আমরা একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক মানুষ ! আজ সমস্ত পৃথিবী জুড়ে একটিমাত্র মানব প্রজাতি বিদ্যমান । এই মানব প্রজাতির বৈজ্ঞানিক নাম Homo sapiens (কোন কোন নৃতাত্ত্বিকদের মতে বর্তমানের মানুষ, Homo sapiens স্পিসিস -এর অন্তর্গত একটি উপ-স্পিসিস (sub-specis) Homo sapiens sapiens, অন্য উপ-স্পিসিসটি হল Homo sapiens idaltu, যার বিলুপ্তি ঘটেছে আজ থেকে প্রায় ১ লক্ষ ৬০ হাজার বৎসর পূর্বে) ! এই দুটি ল্যাটিন শব্দের অর্থ “জ্ঞানী মানুষ” । প্রাণী-বিজ্ঞানের ভাষায় এই মানুষ প্রজাতি Hominidae পরিবারের অন্তর্গত । এই পরিবারের অন্যান্য সদস্য-প্রাণীদের তুলনায় মানুষের বিশেষ পার্থক্য তাঁর দুই-পায়ের উপর ভর করে সোজা হয়ে হাঁটার ক্ষমতা, আর তাঁর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ! যদিও অদ্যাবধি মানুষের ইতিহাস সম্পূর্ণ উন্মোচিত নয়, তবু মানুষ এখন পর্যন্ত যতটুকু আবিষ্কার করতে পেরেছে তাও কোনো বিবেচনাতেই একেবারে নগন্য নয়, আর এই আবিষ্কারের সবটুকুই বিজ্ঞানীদের বৈজ্ঞানিক গবেষণার অবদান । বিজ্ঞানীদের এই আবিষ্কার বিশ্বাসযোগ্য, কারণ কোন বিষয়ে বিজ্ঞানীদের সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে তাদের সূক্ষ পর্যবেক্ষণ, এবং একটি সুনির্দিষ্ট ও সুপরিকল্পিত প্রক্রিয়ায় পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের উপর নির্ভরশীল । সেখানে স্বপ্নাশ্রিত, কল্পনাশ্রিত, বা অতি-প্রাকৃত কোন মনগড়া কাহিনীর উপস্হাপনা পুরোপুরি অবৈজ্ঞানিক এবং ভ্রান্ত বলে বিবেচিত হয় এবং তা আধুনিক মননশীল মানুষের কাছে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য !
মানুষ এই বিশ্ব-প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ! মানুষের ইতিহাস লক্ষ-লক্ষ বৎরের বিবর্তনের ইতিহাস ! বিবর্তনের এক মহা দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আজকের এই আধুনিক মানুষের উৎপত্তি আজ থেকে মাত্র প্রায় ২০ লক্ষ বছর আগে । মহাকালের মহা-আবর্তনের হিসাবে এই আধুনিক মানুষের উদ্ভব আর বিকাশের সময়কাল খুবই সংক্ষিপ্ত ! তবুও মানুষ এর মধেই সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে তাঁর দেশ-সভ্যতা-সংস্কৃতি-কৃষ্টি ! আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এই গ্রহের এত সকল প্রাণীর মধ্যে একমাত্র মানুষ নামক প্রাণীই এই বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী ! আর মানুষের এই বিশেষ ক্ষমতার উৎস অন্য সকল প্রাণীর তুলনায় তাঁর অতি উন্নত বৈশিষ্ট্য-মন্ডিত মস্তিষ্ক !! আধুনিক মানুষের এই উন্নত মস্তিষ্কও এক দীর্ঘ বিবর্তনের ফসল ! মানুষের সরাসরি পূর্বপুরুষ এক প্রকার বানর জাতীয় প্রাণীদের (genus Australopithecus) মস্তিষ্কের ওজন ছিল মাত্র প্রায় এক পাউন্ড ! তারপর দীর্ঘ ৪০ লক্ষ বছরের বিবর্তনের ফল স্বরূপ বর্তমানের আধুনিক মানুষের মস্তিষ্কের গড় ওজন এখন ৩ পাউন্ড ! এই অতি উন্নত মস্তিষ্কের কারণে মানুষ একদিকে যেমন সৃষ্টি করে চলছে তাদের ধরা-ছোঁয়ার অসংখ্য জিনিস, তেমনি অন্যদিকে তারা রচনা করতে পারে বিমূর্ত সব ধারণা ! এই অতি উন্নত মস্তিষ্কের কারণে মানুষ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে তাঁর ভাব প্রকাশের নিমিত্তে উন্নত ভাষা ! মানুষের অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার তাঁর সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রকলা ,ভাস্কর্য ইত্যাদি! মানুষ তাঁর বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন জঠিল মস্তিষ্কের দ্বারা জঠিল সব সমস্যার সমাধান করতে পারদর্শী । মানুষই একমাত্র প্রাণী যে আগুন আবিষ্কার করেছে এবং তাঁর খাবার রান্না করে খেতে পারে ! মানুষই কেবল পারে তাঁর নগ্ন দেহকে মনোরম পোশাকে আবৃত করতে ! মানুষই এক মাত্র প্রাণী যে ক্রমাগত আবিষ্কার করে চলছে অতি উন্নত সব প্রযুক্তি ! মানুষের মস্তিষ্কের সকল বিশেষ ক্ষমতার মধ্যেও আরো একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য তাঁর কোনো কিছু বিশ্লেষণ করার অসাধারণ পারঙ্গমতা ! মানুষ বিমূর্ত কার্য-কারণ-সম্পর্ক (abtract reasoning) বিষয়ে চিন্তা করতে সক্ষম ! মানুষ তাঁর যুক্তি আর কার্য-কারণ সম্পর্কের দৃষ্টিতে কোনো ক্রিয়াকলাপকে অনুপঙ্খ বিশ্লেষণ করার অনন্য-সাধারণ ক্ষমতার কারণে আজ এই ভূপৃষ্ঠের প্রাণী জগতের মধ্যে এক বিশেষ আসনে অধিষ্ঠিত !
