মানুষ তার বিবেক কে নাকি ভয় পায়, কিন্তু তারপরও কেন বারবার বিবেকের কাছে দংশিত হয়? বিবেক তো মানুষের অতীত আর বর্তমানকে আয়নার মতন তুলে ধরে আর প্রতিবিম্ব হিসেবে ভবিষ্যতকে উচিত-অনুচিতের পার্থক্য দেখায়। আসলে সময়ের জল্পনা-কল্পনায় অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের পরিসীমা নিয়ে যথেষ্ঠ বিতর্ক রয়েছে। ব্যাকরণের ভাষায়- “যা আসবে, তা ভবিষ্যত। যা বিগত, তা অতীত। যা শুধু নিরন্তর বহমান, তাই বর্তমান।” মজার ব্যাপার হচ্ছে- ব্যাকরণের গদবাঁধা সংজ্ঞা নিয়ে মাথাব্যাথা না করলেও সময়কে নিয়ে ঠিকই আমাদের মাথা ঘামাতে হয়। আমরা না চাইতেও সময় আমাদের নিত্য সঙ্গী।

আর এই সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে চাই জ্ঞান, দ্রুততা আর বিবেক-বোধ। পুথিগত বিদ্যায় জ্ঞান আরোহন করা এবং প্রযুক্তির কল্যানে দ্রুততার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া হয়ত সম্ভব। কিন্তু বিবেক-বোধ আর ক’টা মানব-প্রাণীর নিত্য সঙ্গী হতে পারে? অবশ্য এজন্য “বিবেক-বোধ”কে দোষ দেয়া নিরর্থক। জগতে সব কিছুই সাধনার প্রতিবিম্ব। বোধ করি, বিবেক-বোধ নামক এই বিষয়টা আমাদের চারপাশের নিরবিচ্ছিন্ন বাতাসের মতন সহজলভ্য কোনো বস্তু নয়। সাধনার বিপরীতে যেমন অলস্যতার মহাজগত, বিবেকের বিপরীতে তেমনি অকৃতজ্ঞতা আর নীচতার অন্ধকার এক জগত বিরাজমান। এই জগতের হাজারো গল্প, আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। তবুও আমরা ভুলে যাই সে গল্প।

ছোটোবেলায় আমাদের দেশের মানব-প্রানীদেরকে বাংলা এবং ইংরেজি উভয় বিষয়েই একটি বাক্য শিখানো হয়- “To err is Human – মানুষ মাত্রই ভুল”। আমার কাছে মাঝে–মাঝে কেন জানিনা মনে হয়, এই বাক্যটির অযুহাতে মানব-প্রানীরা তাদের ভুল-গুলোর প্রতি দিনদিন উদাসীন হয়ে পড়ছেন। আর তাদের এই উদাসীনতাই বোধ করি বিবেক-বোধকে প্রচন্ড শক্তিতে নিচে টানছে।

জমি ভাগ করার মতন বিবেক-বোধেরও নাকি আবার ক্ষেত্রবিশেষ আছে। আজকের দিনের তথাকথিত ভদ্র-সমাজ বিবেক-বোধকে বিভিন্ন ভাগে দেখিয়েছেন। জাতীয় বিবেক, ধর্মীয়-বিবেক, সামাজিক-বিবেক আরো কত কি! কিন্তু এই ভদ্র-সমাজ কি জানেন যে, বিবেক-বোধ আর মানবতার মধ্যে অল্প-বিস্তর পার্থক্য রয়েছে? যে প্রানীর মানবতা নেই, তারা বিবেকের কি বোঝে, তা নিয়ে আমার যথেষ্ঠ সন্দেহ আছে। আপনি বিবেকবান হলে অবশ্যই মানবতার মূল্য দিতে শিখবেন। প্রকৃতপক্ষে বিবেকবোধহীন মানবতার কোন মূল্য নেই। কিন্তু, প্রতিনিয়ত আমরা এই “মানবতা” শব্দটিকে উৎসবের বিষয়বস্তু করে তুলেছি। আজ জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক মহলে মানবতাকে নিয়ে হাজারো যুক্তি-তর্ক করতে দেখা যায়। অথচ, আমাদের এসব যুক্তি-তর্ক মস্তিষ্কের কোন এক কোণে বন্দী হয়ে থাকে। ধমনী দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তা কখনো বজ্রকন্ঠে পৌঁছায় না।

