শ্রদ্ধাঞ্জলি: আমার প্রয়াতঃ শিক্ষক হুমায়ুন আহমেদ

কেশব অধিকারী

 

খবরটা বজ্রাহতের মতোই ছিলো আমার কাছে। আমি সেই কবে থেকে বসে আছি, যখন তিনি বললেন, বাংলাদেশে স্থাপন করবেন একটা আন্তর্জাতিক মানের ক্যান্সার গবেষণাগার এবং হসপিটাল! আমার দৃঢ় বিশ্বাস, একমাত্র তাঁর দ্বারাই এরকম একটা প্রতিষ্ঠানের গোড়াপত্তন সম্ভব ছিলো বাংলাদেশে। এটা আমার মনগড়া কথা নয়, আমি প্রয়াত: আমার এই শিক্ষকে যতটা জানি তিনি তা করতেন তাঁর অতি স্বাভাবিক অভিব্যক্তি এবং ইচ্ছাগুণের জোড়ে। আজ আমি হতাশ। আমি হতাশ এই কারণে যে, দেশে স্বপ্ন দ্রষ্টার কিছুমাত্র অভাব না থাকলেও, স্বপ্নস্রষ্টা এবং সেই স্বপ্নকে মহীরুহে পরিণত করার মানুষ হয়তো আর রইলো না। বার বার আমার স্মৃতি আজ আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তারুণ্যের টগবগে দিন গুলোতে।

 আমি রসায়নের ছাত্র। সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে বাবার চাকুরী সূত্রে পাওয়া কোয়ার্টার থেকে সোজা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল। অধ্যাপক ডঃ মহব্বত আলী তখন প্রভোস্ট। আমি হলে নিবন্ধন এবং সীটের জন্যে আবেদন করলাম। অনুমতি পাবার পরে বিপত্তি দেখা দিলো। অধ্যাপক মহব্বত আলী আমাকে ডাকলেন, বললেন, এটা মুসলিম হল, আমাদের ভুল হয়েছে, তোকে জগন্নাথে যেতে হবে। আমি বললাম, “কোথায় মুসলিম হল? আপনার কাগজে নেই, হলের গেইটে আগে ছিলো, এখন তো সেটা দেখছি উঠিয়ে দিয়েছেন। আমি এখানেই থাকবো। আপনি ব্যবস্থা করুন।“ উনি কোঁকিয়ে উঠলেন, বললেন “তোর ভালোর জন্যে বলছি, তাছাড়া অসুবিধাও আছে।“ আমি বললাম, “সে আমি বুঝিনা কি অসুবিধা, তবে কার্জন হল এলাকা ছেড়ে এই আমি নড়ছি না, এটা স্যার, আমার শেষ কথা।“ তার দুদিন পড়ে, অধ্যাপক মহব্বত আলী ক্লাস থেকে আবার আমাকে ডিপার্টমেন্ট অফিসে (তিনি তখন বিভাগের সভাপতিও বটে!) ডেকে পাঠালেন, বললেন, বিকেলের মধ্যে আমি যেনো শহীদুল্লাহ হলে অধ্যাপক হুমায়ুন আহমেদের সাথে দেখা করি। অধ্যাপক হুমায়ুন আহমেদ তখন ঔপন্যাসিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। প্রচুর নাম ডাক, আমরা গর্বিত তখন বিভাগের ছাত্র হিসেবে। তাঁর সাথে দেখা করতে হবে, শুনে বেশ রোমাঞ্চিত হলাম! বিকেলে হল অফিসে স্যারের সাথে দেখা করতে গেলাম। একটু ভয় ভয়ও লাগছে, কি আবার বলবেন, হাজার হোক, ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক! দূর থেকে আমাকে দেখেই বললেন, “কেশব, আসো, আসো”! কেমন যেনো খানিকটা গম্ভীর গম্ভীর ভাব তারও চেয়ে যেনো বেশ ব্যস্ত, ঠোঁট আর গালের পেশী গুলো স্বাভাবিকের চাইতে সেসময় আর একটু বেশীই টান টান মনে হল! ঠোঁটেতো সিগারেট আছেই!  