মানুষের বিগত তিনশত বৎসরের ইতিহাসে তাদের জীবনের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই ঘটেছে বিস্ময়কর সব আবিষ্কার ! আর এর মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র সমূহ হল কৃষি বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান, তথ্য প্রযুক্তি, প্রকৌশল বিজ্ঞান,পদার্থ বিজ্ঞান, কম্পিউটিং বিজ্ঞান এবং মহাকাশ গবেষণা ! বিজ্ঞানের অসামান্য অগ্রগতির কারণে বর্তমানে খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে মানুষ অর্জন করেছে অভূতপূর্ব সাফল্য ! বন থেকে আহরণ নয়, মানুষ এখন উন্নত কৃষিকার্যের মাধ্যমে উৎপাদন করতে সক্ষম সবার জন্য খাদ্য, চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতির ফলে মানুষের আয়ুষ্কাল বেড়েছে অনেকখানি ! মানুষের সাথে মানুষের দ্রুত যোগাযোগের ক্ষেত্রে ঘটেছে বিস্ময়কর সাফল্য ! এই মহা-মহাবিশ্বের মহাকাশ সম্বন্ধেও নিরন্তর গবেষণা করে মানুষ আবিষ্কার করছে নতুন নতুন সব বিস্ময়কর তথ্য ! আজ থেকে ৪৫ বৎসর পূর্বে বিজ্ঞানীরা চন্দ্র জয় করেছে, এবং এখন মানুষ চেষ্টা করছে মঙ্গলগ্রহে বসতি স্হাপন করতে ! মানুষের এত সকল আবিষ্কারের পিছনে যে প্রণিধানযোগ্য বিষয়টি কাজ করেছে তা হলো অন্ধ-বিশ্বাসে নির্ভরতার পরিবর্তে যুক্তি আর বুদ্ধির প্রয়োগে বিজ্ঞান চর্চা !
এই বিশ্বজগতের রহস্য উন্মোচনের নিমিত্তে বৈজ্ঞানিক গবেষণার ফলশ্রুতিতে আজ মানুষের অনেক প্রাচীন ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে । উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে যে মানুষ এক সময় মনে করত মানুষে মানুষে মূলগত ভাবে বিশেষ পার্থক্য বিদ্যমান – কোন কোন মানুষ অন্য সকল মানুষ থেকে উন্নত বা অবনত । কিন্তু আজ বৈজ্ঞানিক গবেষনার দ্বারা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত যে মানুষের সেই ধারণা ছিল নিতান্তই অলিক কল্পনা – আসলে প্রতিটি মানুষ কৌলিক এবং মৌলিক ভাবে এক এবং অভিন্ন, আমরা সকলে মিলিত ভাবে এক প্রজাতি, এবং দৃশ্যত আমাদের মধ্যে যা পার্থক্য তা নিতান্তই বাহ্যিক ! মানুষ এক সময় মনে করত (এবং দুঃখ জনক ভাবে এখনো অনেকে মনে করে) মানুষের আয়ু সৃষ্টি কর্তা দ্বারা পূর্ব নির্ধারিত , কিন্তু আমরা আজ সকেলই মানতে বাধ্য যে উন্নত দেশ সমূহে উন্নত চিকিৎসা সেবার ফলে মানুষের গড় আয়ু বেড়েই চলছে ক্রমাগত ! মানুষ এক সময় কল্পনা করত ঝড়-বৃষ্টি, বন্যা-খরা এই সকল প্রাকৃতিক দূর্যোগ মানুষের পাপ-পূণ্যের সাথে সম্পর্কিত এবং সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রেরিত ! কিন্তু আধুনিক মানুষরা এখন জানে এইগুলি এই চলমান প্রকৃতির নানা উপাদানের মিথস্ক্রিয়ার ফল, মানুষের পাপ-পূণ্যের সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই এবং মানুষ এখন বিজ্ঞানের অনেক প্রায়োগিক নকশার মাধ্যমে অনেক আগে থেকেই হিসাব নিকাশ করে আবহাওয়া সম্বন্ধে খুব সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাস দিতেও বিশেষ ভাবে সক্ষম ! বিজ্ঞানের এই সকল আবিষ্কার মানুষের চিন্তার জগতে এনেছে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন – মানুষ এখন আর কেবল অন্ধ বিশ্বাসের উপর ভর করে জীবন-যাত্রা নির্বাহ করে না ! আধুনিক মানুষ তাঁর উন্নত মস্তিষ্কের দ্বারা পরিচালিত হয়ে মুক্তবুদ্ধির আলোকে যুক্তি আর বুদ্ধি দিয়ে বিশ্লেষণ করে তাঁর নিজেকে এবং তাঁর চারপাশের জগতকে ! সেই মুক্ত বুদ্ধির তাড়নায় এই আধুনিক মানবগুষ্ঠির মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, তাহলে, কি এই মানব প্রজাতির সত্যিকার বৈশিষ্ট্য ?? – অন্য কথায় বলা যেতে পারে, কি হওয়া উচিত এই মানুষের ধর্ম ??