কিছুদিন আগে আমি হাঁটছিলাম কোনো এক জনাকীর্ন রাস্তায়। সূর্যের তাপ দেখে মনে হল দুপুর হতে এখনও বেশ খানিকটা বাকি। আমি যে রাস্তাটা ধরে হাঁটছিলাম, তার ডান-পাশেই একটা রেললাইন। কিছুটা সময় পরপর ট্রেন যাচ্ছে। ট্রেনগুলো যখন যায়, তখন আশেপাশের সবাই রেললাইনের আশ-পাশ থেকে সরে যায়। কিন্তু আমি বেশ কয়েকবার খেয়াল করে দেখলাম, একটি মধ্য বয়সী ছেলে রেললাইনের খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেন আসলে সে লাইনের আরো কাছাকাছি চলে যায়। ছেলেটির পড়নে একটা ছেড়া-ফাঁটা ফুল-প্যান্ট, গায়ে একটা ময়লা পাঞ্জাবী, মাথার চুলগুলো মোটামুটি কালের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও প্রমাণ রাখছে। খেয়াল করলাম আশেপাশে এত মানুষ, তবু তাকে কেউ লাইন থেকে সরে যেতে বলছেনা বা সরিয়েও দিচ্ছেনা। একটা ট্রেন আসছিল, অবস্থা বেগতিক দেখে, আমি দৌড়ে গেলাম ছেলেটির কাছে, গিয়ে তার হাতটা টান দিলাম। ভাগ্যিস, আমি ট্রেন আসার আগেই তাকে সরিয়ে ফেলেছি। ছেলেটি দেখলাম আমার থেকে এক হাত দূরে পড়ে আছে। অজ্ঞান হয়ে গেছে ভেবে যেই তার কাছে গিয়েছি, অমনি সে তার কংকালপ্রায় হাত-পা দিয়ে আমাকে মারতে শুরু করল। দু-একটা চোট পেয়ে আমিও পড়ে যাই। আমি যখনই পড়ে গিয়েছি, ছেলেটা দ্রুত উঠে এসে আমাকে হাত ধরে টেনে উঠালো। আমি কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম।

– ব্যাথা পাইছেন নি ?

– কিছুটা। কিন্তু বুঝলাম না, আপনি আমাকে মারলেন কেন?

– দ্যাহেন, বেশি কথা কইয়েন না। তারাতারি ভাগেন এহান থিকা, নইলে পুলিশ আইয়া পরব।

কথাটা বলেই ছেলেটা অন্যদিকে হাটতে শুরু করল। ছেলেটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। দু-একজন লোক জড় হয়েছিল আশেপাশে। একজন বলে উঠল- “ভাই আপনেরে মারল, আপনে কিছু কইলেন না ক্যান?”

আমি কোন জবাব না দিয়ে ছেলেটির দিকে যেতে থাকি। ছেলেটি কিছুক্ষণ পরপর পিছনে তাকিয়ে আমাকে খেয়াল করতে থাকে। আর যতই দেখে আমি ওর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি ততই সে দ্রুত হাঁটতে থাকে। আমি কাছাকাছি যেতেই ছেলেটি দৌড় দিল। আমিও পিছু নিলাম। কিছুক্ষন পর আমি ধরে ফেললাম। ছেলেটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল

– আপনের কি হইচ্চে, আপনে আমার পিচ লাইগছেন ক্যান?

– আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলব।

– আমার লগে আপনের আবার কি কতা?