আর ওরকম ব্যস্ত ভাব নিয়েই বললেন, “অধ্যাপক মহব্বত আলী-তো তোমাকে নিয়ে ভীষণ বিপদেই পড়েছেন! তুমি আমার হলের আমার ব্লকেই থাকবে”। জিজ্ঞেস করলেন, “অধ্যাপক নুরুল আমীনকে চেন? ওনার মতে, তোমাকে আর একটু সাহসী হতে হবে!” আমি উত্তরে বললাম, “হ্যাঁ চিনি, উনি আমাদের ইনোরগ্যানিক প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে থাকেন।“ প্রয়াত: আমার এই শিক্ষকের কথা আর একদিন বলবো। কিন্তু আমার এই ঊনসাহসের কথা কেন বলেছিলেন, সেটা বুঝেছিলাম পরে যখন সীট বণ্টনের পরে নতুন বাংলা ছাত্র সমাজের কতিপয় ক্যাডারের হাত থেকে আমার সীট বুঝে নেবার সময় এলো। কিছু কাগজ পত্রের কাজ শেষ করে বিদায় নেবো, এমন সময় বললেন, “ তোমার ছন্দের হাত ভালো, তবে সুড়সুড়ির মাত্রাটা একটু বেশী, ওটা কমাতে হবে”! আমার বুঝতে বাকী রইলো না যে, ডিপার্টমেন্টে ঢুকেই আমি স্ব-উদ্যোগে যে “নবজাগরণ” (সম্ভবত:, স্পষ্ট মনে নেই এই মুহূর্তে নামটা) বন্ধুদের সহযোগিতায় টাঙ্গিয়েছিলাম, তা তাঁর নজরে এসেছে! আমি বললাম, “জ্বি স্যার, পরের গুলো আমি আপনাকে দেখিয়ে নেবো”। এই হলো তাঁর সাথে আমার প্রথম সাক্ষাতের মুহূর্ত! আমি মানুষটিকে দেখেছি খুবই কাছে থেকে, আসলে বলা ভালো যে, আমার সেই সৌভাগ্য খানিকটা হয়েছিলো! আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরষ্কারটি পেয়েছিলাম তাঁর কাছ থেকেই!

পরদিন সন্ধ্যায় আমি শহীদুল্লাহ হলের প্রধান ভবনের নীচ তলার নির্ধারিত একটা একক বিছানা বিশিষ্ট কক্ষের সামনে এসে দাঁড়ালাম। দরজাটা সামান্য খোলা। ভেতরে কিছু একটা আড্ডা চলছে। আমি দরজার কড়া নেড়ে খুললাম। ৮/১০ জন ষণ্ডা প্রকৃতির ছেলে বিভিন্ন ভঙ্গীতে বসে আছে। ধোঁয়ায় ঘরটা প্রায় ঝাপসা। বিকট গন্ধ হঠাৎ এসে আমার সব ইন্দ্রিয়কে সচেতন করে তুললো। বুঝলাম গাঁজার আড্ডা চলছে! একজন বললে, কেয়া বাআপস্! আমি বললাম, “স্যাররা তো এই রুমটিতে আমায় থাকতে বলে পাঠালেন”! চ, ম, প বর্ণ সহযোগে অশ্লীল শব্দের বাক্যবাণে আমাকে আর স্যারদের সৃষ্টির আদিকাল থেকে অদ্যাবধি সকল পূর্ব-পুরুষদের সাথে তাদের কল্পিত কতিপয় যৌন কার্যাদির বর্ণনা দিয়ে ১৫/২০ মিনিট পার করে দিলে। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। নাটের গুরু যে ছিল, সে আমাকে বললো খাটের তলায় যা আছে সেগুলো চালাতে পারবো কিনা। আমি নিচু হয়ে দেখলাম ওখানে ১০/১২টি বিভিন্ন আকার আর আকৃতির আগ্নেয়াস্ত্র! কল্পনা করতে চেষ্টা করলাম, সেই স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাক্কালে বাবার হতে দেখা একখানা দুইনলা বন্দুক ছাড়াতো ইহজনমে আর কোন বন্ধুক দেখেছি বলে মনে পরে না। এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানালাম। সাথে সাথেই মালাউনের বাচ্চা বলে অশ্রাব্য খিস্তি খেউর শুরু হলো। অনুভব করছিলাম আমার ভেতরের আমিটা তখন টগবগ করে ফুটতে শুরু করেছে! আমার ভেতরের ঘৃণাটা তখন বাইরেও হয়তো খানিকটা কাঁপুনি দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। ধীরে