বিশ্ব-প্রকৃতির সাথে একাত্মতা: এই বিশ্ব-প্রকৃতি থেকে মানুষ সহ সকল জীব এবং জড় পদার্থ উদ্ভূত ! আমাদের চারিপাশের প্রাকৃতিক জগতের সাথে আমরা এক জঠিল ও নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ ! আমাদের পরিবেশ সুস্হ আর সজীব থাকলে প্রকৃতি থেকে আমরা পাব আমাদের বাঁচার নিমিত্তে প্রয়োজনীয় বিশুদ্ধ বায়ু, বিশুদ্ধ জল আর খাদ্য ! মানুষের অনেক অবিবেচক কার্যাবলীর কারণে প্রকৃতি আজ নানা ভাবে বিপন্ন ! এক সময় এই পৃথিবীতে মানুষের সম গোত্রীয় বা প্রায়-মানুষ জাতীয় ( Homo erectus, Homo idaltu, Homo habilis ইত্যাদি ) অনেক প্রাণী ছিল ! প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারার কারণে তারা সকলে এক সময় হয়েছে বিলুপ্ত ! মানুষ (Homo sapiens) ছাড়া এখন আর হোমো-গণের (genus Homo) অন্য কোন প্রজাতির অস্তিত্ব নেই – কালের গর্ভে তারা সকলে হয়েছে বিলীন ! মানুষের কর্মকান্ড তার চারপাশের পরিবেশ-প্রকৃতির পক্ষে অনুকূল না হলে পরিবেশ হবে দূষিত, যার ফলে মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাত্রা হবে চরমভাবে বিপদগ্রস্ত আর এর পরিণতিতে মানব প্রজাতিও হয়তবা একসময় হতে পারে বিলুপ্ত ! তাই মানুষের ধর্ম হওয়া উচিত তাদের প্রকৃতি-পরিবেশের প্রতি যত্নশীল হওয়া, তাকে মমতা দিয়ে লালন পালন করা তাদের নিজেদের সুস্হ ও সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার জন্য এবং তাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য একটি বাসোপযোগী সুন্দর পৃথিবী রেখে যাবার জন্য !
সকল মানুষকে সমান জ্ঞানে সম্মান করা: যেহেতু এটি আজ বৈজ্ঞানিক সত্য যে দৈহিক এবং মানসিক গঠনগত ভাবে এই পৃথিবীর সকল মানুষ মৌলিক ভাবে একটি অভিন্ন প্রজাতি; কাজেই স্থান আর পরিবেশগত ভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষে মানুষে যে ভিন্নতা তা নিতান্তই স্থুল ! দৈহিক কর্ম তৎপরতার দ্বারা যেমন দেহকে বলশালী করা সম্ভব তেমনি সুস্থ জ্ঞান চর্চার দ্বারা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করাও সম্ভব ! সাধারণ ভাবে এই মানবগুষ্ঠির সকলেই বুদ্ধিদীপ্ত ! তবে সুযোগের অভাবে অনেকে তাদের নিজেদের বিকশিত করতে অপারগ ! সুযোগের অভাবে অথবা ব্যক্তিগত ও সামাজিক ভাবে অবহেলা, অবজ্ঞা, বা বৈষম্যের কারণে অনেক মানুষ নিপীড়িত এবং দরিদ্র ! বুদ্ধিমান মানুষ হিসাবে প্রতিটি মানুষের ধর্ম এটি মনে রাখা যে আমরা প্রতিটি মানুষের উৎস এক ! আমরা জানি প্রতিটি মানুষের উৎপত্তি দুই জন মানুষ থেকে, সেই দুইজন মানুষের উৎপত্তি আবার চারজন মানুষ থেকে, এমনিভাবে ক্রমাগত পিছনের দিকে যেতে থাকলে এই হিসাবের ফলটি আমাকে বলে দিবে আমি জন্মগত ভাবে আমার পূর্ববর্তী সকল মানুষের সাথে সংযুক্ত, এবং এই হিসাবটি বর্তমানের সকল মানুষের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে দেখা যাবে এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ প্রতিটি মানুষের আত্মীয় ! কাজেই প্রতিটি মানুষকে আমার সমকক্ষ রূপে বিবেচনা করে তাকে সম্মান করা প্রতিটি মানুষের মৌলিক ধর্ম !
সকল জীবের প্রতি দয়াশীল হওয়া: আমরা মানুষ হিসাবে যদি নিজেদেরকে কখনো এই প্রশ্ন করি যে “এই পৃথিবী কি কেবল মানুষের জন্য ?? নিঃসন্দেহে এর উত্তটি হবে “না ” ! মানুষের উৎপত্তির বহু বহু পূর্বে এই পৃথিবীতে উদ্ভিদের জন্ম হয়েছে ! এই পৃথিবীর প্রায় সকল প্রাণীজগতের উৎপত্তি মানুষের আগে ! বিবর্তনের ধারায় তাদের উৎপত্তি আর প্রসার মানব উৎপত্তির পথকে সুগম করেছে, এবং বর্তমান সময়েও এই পৃথিবীর প্রতিটি জীব একে অন্যের উপর নানা ভাবে নির্ভরশীল ! মানবিক বিবেচনায় দুঃখজনক হলেও এটা এক নির্মম সত্য যে এই পৃথিবীতে এক জীব অন্য আর এক জীবের খাদ্য আর তাই এক প্রাণী আর এক জীবকে হত্যা করে চলে প্রতিনিয়ত ! তবে খাদ্য-খাদকের এই সম্পর্কের বিষয়টির বাহিরে সাধারণ ভাবে সমস্ত জীবজগতের প্রতি দয়াশীল হওয়া এবং অকারণে কোন জীবের প্রতি হিংসা প্রদর্শন না করা মানুষের ধর্ম, কারণ এই পৃথিবীটা কেবল আমার একার নয় তাদেরও জন্য !
