বাইবেল এবং উট

আমরা সবাই বাইবেল কিংবা কোরান থেকে ইব্রাহীম (আব্রাহাম), ইয়াকুব (জেকব), ইউসুফ (যোসেফ) এইসব নবীদের গল্প পড়েছি। এইসব নবীদের গল্পের সাথে উট এবং উটবহরের রয়েছে ওতপ্রোত সম্পর্ক। আব্রাহাম উটের বহর নিয়ে মেসোপটেমিয়ায় নমরুদ এর রাজ্য থেকে ইমিগ্রেশন করে পবিত্র ভূমি কানান (আজকের প্যালেস্টাইন) এ হিব্রু জাতির পত্তন করেছিলো এটা তো আমরা সবাই জানি। এছাড়াও বিভিন্ন নবী’র উটপালন, ইউসুফের উটের বহর নিয়ে মিশরে বাণিজ্য, এরকম আরো অনেক ঘটনার সাথেই রয়েছে উটের বর্ণনা। এতোদিন পর্যন্ত খ্রীস্টান এবং ইহুদী বিশ্বাসী বাইবেল বিশারদ ও ইতিহাসবিদরা বলে আসছিলেন যে আব্রাহামের প্যালেস্টাইনে আগমন এবং সেই সাথে ইহুদী জাতির সূচনার ঐতিহাসিক সময়কাল মোটামুটি খ্রীস্ট পূর্ব ২২০০ থেকে ২০০০ সালের দিকে।

সম্প্রতি ইজরায়েলের তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিওলজিস্টরা ইজরায়েলে উটের প্রথম আবির্ভাবকে বৈজ্ঞানিকভাবে নিরূপন করার চেষ্টা করেছেন এবং তাদের প্রাপ্ত ফলাফল বাইবেলের ঐতিহাসিক সঠিকত্বকে একটা বড়ো আঘাত হেনেছে। আর্কিওলজিস্টরা পেয়েছেন যে এই অন্চলে উটের আবির্ভাব ঘটেছে বাইবেল বর্নিত আদি নবীদের যুগ (Age of the Patriarchs 2000-1500 BCE) এর অনেক পরে। এই আবিষ্কার কেবল বাইবেলের ঐতিহাসিকতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেনি, সেই সাথে বাইবেল যে বর্নিত ঘটনাগুলির অনেক পরে লেখা হয়েছিলো সেটাও স্পষ্ট করেছে।

Domesticated Camel in Mesopotamia (Relief in British Museum)

প্রত্নতাত্তিকরা মোটামুটি একমত যে বন্য উটকে প্রথম বশীকরন করে ভারবাহী পশু হিসেবে গৃহপালিত করা হয় খ্রী: পূ: ২০০০ সালের দিকে আরব উপদ্বীপে, বর্তমানের সৌদী আরবে। এই গৃহপালিত উট ও উট দ্বারা মাল পরিবহনের ব্যবস্থা আরব উপদ্বীপ থেকেই আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন অন্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্ট এর ড: এরেজ বেন-ইউসেফ এবং ড: লিদার সাপির ইজরাইলে প্রথম গৃহপালিত উটের সন্ধানে প্রত্নতাত্তিক গবেষনা করেছেন ইজরাইল ও জর্ডানের সীমান্তবর্তী আরাভা উপত্যকায়।

আরাভা উপত্যকায় পাওয়া গেছে প্রাচীন তামার খনি। লোহার ব্যবহার প্রচলনের আগে ব্রোন্জ ছিলো সভ্যতার প্রধান ধাতু। ব্রোন্জ তৈরীর মূল উপাদান তামা একারনে ব্রোন্জ যুগে (খ্রী: পূ ৩০০০ থেকে খ্রী: পূ: ১০০০) যেখানেই তামার খনির সন্ধান পাওয়া যেতো সেখানেই শিল্প-বাণিজ্য ও জনপদ কেন্দ্র গড়ে উঠতো। প্রত্নতাত্তিকেরা আবিষ্কার করেছেন যে আরাভা উপত্যকা খ্রী: পূ: ১৩০০ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে তামা উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠে। সুতরাং সেই সময়ে যদি ইজরাইলে উটের প্রচলন হয়ে থাকে তবে নিশ্চই আরাভা উপত্যকায় তার নিদর্শন পাওয়া যাবে।