ধীরে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা চলে এলাম হল গেটের দরজায় বসা হুমায়ুন স্যারের কাছে। বললাম, স্যার দুটো আর্জি আছে। প্রথমত: আমাকে ডাবল সীটের রুমে দেবেন আর দ্বিতীয়ত: এমন কারো কাছে আমাকে পাঠাবেন না যারা আদৌ ছাত্রই নয়। জানলে কি করে যে এরা ছাত্র নয়? জানতে চাইলেন স্যার। বললাম, “ মুখের ভাষায়”। পাশে বসা অধ্যাপক নুরুল আমীন বললেন, “বলেছিলাম না, হবেনা হবেনা……! ঠিক আছে, (আমাকে নির্দেশ করে) তুমি এক কাজ করো, এপাশের ব্লকের দুহাজার একচল্লিশ এ চলে যাও, ওখানে গণিতের আইনুল হক আছে। তুমি ওর সাথে থাকো।” এদিকে অধ্যাপক হুমায়ুন আহমেদ বেশ একটা বিরক্তির ভাব নিয়ে সাথে দুজন দারোয়ান নিয়ে সোজা চলে গেলেন ভেতরে। পেছন পেছন আমি আমার পেটরা সমেত চললাম ২০৪১ এর উদ্দেশ্যে। এসে দেখি এ রুমের দুটি বিছানাই ভারমুক্ত পরে আছে। দরজার একপাশে ছোট এক টেবিলে হালকা গড়নের এক অতি নির্বিবাদী খোকা সদৃশ ছেলে অখণ্ড মনোযোগে গণিত চর্চায় মগ্ন! বুঝলাম ইনিই তবে আইনুল। নিজের পরিচয় দিয়ে অধ্যাপক নুরুল আমীনের কথা তাকে বললাম। সে বললো, কোন অসুবিধা নেই যেকোনো একটা বিছানা তুমি গুছিয়ে নাও, অন্যটা আমি নেবো। সেই থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষদিন পর্যন্ত আমরা ছিলাম ও-ঘরের বাসিন্দা। জানালার ধারের বিছানাটা নিয়েছিলাম আমি। জানালার ওপারেই নীচে সরু রাস্তা আর রাস্তার ওপারে শহীদুল্লাহ হলের পুকুর! ঠিক এমন সময় নীচ থেকে ভেসে এলো হুমায়ুন স্যারের গর্জন! ছুটে বারাণ্ডায় এলাম দুজনেই। দেখি অধ্যাপক হুমায়ুন আহমেদ সেই রুমের দুইজনকে বুকের কাছের কলার খামচে ধরে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে হলের গেট এর দিকে যাচ্ছেন! আমার সেদিন মনে হয়েছিলো, হুমায়ুন স্যারের খ্যাতিই এই সাহসের উৎস। কিন্তু সেই ভুল ভাঙ্গতে বেশী দেরী হয়নি আমার। নীতিগত প্রশ্নে তাঁকে ভীষণ জেদি আর একগুঁয়ে বলেই জেনেছি আমি পরে।

অকুতোভয় এই শিক্ষককে আমি ডিপার্টমেন্টেও দেখেছি একেবারেই নির্বিকার ভাবে নিজস্ব বিশ্বাসের জায়গাটাকে অবলীলায় প্রতিষ্ঠা করতে। আপাত: সীমাবদ্ধতায়, সৌজন্য-হেতু বিভাগের ছাত্র, শিক্ষক এমনকি সমাজের বিভিন্ন স্তরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকেও দেখেছি তাঁকে, তাঁর তাৎক্ষনিক বিজ্ঞান ও বিশ্বাস নির্ভর মতামতকে সমর্থন দিতে। আমরা তাঁকে কথাশিল্পী বলছি, আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে, যা একেবারেই অকাট্য এবং নির্ভেজাল সত্যি। আড্ডায় বসলে কারো সাধ্য নেই যে তাঁর বক্তব্য উত্থাপনের শিল্পগুণের ভেতর থেকে তর্কটাকে আলাদা করে বিতর্কের দেয়াল তুলতে পারে! বরাবর আমি তাই দেখেছি, তাঁর বাসায় একান্ত আলাপচারিতায় লেখক, শিল্পী, শিক্ষক এমনকি বোধ্যাধার্মিকদের মাথা নাড়তে, যা তাঁদের চিরন্তন সংস্কার, বিশ্বাস এবং অভিজ্ঞার পরিপন্থী! তাই তাঁর বক্তব্যের পটুতাই তাঁর সাহিত্যপ্রেমীদের আকর্ষণের মূল কারণ সন্দেহ নেই।

