১৯০২ সালের এক গভীর রাত। প্রচন্ড শীত পড়েছে প্যারিস শহরে। সারা শহরের মানুষ বিছানার ওমে সঁপে দিয়েছে শরীর। কিন্তু একটা স্যাঁতস্যাঁতে ভেঙেপড়া শেডের নিচে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন দুটো মানুষ। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। অথচ এ দু’জনকে ঘিরে রয়েছে একটা বিস্ময়কর নীলাভ উজ্জ্বল আভা। দুষ্প্রাপ্য তৃপ্তি এবং প্রশান্তি জ্বলজ্বল করছে তাঁদের চোখেমুখে। দীর্ঘ ৪৫ মাসের অক্লান্ত পরিশ্রম সার্থক হয়েছে তাঁদের। পাওয়া গেছে বিশুদ্ধ রেডিয়াম – যার আবিষ্কারক এই দু’জন মানুষ মেরি কুরি ও তাঁর স্বামী পিয়ের কুরি। পরের বছরই তাঁরা পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। বিজ্ঞান জগতে তাঁদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লেও তখনো তাঁদের ছিল না ভালো কোন চাকরি, গবেষণাগার বা সম্মানজনক সামাজিক স্বীকৃতি।
বিয়ের এগারো বছরের মাথায় দুর্ঘটনায় স্বামীকে হারিয়ে ছোট ছোট দুটো মেয়েকে নিয়ে নিজের যোগ্য সম্মান ও অধিকার অর্জনের জন্য ধরতে গেলে সারাজীবনই সংগ্রাম করতে হয়েছে মেরি কুরিকে। ফ্রান্সের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মেরির নামে কলংক রটিয়েছে – আর মেরি তখন তাঁর একক গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ অর্জন করেছেন দ্বিতীয় নোবেল পুরষ্কার। গবেষণা আর দুটো মেয়েকে বুকে ধরে এগিয়ে গেছেন নীরবে। গড়ে তুলেছেন বিশ্ববিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান – রেডিয়াম ইনস্টিটিউট। মৌলিক বিজ্ঞানের গবেষণায় মেয়েদের অংশগ্রহণের অগ্রদূত মেরি কুরি। তিনি ছিলেন বিশ্বের সর্বপ্রথম মহিলা যিনি বিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। তিনিই প্রথম মহিলা যিনি নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন এবং একমাত্র মহিলা বিজ্ঞানী যিনি দু’বার নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। শুধু তাই নয় – নিজের মেয়ে আইরিনকে গড়ে তুলেছেন বিজ্ঞানী হিসেবে। আইরিন কুরি ও তাঁর স্বামী ফ্রেদেরিক জুলিও রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন নিউক্লিয়ার কেমিস্ট্রিতে তাঁদের মৌলিক অবদানের জন্য।
কুরি পরিবারের প্রতি বিজ্ঞানজগৎ বিশেষভাবে ঋণী। এই পরিবার ছয়টি নোবেল পুরষ্কার পাবার পাশাপাশি মানবকল্যাণে যে অবদান রেখে গেছেন তা অতুলনীয়। ক্যান্সার চিকিৎসায় তেজষ্ক্রিয়তার ব্যবহারের পথিকৃৎ মেরি কুরি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কিশোরী মেয়েকে সাথে নিয়ে মেরি ছুটে গিয়েছিলেন যুদ্ধাহত সৈনিকদের চিকিৎসায়। এক্স-রে ও রেডিয়াম ব্যবহার করে তাঁরা প্রাণ বাঁচিয়েছেন শত শত মানুষের। মানুষের প্রতি কুরিদের ভালোবাসা তেজষ্ক্রিয় শক্তির মতোই – যা সাধারণ চোখে দেখা যায় না কিন্তু অনুভব করা যায় তার ফলের মাধ্যমে। পিয়ের ও মেরি কুরির তেজষ্ক্রিয় ভালোবাসার পরিচয় পেতে হলে আমাদের জানতে হবে তাঁদের নিরন্তর সংগ্রামের কাহিনি, ব্যক্তিগত জীবন ও ভালোবাসার কাহিনি।
পিয়ের কুরি
