মীজান ভাই (অধ্যাপক মীজান রহমান)কে  মুক্তমনা ব্লগে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেবার কিছু নেই। তিনিই সম্ভবতঃ বাংলা ব্লগস্ফিয়ারের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্লগার। বাংলাদেশের যে কয়জন একাডেমিয়ার সাথে যুক্ত শিক্ষাবিদ আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছেন, বাংলাদেশকে পরিচিত করতে পেরেছেন দর্পভরে বিশ্বের অঙ্গনে, তার মধ্যে মীজান রহমান অন্যতম। সেই ১৯৬৫ সালে কানাডার অটোয়াস্থ কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যোগ দিয়েছিলেন, সেখানে একটানা তেত্রিশ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের গণিতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সেরা শিক্ষকের সম্মান সহ বহু সম্মানেই তিনি ভূষিত হয়েছেন। তিনি গতবছর একটি চমৎকার বই লিখেছেন ‘শূন্য’ নামে। কেউ যদি গণিতের শূন্য নামের মহিমায় আচ্ছন্ন হতে চান, বইটি তাকে পড়তে হবে।

বলতে ভাল লাগছে, শ্রদ্ধেয় মীজান রহমানের সাথে একটা গুরুত্বপূর্ণ বই লেখায় হাত দিয়েছি। মহাবিশ্বের উৎপত্তির প্রান্তিক ধারণাগুলো নিয়ে হবে এই বই। মীজান রহমান যেমন গণিতের শূন্যতা নিয়ে লেখালিখি করেছেন, আমারও আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল শূন্যতা; তবে সেটা গণিতের নয় পদার্থবিজ্ঞানের শূন্যতা। শূন্যতার পুরো  ব্যাপারটি শুধু গণিতবিদদের নয়, আধুনিক জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণারও সজীব একটি ক্ষেত্র। স্টিফেন হকিং, স্টিফেন ওয়েনবার্গ, অ্যালেন গুথ, আঁদ্রে লিণ্ডে, আলেকজাণ্ডার ভিলেঙ্কিন এবং লরেন্স ক্রাউস সহ মূলধারার প্রায় সকল পদার্থবিজ্ঞানীরা আজ মনে করেন, আধুনিক স্ফীতিতত্ত্ব অনুযায়ী কোয়ান্টাম স্তরে ‘শূন্যতা’র মধ্য দিয়ে এক সময় মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিল, এবং ব্যাপারটা অসম্ভব কিছু নয়। এ নিয়ে আমি বেশ কিছু লেখা লিখেছি বাংলায়।  সেগুলো গ্রন্থিত করে মীজান রহমানের সাথে বই লেখার প্রয়াস নেয়া হয়েছে।  দেখা যাক।  বইয়ের নাম ধাম এখনো ঠিক করা হয়নি, তবে ফেসবুকে একটা পেইজ করে রাখা হয়েছে ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব : মহাবিশ্বের উৎপত্তির সাম্প্রতিক ধারণা’।  আশা করছি সেখান থেকে বইটার ব্যাপারে সর্বশেষ তথ্য পেতে পারবেন পাঠকেরা ।  

এই বইটা লিখতে গিয়ে নতুন করে মহাবিশ্বের ইতিহাস ঝালাই করতে হচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে বিগ ব্যাং এর উপর পড়লাম। কত নতুন ঘটনাই যে জানলাম, আর শিহরিত হয়ে উঠলাম রোমাঞ্চে।  ভাবছি এ নিয়ে দুই পর্বের সিরিজ লিখব। প্রথম পর্বে থাকবে চিরায়ত  বিগ ব্যাং এর ধারনা এবং এর পেছনের ইতিহাস। পরের পর্বে আসবে স্ফীতিতত্ত্ব সহ বিগ ব্যাং পরবর্তী আধুনিক ধারনাগুলো। আশা করছি পাঠকেরা সাথে থাকবেন।

 পর্বগুলো বইয়ের অধ্যায়ের  কথা মাথায় রেখে লেখা বলে আকারে বড়। ব্লগ হিসেবে পড়তে হয়তো পাঠকদের গলদঘর্ম হতে হবে। এই অসুবিধার জন্য আমার তরফ থেকে দুঃখপ্রকাশ করছি।