মানবধিকার প্রতিষ্ঠা করা: আজ থেকে প্রায় আড়াই শত বৎসর পূর্বে দার্শনিক জিন রশু (Jean Rousseau) বলেছিলেন, “মানুষ জন্মগ্রহণ করে মুক্ত কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলিত” ! আজ এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে এই পৃথিবীতে সুস্থ ও সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকা , বেড়ে উঠা এবং মুক্তভাবে চিন্তা করার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিটি মানুষের জন্মগত অধিকার ! কিন্তু যুগে যুগে মানুষ কিছু অন্ধ-বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে বা নিজেদের অশুভ ইচ্ছা চরিতার্থ করতে অন্য মানুষকে তাদের সেই জন্মাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে ! বিশেষ করে নারী ও শিশুরা নানা ভাবে নিগৃহীত ও লাঞ্চিত হয়েছে বহুকাল ধরে ! নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের অধিকার এই পৃথিবীর আলো-বাতাস সমভাবে ভোগ করার ! প্রতিটি মানুষের কর্তব্য তাঁর নিজের এই জন্মগত অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হওয়া এবং অন্য সকলের অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা এবং কোনভাবেই তাঁর সেই মৌলিক অধিকারে বাঁধা সৃষ্টি না করা ! বর্তমানের United Nations এর Universal Declaration of Human Rights – মুখবন্ধের প্রথম বাক্যটি হলো ” মানব পরিবারের সকল সদস্যের অন্তর্নিহিত মর্যাদা এবং সমান ও অবিচ্ছেদ্য মানবধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করা হল এই পৃথিবীতে মানুষের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার আর শান্তি প্রতিষ্ঠার মূল ভিত্তি” ! কাজেই এই পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষের তাঁর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করা এবং অন্য সকলের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সমর্থন আর সহায়তা প্রদান করা তাঁর মানব-ধর্ম !
ন্যায়-নীতি ও আদর্শবান হওয়া: যে সকল নিয়ম -নীতি পালনে ব্যক্তি জীবন শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সুস্থ থাকে ও সমাজজীবনে বৈষম্য দূর হয়ে সাম্যতা, শান্তি আনয়নে সহায়তা করে সাধারনভাবে তাই ন্যায়-নীতি ! যদিও স্থান, কাল ভেদে ন্যায়-নীতির কিছুটা হের-ফের হতে পারে তবে মানব-ইতিহাসের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আর যুক্তি- বুদ্ধির সহায়তায় বিশ্ব-ব্যাপিই ন্যায় নীতি সম্বন্ধে বর্তমান যুগের আধুনিক মানুষের একটা মোটামুটি স্পষ্ট ধারণা সৃষ্টি হয়েছে ! এই নীতি-আদর্শগুলো আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম নিরপেক্ষ ভাবে ! এই নীতি-আদর্শগুলোর ভিত্তি মানুষের বুদ্ধিদীপ্ত চেতনা আর যৌক্তিক বিবেচনা ! উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় এক সময় ধর্ম রক্ষার নামে মানুষ অসহায় বিধবা নারীকে আগুনে পুড়িয়ে মারত ! এক সময় আরব দেশে মেয়ে শিশুকে জীবন্ত কবর দিত ! বর্তমানের যেকোন মুক্তবুদ্ধির মানুষের কাছে এই কাজগুলি বিবেচিত হবে নিছক বর্বরতা রূপে ! তাই কোন অন্ধ বিশ্বাসের উপর রচিত কোন নীতি নয়, মানুষের যুক্তির কঠিন কষ্টি পাথরে পরীক্ষিত নীতি -আদর্শ পালনই হোক আধুনিক মানুষের ধর্ম ! আবার , কোন অন্ধ-বিশ্বাসের পরিবর্তে ন্যায়- নীতির ভিত্তি হওয়া উচিৎ বিজ্ঞান ! যেমন বিজ্ঞানের সূত্র অনুসারে প্রতিটি ক্রিয়ারই আছে একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া ! মানুষের ন্যায়-নীতির ক্ষেত্রেও এটি প্রয়োগযোগ্য ! যেমন কাউকে অকারণে আঘাত করলে সে পাল্টা আঘাত করবে বা করতে চেষ্টা করবে এটাই স্বাভাবিক ! অপরদিকে কোন মানুষকে, এমনকি অন্য কোন প্রাণী, বা তরু-লতাকেও সত্যিকার ভালবাসা প্রদর্শন করতে পারলে তার প্রতিদানে সে ঘৃনা প্রদর্শন করবে সেটা একেবারেই প্রাকৃতিক নিয়ম-বিরুদ্ধ ! অতএব যুক্তি, বুদ্ধি, আর বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে ন্যায়–নীতির অনুসরণই হোক মানুষের প্রকৃত ধর্ম !
উন্নত মস্তিষ্ককে কাজে লাগিয়ে যুক্তিবাদী হওয়া: বুদ্ধি, যুক্তি, আর বিশ্লেষণ ক্ষমতা আধুনিক মুক্তমনা মানুষদের জীবন যাত্রা নির্বাহের প্রধান সহায়ক ! তাই অন্ধ বিশ্বাস আর কুসংস্কার কে দূরে সরিয়ে রেখে নিরন্তর জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে মানুষের বুদ্ধিকে আরো শানিত করা, যুক্তিবাদী মনকে আরো ক্ষুরধার করা, মস্তিষ্কের বিশ্লেষণ ক্ষমতাকে আরো তীক্ষ্ণ করা হোক আধুনিক মানুষের ধর্ম ! একটি যুক্তিবাদী মন তাঁর যুক্তি ও বুদ্ধির চর্চার মাধ্যমে অনায়াসেই সকল মানুষের জন্য হিতকর সিদ্ধান্ত নিয়ে সেই মত কর্মে নিয়োজিত হতে পারে ! একটি উদাহরণ দেয়া যাক ! একজন যুক্তিবাদী সুশিক্ষিত মানুষ বুঝতে পারবে এই পৃথিবীর সম্পদ সীমিত, তাই অন্য সকলের অধিকারের কথা চিন্তা করলে সে সহজেই বুঝতে পারবে সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরিমিত বোধ এবং সর্ব ক্ষেত্রে অপচয় রোধ করা তাঁর কর্তব্য, বা অন্য কথায় বলা যেতে পারে এটি হওয়া উচিৎ তাঁর ধর্ম ! এই বিষয়ে মহাত্মা গান্ধীর মহা-মূল্যবান উক্তি ” There is enough on Earth for everybody’s need, but not enough for everybody’s greed”!