ডাক্তার ইউজিন কুরি ও মিসেস সোফিয়েক্লেরা দেপাউলি’র দ্বিতীয় সন্তান পিয়ের কুরির জন্ম প্যারিসে ১৮৫৯ সালের ১৫ই মে। পিয়েরের বড় ভাই জাকো পিয়েরের চেয়ে তিন বছরের বড়। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ হাসিখুশি আনন্দ আর স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন পিয়ের। বাবা-মা ভীষণ উদার মুক্তমনা। ধর্মীয় বিধিনিষেধের কোন বালাই নেই কুরি পরিবারে। অথচ মানবিক গুণাবলীতে অতুলনীয় এ পরিবারের প্রত্যেকটি মানুষ।
বাবা ইউজিন ডাক্তারি পাস করে প্যারিসের মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে কাজ শুরু করেন। ডাক্তারি প্র্যাকটিসের বদলে তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষক হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেরকম কোন সুযোগ না পেয়ে জীবিকার তাগিদে রোগী দেখার কাজ শুরু করতে হলো। কিন্তু ডাক্তারিকে কাজে লাগিয়ে ধনসম্পদ বাড়ানোর প্রতি কোন ইচ্ছে কোনদিনই হয়নি ডাক্তার ইউজিনের। সমাজবদলের সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন সবসময়। ১৮৪৮ সালের ফ্রান্সের ‘ফেব্রুয়ারি বিপ্লব’-এ সরাসরি অংশগ্রহণ করে সরকারি সেনাবাহিনীর হাতে লাঞ্চিত হয়েছেন। সেনাবাহিনীরা তাঁর মুখে গুলি করেছিল। কোনরকমে বেঁচে উঠেছিলেন সেবার। তারপর প্যারিস শহরে যখন কলেরা মহামারীর রূপ নেয় – সারা শহরের সব ডাক্তার নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু ইউজিন নিজের কথা না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সাধারণ মানুষের প্রাণ বাঁচাতে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে চিকিৎসা শিবির খুলে শত শত মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছেন।
নিজের ব্যক্তিগত সুখের কথা কখনোই ভাবতেন না ডাক্তার ইউজিন। খুবই সাদাসিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত ইউজিন নিজের ছেলেদের ভেতরও সেই পরার্থপরতার উন্মেষ ঘটাতে পেরেছিলেন। তখনকার ফ্রান্সের প্রাতিষ্ঠানিক স্কুলের শিক্ষা-ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ছিল না ইউজিনের। তিনি তাঁর ছেলেদের স্কুলে পাঠাননি একদিনের জন্যও। বাড়িতেই তাদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছিলেন উন্মুক্ত পরিবেশে। ধরতে গেলে তাদের যা ভালো লাগে তাই পড়েছে তারা ছোটবেলায় এবং সেভাবে লেখাপড়ার প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। একই সাথে ভালোবাসা তৈরি হয়েছে প্রকৃতির প্রতিও।
১৮৭১ সালে পিয়েরের বয়স যখন মাত্র বারো বছর – ফ্রান্সে কমিউন বিল্পব শুরু হলো। সাধারণ মানুষের বিপ্লবে সরকারি বাহিনী নির্বিচারে গুলি করছে। ডাক্তার ইউজিন সাধারণ মানুষের পক্ষ নিয়ে তাঁদের চিকিৎসার জন্য বাড়িতে সেবাকেন্দ্র গড়ে তোলেন। পিয়ের ও জাকো বিপদের ঝুঁকি নিয়ে আহতদের রাস্তা থেকে বয়ে নিয়ে আসতেন সেবাকেন্দ্রে। সামাজিক রাজনৈতিক বিপ্লবের সাথে এভাবেই হাতেখড়ি হয়েছে তাঁদের।