– আপনি ভয় পাবেন না, আমি আপনার কোন ক্ষতি করব না।

ছেলেটা আমার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠল।

– আমি কি মাইয়া মানুষ যে আপনে আমার ক্ষতি কইরবেন?

– তাহলে ভয় পাচ্ছেন কেন?

– ভয় পামু না ক্যান? আমি এহানে দাঁড়াইয়া থাকি, আর মাইনষে আমারে মারুক, না? আপনের কইতাছি আমার পিচ ছাড়েন, নইলে ভাগাড়ে নিয়া মাইরা ফালামু কইলাম।

– আপনি অযথাই ভয় পাচ্ছেন, লোকজন আপনাকে মারবে কেন? আমি আপনার কোন ক্ষতি করবনা বললাম তো।

ছেলেটি আবারো হেসে দিয়ে বলল- আরে আমি কি মাইয়া মানুষ নাকি, হালায় কয় কি, আমার বলে ক্ষতি করবনা …হো হো…

– তাহলে একটু দাড়ান, কথা বলি।

ছেলেটা দাঁড়িয়ে পড়ল- নেন, কি কইবার চান, তাড়াতাড়ি কইয়া ভাগেন।

– আপনার নাম কি?

– নামে কিচ্চু আসে যায় না।

– আপনি থাকেন কোথায়?

– আমার থাকনের জায়গা নাই। যেহেনেই রাইত, সেহেনেই কাইত।

– চলুন একটা যায়গায় গিয়ে বসি, তারপরে কথা বলি।

– আমার টাইম নাইক্যা, সিগন্যাল দেওন লাগব। আমি সিগন্যাল না দিলে আবার ট্রেন যাইব না……… কথাটা বলে ছেলেটা হি হি করে হেসে উঠল।

– আপনি কে?

– আমি এই এলাকার ডন……… কথাটা বলে সে আবারো হেসে উঠল।

– আপনার আর কে কে আছে?

– আমার কেউ নাই, কেউ নাই, তয় একখান শত্রু আছে। হিডারে মাইরতে পারলে আমি এই ট্রেন গুলার মালিক হইয়া যামু।

– কে আপনার শত্রু ?

– হেই কথা আপনারে কমু ক্যান? আপনে কি আমার বেয়াই লাগেন?

– আচ্ছা, এই যে আমার সাথে এতক্ষণ কথা বললেন, আপনার কি খারাপ লেগেছে?

– না তা লাগে নাই, তয় আপনে খাড়ান, আমিএকখান সিগনাল দিয়া আসি।

কথাটা বলেই ছেলেটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে গিয়ে রেললাইনের উপরে উঠে হাতে একটা কালো পলিথিন নিয়ে হাত নাড়াতে লাগল।

কিছুটা বাদেই ছেলেটা আবার ফিরে আসল।

– কন আর কি কি কইবেন?

– আপনার হাতে সময় আছে এখন?

– সময় কি আমগো হাতে থাকবার জিনিস? হেইডা তো বড়লোকগো ব্যাপার।

– মানে? আপনার কথা ঠিক বুঝলাম না।

– এইডা না বুঝোনের কি অইল? হেড়া যেমনে চায় হেমনেই দিন-রাইত কইরবার পারে। এইবার বুঝেন নাই?

আমি ছেলেটার কথা শুনে কিছুটা অবাক হয়ে গেলাম। আমার কাছে হঠাৎ করে মনে হল ছেলেটাকে আমি যেমন ভাবছিলাম তেমন নয়, হয়ত একটু আলাদা। একথা ভেবে আমি প্রশ্ন চালিয়ে যেতে লাগলাম, আর সে একের পর এক উত্তর দিতে থাকল।

– হ্যা, এবার বুঝেছি। আচ্ছা ভাই বললেন না তো আপনার শত্রুটার নাম কি?

– তার আগে কন আপনে ক্যাডা?