একবার কার্জন হলের পরীক্ষার হলে অধ্যাপক হুমায়ুন আহমেদ মূল ডায়াস থেকে নেমে এসে এক সারিতে বসা ৫/৬ জন ছাত্রের খাতা ছ্যাঁত ছ্যাঁত করে ছিনিয়ে নিয়ে গেলেন। ডায়াসে ফিরে ঘোষণা দিলেন, সাধ্য থাকলে কাটা রাইফেলের সাহায্য নিয়ে খাতাগুলো যেনো তারা ফিরিয়ে নিয়ে যায়! পাতা উল্টানোর ছপাৎ ছপাৎ শব্দ আর কলমের কর্মকাণ্ড থমকে যাবার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র-হলে চেয়ার টেবিলের খানিক আর্তনাদ উঠলো, সবার দৃষ্টি হলের একটা বিশেষ দিকে! ৫/৬ জন রক্ত চক্ষে স্থির তাকিয়ে আছে হুমায়ুন আহমেদের দিকে। দূর থেকে সামনে টেবিলের উপড়ে আধহাত খানিক লম্বা সরু জলের পাইপের মতো ২/৩ টা কালচে বস্তু! পরে শুনেছি ওগুলোই কাটা রাইফেল! তার ২/৩ মিনিট পরেই ওরা বেরিয়ে গেলো কোনও অঘটন ছাড়াই! নাম আগে শুনলেও স্বচক্ষে কাটা রাইফেল এই প্রথম আমি দেখেছি! আমরা পরীক্ষার্থীরা সেদিন একই ভাবে বিস্মিত হয়েছিলাম, ভয়ও পেয়েছিলাম স্যারের এহেন কর্মকাণ্ডে।

আর একদিন সন্ধ্যারাতে আমি স্যার এর বাসায়। শহীদুল্লাহ হলের প্রধান ভবনের এর গেট সংলগ্ন দোতলায় বাসা। স্যার লিখছেন এক মনে। পরনে লুঙ্গী আর খালি গা! মেঝেতে বসে টি টেবিলের মতো নিচু একটা টেবিলে লিখছেন। মাঝে মাঝে কয়েক পাতা করে শিলাকে (স্যারের দ্বিতীয় মেয়ে) দিয়ে পড়াচ্ছেন! অন্য একটা টি-টেবিল সংলগ্ন সোফায় আমি বসা, উল্টোদিকে খুবই শান্ত স্বভাবের নোভা (বড় মেয়ে) অংক (যতদূর মনে পড়ছে) করছে! মাথার বিসদৃশ টাক টাকে ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টায় আমার চুলের দৈর্ঘ্য স্বাভাবিকের চাইতে বেশী থাকতো বরাবর। দুপাশে ঘাড়ের কাছে শিলা আর বিপাশা (ছোট মেয়ে), ওরা দুই বোন ওদের ঘটের সমস্ত বিদ্যা উজাড় করে আমার টাক ঢাকার চেষ্টাটাকে অব্যর্থ কৌশলে ব্যার্থ করে তুলতে ব্যস্ত! হঠাৎ দূর থেকে একটা মিছিলের শব্দ ধীরে ধীরে ভেসে এলো কাছে। “হুমায়ুন আহমেদের চামড়া, তুলে নেবো আমরা”! হলের সীট বণ্টন বিতর্কে কতিপয় ছাত্রের মিছিল। ব্যলকোনী থেকে দেখলাম, শহিদুল্লাহ হলের ভবন-১ আর পুকুরের মাঝের রাস্তা দিয়ে মিছিলটা ফজলুল হক হলের দিক থেকে শহীদুল্লাহ হলের প্রধান ভবনের দিকে এগিয়ে আসছে। আমাদের সবার নিষেধ উপেক্ষা করে স্যার নেমে গেলেন নীচে। ভবনের প্রধান ফটকের সামনে কাঁটা গাছে ঘেরা গোলচক্রমতো ফ্ল্যাগহোষ্টিং এর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। উপর থেকে আমরা দেখছি। মিছিলটা কাছে এগিয়ে আসতেই অধ্যাপক হুমায়ুন আহমেদ হাত তুলে মিছিলকারীদের উদ্দ্যেশ্যে বললেন, “এদিকে আসো তোমরা কে কে আমার চামড়া তুলতে চাও”! মিছিলের সামনের সারিতে যারা ছিলো, তাদের