চৌদ্দ বছর বয়সে পিয়ের বাড়িতে গণিতের শিক্ষক হিসেবে পেলেন ফ্রান্সের বিশিষ্ট গণিতজ্ঞ আলবার্ট ব্যাজিলকে। প্রফেসর ব্যাজিল পিয়েরের মধ্যে গাণিতিক ও বৈজ্ঞানিক যুক্তির প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তোলেন। পিয়েরের লেখাপড়া দ্রুতগতিতে চলতে শুরু করলো। ষোল বছর বয়সে এইচ-এস-সির সমতুল্য পরীক্ষায় পাস করে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন পিয়ের। আঠারো বছরের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স ডিগ্রির সমতুল্য ডিগ্রি পেয়ে গেলেন। গবেষণা করার জন্য পিএইচডি কোর্সে ভর্তি হতে ইচ্ছে আছে, কিন্তু বাড়িতে টাকা-পয়সার অভাব খুব। বড়ভাই জাকো সরবোনের খনিজবিদ্যার ল্যাবোরেটরিতে টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করছেন। পিয়েরও পদার্থবিদ্যার ল্যাবোরেট অ্যাসিস্ট্যান্ট পদে যোগ দিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের শেষে নিজেদের গবেষণা শুরু করলেন পিয়ের ও জাকো। তিন বছরের মধ্যেই তাঁরা দু’ভাই মিলে পদার্থবিজ্ঞানের একটি উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার ‘পাইজোইলেকট্রিক ইফেক্ট’ আবিষ্কার করে ফেললেন। গ্রিক শব্দ পাইজো – মানে চাপ দেয়া। কুরি ভাইয়েরা দেখলেন কিছু কিছু ক্রিস্টালে চাপ প্রয়োগ করলে বৈদ্যুতিক বিভব তৈরি হয়। আবার বিপরীতক্রমে যখন একই ক্রিস্টালকে বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের মধ্যে রাখা হয় ক্রিস্টালের ওপর চাপ তৈরি হয়ে তা সংকুচিত হয়ে যায়। পদার্থবিজ্ঞানের সাম্যতার তত্ত্বে এটা নতুন সংযোজন। পাইজোইলেকট্রিক থিওরি কাজে লাগিয়ে পিয়ের ও জাকো তৈরি করলেন কোয়ার্টজ ইলেকট্রোমিটার – যা অতি ক্ষুদ্র বিদ্যুৎ-প্রবাহও মাপতে পারে। বর্তমানে কোয়ার্টজ ঘড়ি, মাইক্রোফোন, ট্রান্সডিউসার সহ অসংখ্য ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিতে পাইজোইলেকট্রিসিটি ব্যবহার করা হয়।
সরবোন ইউনিভার্সিটির ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান হিসেবে পিয়ের কুরির বেতন যাচ্ছেতাই রকমের কম। তাছাড়া তাঁর কাজেরও কোন একাডেমিক স্বীকৃতি নেই। তিনি ভালো কোন প্রতিষ্ঠানে কাজ খুঁজছিলেন যেখানে কমপক্ষে স্বাধীনভাবে গবেষণা করার সুযোগ থাকবে, থাকবে গবেষণাগারের সুবিধা।
১৮৮৩ সালে ইকোল মিউনিসিপেল দ্য ফিজিক অ্যাট কিমিয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়েল্স (ইপিসিআই)-এ যোগ দেন পিয়ের। সরবোনের মত বড় প্রতিষ্ঠান এটা নয়। তবে কাজের স্বাধীনতা আছে। পরীক্ষামূলক কাজ করার সুযোগ বেশি না থাকাতে পিয়ের তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের কাজে হাত দিলেন। চৌম্বকত্ব নিয়ে কাজ শুরু করলেন তিনি। পদার্থের চৌম্বক ধর্ম ও তাপমাত্রার মধ্যে একটা সম্পর্ক আবিষ্কার করলেন তিনি। একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রার উপরে গেলে চৌম্বক পদার্থের ধর্মের মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়। পদার্থবিজ্ঞানে এই তাপমাত্রাকে ‘কুরি তাপমাত্রা’ বলা হয়। এই ‘কুরি’ হলেন পিয়ের কুরি।
পিয়ের কুরি ইপিসিআই-এ কাজ করেছেন বাইশ বছর – ১৮৮৩ থেকে ১৯০৪ পর্যন্ত। শুরুতে স্কুল অব ফিজিক্সের ল্যাবোরেটরি ডিরেক্টর হিসেবে, শেষের দু’বছর প্রফেসর হিসেবে। ধরতে গেলে তাঁর বৈজ্ঞানিক জীবনের পুরোটাই কেটেছে এই প্রতিষ্ঠানে। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান থেকে তিনি আবার পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানের কাজ শুরু করেন ১৮৮৯ সালে।