– আমি আপনার মতনই একজন মানুষ মাত্র ।

– আপনে আমার মতন মাইনে? ওই হালার পুত, তোর কয় বেলা না খাইয়া থাকতে অইচে? তোরে কয়বার চোর বইল্যা মাইর খাইতে অইচে? ক, কস না ক্যান?

– আচ্ছা ভাই আপনি শান্ত হোন? আমি মেনে নিচ্ছি আমি আপনার মতন নই। কিন্তু আপনার জীবনে এত কি ঘটেছে যে লোকে আপনাকে মারতে চায়?

ছেলেটি আমার দিকে রক্তবর্ণ চক্ষুতে তাকিয়ে ছিল। মনে হচ্ছিল, সে আমাকে চোখ দিয়েই মেরে ফেলতে পারে। কিন্তু হঠাৎ তার মুখের ভঙ্গি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসল।

তারপর আপন মনেই বলতে শুরু করল-

বাপ-মায় আমার নাম রাইখছিল শহীদ। আমার বাপে ছোটো-খাটো একখান পিয়নের চাকরী কইরত। তহন আমি ক্লাস ফাইবে পড়ি, একবার একখান হুন্ডার নিচে পইড়া আমার পা ভাইঙ্গা গেল। আমার ঠ্যাঙ্গের চিকিৎসা করাইতে গিইয়া আমার বাপের মেলা ট্যাহা-পয়সা নষ্ট হইয়া গেল। কিন্তু ঠ্যাংডা ভালা অইল না। আমারে হের পর থেইক্যা ল্যাংড়াইয়া চইলতে অয়। আমার বাপ মইরা গেল আমি যহন থার্ড কেলাছে পরীক্ষা দিছিলাম তার পরেই। বাপের পেনশিনের ট্যাহা-পয়সা উঠাইতে পারি নাই। যে অপিস থেইক্যা বেতন দিত, হেইখানে ট্যাহা-পয়সা ঘুষ না দিলে পেনশিন দেয় না। পড়ালেহা করমু না ভাবছিলাম। প্যাটে থাকলে না পিটে সইব! চাচারা সম্পত্তি গুলান হাত কইরা ফালাইল উকিলেরে ট্যাহা-পইসা দিয়া। মা’রে নিয়া গেছিলাম নানার বাড়ি। নানায় আমগোরে দেইখ্যা চেইতা উইঠা মা’রে কয় – তোরে বিয়া দেওনের সময় তো তোর জামাই এক ট্যাহা কম নেয় নাই, সব কিছু বেইচ্চা তোরে বিয়া দিছি, এহন আবার তোরে খাওয়ান লাইগবো? পারুম না। চইলা যা আমার বাড়ি থেইক্যা। আমার বাপের জমি ফেরত পাইতে অইলে থানায় কেস করন লাগব, হেই ট্যাহাও নাই মার কাছে। থানায় যহন গেছিলাম, দেহি দারোগা কুত্তার বাচ্চা আমার মা’র দিকে ক্যামনে তাকায়। আমার মা’রে আমি কইলাম –“থাক আমগো জমি লাগবো না। আমি বাঁইচ্যা থাইকলে তুমারে ম্যালা জমি কিন্যা দিমু।”

আমার মা তহন আমারে নিয়া শহরে আইল। মা মাইনষের বাড়িতে কাম খুঁজতে লাইগল। দুইদিন, দুই রাত রাস্তায় রাস্তায় কাটাইছি। হেরপর মা এক বাড়িতে কাম খুইজা পাইল। বাড়ির মালিক মা’রে কামে নিব, তয় আমারে সাথে নিতে রাজি অয় না। তহন আমি আমার মা’রে কইলাম –“মা আমি তুমারে ছাড়া থাইকতে পারুম না।”