Archaeological dig site in the Copper Mines of Arava valley

এরেজ বেন ইউসেফ এবং লিদার সাপির এর টীম আরাভা উপত্যকায় অনেক খনন, গবেষণা ও রেডিওকার্বন ডেটিং করে দেখেছেন যে এই উপত্যকায় প্রথম গৃহপালিত উটের দেহাবশেষ পাওয়া যাচ্ছে কেবল মাত্র খ্রী: পূ: ১০০০ এর কাছাকাছি এবং তার পরের সময় হতেই। আরও উল্লেখ্য যে খ্রী: পূ: ৯০০ এর দিকে প্রায় প্রতিটি সক্রিয় তামার খনির খননেই প্রচুর উটের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে কিন্তু খ্রী: পূ: ১০০০ এর পূর্বের সাইটগুলোতে কিছুই পাওয়া যায় নি। সেই সময়টি তো আব্রাহাম, আইজাকের সময় থেকে অনেক পরে তো বটেই এমনকি রাজা ডেভিড এর রাজত্বকালীন সময় (আনুমানিক খ্রী: পূ: ১১০০) এর ও পরে।

প্রত্নতাত্তিকেরা আরও পেয়েছেন যে এই সময়টিতে উটের হঠাৎ আবির্ভাবের সাথে সাথে তামা উৎপাদন টেকনোলজী ও জনবসতির ধরনেরও হঠাৎ বিপুল পরিবর্তন হয়। একারনে তারা অনুমান করছেন যে এই অন্চলে সেই সময়ে উটের প্রচলন করে কোনো বাইরের শক্তি, সম্ভবত মিশরীয় রাজ্য তাদের বাণিজ্য পথের মাধ্যমেই।

এই সংবাদটি পাঠকেরা পড়ে দেখতে পারেন নীচে দেয়া লিংক টি থেকে।

http://www.eurekalert.org/pub_releases/2014-02/afot-fif020314.php

তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয় এই আলোড়ন সৃষ্টিকারী গবেষনা প্রকাশের প্রেস রিলিজে সরাসরি মত প্রকাশ করে যে “” The discrepancy “is direct proof that the [Biblical] text was compiled well after the events it describes,”

এই আবিষ্কারটি যদি মোটামুটি স্বীকৃত ইতিহাস হিসেবে স্থান পেয়ে যায় তবে এর গুরুত্ব হবে অপরিসীম। এতে প্রথমত পরিষ্কার হবে যে বাইবেলে বর্নিত নবীদের গল্পগুলি কোনভাবেই পুরোপরি ঐতিহাসিক হতে পারে না এবং বাইবেলের গল্পকাহিনীগুলি লেখা হয়েছিলো খ্রী: পূ: ৮০০-৯০০ সালের পরে, যখন ইজরায়েলে গৃহপালিত উটের ব্যবহার ব্যপক হারে ছড়িয়ে পরেছিলো। যেহেতু সেই সময়ে ইজরায়েলে অনেক উট ছিলো সেহেতু বাইবেলের কাহিনীকাররা ধরেই নিয়েছিলেন যে সেই আব্রাহাম, যোসেফ এর সময়েও উট সর্বত্র প্রচলিত ছিলো।

তবে বিজ্ঞানীদের এই আবিষ্কারটি নিয়ে আরো কিছু বলার আছে। পৃথিবীতে বর্তমানে সবচেয়ে বেশী প্রত্নতাত্তিক খনন ও গবেষনা পরিচালিত হয় ইজরায়েলে। যেহেতু ইজরায়েল বাইবেল বর্নিত ঐতিহাসিক পবিত্রভূমি, সেহেতু ঈজরায়েলের মাটিতে খনন করে বাইবেলকে সত্য প্রমানের প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন খোজার জন্যে ফান্ডের অভাব হয় না। বিশেষ করে আমেরিকার রক্ষনশীল খ্রীষ্টানরা তো এ ধরনের খননের জন্যে টাকার ঝাপি খুলে বসেই আছে। যে কোন একটি সময়ে ইজরায়েলে শত শত অ্যামেচার প্রত্নতাত্তিক দল খনন করছে বাইবেলে বর্নিত ঘটনাগুলিকে সত্য প্রমানের জন্যে।

বাইবেলের ঐতিহাসিকতা প্রমানের নিদর্শন পাওয়ার পেছনে ইজরায়েলীদের ও অনেক স্বার্থ রয়েছে। ইজরায়েল জানে যে প্যালেস্টাইনীদের উৎখাত করে সেখানে নতুন করে আবার ইজরায়েল রাষ্ট্র গড়ার পেছনে একটি দাবীকে বারবার বড়ো সমর্থন হিসেবে দেখানো হয় যে এই ভূমিটি অনেক হাজার বছর আগে থেকেই ইহুদীদের বাসভূমি। সুতরাং বাইবেলের পক্ষে যায় এমন কোনো নিদর্শন, পক্ষান্তরে বর্তমান ইজরাইলের পক্ষেই যায়। সুতরাং ইতিহাস আর প্রত্নতত্ত ইজরায়েলীদের কাছে কেবল ইতিহাস আর জ্ঞানচর্চার বিষয় নয়, বর্তমানের রাজনীতি আর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার জন্যে অতি গুরুত্বপূর্ন জলজ্যান্ত বিষয়।