১৮৮৯ থেকে ১৮৯১ সালের মধ্যে তিনি তৈরি করেন পিরিয়ডিক প্রিসিশান ব্যালেন্স – যা দিয়ে অতিসূক্ষ্ম ভরের তারতম্য মাপা সম্ভব। মাইক্রোমিটারের কাঁটার সামান্য বিচ্যুতি – যা খালি চোখে দেখা যায় না – তা মাপার জন্য মাইক্রোমিটারের সাথে মাইক্রোস্কোপের সংযোগ ঘটান তিনি। [পরবর্তীতে মেরি কুরির সাথে রেডিয়াম ও পোলোনিয়াম আবিষ্কারের সময় বিশেষ কাজে লেগেছিলো এই ‘কুরি ব্যালেন্স’।]
নিজের দেশ ফ্রান্সে তেমন কোন পরিচিতি না পেলেও উদীয়মান পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে পিয়ের কুরি আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিতি লাভ করতে শুরু করেছে। লর্ড কেলভিন পিয়ের কুরির কাজকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন।
১৮৯৪ সালে পিয়ের যখন চৌম্বক পদার্থের ধর্মের সাথে তাপমাত্রার সম্পর্ক নিয়ে কাজ করছিলেন, একদিন সরবোনের প্রফেসর জোসেফ কাওয়ালস্কি তাঁকে নিমন্ত্রণ করলেন তাঁর বাসায়। বললেন এক উদীয়মান পদার্থবিজ্ঞানীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবেন। নির্দিষ্ট সময়ে পিয়ের গেলেন কাওয়ালস্কির বাসায়। সেখানে পরিচয় হলো সরবোনের কৃতী ছাত্রী মারিয়া স্ক্লোদভস্কা’র সাথে।
মারিয়া স্ক্লোদভস্কা
পোল্যান্ডের ওয়ার্শ শহরের ফ্রেটা স্ট্রিটের একটা বাড়িতে ১৮৬৭ সালের ৭ই নভেম্বর মারিয়ার জন্ম। মারিয়ার মা ব্রোনিস্লাভা স্ক্লোদভস্কি ছিলেন একটা প্রাইভেট স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। বাবা ভ্লাদিস্লাভ স্ক্লোদভস্কি ছিলেন পদার্থবিদ্যা ও গণিতের শিক্ষক। স্ক্লোদভস্কি পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান মারিয়া। সবাই আদর করে ডাকে মানিয়া। মানিয়ার জন্মের সময় তার বড় তিন বোন সোফি, ব্রোনিয়া ও হেলার বয়স যথাক্রমে ছয়, তিন ও দেড় বছর এবং ভাই জোসেফের বয়স ছিল চার বছর। সবার আদরে আদরে বড় হচ্ছিল মানিয়া। তাদের বাসাটা ছোট এবং নানারকমের প্রাত্যাহিক অভাব থাকলেও ভালোবাসার অভাব ছিল না কখনো।
মানিয়াদের পারিবারিক পরিবেশ ছিল চমৎকার, প্রাণবন্ত। শিক্ষক বাবা-মা ছেলেমেয়েদের মনে শিক্ষার প্রতি অনুরাগ সৃষ্টি করতে সদাসচেষ্ট। বাড়ির আলমারিভর্তি বই আর যন্ত্রপাতি। ছোট্ট মানিয়া পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে আলমারি ধরে দাঁড়ায় আর অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে বই আর যন্ত্রপাতিগুলোর দিকে। বাবাকে জিজ্ঞেস করে এটা কী, ওটা কী। বাবা সস্নেহে সোৎসাহে বুঝিয়ে দেন।
মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই মানিয়া পড়তে শিখে গেলো। গল্প কবিতা ইতিহাস পদার্থবিদ্যা গণিত হাতের কাছে যা পায় তাই পড়ে ফেলে। যদিও সে বেশিরভাগ জিনিসই বুঝতে পারে না, কিন্তু পড়াশোনার নেশায় পেয়ে বসে তাকে।
মানিয়ার জন্মের পর থেকেই যক্ষায় আক্রান্ত হন তার মা। দিনের পর দিন শরীর খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অসুস্থতার কারণে মা স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। সংসারের পুরো খরচের দায়িত্ব এসে পড়ে বাবার কাঁধে। কিন্তু সেখানেও সমস্যা দেখা দেয়।