সকলের হিতার্থে ইহজাগতিকতা (Secularism)-র চর্চা : মানব ইতিহাসের ঊষালগ্ন থেকেই কিছু কিছু মানুষের উদার এবং মুক্তদৃষ্টির কারণে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা অব্যাহত ভাবে এগিয়ে চলছে ! আজ এটি বিজ্ঞানের সত্য যে আমাদের এই দৃষ্টিগ্রাহ্য জগতের সমস্ত ঘটনাবলী নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে কিছু প্রাকৃতিক নিয়ম ( (Physical laws)-এর মাধ্যমে ! কিছু ছোট্ট উদাহরণ দেয়া যায় : আকাশের দিকে ঢিল ছুড়লে তা মাটিতে ফিরে আসে, ক্ষুধার নিবৃত্তি হয় কেবল খাদ্যের দ্বারা, বা একটি পেশীবহুল মানবদেহ ঘটন সম্ভব কেবল ব্যায়ামের দ্বারা ! অনন্ত প্রহর ধরে প্রার্থনা করলেও আকাশের দিকে ছোড়া ঢিল মাটির দিকে ফিরে আসা রোধ করা যাবে না ! এক কঠিন কার্য-কারণ (cause and effect) সম্পর্কের নিয়মে বাঁধা এই জগৎ ও জীবন ! আমার জন্ম গ্রহণে আমার কোন ইচ্ছা-অনিচ্ছার ভূমিকা ছিল না ! কিন্তু আমার জন্মের পর আমার বাঁচার জন্য, আমার একটি সুস্থ-সুন্দর দেহ-মন গঠনের জন্য, এই পৃথিবীতে একটু সুন্দর জীবন-যাত্রা নির্বাহের জন্য প্রয়োজন এই জাগতিক নিয়মের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেকে গঠন করা এবং কর্ম করা ! এই পৃথিবীর সকল জীব জগৎ এই নিয়মের অধীন ! এই প্রাকৃতিক নিয়মকে সম্মান করে যুক্তি আর বুদ্ধি খাটিয়ে জীবন যাত্রা নির্বাহ করার মধ্যে নিহিত এই মানব সমাজের জন্য এক উন্নত জীবন ! এর বিপরীতে কোন মনগড়া কল্প কাহিনীর উপর নির্ভর করে জীবন চালিত করলে এই পৃথিবীতে ঠিকে থাকাই যে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় এটা আজ প্রমাণিত সত্য ! তাই মানুষ তাঁর নিজের এবং সমস্ত মানব সমাজের উন্নতির স্বার্থে প্রয়োজন ইহজাগতিকতার চর্চা করা !
বিজ্ঞানমনস্কতা ও বিজ্ঞানচর্চা: যদিও এটা সত্যি মানুষ এখনো সব সত্য আবিষ্কার করতে পারেনি – বিজ্ঞান এখনো সব প্রাকৃতিক রহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম হয় নি, তবু একথাও সত্যি, সত্যকে উম্মোচিত করার জন্য বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা -নিরীক্ষার কোন বিকল্প নেই ! বিজ্ঞান ও অন্ধ-বিশ্বাস একে অপরের বিপরীত ! বিজ্ঞানের কাজ সত্যকে উন্মোচিত করা আর অন্ধ-বিশ্বাস করে তার ঠিক উল্টোটা ! মন-গড়া অতি-প্রাকৃত কল্প-কাহিনীর রচনা দ্বারা অন্ধ-বিশ্বাস সত্যকে আড়াল করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে ! যৌক্তিক কোন পরিণতির দিকে মানুষের চেতনাকে পরিচালিত করার পরিবর্তে তাকে অযৌক্তিক ফ্যান্টাসিময় এক জগতে নিক্ষেপ করে ! ফলে মানুষ তার প্রভাবে বাস্তবতার পরিবর্তে কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করে ! এই পরিণতিতে দেহের বল আর মস্তিষ্কের বুদ্ধি খাটিয়ে জীবন আর জগতের উন্নতি সাধন করার পরিবর্তে মানুষ প্রার্থনা দ্বারা অনায়াসে কোন কর্ম না করেই ফল লাভ করতে চায় ! কিন্তু মানুষের অভিজ্ঞতা আর যুক্তি দ্বারা আমরা জানি এটা এখন নিছক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই না ! মানুষের এই ধরনের মানসিকতা তার নিজেকে ও সমাজকে এগিয়ে নেয়ার পরিবর্তে পশ্চাতমুখী করে তোলে ! মানুষের অগ্রগতি ব্যাহত হয় পদে পদে ! তাই প্রতিটি মানুষ তার নিজের স্বার্থে এবং সমষ্টিগত ভাবে সমস্ত মানব সমাজের স্বার্থে হওয়া উচিত বিজ্ঞান মনস্ক, এবং বিজ্ঞান চর্চা করা হোক তাঁর ধর্ম ! এই যুগের প্রতিটি শিশুর জন্য এখন বিজ্ঞান শিক্ষা আর কোন ঐচ্ছিক বিষয় নয়, বরং সকল শিশুর জন্য এটি একটি অবশ্য পঠনীয় বাধ্যতামূলক বিষয় হওয়া মানব ধর্মের অন্তর্গত !