কাছে ব্যাপারটা ছিলো একেবারেই অভাবিত! প্রথমে তারা ভাবতেই পারেনি যে সত্যি সত্যি অধ্যাপক হুমায়ুন আহমেদ এভাবে সামনে এসে দাঁড়াবেন। অবিশ্বাস্য চোখে আধো অন্ধকারে জুল জুল করে তারা চেয়ে দেখলো, দেখলো স্যার সত্যি সত্যি তাদের সামনে দাঁড়িয়ে! তাঁর চামড়া তুলতে ডাকছেন! কে মুখ লুকাবে কার পেছনে তার যে প্রতিযোগিতা সেদিন দেখেছিলাম, আজও আমার মনে আছে স্পষ্ট! পাঁচ মিনিটের মধ্যে সেদিনের সেই জঙ্গি মিছিল উধাও হয়ে গিয়েছিলো। স্যার যখন উপড়ে উঠে এলেন, আমরা বললাম, এভাবে হঠাৎ নীচে নেমে যাওয়া ঠিক হয়নি, কারণ যেকোনো মুহূর্তে কেউ অযাচিত আচরণ করতে পারতো। স্যার অসম্মতি জানালেন, বললেন- “সে জন্যে নৈতিক শক্তির দরকার হয়। সেটা তাদের ছিলোনা।”

জগন্নাথ হলের অক্টোবর দুর্ঘটনার পরের বছর! আমাদের শহীদুল্লাহ হলের বার্ষিক ক্রীড়া এবং সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা হচ্ছে। আমি একটা মাত্র ইভেন্টে অংশগ্রহণের জন্যে নাম জমা দিয়েছিলাম। সেটা ছিলো ‘উপস্থিত বক্তৃতা’। মজার ব্যাপার হলো, গত বছর এই সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার বিষয় গুলো পরিচালনা করেছিলেন অধ্যাপক নূরুল আমীন যিনি তখন প্রয়াত:, ১৬ই অক্টোবর, আগের বছর (১৫ই অক্টোবরে ঘটে জগন্নাথ হল দুর্ঘটনা)! আর এবার সে একই অনুষ্ঠান পরিচালনা করছেন তাঁরই সহকর্মী অধ্যাপক হুমায়ুন আহমেদ! মধুর ক্যান্টিনে যাবার আগে বিকেলে আমাকে ঐ প্রতিযোগিতার জন্যে স্টেজে দাঁড়াতে হবে। গেলাম, লটারিতে আমার ভাগ্যে জুটলো “আমার প্রিয় মানুষ”। ২ মিনিট ভাববার সময় পেলাম! জগতের শতেক শ্রেষ্ঠ মহিমান্বিত মুখ গুলো আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠলো! এঁরা সবাই এতো বড় যে, ঘণ্টার পর ঘন্টা ধরে তাঁদের বিষয়ে বললেও ফুরবে না। আমার বেশী ভাবতে ভালো লাগলো না। মনে হয় কিছু ভাবিও নি। ইতোমধ্যে আমার ডাক এলো। চলে এলাম স্টেজে। ডায়াসের সামনে মাইক্রোফোন হাতে বেশ খানিকটা আড়ষ্ট হয়েই আমি গড় গড় করে বলে গেলাম আমার প্রয়াত: শিক্ষক অধ্যাপক নূরুল আমীনের কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতি-গাঁথা। সেই সব স্মৃতি এক একটা অভিজ্ঞতা, এক একটা আবেগ, এক একটা প্রদীপ শিখা, শিক্ষা; পাঠ্যবই-এ কিংবা ক্লাসে তার উপস্থিতি সাধারনতঃ থাকে না। আমার প্রিয় মানুষ আমার শিক্ষককে সেদিন আমি এভাবেই তুলে ধরেছিলাম সাধারণ্যে তাঁর অজানা কিছু দিক নিয়ে। আমার সময় শেষ হলো, আমি স্টেজ থেকে নেমে সোজা রওয়ানা হয়েছি মধুর ক্যান্টিনের দিকে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছি বেশ খানিকটা। এমন সময় মনে হলো উপর থেকে কেউ দ্রুত নেমে আসছে। পেছন ফিরে তাকাতেই চোখে পরলো, অধ্যাপক হুমায়ুন আহমেদ ছুটে আসছেন, ‘কেশব, একটু দাঁড়াও’ বলতে বলতে। আমি