পোল্যান্ড তখন রাশিয়ান জারের অধীনে। পোল্যান্ডের কোন স্বাধীন অস্তিত্ব নেই। রাশিয়ানরা যেভাবেই পারে পোলিশদের ওপর অত্যাচার চালায়। সরকারি কোন কাজে, স্কুল কলেজে পোলিশ ভাষা অচল। পোলিশদের বদলে রাশিয়ানদের চাকরি দেয়া হচ্ছে সব জায়গায়। পোলিশ হবার কারণে একদিন চাকরি চলে যায় মানিয়ার বাবার। সাংসারিক খরচ মেটাবার জন্য তিনি নিজের বাসাকে অনেকটা স্কুল-বোর্ডিংয়ের মতো করে ফেলেন। বাড়িতে বাইরের লোকের সংখ্যা বাড়তে থাকে আর মানিয়াদের থাকার জায়গা শোয়ার জায়গা কমতে থাকে। অপরিচিত মানুষের সামনে মানিয়ারা আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে, নিম্নস্বরে কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
মায়ের অসুস্থতার কারণে সংসারের কাজের বেশির ভাগই বড়বোন সোফির কাঁধে এসে পড়ে। তদুপরি অসুস্থ মায়ের সেবাযত্নের পুরোটাই সামলাচ্ছিলো সোফি। মানিয়ার বয়স যখন নয় বছর – তখন পনেরো বছরের সোফি টাইফাস রোগে আক্রান্ত হয়। কিছুদিনের মধ্যেই মারা যায় সোফি। প্রাণবন্ত দিদিকে হারিয়ে কেমন যেন নিষ্প্রাণ হয়ে যায় মানিয়া।
পরের বছর একটা প্রাইভেট বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয় মানিয়াকে। স্কুলের চব্বিশ জন ক্লাসমেটের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে ছোট কিন্তু সবচেয়ে মেধাবী মানিয়া। স্কুলে রাশিয়ান ভাষায় পড়াশোনা হয়, কিন্তু গোপনে তারা পোলিশ ভাষায় কথা বলে, পোলিশ ভাষায় লেখা বইপত্র পড়ে। পোল্যান্ডের প্রতি যে ভালোবাসা মানিয়ার মা-বাবা তাঁর মনে জাগিয়ে তুলেছেন তা কখনোই ভোলেননি মানিয়া।
স্কুলের ছুটিতে বাসায় এসে মা-বাবা ও ভাই-বোনদের সাথে আনন্দে সময় কাটে মানিয়ার। কিন্তু সে আনন্দ বেশিদিন টিকলো না। বড়মেয়ে সোফির মৃত্যুশোক সামলাতে পারলেন না অসুস্থ ব্রোনিস্লাভা। মাত্র ৪২ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
মাকে হারিয়ে পাগলের মত হয়ে গেল মানিয়া। প্রচন্ড অবসাদ ঘিরে ধরলো তাকে। এদিকে স্ত্রীকে হারিয়ে চারটি ছেলেমেয়ে মানুষ করার দায়িত্ব একা নিজের ঘাড়ে তুলে নিলেন ভ্লাদিস্লাভ। স্ত্রীর চিকিৎসার খরচ চালানোর জন্য এক আত্মীয়ের পরামর্শে সমস্ত সঞ্চয় একটা ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডে রেখেছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর ঐ ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড দেউলিয়া হয়ে যায়। ফলে সঞ্চয়ের পুরোটাই হারালেন তিনি। অভাব ঘিরে ধরলো চারদিক থেকে।
অনেক কষ্টে আরেকটা স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি খুঁজে নিলেন ভ্লাদিস্লাভ। সংসার খরচের সমস্যা কিছুটা মিটলো। এর মধ্যেও সব ছেলেমেয়েরা ভীষণ পরিশ্রমী। ছেলে জোসেফ গোল্ডমেডেল পেয়ে স্কুল ফাইনাল পাস করে ওয়ার্শ ইউনিভার্সিটিতে মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হয়েছে। মানিয়ার দিদি ব্রোনিয়াও গোল্ড মেডেল পেয়ে স্কুল ফাইনাল পাস করেছে। ভাইয়ের মত ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছে তারও। কিন্তু পোল্যান্ডে মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষা তখনো নিষিদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হলে যেতে হবে ফ্রান্সে। সেরকম অর্থনৈতিক সামর্থ্য তাদের নেই। সংসারের কাজকর্ম এবং বাড়িতে যেসব ছাত্ররা থাকে তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করার সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলো ব্রোনিয়া।