পাদটিকা: সবশেষে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম সম্বন্ধে কিছু কথা ! আজ এটি যেকোন আধুনিক মানস-সম্পন্ন একজন মুক্তবুদ্ধির ও চিন্তাশীল মানুষের কাছে অবধারিত ভাবে সত্য যে, সকল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মই মানুষ-সৃষ্ট ! মানব-বিবর্তনের সুদীর্ঘ ইতিহাসের তুলনায় এই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলোর বয়স নিতান্তই অল্প, তবে গত ৩০০ বছরের বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব ও অত্যাশ্চর্য সব আবিষ্কারের সময়কালের তুলনায় সেই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলো বেশ প্রাচীন যদিও সবচেয়ে প্রাচীন ধর্মটির বয়সও ঐতিহাসিকদের গবেষণায় ২৫০০- থেকে ৩৫০০ বছরের বেশি নয় ! আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, দুঃখ জনক হলেও মেনে নিতে হয় যে, একদিকে মানুষ যেমন তাঁর উন্নত মস্তিষ্কের দ্বারা ক্রমাগত সৃষ্টি করে চলেছে নতুন নতুন সকল উন্নত প্রযুক্তি, মানুষ একদিকে যেমন প্রচন্ডভাবে মুক্তবুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হয়ে আশ্চর্যরকমভাবে বিশ্লেষণধর্মী অন্যদিকে আবার কোন কোন ক্ষেত্রে ভীষণ রকমভাবে অন্ধ বিশ্বাসের অনুসারী এবং পশ্চাতমুখী ! এর কারণ মনে হয় এই যে মানুষের অতি উন্নত মস্তিষ্কের গভীরে মনে হয় কোন ভাবে এখনো প্রোথিত হয়ে আছে তার আদিম কল্পনাশ্রয়ী এক মন ! মানুষের ইতিহাসের প্রভাতকালে যখন ধীরে ধীরে তাঁর মস্তিষ্কের ক্রম উন্নতির সাথে সাথে তাঁর মনে ঘটেছে জ্ঞানের উন্মেষ , তখন তার চারপাশের অজানা জগতকে জানার জন্য তার মনে জন্মেছে এক প্রবল আকাঙ্খা ! সেই জগতকে সে সঠিক ভাবে বিশ্লেষণ করতে না পারলেও সে কল্পনা করেছে তার একটা কারণ নির্ধারণ করতে ! তারপর মানুষের আরো বিবর্তনের সাথে সাথে মানুষ কল্পনার সাথে সাথে প্রয়োগিক বিজ্ঞানের আশ্রয় নিয়ে কল্পনার বিপরীতে সত্যকে উন্মোচিত করতে শুরু করে ! মানুষ একদিকে সত্যকে আবিষ্কার করে চলছে প্রতি নিয়ত, কিন্তু সাথে সাথে বাদ দিতে পারেনি এখনো তার কল্পনাশ্রয়ী মনকেও ! তাই মানুষের সেই কল্পনাশ্রয়ী মন স্বপ্ন দেখে জীবনের এক কঠিন সত্য, জীবনের শেষ পরিণতি “মৃত্যু”-র পরেও আর এক জীবনের ! লক্ষ-কোটি কোষের সমন্বয়ে গঠিত আমাদের এই রক্ত-মাংসের গড়া এই বস্তু- দেহে যেখানে প্রতিনিয়ত চলে আর সকল প্রাকৃতিক ধারার অনুসরণে চিরাচরিত নিয়মের ভাঙ্গা-গড়া, সেই নশ্বর দেহে মানুষ কল্পনা করে এক অলৌকিক আর অবিনশ্বর আত্মার অধিষ্ঠান ! অনেক জানার মধ্যেও মানুষ যখন হাবুডুবু খায় এক মহা-অজানার মহা-সমুদ্রে, তখন সে কল্পনা করে এক সর্বশক্তিমান আর সব-জান্তা সৃষ্টিকর্তার ! বর্তমানের অনেক মানুষের কাছেই মানুষের এই সকল অনুভূতি “আধ্যাত্মিকতা ” নামে পরিচিত ! মানুষের এই আধ্যাত্মিক প্রয়োজন মিটাতে এই মানুষ-সৃষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলো এখনো পর্যন্ত রাখছে বেশ কিছু ভূমিকা ! তবে সকল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অন্তর্গত ধর্মীয় পুস্তকগুলি মানুষের আধ্যাত্মিক তৃষ্ণা মিটতে বেশ কিছু ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারলেও মানুষের যৌক্তিক বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটিয়ে মানুষের মনকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে পরিচালিত করার পরিবর্তে মানুষকে অবৈজ্ঞানিক, অন্ধবিশ্বাস আর নিয়তি-নির্ভরশীল এক নিশ্চল মানুষে পরিণত করতে, এবং মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টিতে এই ধর্ম গ্রন্হগুলি রাখছে এক বিশেষ নেতিবাচক ভূমিকা ! কারণ এই ধর্মগ্রন্হগুলি মূলত আজগুবি মনগড়া