আরেকটি ব্যাপার। দীর্ঘদিন কারাবাসের পর মুক্তমনা ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীন আজ জামিন পেয়েছেন (এ ব্যাপারে বিপ্লব রহমানের পোস্ট দ্রঃ)। গত পয়লা এপ্রিল জামাতি আর হেফাজতি মোল্লাদের তোষামোদ করতে গিয়ে যেভাবে সরকারের পক্ষ থেকে প্রগতিশীল ব্লগারদের হাতকড়া পরিয়ে পাকড়াও করা হয়েছিল, তা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়। এর পর থেকেই আমরা চেষ্টা করেছি ব্লগারদের মুক্ত করতে। শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বব্যাপী। আমাদের সে আহবানে সাড়া দিয়ে সারা বিশ্বের মুক্তচিন্তক আর মানবতাবাদীরা রাস্তায় নেমেছেন প্ল্যাকার্ড হাতে। অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, সিএফআই, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস সহ বহু সংগঠনই বিবৃতি দিয়েছিল সরকারের বাক স্বাধীনতার উপর এই আগ্রাসনের প্রতিবাদে। আমি নিজেও বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলাম আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়। আর বাংলাদেশে ব্লগার এবং অ্যাক্টিভিস্টরা তো কয়েক দফা করে পথে নেমেছেন। কৃতজ্ঞতা জানাই সবাইকে যারা আসিফের এই কঠিন সময়গুলোতে পাশে ছিলেন, আশার খোরাক যুগিয়েছিলেন। আমার এই সিরিজটি আসিফের জন্য উৎসর্গীকৃত হচ্ছে।
:line:

 

মহাবিস্ফোরণের কথা

অভিজিৎ রায়

 

 

আমরা সবাই নক্ষত্রের সন্তান

মহাবিশ্ব সংক্রান্ত যে কোন বিজ্ঞানের বই খুললেই আমরা দেখি সেটা অবধারিতভাবে শুরু হয় বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ দিয়ে। সেই যে ১৯২৯ সালে এডউইন হাবল তার বিখ্যাত টেলিস্কোপের সাহায্যে আকাশের গ্যালাক্সিগুলোর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন গ্যালাক্সিগুলো একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে – তা দেখেই কিন্তু এক ধরণের ধারনা পাওয়া যায়, দূর অতীতে নিশ্চয় তারা খুব কাছাকাছি ছিল, খুব ঘন সন্নিবদ্ধ অবস্থায় গাঁটবন্দি হয়ে। আর সেই গাঁট-পাকানো অবস্থা থেকেই সবকিছু চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে আকস্মিক এক বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। এটাই সেই বিখ্যাত ‘বিগ ব্যাং’- এর ধারণা। এ ধারণা অনুযায়ী, প্রায় ১৩৭০ কোটি বছর আগে অতি উত্তপ্ত এবং প্রায় অসীম ঘনত্বের এক পুঞ্জিভূত অবস্থা থেকে এক বিশাল বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে উদ্ভব ঘটেছে আমাদের এই চিরচেনা মহাবিশ্বের ।

 