মানিয়া সবে কৈশোরে পা দিয়েছে। স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মেই মনে ভালোলাগা ভালোবাসার জন্ম নেয়। তাদের বাড়িতে বোর্ডার হিসেবে আসে সুদর্শন তরুণ ছাত্র ভিটোল্ড রোমোকি। প্রথম দর্শনেই তার প্রেমে পড়ে যায় কিশোরী মানিয়া। পিঠাপিঠি বড়বোন হেলাকে জানাতেই জানতে পারে হেলাও মজে গেছে একই তরুণে। দু’বোনের মধ্যে প্রকাশ্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় ভিটোল্ডকে নিয়ে – প্রেমের প্রতিযোগিতা। তাতে ব্রোনিয়ার কিছুটা সুবিধাই হলো, কারণ বোর্ডিং সংক্রান্ত অনেক কাজই তখন হেলা আর মানিয়া বলার আগেই করে ফেলতে শুরু করেছে। তবে এই মোহ বেশিদিন থাকেনি। ভিটোল্ড চলে যাবার পর হেলা আর মানিয়া দু’জনই দু’দিকে মন দিয়েছে।
বাসার কাছাকাছি একটা রাশিয়ান স্কুলে ভর্তি হয়েছে মানিয়া। স্কুলে কেউ তাকে ‘মানিয়া’ বলে ডাকে না – আসল নাম ‘মারিয়া’বলেই ডাকে। পাশের বাসার কাজিয়া প্রাইবোরোভস্কা তার বেস্ট ফ্রেন্ড। কাজিয়ার সাথে হেঁটে হেঁটে স্কুলে যায় মারিয়া। একই সাথে নাচ শেখে, খেলাধূলা করে, দু’জনের সুখদুঃখের কথা শেয়ার করে। স্কুলের পোলিশ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভালোবাসে – একই সাথে রাশিয়ানদের ঘৃণা করে।
১৮৮৩ সালের ১২ জুন স্কুল সার্টিফিকেট পাস করে মারিয়া। সেরা শিক্ষার্থী হিসেবে স্বর্ণপদক পায়। এখন কী করবে সে? ব্রোনিয়াও স্বর্ণপদক পেয়ে বাড়িতে বসে আছে। হেলাও স্কুল পাস করে বসে আছে। মেয়েদের জন্য পোল্যান্ডে উচ্চশিক্ষার দরজা বন্ধ করে রেখেছে রাশিয়ান জার সরকার। ব্রোনিয়ার ইচ্ছা ফ্রান্সে গিয়ে ডাক্তারি পড়বে। মারিয়ার ডাক্তার হবার ইচ্ছে নেই – কিন্তু ফ্রান্সের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় সরবোনে পড়ার স্বপ্ন তার।
ব্রোনিয়া প্রাইভেট টিউশনি শুরু করেছে ফ্রান্সে যাবার খরচ জমাবার উদ্দেশ্যে। হেলা উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন বাদ দিয়েছে। সে ঠিক করেছে ব্রোনিয়া ও মারিয়া ফ্রান্সে চলে গেলে সে-ই পোল্যান্ডে থেকে তার বাবার দেখাশোনা করবে।
ভবিষ্যৎ চিন্তার হতাশায় খুব অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে মারিয়া। তার অবসাদ কাটানোর জন্য তার বাবা তাকে কিছুদিনের জন্য গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। প্রায় এক বছর মারিয়া তার কাকাদের বাড়িতে থেকে ঘোড়ায় চড়ে, সাঁতার কেটে, হাসি আনন্দে কাটিয়ে ওয়ার্শ ফিরে আসে অবসাদমুক্ত হয়ে।
ইতোমধ্যে তার বাবা অবসর গ্রহণ করেছেন। পেনশনের টাকায় সংসার চালানো সম্ভব নয়। বড় বাসা ছেড়ে দিয়ে একটা ছোট বাসায় চলে এলেন তারা। ব্রোনিয়া আগে থেকেই টিউশনি করছিল। জোসেফ ও মারিয়াও সংবাদপত্রে ‘পড়াইতে চাই’ বিজ্ঞাপন দিলো।
বাসা থেকে মাইলের পর মাইল হেঁটে গিয়ে কয়েকটা টিউশনি করে মারিয়া। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বিরক্ত হয়ে গেলো সে। বেশির ভাগ ছাত্রছাত্রীই অলস, ফাঁকিবাজ। আবার অনেক সময় দেখা যায় যে মাসের শেষে তার বেতনটা দিতেও ভুলে যাচ্ছে তারা। বছর খানেক পর বিরক্ত হয়ে সে বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিউশনি করা ছেড়ে দিয়ে এক বিখ্যাত উকিলের বাড়িতে গভর্নেসের চাকরি নিলো।