দাঁড়ালাম, স্যার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, “আজকের এই প্রতিযোগিতায় তুমিই শ্রেষ্ঠ বক্তা, আমি বিচারক নই, তবে আমি বিচারক হলে, তোমাকেই শ্রেষ্ঠ বক্তা নির্বাচিত করতাম! আমি খুব খুশি হয়েছি, আমার মনে থাকবে তোমার কথা”। গর্বে আমার বুক ফুলে উঠেছিলো, চোখের কোণে জল জমেছিল কিনা আজ আর মনে করতে পারছিনা। তবে একথা নিশ্চিত ভাবে মনে আছে যে, কোন পুরষ্কার বা প্রতিযোগিতার কথা আমার মাথায় ছিলো না। কারণ আমি মোটেও কোন ভালো বক্তা নই। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতা কেটে যাবার পর মনে হলো, যা আজও আমি বিশ্বাস করি যে, আমিতো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পুরষ্কারটি সেদিনই জিতে নিয়েছি! আর অধ্যাপক হুমায়ুন আহমেদ নিজেই আমাকে সেই পুরষ্কারটি দিয়েছিলেন! স্যার এতো দীর্ঘ সময় রোগ ভোগের পর অকালে আমাদের ছেড়ে গেলেন, এই সংবাদটি পড়ার পর থেকে আমি বিমর্ষ দিন কাটাচ্ছি। স্মৃতি গুলো আমাকে ভীষণ তাড়িত করছে। অথচ, প্রথম আলোর সংবাদ মন্তব্যে মাঝে মাঝে স্যরের আরোগ্য কামনা করে ২/১ লাইন লেখা ছাড়া কিছুই আমি করতে পারিনি। নোভা, শিলা আর বিপাশাকে আমার মনে পড়ছে, মনে পড়ছে ম্যাডাম গুলতেকিন আহমেদ কে। অসম্ভব ভালোবাসতেন তাঁর তিন মেয়েকে।

আমার বিয়ের খবর স্যারকে যখন জানিয়েছিলাম, স্যার তখন খুব ব্যস্ত টেলিভিশনের নাটক নিয়ে। আমাকে আমার জর্জ হ্যারিসন কে সাথে নিয়ে বাসায় যেতে বললেন। জর্জ হ্যরিসন আমার বৌ। আমার প্রিয় তারকা শিল্পীর নামে ওকে আমি তখন ডাকতাম। তার পরে কোন এক সন্ধ্যায় চাঁদের হাসির বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে ভেসে ঢাকার গাউছিয়া মার্কেট থেকে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যেতেই কাছাকাছি কোন (এখন জায়গার নামটা ঠিক মনে পড়ছেনা) অ্যাপার্টমেন্টে স্যারের বাসায় আমরা গিয়েছিলাম। স্যার কম্পিউটারে টাইপ করছিলেন। খালি হাতে নতুন বউ এর মুখ দেখলে নাকি অমঙ্গল হয় (বউ এর নাকি নিজের তা অবশ্য স্যার বলেননি!), তাই উঠে চলে গেলেন ভেতরের ঘরে। ফিরে এসে জর্জ হ্যারিসনের নাম ঠিকুজির খোঁজ নিতে গিয়ে বললেন, ‘এই মেয়ে, তোমার গলাটা এতো ভারী কেনো হে? আদা আর মধু খাবে।‘ এখনো স্পষ্ট শুনতে পাই তাঁর গলা।

এই বাসাতেই আর একদিন তাঁর সঙ্গ পেতে গিয়েছিলাম আমি আর আমার জর্জ হ্যরিসন। গিয়ে দেখি তিনি তাঁর পারিষদবর্গ সমেত নিত্য দিনের আড্ডায় ব্যস্ত! ড্রয়িং রুমটা একটা খোলা হল ঘরের মতো। কোন সোফা বা চেয়ার নেই। মাটিতে ঢালা বিছানা! দেয়ালের দিকে সারি সারি বর্গাকৃতির বড় বড় বালিশ। কেউ কোলে কেউ পিঠে বালিশ নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন আড্ডা চলছে! আড্ডা মানে নানা ধরনের অদ্ভুত কাহিনী আর ঘটনার জমজমাট ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ! স্বভাবতই