শহরের পেটের ভিতরের ছোট্ট গ্রাম আমঝরা। আজ শুক্কুরবার, সেখানে আজ হাটবার। আমঝরার হাট- আনন্দের হাট- বিকিকিনির হাট। আরো এক কারনে সবার মনে আনন্দ আজ দেড়ী। কারনটা হলো গরু চুরি করতে যেয়ে মসা চোর ধরা পড়েছে। কম বয়সী একটা আমগাছের সাথে তারে শক্ত করে পিঠ মোড়া দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। দশহাত দূরে আরেকটা ছোকড়া আমগাছের সাথে দুটো দামড়াও বাঁধা। লোকজন বৃত্তবন্দী করে ঘিরে রেখেছে গরুচোর সহ গরু দুটোকেও। বলদজোড়া চোখ বড় বড় করে দেখছে মসা চোরকে। কি জানি তাদের মনে কি হাওয়া! একটু পরেই খেলা শুরু হবে বাতাসে মাটিতে। হারান মুটে এক আঁটি তল্লাবাঁশের বোঝা এনে রাখলো মসাচোরের বাম কোল বরাবর। এই বাঁশগুলো সব ভাঙ্গা হবে মসা চোরের হাতে-পায়-পাছায়-পিঠে। মেম্বার সাহেবের হুকুম। কত্তোবড় সাহস, সিঁধেল চুরি ছেড়ে গরু চুরি ধরেছে হারামজাদা। তাও আবার করবি কর এক্কেবারে মেম্বারের গরুচুরি। কথায় কয় না- ‘চোরের দশদিন, গিরির একদিন।’ খেলা শুরু হয়ে গেছে। সবাই জানে মেম্বারের মন নরম, দয়ার শরীর- তাই দুয়েকটা চড়-থপ্পড় মেরে হাট-কমিটির হাতে ছেড়ে দিয়ে রাগে গর্জে ওঠে সে- নে তুরা ওর এট্টা সুবিচার কর। তা না হলি আমার যে আর মান থাহে না।
হাটের লোক করিতকর্মা- ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে। মেম্বারের কথা শেষ হবার প্রায় সাথে সাথে আসল খেলা শুরু হয়ে গেলো। মসা চোরের গায়ের ছেড়া ‘ফুনা’টা টান মেরে ছিড়ে ফেলে দিয়ে তারে উদোম করে ফেললো এক হাটুরে। তারপর একের পর এক তল্লা বাশের লাঠি ভাঙ্গার পটপট শব্দ। খেলা দেখে বলদজোড়া দাপাদাপি করে, আর মানুষগুলো হেসে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে। মজা বটে। আর ওদিকে মসা চোরের এক রা- ওরে মারে, ওরে বাজান রে। গায়ে একফোটা চর্বি নেই, মাংশ নেই হারামজাদার। মেরে ধরে আরাম পাওয়া যায় না- হাটুরেদের আক্ষেপ। সবচেয়ে মজাদার খেলাটা এখনও বাকী- তা হলো কাটা ঘায়ে নুন ভরে দেয়া। এই কাজ হারান মুটে ছাড়া আর কেউ করে না। হারান নুন হাতে নিয়ে রেডী। অসাড় উপুড় হয়ে পড়ে থাকা মসার কাটা ঘার ফাকে যেই লবন পড়লো অমনি মসা চোর যেন জ্যন্ত হয়ে গেল। গলা ছাড়লো সপ্তমে। তা দেখে হাটুরেদের হাসি যেন থামে না। যন্ত্রনায় মুখ ওর এখন নীল। হাত জোড় করে হাট কমিটির চেয়ারম্যনকে বললো- আপনি আমার ধম্মের বাপ, আমার মাইয়েডার নাম ফেলী, ওরে আপনি এট্টু দেইহেন, দানাপানি দিয়েন, ওর কেউ নেই। আমার জান প্রায় শেষ। আমি আর বাচপো না।
এই কথা বলে মসাচোর চুপ মেরে গেলো। মনে হয় জ্ঞান হারালো।
চেয়ারম্যান চিতকার করে উঠলো- এই তুরা কেউ হাড় বজ্জাতটার কথা শুনিসনে। ও ভেক ধরেছে। নুন ছিটানোয় ভঙ্গ দিস না রে হারান। চোরের আবার কন্যা শোক।
মুখে শব্দ করে শ্লোক কাটে হাটুরেদের সর্দার-
তুরা হলি ছন্নছাড়া
তোর বাপ-ভাই গরু চোরা।
গরু চোরার এমনি গুণ-
কাটে কাটে বসাই নুন।
দুপুর গড়িয়ে এক সময় সন্ধ্যা নামে আমঝরার হাটে। হাটুরেদের উল্লাশে তাতে ভাটা পড়ে না তেমন। ওদিকে অনতিদূরে সুঠাম শহরের হরেক রঙের বাতিগুলো একে একে জ্বলে উঠে, কিন্তু তাদের ন্যুনতম একটা আলোর রশ্মিও ধেয়ে আসে না আমঝরার দিকে। কি জানি কোন যাদুবলে সব আলো উপর দিকে চলে যায়। আলোর সে বাহারী চমকের দিকে ঘোলাটে দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে মসাচোর।
বাবা মানেই বাবা, সে চোর হলেও বাবা।ভাল লেগেছে গল্পটি।
@গীতা দাস,
তা ঠিক। স্বভাব-চরিত্রে বাঙালীর অনেক পরিবর্তন এসেছে। অনেক জিনিসই অবিকল যা ছিল তাই আছে। গল্পটা তারই একটা প্রমান।
খুবই করুন এক কাহিনী। আমাদের সমাজে ছোট-খাট অপরাধীদের ক্ষেত্রে খড়গহস্ত। কিন্তু, অনেক বড় বড় অপরাধীদের কিছু বলার সাহস পায় না…!