মারিয়া আশা করেছিলো উকিলের বাড়িতে উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ থাকবে, বাইরের চাকচিক্যের সাথে মিলিয়ে তাদের মনমানসিকতাও সেরকম উজ্জ্বল থাকবে। কিন্তু মারিয়ার আশাভঙ্গ হতে দেরি লাগলো না। দুটো ছেলেমেয়েকে সাত ঘন্টা পড়িয়ে অন্যান্য কাজ করতে করতে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে যেতো মারিয়া। কিছুদিনের মধ্যেই উকিলের বাড়িটাকে তার জেলখানা মনে হতে লাগলো। মারিয়া দেখতে পেলো উচ্চবিত্ত সমাজের এই মানুষগুলোর বাইরের রূপ আর অন্তরের রূপে কত পার্থক্য। বাইরে এরা অভিজাত ফরাসি ভাষায় কথা বলে, জনগণের ওপর দরদ দেখায়, লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে পার্টি দেয়, অথচ বাড়ির কাজের লোকের বেতন দেয় না মাসের পর মাস। মারিয়ার মনে হতে থাকে বাস্তব দুনিয়ার অনেক নোংরা দিকের সাথে তার পরিচয় ঘটছে।
১৮৮৫ সালে ব্রোনিয়া টিউশনির টাকা জমিয়ে ফ্রান্সের সরবোন ইউনিভার্সিটির মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হয়েছে। থাকার জন্য সবচেয়ে সস্তায় বাসাভাড়া নিয়েছে প্যারিসের ল্যাটিন কোয়ার্টারে। কিন্তু তাতেই তার জমানো টাকা শেষ। এখন মেডিকেলে পড়াশোনার খরচ, থাকা-খাওয়ার খরচ কীভাবে চলবে বুঝতে পারছে না। মারিয়া ব্রোনিয়াকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এলো। দু’বোনের মধ্যে চুক্তি হলো – মারিয়া গভর্নেসের চাকরি করে ব্রোনিয়ার লেখাপড়ার খরচ চালাবে, পরে ব্রোনিয়া পাস করার পর মারিয়ার পড়ার খরচ চালাবে।
উকিলের বাড়ির চাকরি ছেড়ে ওয়ার্শ থেকে একশ’ মাইল দূরে একটা গ্রামে ভালো বেতনের গভর্নেসের চাকরি নিয়ে চলে গেলো মারিয়া। নতুন মনিব মিস্টার জোরাভস্কির বিশাল চিনির কল। মানুষ হিসেবেও তাঁকে বেশ ভালোই মনে হলো মারিয়ার। তবে মিসেস জোরাভস্কি মারিয়ার সাথে খুব একটা ভালো ব্যবহার করেন না। মারিয়া জানতে পারে – মিসেস জোরাভস্কিও প্রথম জীবনে গভর্নেসের কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। জোরাভস্কি পরিবারের চার মেয়ে ব্রঙ্কা, আঞ্জিয়া, স্টাস, আর ম্যাটিস্না বাড়িতেই থাকে। মারিয়ার কাজ হলো তাদের দেখাশোনা করা, পড়ানো, এবং সঙ্গ দেয়া। ব্রঙ্কা মারিয়ার সমবয়সী – মারিয়ার সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেলো তার। অন্য তিনজন অনেক ছোট। বিশাল বাড়িতে মারিয়ার ঘরটিও বেশ বড়। ঘোড়ায় চড়ে, উন্মুক্ত প্রান্তর আর মাইলের পর মাইল ইক্ষুক্ষেতের পাশ দিয়ে বেড়াতে বেড়াতে ভালোভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিলো মারিয়ার। মেয়েদেরকে পড়িয়ে কিছুটা সময় থাকলে নিজের পড়াশোনা করার চেষ্টা করে। সে ভোলেনি যে একদিন তাকে সরবোন ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যেতে হবে। সেজন্য তার ফরাসি ভাষা জানা দরকার, গাণিতিক দক্ষতা দরকার।
একদিন বাগানে বসে গভীর মনযোগে ক্যালকুলাস করছে মারিয়া – হঠাৎ টেবিলে কার ছায়া পড়তে চমকে ওঠে। তাকিয়ে দেখে ভীষণ হ্যান্ডসাম এক তরুণ দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। চোখের পলক পড়ে না মারিয়ার। মানুষ এত সুন্দর হয়!
