সাবধানেই নারীকে রক্ষা করো না কেন তারা বহুগামি হবেই।
@ নরকের পথে সব সময় নারীদের গমন।
@ রমণী ত্যাগ করা পুরুষই একমাত্র প্রকৃত সুখ লাভ করতে পারে।
@ রমণী ত্যাগ করে ধর্ম করাই মঙ্গল।
@ নারী সংসর্গ দুর্গতি আনয়ন করে।

নিম্নে দানবকে প্রদান করা বোধিসত্ত্বের উপদেশ গাঁথা তুলে ধরা হলঃ

“তুমি তব ভার্যা যারে পেটিকা ভিতরে
পুরিয়া কুক্ষিতে সদা রাখো রক্ষাতরে,
তৃতীয় বায়ুর পুত্র ভার্যা সঙ্গে তব
কুক্ষি মধ্যে করিতেছে মদন উৎসব।
যত সাবধানে করো না কেন রক্ষণ
বহু ছল জানে নারী, বিশ্বাস কখন
চরিত্রে তার আর করা নাহি যায়
নরকের পথে নারী প্রপাতের প্রায়।
রমণী সংসর্গ ত্যাজি যে জন বিচরে,
বীত সুখ হয়ে সেই সুখ লাভ করে।
রমণী সংসর্গ ত্যাজি ধর্ম অনুষ্ঠান
ইহাই বিজ্ঞের পক্ষে মঙ্গল নিদান।
এই সুখ তাহাদের প্রার্থনীয় অতি
রমণী সংসর্গে ঘটে অশেষ দুর্গতি।”

কোন বিশেষ নারী নয়, নির্বিশেষে সকল নারীই ব্যভিচারিণী, না এটা আমার কথা নয় বলেছেন স্বয়ং বোধিসত্ত্ব যার মহত্ত্ব সম্পর্কে চতুর্থ পর্বে বর্ণনা করেছিলাম। সকল নারীই যে ব্যভিচারিণী এই বিষয়ে আলোচনা করবো ১৪৫ নম্বর জাতক যার নাম রাধ জাতক। এই জাতকের অতীতবস্তুতে ব্যভিচারিণী ব্রাহ্মণীকে ব্রাহ্মণ বাঁধা দিতে গেলে বোধিসত্ত্ব বলেন, “ভাই তুমি নিতান্তই অবোধ, কিছুই বুঝো না, তাই এইরূপ বলিতেছো। রমণীদের সঙ্গে বহন করিয়া লইয়া বেড়াইলেও রক্ষা করিতে পারা যায় না।” এরপর বোধিসত্ত্ব নিম্নোক্ত গাঁথাটি বলেনঃ

“তুমি নাহি জান আরও কতো জন
না হইতে অর্ধ রাত্রী দিবে দর্শন!
নিতান্ত অবোধ তুমি, তাহারই কারণ
বলিলে করিতে মোরে অসাধ্য সাধন।
কামিনীর কুপ্রবিত্তি, পতিভক্তি বিনা
দমিতে যে পারে কেহ, আমিতো দেখিনা।
কিন্তু সেই পতিভক্তি, হায় হায় হায়
নারীর হৃদয়ে কিছু নাহি দেখা যায়।”

নারী নিয়ন্ত্রণ পুরুষতন্ত্রের জন্য অন্যতম দুশ্চিন্তার কারণ। বৌদ্ধশাস্ত্রের নারী সংক্রান্ত প্রতিটি উপদেশের মধ্যে নারীকে নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি প্রকট ভাবে দেখা যায়। কিন্তু তারপরও “নারী হলো দুর্নিবার, তাকে কখনোই নিয়ন্ত্রণ করা যায় না” এই উপদেশও দিয়েছেন স্বয়ং বোধিসত্ত্ব। বোধিসত্ত্বের মতে, “রমণীরা একবার খারাপ হওয়া শুরু করলে তাকে কখনোই ফিরানো সম্ভব হয় না। তাই পূর্বে থেকেই রমণীকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।”

এই বিষয়ে আমরা আলোচনা করবো বৌদ্ধশাস্ত্রের ২৬২ নম্বর জাতক যার নাম মৃদুপাণি জাতক। এই জাতকের বর্তমানবস্তুতে কোন এক উৎকণ্ঠিত ভিক্ষুকে উদ্দেশ্য করে বোধিসত্ত্ব বলেন, “রমণীরা স্বীয় প্রবৃত্তির অনুসরণ আরম্ভ করিলে তাহাদিগকে রক্ষা করা অসম্ভব। পুরাকালে পণ্ডিতজনেও নিজের কন্যা রক্ষা করিতে পারেন নাই। পিতা কন্যার হাত ধরিয়াছিলেন, তথাপি সেই কন্যা প্রণোদিত হইয়া পিতার অজ্ঞাতসারে পুরুষান্তরের সহিত পলায়ন করিয়াছিলো।”

এই জাতকের অতীত বস্তুতে জানা যায়, বোধিসত্ত্ব পুরাকালে বারানসীর রাজপদে অধিষ্ঠিত হন। তার কন্যা ও ভাগিনেয় পরস্পর প্রেমাসক্ত হয়ে পড়ে। পুরুষের প্রেমে নারীটি এতোই উদ্বেলিত ছিল যে, সংকেতস্থলে মিলনের জন্য কৌশলে পলায়ন করে। এজন্যই বোধিসত্ত্ব বলেছেন, ‘হাত ধরিয়া বেড়াইলেও কেহ রমণীদিগকে রক্ষা করতে পারে না। রমণীরা এমনই অরক্ষণীয়া।’ এ বিষয়ে বোধিসত্ত্ব যে গাঁথাটি বলেন তা হলোঃ

“কে পারে তুষিতে বল রমণীর মন
সাবধানে বলি সদা মধুর বচন!
নদীতে ঢালিলে জল,
কে কবে লভিবে ফল?
ললনার বাসনার অন্ত নাহি পাই।
নিয়ত নরক পথে নারীর গমন
দূর হতে সাধু তারে করে বিসর্জন।
তুষিতে নারীর মন যে করে যতন,
ভালোবাসে দেয় তারে যত পারে ধন,
ইহা মুত্র নাশ তার
যেন নারী দুর্নিবার,
ইন্ধনে লভিয়া পুষ্টি তাহাই যেমন
মুহূর্তের মধ্যে নাশ করে হুতাশন,
তেমনি নারীগণে যেবা ভালোবাসে
তাহাকেই পিশাচীরা অচিরে বিনাশে।”

(চলবে)

তথ্যসূত্রঃ

সমুদগ জাতক

রাধ জাতক

মৃদুপাণি জাতক

পূর্বের পর্বসমূহঃ

বৌদ্ধশাস্ত্রে পুরুষতন্ত্র (পর্ব ০৪)

বৌদ্ধশাস্ত্রে পুরুষতন্ত্র (পর্ব ০৩)

বৌদ্ধশাস্ত্রে পুরুষতন্ত্র (পর্ব ০২)

বৌদ্ধশাস্ত্রে পুরুষতন্ত্র (পর্ব ০১)