কল্প-কাহিনীতে ভরপুর ! অনেকেই হয়ত বলবেন ধর্মগ্রন্হগুলি আমাদের নৈতিকতার শিক্ষা দেয় ! কথাটার মধ্যে আংশিক সত্যতা থাকলেও সে বিষয়ে বিশেষ আলোচনার অবকাশ বিদ্যমান ! যদিও মানুষের নৈতিকতার উৎপত্তির সঠিক ইতিহাস অজ্ঞাত তবে মানব ইতিহাসের অতি শৈশব কাল থেকেই (প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলির উৎপত্তির অনেক পূর্বেই) মানুষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই ধীরে ধীরে মানুষের মনে কিছু কিছু নৈতিক আচরণের প্রয়োজন দেখা দেয় ! উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় মানুষের বেঁচে থাকার স্বার্থেই প্রয়োজন হয়ে উঠে একে অন্যের সাথে সহযোগিতা করার ! গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে ধর্ম নিরপেক্ষ ভাবে মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক নৈতিক শিক্ষার কথা বলে গেছেন ! যদিও বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম গুলির একটি উপাদান মানুষের জন্য নৈতিক শিক্ষা তবে এই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলো নিয়েই আছে অনেক জিজ্ঞাসা ! প্রথমত, এই পৃথিবীতে একটি মাত্র মানবগুষ্ঠির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম কিন্তু একটি নয় – বহু ! দ্বিতীয়ত, সেই প্রত্যেক ধর্মের ধর্মপ্রাণ মানুষেরা দাবি করেন সেই সকল ধর্ম এক সর্বশক্তিমান ঈশ্বর, আল্লাহ, ভগবান, বা জিহোভা কর্তৃক প্রেরিত এবং সেই ধর্মের অন্তর্গত নৈতিক শিক্ষাগুলি সরাসরি ঈশ্বরের কাছ থেকে প্রাপ্ত ! কিন্তু প্রশ্ন হলো বিভিন্ন ধর্মে ঈশ্বরের যে স্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে তা কিন্তু এক নয়, বরং কোন কোন ক্ষেত্রে একে অপরের সাথে প্রচন্ডরকম বিরোধপূর্ণ ! উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় হিন্দু ধর্মের অনুসারীদের ভগবান মানুষ হয়ে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়, আবার ঈশ্বরের মৃন্ময়মূর্তি গড়ে হিন্দুরা তাঁর পূজা করে ! অপর দিকে ইসলাম ধর্মের অনুসারীদের কাছে মাটির দেবতাকে পূজা করা তো বহু দুরের কথা এমনকি ঈশ্বরের এই রূপ স্বরূপ কল্পনা করাও এক ভয়ঙ্কর পাপ ! আবার খ্রিষ্ট ধর্মের অনুসারীদের কাছে যিশু খ্রিষ্ট ঈশ্বরের সন্তান, আর বুদ্ধ ধর্মালম্বীদের কাছে গৌতম বুদ্ধ স্বয়ং ভগবান ! এখন প্রশ্ন হল কে বলবে কোনটা সঠিক ? নাকি তার কোনটাই সঠিক না !!!!!
এবার আসা যাক নৈতিকতার প্রসঙ্গে ! ক্ষেত্র ভেদে এক প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের নৈতিকতার শিক্ষার সাথে অন্য আর এক ধর্মের নৈতিক শিক্ষার রয়েছে প্রচন্ড ফারাক ! একটা ছোট্ট উদাহরণ : বুদ্ধের নৈতিক শিক্ষা – প্রাণী হত্যা মহাপাপ বা অন্য কথায় সকল প্রাণীর প্রতি করুণা প্রদর্শন ধর্মের অঙ্গ, খ্রিষ্ট ধর্মের নৈতিক শিক্ষা “তোমার প্রতিবেশিকে তোমার নিজের মত ভালবাস” ! অপর দিকে ইসলাম ধর্মের এক নৈতিক শিক্ষা ” মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই “- আর তাদের প্রার্থনা কেবল বিশ্বের সকল মুসলমানদের মঙ্গল কামনায়, আর হিন্দুরা তাদের নিজের ধর্মের লোকদের মধ্যেই উচ্চ বর্ণ আর নিম্ন বর্ণের মত এক হিংসাত্বক ভেদাভেদ সৃষ্টির দ্বারা (এবং এই ধর্মের শিক্ষা এই বর্ণ-ভেদ ঈশ্বর কর্তৃক আরোপিত – ব্রাহ্মনরা নারায়নের মস্তক থেকে উদ্ভূত বিধায় তাঁরা মানব শ্রেষ্ঠ !!!) এক শ্রেণীর মানুষকে আলাদা করেছে অস্পৃশ্য-অচ্ছুত রূপে !! কাজেই এখন আবারও প্রশ্ন মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের বিষয়ে বিভিন্ন ধর্মের অন্তর্গত এই পরস্পর বিরোধী নৈতিক শিক্ষাগুলো কোনটি ঈশ্বর কর্তৃক প্রেরিত ? নাকি এর একটিও নয় !!!!!!!