অবশ্য আজকে আমরা মহাবিশ্বকে যেভাবে দেখি, মহাবিশ্বের ঊষালগ্নে এর প্রকৃতি কিন্তু একদমই এরকম ছিল না, ছিল অনেকটাই আলাদা। আজকে আমরা যে চারটি মৌলিক বলের কথা শুনতে পাই – সবল নিউক্লিয় বল, দুর্বল নিউক্লিয় বল, তাড়িতচৌম্বক বল এবং মাধ্যাকর্ষণ বল – বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, এই চারটি বল ‘সুপার ফোর্স’ বা অতিবল হিসেবে একসাথে মিশে ছিল।  ওরকম ভাবেই ছিল তারা মহাবিস্ফোরণের ঊষালগ্ন থেকে শুরু করে ১০-৪৩ সেকেন্ড পর্যন্ত। প্রথম এক সেকেন্ড পর্যন্ত মহাবিশ্ব ছিল যেন জ্বলন্ত এক নিউক্লিয় চুল্লি।  তাপমাত্রা ছিল একশ কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের চেয়েও বেশি। সেসময় কোন চেনা জানা কণা ছিল না, চারদিক পূর্ণ ছিল কেবল প্লাজমার ধোঁয়াশায়। এক সেকেন্ড পরে কোয়ার্ক, ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রনের মত মৌলিক কণিকাগুলি তৈরি হয়। তিন সেকেন্ড পরে প্রোটন আর নিউট্রন মিলে তৈরি হল নিউক্লিয়াস, এর পরে যথাক্রমে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, লিথিয়াম। কিন্তু মহাবিশ্বের উদ্ভবের প্রায় কয়েক লক্ষ বছর পর্যন্ত আমরা যাকে জড়পদার্থ বা ম্যাটার বলি সেরকম কিছুই তৈরি হয় নি। তখন আসলে রঞ্জন রশ্মি, আর বেতার তরঙ্গের মত লম্বা দৈর্ঘ্যের অতি তেজী রশ্মিগুলোই বরং পদার্থের উপর রাজত্ব করছিল। প্রায় চার লক্ষ বছর পরে তাপমাত্রা খানিকটা কমে তিন হাজার ডিগ্রি কেলভিনে নেমে আসার পরই কেবল প্লাজমা থেকে স্থায়ী অণু গঠিত হবার মত পরিবেশ তৈরি হতে পেরেছে। এসময়  মহাবিশ্বের কুয়াশার চাদর ধীরে ধীরে সরে গিয়ে  ক্রমশ  স্বচ্ছ হয়ে আসে, পথ তৈরি হয় ফোটন কণা চলাচলের। আর তার পরই কেবল তেজস্ক্রিয় রশ্মিসমূহের উপর জড়-পদার্থের আধিপত্য শুরু হয়েছে। এর পর আরও প্রায় একশ কোটি বছর লেগেছে গ্যালাক্সি জাতীয় কিছু তৈরি হতে। আর আমাদের যে গ্যালাক্সি, যাকে আমরা আকাশগঙ্গা নামে ডাকি, সেখানে সূর্যের সৃষ্টি হয়েছে আজ থেকে প্রায় পাঁচশত কোটি বছর আগে। আর সূর্যের চারপাশে ঘূর্ণ্যমান গ্যাসের চাকতি থেকে প্রায় ৪৫০-৪৬০ কোটি বছরের মধ্যে তৈরি হয়েছিল পৃথিবী সহ অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহগুলো।

চিত্র: মহাবিস্ফোরণের কালপঞ্জি (ছবির কৃতজ্ঞতা :অপূর্ব এই মহাবিশ্ব, এ এম হারুন-অর-রশীদ এবং ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী)

এই জায়গায় এসে একটি  মজার তথ্য উল্লেখ করব, আর তথ্যের  অভিব্যক্তিটি এতোই শক্তিশালী যে, এটা আমাদের মত কাঠখোট্টা বিজ্ঞান লেখকদেরও কাব্যিক করে তোলে প্রায়শই। বিষয়টা হল – বিগ ব্যাং থেকে সবকিছুর শুরু বলে আমরা জানি। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, মহাবিস্ফোরণের পর মুহূর্তে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম কিংবা লিথিয়ামের মত মৌল তৈরি হলেও আমাদের জীবনের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যে মৌলগুলো – কার্বন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন এবং লৌহ – এগুলো কিন্তু সে সময় তৈরি হয়নি। এগুলো তৈরি হয়েছে অনেক অনেক পরে কোন না কোন নাক্ষত্রিক বিস্ফোরণ থেকে, যাদের আমরা মহাকাশে সুপারনোভা বলে জানি। ‘অনেক অনেক পরে’  বলছি কারণ, বিজ্ঞানীরা গণনা করে দেখেছেন, প্রথম নক্ষত্র তৈরি হয়েছিল বিগ ব্যাং ঘটার অন্তত ৭৫ কোটি বছর পরে। আর তারকার  বিস্ফোরণ – মানে সুপারনোভার মত ব্যাপার স্যাপার ঘটতে সময় লেগেছিল আরো অনেক। তবে যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল – আমাদের এই দেহ কার্বন দিয়ে, কিংবা দেহের ভিতরকার হাড়গুলো ক্যালসিয়াম দিয়ে তৈরি হতে পেরেছে হয়তো এ জন্যই – কেননা সুদূর অতীতে কোন না কোন নক্ষত্র নিজেদের বিস্ফোরিত করে তার বহির্জগতের খোলস থেকে এই জীবনোপযোগী মৌলগুলো ছড়িয়ে দিয়েছিল মহাশূন্যে। অনেক পরে সেই মৌলগুলো শূন্যে ভাসতে ভাসতে জড়ো হয়েছে সূর্য নামক এক সাদামাঠা নক্ষত্রের চারপাশে ঘূর্ণনরত এক সুনীল গ্রহে, এবং শেষ পর্যন্ত তৈরি করেছে প্রাণের বিবর্তনীয় উপাদান। আমাদের ছায়াপথের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে অন্তত ২০ কোটি নক্ষত্র এভাবে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে, হয়তো আমার আপনার ভবিষ্যৎ জন্মকে সার্থক করে তুলবে বলে। আমরা সবাই আসলে নক্ষত্রের ধূলি – স্টারডাস্ট[1]। এর চেয়ে কাব্যিক অনুরণন আর কীই বা হতে পারে? সেজন্যই বোধ হয় লরেন্স ক্রাউস তার ‘ইউনিভার্স ফ্রম নাথিং’ গ্রন্থে বলেছেন[2],