মা কইল- আমি কি তরে ছাড়া থাইকতে পারুম? কি কস তুই? আমি অই কাম করুম না। মা ওই কাম নিল না। তয় প্যাটে আর সয় না তহন, আমার মা’র মুখের দিকে আমি তহন তাকাইতে পারিনা। আমার মা’র মুখটা তহন শুহাইয়া কাঠ অইয়া গ্যেছে। আমি মনে মনে ঠিক কইরলাম- আমিই কাম খুঁজুম। কিন্তু আমারে কেউই কোন কামে নেয় না। উপায় না দেইখ্যা মা আর আমি ভিক্ষা করন শুরু করি। একদিন এক সাহেব, মা’রে আর আমারে তার বাড়িতে কাম দিবার চাইল। সাহেবের বাড়িতে গিয়া আমার চোখ কপালে উইঠ্যা গেছিল। বিশাল বাড়ী। সাহেবরে একদিন কইছিলাম – “সার, আমারে যদি একটু পড়ালেখার বন্দোবস্ত কইরা দিতেন…”

কতাটা হুইন্যা হে আমারে কইল- পড়ালেখা করবি? বান্দীর বাচ্চার শখ কত? পড়ালেখা শিখবে? এত শখ, যা নিজে ইনকাম করে পড়।

কতাটা হুইন্যা আমি নিজেরে কই – সার তো ঠিকই কইচে, আমার পড়ালেহা করনের এত শখ ক্যান? আমি তো বান্দীর বাচ্চাই। কিন্তু আমার মা’রে দেহি কতাগুলান হুইন্যা কাইন্তাছে। আমি আমার মায়ের কাইন্দন দেখবার পারি না। মা’রে কইলাম – তুমি কাইন্দোনা, সারে তো কইচেই যে আমারে বি আর টি সি’র ট্রেনিং করাইব। দেইক্ষ, আমি ট্যাহা কামাই কইরা তুমারে জমি কিন্যা দিমু। মায় তহন আমারে জড়াইয়া ধইড়া কানতো খালি। আমি মা’রে আমার কষ্ট বুঝবার দিতাম না। আমগোরে তারা মাইপ্যা খাইতে দিত। কইত, বেশি খাইলে নাকি আমরা আরাম পাইয়া যামু, কামে ফাঁকি দিমু। আমার মায়রে তারা ম্যালা কিচু কইত। আমার মায় কিচ্চু কইত না। একবার মা’র জ্বর আইল, হেরা মা’রে অষুধ না দিয়া খাওন বন্ধ কইরা দিল আর কইল, আমার মায় নাকি ঢং ধরছে। কতাটা হুইন্যা আমি চেইতা গিয়া কইলাম – “ঢং তো করেন আপনেরা, আমার মায় জ্বরে মরে আর আপনেরা কন ঢং!”

কতাটা হুইন্যা সাহেবে, তার বউতে আর হের মাইয়্যা আমারে আর আমার মা’য়রে লাত্তি-গুতা দিয়া বাড়ী থেইক্যা বাইর কইরা দিল। মাইর খাইয়া আমার মা’র শরীলডা আরো খারাপ অইয়া গেল। রাস্তায় রাস্তায় ঘুইরা ভিক্ষা করতে শুরু কইরলাম আবার। মা অই জ্বর শরীল নিয়াই আমার লগে ভিক্ষা কইরত। একদিন ভিক্ষা কইরতাছি, এমন সময় দেহি, মা হঠাত কইরা রাস্তায় পইড়া গেল। তহন বুঝবার পারি নাই আমার কপালও ফাইট্যা গেল সেদিন থেইক্যা। মায় আমারে ছাইড়া গেল রে………… কথাটা বলে ছেলেটা চিৎকার করে কাঁদতে আরম্ভ করল। আমিও আমার চোখে জলের অস্তিত্ব টের পেলাম। আমার সারাটা শরীর ভারী হয়ে আসল। ছেলেটা এভাবে কিছুক্ষণ কান্না করতে লাগল।