@শেহজাদ আমান,
হা, গল্পের এই অংশটা আমাদের ভিতরকার মানুষটাকে ধরে সজোরে নাড়া দেবার জন্যে। আমারা মানুষকে এখনও বিচার দিতে পারিনি, এটা আমাদের সার্বিক ব্যর্থতা। কারো দায় এরাবার সুযোগ নেই।
অসাধারণ
@রিয়াদ,
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
গল্প বলার ভঙ্গিটা ভালো লেগেছে। সাবজেক্টও ভালো, লেখনীও।
সংলাপ ছাড়া বাকি অংশে প্রমিত বাংলা ব্যবহার করলে ক্ষতি ছিলোনা। (F) (F) (F)
@দেব প্রসাদ দেবু,
পড়ার জন্যে ধন্যবাদ। লাল গোলাপ আপনাকেও।
একটা কথা কি জানেন???
আপনার গদ্যের সাথে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গদ্যের বেশ মিল আছে।
বাংলা সাহিত্তে আমি শুধু তার লেখাতেই এমন গদ্যের উপস্থিতি লক্ষ করেছি।
আমার মায়ের মুখে শুনেছি গ্রামে নাকি গরুচোর ধড়া পড়লে সেখানে একটা উৎসব উৎসব আমেজ হত; দূর দূর থেকে মানুষ আসতো গরু চোর দেখতে।
গরু চোরের প্রধান শাস্তি ছিল পায়ের চামড়া তুলে দিয়ে সেখানে লবন ঘষে দেয়া।
গলায় জুতোর মালা পড়িয়ে সেই গরু চোরকে ২-৩ গ্রাম ঘুরানো হত।
আম্মুরা নাকি ছোটবেলা অপেক্ষা করে থাকতো কবে একটা গরু চোর ধরা হবে।
গরু চোরের পেছন পেছন গ্রাম থেকে গ্রাম হাঁটা নাকি বেশ মজাদার একটা বিষয় ছিল 🙂
আপনার লেখাটা পড়ার সময় পাশে আম্মু ছিল; দুজন এক সাথেই পড়ছিলাম।
একটি গল্প বললেন তিনি তার ছোটবেলার।
কিছু বিশেষ ধরনের চোর নাকি ছিল যারা বিষ দিয়ে গরু মেড়ে ফেলত।
মড়া গরু তো আর খাওয়া যায়না তাই ফেলে দেয়া হত খালে।
চোর তখন সেই গরুর চামড়া চুরি করে নিয়ে যেত।
এমন চোরের ধরা খেলে চোখ তুলে দেয়া হত খেজুর কাঁটা দিয়ে।
কি ভয়ংকর কথা :-s
লেখাটি বেশ ছিমছাম এবং চমৎকার হয়েছে :clap
@এম এস নিলয়,
ধন্যবাদ সময় নিয়ে গল্প পড়ার জন্যে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস স ম্প র্কে উইকিপেডিয়ার মাধ্যমে আগেও জেনেছি, কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তার বই পড়ার সময়ও সুযোগ এখনও হয়নি। গল্পের বিষয় বস্তু সম্পর্কে আপনার অনুভুতি সঠিক। গ্রামে বড় হবার কারণে যে স্মৃতি সমূহ মাথায় জড়ো আছে তাতে রঙ চড়িয়ে উপস্থাপন করি মাত্র। তাতে পাঠকদের ভালো লাগলে নিজেরও ভালো লাগে- ভালোলাগা ভাগাভাগি হয়ে যায় আরকি। ভাল থাকুন।
আইনের হাত নাকি অনেক লম্বা।আসলেই কি অনেক লম্বা।যদি লম্বাই হয় তাহলে কেন আমঝরা হাট অবধি যায়না ?নাকি আইনের অদৃশ্য হাত কাটা গায়ে লবন মাখায় ?
@শাহাদাত ইমরান, যার হাতই এত লম্বা চিন্তা করুন তার বাকী অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কত লম্বা।
এই কারনেই এত বড় শরীর নিয়ে আইন সব জায়গায় যেতে পারেনা।
গরিবের কুঁড়ে ঘরে আইন ধুঁকতে পারেনা এই মস্ত শরীরের কারনেই; তাই আইন শুধু অট্টালিকা আর বড় শহরেই দর্শন দেয়।
সিম্পল 🙂
@শাহাদাত ইমরান,
হয়তো তাই। আপনার মনে যে জিজ্ঞাসা জেগেছে সেটা অনেকেরই প্রশ্ন, কিন্তু এখনও পর্যন্ত উত্তর জানা নেই। তবে আমার মনে হয়, যদি সঠিক পথে সংস্কৃতিটাকে প্রবাহিত হতে দেয়া যায়, তবে এই প্রশ্নের ফলিত উত্তর আমরা পেয়ে যাবো।