‘আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে সবচেয়ে কাব্যিক যে সত্যটা আমি জানি তা হল, আপনার দেহের প্রতিটি অণু পরমাণু একসময় লুকিয়ে ছিল একটি বিস্ফোরিত নক্ষত্রের অভ্যন্তরে। অধিকন্তু, আপনার বাম হাতের পরমাণুগুলো হয়তো এসেছে এক নক্ষত্র থেকে, আর ডান হাতের গুলো এসেছে ভিন্ন আরেকটি নক্ষত্র থেকে। আমরা আক্ষরিক ভাবেই সবাই নক্ষত্রের সন্তান, আমাদের সবার দেহ তৈরি হয়েছে কেবল নাক্ষত্রিক ধূলিকণা দিয়ে’।

  চিত্র: আমরা আক্ষরিক ভাবেই সবাই নক্ষত্রের সন্তান, আমাদের সবার দেহ তৈরি হয়েছে কেবল নাক্ষত্রিক ধূলিকণা দিয়ে।

 

রসিকরাজ গ্যামো ভাঁড়

ছোটবেলায় আমরা গোপাল ভাঁড়ের অনেক গল্প পড়তাম। গোপাল ভাঁড়ের একেকটা গল্প পড়তাম আর হাসির চোটে আমাদের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যেত একেবারে। কিন্তু তখন কি কস্মিন কালেও জানতাম, গোপাল ভাঁড়ের চেয়েও রসিক এক বিজ্ঞানী আছেন, তার অবদানের কথা উল্লেখ না করলে বিগ ব্যাং এর ইতিহাসটা অসম্পূর্ণই থেকে যাবে!

 

তিনি জর্জ গ্যামো। আমরা যে বিগ ব্যাং এর কথা বলি সেই বৈজ্ঞানিক ধারণাটি বিজ্ঞানের জগতে প্রতিষ্ঠিত করার প্রাথমিক কৃতিত্ব অবশ্যই এই কৃতি পদার্থ বিজ্ঞানীর; তাঁর বিস্ময়কর প্রতিভার স্পর্শ কেবল পদার্থবিদ্যা নয়, জ্যোতির্বিজ্ঞান, তেজস্ক্রিয়তা থেকে শুরু করে এমনকি জীববিজ্ঞানেরও নানা শাখায় ছড়িয়ে রয়েছে। রুশ-দেশের এই রসিক আর খেয়ালী বিজ্ঞানী, যিনি আবার শখের যাদুকরও ছিলেন, প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে একক চেষ্টাতেই বলা যায় ‘বিগ-ব্যাং’র ধারণাকে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেজন্য অনেকে  আজ তাকে অভিহিত করেন ‘বিগ ব্যাং এর পিতা’ হিসেবেও।

 