আধুনিক মানুষের কাছে নৈতিক শিক্ষার ভিত্তি হবে তাদের উন্নত মস্তিষ্কের বুদ্ধি, বিবেচনা খাটিয়ে, “এই পৃথিবীর সকল মানুষ এক অভিন্ন প্রজাতি”, এই বৈজ্ঞানিক সত্যটি মনে রেখে এমন ন্যায় নীতি প্রতিষ্ঠা ও পালন করা যা সকলের জন্য একটি শান্তিময় পৃথিবী তৈরী করতে রাখবে এক বিশেষ ভূমিকা ! কোন বাচ-বিচার ছাড়াই এই সকল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগ্রন্হ সমূহের সবকিছুই সার্বিকভাবে গ্রহণ আর পালনের মাধ্যমে কেহই একজন সত্যিকারের মানুষ হতে পারে না কারণ এর প্রায় সবকিছুই অবৈজ্ঞানিক এবং কল্পনা প্রসূত এবং মানুষে মানুষে মিলনের পরিপন্থী ! তবে এতৎসত্ত্বেও পরিশেষে এই কথা বলা যায় প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম সমূহের সকল নেতিবাচক উপাদান সত্বেও সকল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মেই আছে কিছু নির্মল আনন্দের আনুষ্ঠানিকতা ! সেই আনুষ্ঠানিকতা সমূহ সতর্কতার সাথে পালন করলে আমাদের যৌক্তিক -বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে কলুষিত না করেও সকলের অংশ গ্রহনের মাধ্যমে মানুষ পেতে পারে কিছু আনন্দ ! সর্বান্তকরণে কামনা করি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের এই আনন্দানুষ্ঠানগুলি বর্তমানের এই আধুনিক মানবগুষ্ঠির কাছে কেবল আনন্দ আর ঐতিহ্যের অংশ রূপেই বেঁচে থাকুক আর আমাদের প্রাত্যহিক জীবন-যাত্রা নির্বাহে “মানব ধর্ম’-ই হোক এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের ধর্ম – যেখানে আমরা সকলেই এক প্রজাতি এবং আমাদের সকলের আদর্শিক ধর্ম হোক এক, আর তা হলো – “বিজ্ঞান- মনস্কতা “, “বিজ্ঞান চর্চা”, আর বাহ্যিক জাত-পাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই পৃথিবীর সকল মানুষের কল্যাণ হয় এমন নীতি-আদর্শ গ্রহণ ও পালন করা ! তবেই এই পৃথিবী হয়ে উঠবে সকলের জন্য বাসযোগ্য কল্যাণময় আর শান্তিময় এক আবাস- স্থল !!
ভাইজান, ভালোই বলেছেন। কিন্তু সকল ধর্মকে বিজ্ঞানের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো প্রয়াস কতটা সঠিক? এমন করলে কী দোষ যে, বিজ্ঞানের মাপকাঠিতে য ধর্ম টিকবে সেটাকে গ্রহণ করবো, আর যেটা টিকবে না সেটা গ্রহণ করবো না।
“এক সময় আরব দেশে মেয়ে শিশুকে জীবন্ত কবর দিত ” its not true .
দাদা অনেক ভালো লাগলো..
প্রিয় অনিমেশ দাদা,
পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ, আর ভাল লেগেছে জেনে অনেক খুশি হলাম ! ভাল থাকবেন !
বিগবেং যদি সত্য হয়
তাহলে বিবর্তন বাদ সত্য
যদি এক ভাষা থেকে বস ভাষার সৃষ্টি হয়
তাহলে বিবর্তনবাদ সত্য ।
অনেক দিন পর আপনার লেখা পেলাম। বুদ্ধ ধর্ম তো নিরঃঈশ্বর বাদী। তাদের সেমেটিক ধর্ম গুলোর সাথে এক করেছেন কেন? ভাল লিখেছেন। মানুষ তার প্রয়োজনেই ধর্মের সৃষ্টি করেছে আবার তা প্রয়োজনেই ধ্বংসাত্বক ধর্ম থেকে দুরে সরে যাবে। শুধু থেকে যাবে কিছু আচার অনুষ্ঠান। মানবিকতা প্রতিষ্ঠা পাবে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে।
@রওশন আরা,
গৌতম তো বোধহয় নিরীশ্বরবাদই প্রচার করেছিলেন। কিন্তু এখন তো আর বৌদ্ধধর্ম নিরীশ্বরবাদী নেই। গৌতম নিজেই এখন ভগবান বুদ্ধ। এই ধর্মটা এখন একেশ্বরবাদী প্যাগানিজম।
আমার মতে ধর্মগুলো আসলে ঃ
১) সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত ঈশ্বরবিশ্বাসকে ব্যবহার করে কতিপয় মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক শিখর সন্ধানের হাতিয়ার (যেমন আব্রাহামিক ধর্মগুলো)
২) সমকালীন সমাজব্যবস্থা ও মানুষের সামাজিক আচরণকে কেন্দ্র করে কিছু ব্যক্তির দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ (যেমন অধিকাংশ প্যাগান ধর্ম)
যিনি স্রষ্টা (বা আদৌ যদি তিনি থাকেন) তিনি সৃষ্টির আনন্দ লাভেই সৃষ্টি করেন, পরবর্তিতে সৃষ্টের নৈবেদ্য লাভের উদ্দেশ্যে নয়।
শ্রদ্ধেয়া রওশন আরা,
এটি কষ্ট করে পড়ার জন্য ও মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ ! বৌদ্ধ ধর্ম মৌলিক ভাবে নিরীশ্বরবাদী ধর্ম হিসাবে অন্য সকল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম থেকে আলাদা হলেও এখন কিন্তু এটি আর সকল ধর্মের মতই একটি ঈশ্বরবাদী ধর্মে পরিনত হয়েছে ! কারণ এখন বৌদ্ধ-ধর্মালম্বীরা মনে করে গৌতম বুদ্ধই ছিলেন স্বয়ং ভগবান ! এমনকি হিন্দুরা বৌদ্ধ ধর্মকে হিন্দু ধর্মের একটি শাখা হিসাবে মনে করে আর বুদ্ধকে মনে করে একজন অবতার (মহাদেব) রূপে ! কাজেই বৌদ্ধধর্ম বর্তমানে অন্য ধর্মের মতই একটি ধর্ম, আর তাইতো দেখি বার্মায় একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুকে মুসলমান হত্যায় নেতৃত্ব দিতে !!!
@অমল রায়, এটি নতুন খবর। এটি আমার জানা ছিল না। তাই তো দেখি বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মানুষ হত্যায় নেমেছে। অসংখ্যা ধন্যবাদ।