স্যারই ছিলেন মধ্যমণি! ভেতরের হেঁসেল থেকে খানিক বাদে বাদে ট্রেতে করে চায়ের সরবরাহ এসে পৌঁছুচ্ছে আড্ডায়। তখন বেগম খালেদা জিয়া দেশের প্রধানমন্ত্রী! একসময় স্যার জানালেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁকে বঙ্গভবনে সাক্ষাতের আমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর পি এস স্যারকে ফোন করে বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নাকি তাঁর উপন্যাসের একান্ত ভক্ত! তাই স্যার আমাদের কাছে জানতে চাইলেন, তিনি একজন অতিশয় নগণ্য ঔপন্যাসিক হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে কি নিয়ে যাবেন? স্যারের অর্থ বিত্তের তখন মোটেও অভাব ছিলোনা। তিনি বস্তায় ভরে টাকা খাটের তলায় রাখতেন! শৈশবে অনটনে কেটেছিলো তাঁর দিন। একসাথে অনেক টাকা দেখার বাসনাই ছিলো বস্তায় ভরে টাকা খাটের তলায় রাখার কারণ। কিন্তু সে যাই হোক, প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবেন কি নিয়ে! এর হরেকরকম সমাধান সবাই দিলেও, তাঁর স্বীয় সিদ্ধান্তই ছিলো চূড়ান্ত! আমাকে বললেন, ‘আমার এ-পর্যন্ত প্রকাশিত উপন্যাসের ২-সেট উপহার হিসেবে কেমন হয়? আমিতো একজন লেখক। একজন লেখকের সব চেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে আপন আর সবচেয়ে বড় তো তার সৃষ্টি, তাই না? আমি মনে করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্যে এইটেই হবে সবচেয়ে উত্তম উপহার। যেহেতু আমাকে জানানো হয়েছে প্রধানমন্ত্রী আমার উপন্যাসের একজন একনিষ্ঠ পাঠক।“ মুখে তাঁকে তখন কিছু না বললেও সার্বিক পরিস্থিতিতে আমার মনে হয়েছিলো এটি এক ধরনের অত্যাচার। কারো কারো কাছে হয়তো মধুর অত্যাচার। তবে গর্বের, সম্মানের। স্যারের জীবন যাপনের ভেতরে ছিলো একধরনের সরলতা। যে সরলতা তিনি তাঁর চারপাশের মানুষের মাঝে হয়তো খুঁজতেন। তার উপন্যাসের চরিত্র গুলোতে তাই সেই সরলতার এক অসাধারণ বহিঃপ্রকাশ ঘটে, তবে একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিকতায় আর রম্যময়তায়। এমনকি যে সন্ত্রাসী, ছিঁচকে চোর, কিংবা মহল্লার ঠগ-বাটপার, তার ভেতরের সরলতাও কি এক মোহময়তায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সৃষ্টিতে, যা সাধারণের হৃদয় ছুঁয়েছে অবলীলায়। মাঝে মাঝে মনে হয় এই যে এক অস্থির সংঘাতময় প্লাজমিক সমাজে আমাদের বাস, এরই মধ্যে কোথায় যেনো লুকিয়ে আছে মমত্ত্ব, সেই অফুরন্ত মমত্ত্বের সন্ধান পেয়েছিলেন হুমায়ুন আহমেদ, আর সমাজ পেয়েছে অমরত্ত্বের স্বাদ। তাই বোধ হয় আমরা আজও অভাব, অনটন, সন্ত্রাস, দাঙ্গা, হাঙ্গামা, হানাহানির মধ্যেও বেশ আছি; ভেঙ্গে পড়েনি সমাজ বা সামাজিক অবকাঠামো। হুমায়ুন অহমেদ এসবই জানতেন, আর জানতেন বলেই তিনি বিনির্মাণ করতে চেয়েছিলেন এক জগৎশ্রেষ্ঠ ক্যান্সার ইন্সটিটিউট এবং গবেষণাগার এ মাটিতেই এ সমাজেই।