গ্যামোর আদি নিবাস ছিল রাশিয়ায়। আমরা যে ফ্রিডম্যানের কথা জানি, যিনি এক সময় আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের গাণিতিক সমাধান হাজির করেছিলেন মহাবিশ্বের প্রসারণ তুলে ধরতে, সেই আলেকজান্ডার ফ্রিডম্যান ছিলেন এক সময় গ্যামোর শিক্ষক, পড়াতেন পেট্রোগ্রাডে ১৯২৩ -২৪ সালের দিকে[3]। বোঝাই যায় গুরু মারা বিদ্যা ভালই রপ্ত করেছিলেন গ্যামো।

 

গ্যামোর প্রতিভার বর্ণিল আলোকচ্ছটার সাথে রাশিয়ার বাইরের পৃথিবী পরিচিত হয়েছিল সেই ১৯২৮ সালেই। গ্যামো তখন জার্মানির গোটিংগ্যান বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার সাথে পরিচিত হতে। গিয়েছিলেন অনেকটা তার শিক্ষক অরেস্ট কোভলসনের জোরাজুরিতেই। গ্রীষ্মকালীন অবকাশটাতে কৃতি ছাত্রকে যেন উপোষ করে কাটাতে না হয় সেজন্য একটা শিক্ষাভাতাও যোগাড় করে দিয়েছিলেন শিক্ষক মশাই। জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তখন আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের নানামুখী গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু। গ্যামো সেখানে গিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই একটা গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করে ফেললেন।  তেজস্ক্রিয় পদার্থের অবক্ষয়কে ব্যাখ্যার জন্য সুরঙ্গ প্রভাব (‘টানেলিং এফেক্ট’) ব্যবহার করলেন, যা এতদিন কেবল কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জগতেই ব্যবহৃত হত। তার এই নতুন ব্যাখ্যা সরাসরি পরীক্ষণ থেকে হাতে কলমে পাওয়া উপাত্তের সাথে মিলেও গেল অবিকল।

 

গ্রীষ্মকালীন অবকাশ শেষে রাশিয়া ফেরার পথে ভ্রমণপ্রিয় গ্যামো ভাবলেন, ফিরে যখন যাচ্ছিই – একটু না হয় ডেনমার্ক ঘুরে যাওয়া যাক। সেখানে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের দিকপাল নিলস বোর কি করে যেন গ্যামোর তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে কাজের (সেটা তখনো কোথাও প্রকাশিত হয়নি) খোঁজ পেয়েছিলেন।  ডেনমার্কে গ্যামোর সাথে সাক্ষাৎ করে আর তার কাজ সামনাসামনি দেখেশুনে বোর এতটাই মুগ্ধ হন যে, কোপেনহেগেনে তার ইন্সটিটিউটে গ্যামোকে ফেলোশিপের প্রস্তাব দিয়ে দিলেন। গ্যামো মহা উৎসাহে কাজ শুরু করে দিলেন তখনই। কিন্তু গ্যামো চাইলে কি হবে, বাধা আসলো খোদ সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকেই। কিছুদিন বোরের ইন্সটিটিউটে কাজ করার পর গ্যামো তখন (১৯৩০) রোমে নিউক্লীয় পদার্থবিজ্ঞানের এক সেমিনারে যোগদানের পায়তারা করছিলেন। কিন্তু সোভিয়েত অ্যাম্বেসি থেকে বলা হল তার পাসপোর্টের মেয়াদ আর বাড়ানো হবে না, এত জায়গায় ঘোরাঘুরি বাদ দিয়ে তাকে ‘ঘরের ছেলে ঘরে’ মানে সোজা সোভিয়েত ইউনিয়নে ফেরত যেতে হবে।

 