স্যার, আমি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী হিসেবে কঙ্গোতে নিয়োজিত, দেশের বাইরে থাকার কারনে ভেবেছিলাম আপনার বই হয়ত পড়তে পারব না। অনলাইনে পেয়ে সেই আফসোস নাই। আপনার লেখা অস্ত্রেলিয়ার পথে পথে বইটা অসাধারণ ছিল। আমি জানি এই বইটাও জীবনকে অন্যভাবে ভাবতে শেখাবে।
বিজ্ঞানীদের জীবনী খুব ভাল লাগল।ছাত্ররা বিজ্ঞানে উৎসাহিত হউক।
@বাবু, অনেক ধন্যবাদ। বিজ্ঞানে উৎসাহিত করার ব্যাপারটা দিনে দিনে কঠিন হয়ে উঠছে।
একটা ধাঁধাঁ; বলুনতো, “চোখের পলক পড়ে না মারিয়ার। মানুষ এত সুন্দর হয়!” ইনি কে?
উত্তর: রেডিয়াম ভালোবাসার আবীরে মেখে আগামী পর্বে প্রদীপ দা দেবেন!
(F)
@কেশব কুমার অধিকারী, অনেক ধন্যবাদ। দ্বিতীয় পর্বে মানুষটার পরিচয় প্রকাশিত হয়েছে।
ছোট বেলায় ধাঁ ধাঁ দিতাম, আমাকেও দিত — বল তো , কে দুবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছে?
উত্তর হত, মাদাম কুরি । যতদূর মনে পড়ে মেরি বলতাম না। কেন? জানি না। আর একজন ছোট্ট মেয়ে হয়েও অহং ভাব জাগত একজন নারী দুইবার নোবেল পেয়েছে বলে।
তবে তার কাহিনী এত বিশদ জানতাম না। ধন্যবাদ। ‘ক্রমশ’ এর জন্য অপেক্ষা রইল।
@গীতা দাস, অনেক ধন্যবাদ। মেরি কুরিই এখনো একমাত্র মহিলা যিনি দু’বার নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। পুরুষদের মধ্যে কয়েকজন আছেন যাঁরা একাধিক বার নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।
মনে মনে মেরি কুরিকে নিয়ে লেখা আশা করছিলাম আপনার কাছে, পেয়েও গেলাম। মেরিকুরি আর পিয়েরি কুরির ভালোবাসার মতো রোমান্টিক কাহিনী আর হওয়া সম্ভব না!
“তেজস্ক্রিয় ভালোবাসা” শিরোনাম দিলে কেমন হতো? “রেডিয়াম ভালোবাসা” ও অবশ্য দারুণ!
পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম। (F)
@রামগড়ুড়ের ছানা, অনেক ধন্যবাদ। তেজষ্ক্রিয় ভালোবাসা মেরি কুরির ক্ষেত্রে যথার্থ। কিন্তু তেজষ্ক্রিয়তা মানে রেডিও-এক্টিভিটি প্রথম আবিষ্কার করেন হ্যানরি বেকোয়ারেল। তাই মেরির আবিষ্কৃত রেডিয়ামেই মেরিকে ভালোবাসার প্রচেষ্টা।