তাঁর উপন্যাসে যে সব চরিত্র আর ঘটনা গুলো উঠে আসতো তার বেশীর ভাগই আমাদের সমাজ এবং পারিবারিক জীবনের উপাখ্যান থেকেই। বস্তুত: কিছু কল্পনা বিলাসী মানুষের অদ্ভুত চিন্তা গুলোকেই তিনি সন্নিবেশিত করতেন। তিনি নিজেও ছিলেন কল্পনা বিলাসী মানুষ, তবে বাস্তবতা বিবর্জিত অপরিমার্জিত নন। প্রতিটি মানুষের মাঝেই তা কম-বেশী থাকে। কেউ প্রকাশ করে, অঘটনঘটনপটিয়সী হয়, কেউ চুপসে থাকে। মজার ব্যাপার হলো, আমাদের সমাজের অধিকাংশের মনেই রেখাপাত করতো তাঁর উপন্যাসের চরিত্র গুলো। কল্পনা বিলাসী মন গুলো আরোও বিলাসী হয়ে উঠতো। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় হুমায়ুন আহমেদ তাঁর সমসাময়িক কালের তরুনমনে তাঁর আস্থাশীল অন্তরস্থ অবয়বের একটি ছায়া সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। আমি ব্যক্তিগত ভাবে হুমায়ুন সাহিত্যে পারদর্শী নই কিংবা অগাধ বিচরণও নেই, কিন্তু পরিবার থেকে শুরু করে উঠতি সমাজে তাঁর একটা অন্তরাত্মার ছায়া চিহ্ন যেনো পাই।

একদিন এক সান্ধ্য আড্ডায় স্যার হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন উপস্থিত সবাইকে, “আচ্ছা বলতো, আল্লাহ-পাক কাকে বেহেস্তের জন্যে অগ্রাধিকার দেবেন? যিনি একজন নামাজী, পরহেজগার নিষ্কলুষ মানুষ তাকে নাকি এমন কাউকে যিনি অজস্র মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন?” উপস্থিত অভ্যাগতেরা স্পষ্ট দুভাগে ভাগ হয়ে গেলেন। কিন্তু স্যারের স্পষ্ট উক্তি ছিলো, “কোরানের ভাষ্যমতে যিনি আল্লাহ-পাকের সৃষ্টির সেবা করেন, আল্লাহ-পাক তাকে বেহেস্ত নসীব করবেন। স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিং এমন মানুষদের একজন।“ এ নিয়েও উপস্থিতদের মাঝে গুঞ্জন শুরু হলে তিনি বিষয়টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞেস করবেন বলে জানিয়েছিলেন। ইমাম সাহেব তাঁকে কি জবাব দিয়েছিলেন তা আমার আর জানা হয়নি, তবে ঘটনাটি থেকে আমার মনে হতো ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যাপক হুমায়ুন আহমেদ এর ভেতরে দ্বন্দ্ব কাজ করতো। সাদা মাটা পারিবারিক জীবনের ঘটনা প্রবাহ যেরকম, ঠিক সেরকম ভেতরের সুপ্ত উচ্ছ্বাসটাকে উস্কে দিয়ে সাদামাটা ভাবেই তুলে আনতে পারতেন। ফলে সাধারণ ঘটনা গুলো হয়ে উঠতো অসাধারণ অর্থাৎ লুকিয়ে থাকা সুপ্ত আকাঙ্ক্ষাটাকে সাধারণ্যে জাগিয়ে দিতেন। যার জন্যে কাউকে কাউকে আমরা হিমু হয়ে উঠতে দেখি! এখানেই হুমায়ুন অহমেদ এর সফলতা। আজ ১৯শে জুলাই। গতবছর এদিনেই আমাদের এই কথা সাহিত্যিক বিদায় নিয়েছিলেন চির প্রস্থানের পথে। দেখতে দেখতে পেড়িয়ে গেলো একটি বছর। কিন্তু স্যার এর সেই কথাটি আমি আজও ভুলিনি, কাউকে অভিগ্রহণ করতে হলে “নৈতিক শক্তির দরকার হয়“। পরম শ্রদ্ধায় আজ আমি তাঁকে স্মরণ করছি।