আমিও চুপ করে ছিলাম।

ছেলেটা আবার বলতে শুরু করল- আমি কাম নিছিলাম রুটির দুকানে, মালিক আমারে বেতন দিত না, বদলে থাকতে আর খাইতে দিত। একদিন মালিকটাও মারা গেল । হেরপর হের ছওয়াল-পোলাপাইন দুকানে বইসত। পেত্থম পেত্থম আমারে কিচ্চু কইত না, তয় কয়দিন যাওনের পর হেরা আমারে চোর বানাইয়া দুকান থেইক্যা বাইর কইরা দিল । তারপর যত কাম করছি, সবাই আমারে একখান কতাই কইচে, তুই তো ল্যাংড়া তোরে কামে নিয়া বিপদে পরুম নি? কত দিন-রাইত না খাইয়্যা কাটাইচি? আইজকা আমি রেললাইনে থাকি, এই রেললাইনই আমার এহন সব। সন্ধ্যার সময় পুলাপাইনরে গাঞ্জার খোঁজ কইরা দিই, ওরাই আমারে পাঁচ-দশ ট্যাহা দেয়, অই দিয়াই খাইয়া চলি। অনেক মাইনষে আমারে শহীদ পাগল কইয়া চিনে, আসলে আমি পাগলা না। আমার আগের কতা যহন মনে পইড়া যায়, তহন আমি পাগলের মতন অইয়া যাই। অহন খালি মইর‌্যা যাইতে ইচ্ছা করে, তাই আপনে যহন আমারে বাঁচাইতে গেছিলেন, তহন আপনেরে মাইরচিলাম। আমি গাঞ্জার ব্যবসা করি দেইখ্যা লোকজনে পাইলে আমারে মাইরতে আহে। আমার জীবনে কোন দুঃখ নাই ভাই, খালি এক্ষান দুঃখ আছে। আমার মারে জমি কিন্যা দিবার পারি নাই। মারে কত কইতাম, আমি বাঁইচ্যা থাইকলে তুমারে ম্যালা জমি কিন্যা দিমু। জমি, এই জমির লাইগ্যা আমার মারে বান্দীগিরি কইরতে অইচে। আইজ এই রেললাইনের এত্তবড় জমিতে আমি থাহি, কেউ দেইখবার নাই। কাউরে কইতে পারিনা, আমি বাঁইচ্যা থাইকলে তুমারে ম্যালা জমি কিন্যা দিমু। মারে, ও মা, তুই কইরে মা, মা দেইহা যা আইজ আমার কত্ত জমি। মারে, ওই মা, তুই কই রে মা?

আবার কিছুক্ষণের জন্য নীরবতা নেমে আসে।

কিছুক্ষণ পর ছেলেটি আমাকে জিজ্ঞেস করে- আর কিচু জিগাইবেন?

আমি শুধু ‘না’ শব্দটা বলেই সেখান থেকে বিদায় নিই। বলতে পারিনি কিছুই, করতেও পারিনি কিছু।

আমার কানে শুধু বাঁজতে থাকে – “আমি বাঁইচ্যা থাইকলে তুমারে ম্যালা জমি কিন্যা দিমু”

যেতে যেতে ভাবতে থাকি রেললাইনের পাশে পড়ে থাকা এসব শহিদদের কথা। তথাকথিত ভদ্র সমাজের কাছে এরাই বুঝি বিবেকবোধহীন। কিন্তু নিজের ঐ কাঁচে বন্দী বিবেক-বোধ আর লাখটাকার মানবতাকে একবার প্রশ্ন করে দেখুন তো- আমাদের কি এতটুকু করবার ছিল না এইসব শহিদদের জন্য? আসলেই কি এরা বিবেকবোধহীন? নাকি এদেরকে আমরা বঞ্চিত করে রেখেছি?

যদি তাই করে থাকি, তাহলে আসল নির্বোধ, বিবেকবোধহীন কারা? উত্তর দিতে পারবেন? মনে হয় পারবেন না।