কিন্তু প্রত্নতত্তের উপরে এতো কিছু নির্ভর থাকার পরেও ইজরায়েলের যারা খ্যাতনামা আর্কিওলজিস্ট, তারা অত্যেন্ত অবজেক্টিভ ভাবেই ইতিহাস ও প্রত্নতত্তের চর্চা করছেন। ইজরায়েলের বিখ্যাত আর্কিওলজিস্টরা এমন অনেক আবিষ্কার ও মত দিয়েছেন যা মোটের উপরে বাইবেলের বিরুদ্ধেই যায়। জিভ হারজগ নামের একজন প্রত্নতত্তবিদ, ইজরায়েলী একাডেমিক আর্কিওলজিস্টদের গত ৭০ বছরের গবেষণা ও খননকে সামারাইজ করেছেন এভাবে

“This is what archaeologists have learned from their excavations in the Land of Israel: the Israelites were never in Egypt, did not wander in the desert, did not conquer the land in a military campaign and did not pass it on to the 12 tribes of Israel. Perhaps even harder to swallow is the fact that the united monarchy of David and Solomon, which is described by the Bible as a regional power, was at most a small tribal kingdom. And it will come as an unpleasant shock to many that the God of Israel, Jehovah, had a female consort and that the early Israelite religion adopted monotheism only in the waning period of the monarchy and not at Mount Sinai.Most of those who are engaged in scientific work in the interlocking spheres of the Bible, archaeology and the history of the Jewish people – and who once went into the field looking for proof to corroborate the Bible story – now agree that the historic events relating to the stages of the Jewish people’s emergence are radically different from what that story tells.”

http://mideastfacts.org/facts/?option=com_content&task=view&id=32&Itemid=34

তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক প্রত্নতত্তবিদ প্রফেসর ইজরেল ফিংকেলস্টাইন, যাকে বাইবেল প্রত্নতত্তের পিতা বলা হয়, তার গবেষনায় মত প্রকাশ করেন যে রাজা দাউদ-সলোমনের সময়ে জেরুজালেম ছিলো এক ধনী, বিশাল রাজ্যের রাজধানী তো নয়ই বরং ছোট্ট একটি উপজাতিয় শহর। আশেপাশে মিশর, আসিরীয়, ব্যাবিলনীয় রাজ্যগুলির মাঝে অপাংক্তেয় একটি গ্রামের মতো।

https://www.middleeastmonitor.com/news/middle-east/2705-senior-israeli-archaeologist-casts-doubt-on-jewish-heritage-of-jerusalem

আমরা দেখছি যে এতো বড়ো স্টেক থাকা সত্বেও ইজরাইলে ফিংকেলস্টাইন, এরেজ বেন ইউসেফ, লিদার সাপির এর মতো খ্যাতনামা প্রত্নতত্তবিদরা নির্মোহভাবে কেবল ইতিহাস ও জ্ঞানের সাধনাই করছেন। সেই জ্ঞান যদি নিজ দেশ ও জাতির জন্যে সুখকর না হয় তবুও তার চর্চা ও প্রকাশ তাদের কোনো আপত্তি নেই।

আমাদের দেশে ইতিহাস ও প্রত্নতত্তের গবেষণা ও আলোচনায় যে জিনিষটি মুখ্য হয়ে দেখা দেয় সেটি হলো ইতিহাসের মূল উদ্দ্যেশ্যই হলো যেনো বাংলাদেশ ও বাংগালী জাতির গৌরবগাথার বর্ণনা। নির্মোহভাবে ইতিহাসচর্চার কোনো ট্র‍্যাডিশনই আমাদের মাঝে গড়ে উঠে নি। একথা অনস্বীকার্য যে জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস-সমাজ চেতনায় আমরা ইহুদী এবং অন্য অনেক জাতির চেয়েই পিছিয়ে আছি। কিন্তু এটা সময় ক্ষেপনের কোনো অজুহাত হতে পারে না। চারিদিকে এতো নিদর্শন থাকা সত্বেও আমরা পৃথিবীর আধুনিক চিন্তা-চেতনাকে গ্রহন করবো না বরং পশ্চাদপর ট্রাইবাল চিন্তা-ভাবনা দ্বারাই পরিচালিত হবো, এই উদ্দ্যেশ্যে অবিচল থাকলে আমরা ক্রমাগত পিছিয়েই থাকবো।