গ্যামো ফিরলেন রুশ দেশে। স্ট্যালিনের জামানা চলছে তখন। গ্যামো নিজ দেশে ফিরে এমন এক জন্মভূমিকে দেখতে পেলেন যেখানে মহামতি স্ট্যালিন এবং তার স্তাবকেরা শিল্প সাহিত্য বিজ্ঞান সবকিছুকেই মার্ক্সিজমের নাগপাশে বন্দি করে রেখেছেন। ধর্মান্ধ এবং প্রতিক্রিয়াশীল রাষ্ট্রের মত সেখানে সাহিত্য সংস্কৃতি সৃষ্টির গৎবাঁধা ছক বাৎলে দেওয়া হয়েছিলো, এর অন্যথা হলে তাদের ‘কমি-ধর্মানুভূতিতে’ আঘাত লাগত।  বাংলা ব্লগের ব্লগারদের লেখায় ধর্মের সমালোচনা,  কিংবা কোন কার্টুনিস্টের কার্টুন আঁকা কিংবা ‘মুহম্মদ বিড়াল’ নিয়ে নির্দোষ কৌতুকেও যেমন  ইসলামের অনুসারীদের পিত্তি জ্বলে যায়, তেমনি স্ট্যালিনকে নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে কমিউনিস্ট অনুসারীদের গায়ে লাল লাল ফোস্কা পড়তো। তার প্রমাণ পাওয়া যায়  ব্যঙ্গাত্মক রচনার জন্য স্ট্যালিনীয় জামানায় সিন্যভস্কি-দানিয়েলের বিচারের প্রহসনে। জেলখানায় সাত বছর বন্দি রাখা হয়েছিলো সিন্যভস্কিকে, দানিয়েলের কপালে জুটেছিলো পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। সলঝনিৎসনের উপন্যাস ‘ফার্স্ট সার্কেল’ (First Circle)-এ দেখানো হয়েছিলো কিভাবে উপন্যাসের নায়ক শেষ পর্যন্ত স্ট্যালিনের শ্রম শিবিরে নিজেকে খুঁজে পায়।  সলঝনিৎসনকে সে সময় দেশ ত্যাগ করতে কিংবা নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। আঁদ্রে শাখারভকে গোর্কিতে নির্বাসন দেওয়া হয়। এই উদাহরণগুলো উল্লেখ করে এক সময় একটা লেখা লিখেছিলাম ‘মার্ক্সবাদ কি বিজ্ঞান?’ (২০০৮) শিরোনামে যা বাংলা ব্লগস্ফিয়ারে পক্ষে বিপক্ষে নানা তর্ক-বিতর্ক এবং আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়েছিল[4]। কেবল সাহিত্য নয়,স্ট্যালিন এবং তার আদর্শবাদী সৈনিকেরা ভাবতেন বিজ্ঞানকেও মার্কসীয় মতবাদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে, নইল চলবে না। মার্কসীয় মতবাদের সংগে সংগতিপূর্ণ করার লক্ষ্যে সময় সময় বিজ্ঞানের শাখাগুলোকে বিকৃত করতেও পিছপা হননি। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শাখাটি ছিল জেনেটিক্স বা বংশগতিবিদ্যা। রাশিয়া একসময় সারা পৃথিবীতেই জেনেটিক্সের গবেষণায় শীর্ষস্থানে ছিলো, অথচ স্ট্যালিনের আমলে রাশিয়ায় জেনেটিক্সের উপর গবেষণার লালবাতি জ্বলে গিয়েছিল। তা হবে নাই বা কেন। মার্ক্সবাদকে বাঁচাতে বংশাণুবিদ্যাকেও বিকৃত করতে পিছপা হননি শাসকেরা। এই উদ্দেশ্যে সেসময় লাইসেঙ্কো নামক এক ঠগ বিজ্ঞানীকে নিয়োগ করা হয়[5]। যখন ভাভিলভ সহ অন্যান্য বিজ্ঞানীরা লাইসেঙ্কোর তত্ত্বের ভুল ধরিয়ে দেন তখন স্ট্যালিন তাদের সবকটাকে ধরে গুলাগে পাঠিয়ে দেন। ভাবিলভকে গুলি করে হত্যা করা হয়। শুধু ভাভিলভ নয়, স্ট্যালিনের প্রতিহিংসার স্বীকার হয়ে সে সময় আরো প্রাণ হারিয়েছিলেন কার্পেচেঙ্কো, সালমোন লেভিট, ম্যাক্স লেভিন, ইস্রায়েল আগলের মত বিজ্ঞানীরা।  লাইসেঙ্কোর পাশাপাশি  স্ট্যালিন জামানায় লেপিশিঙ্কায়া নামের আরেক ঠগ বিজ্ঞানীকে প্রমোট করা হয়েছিল – উদ্দেশ্য সেই  ‘পুঁজিবাদী জেনেটিক্স’ সরানো।  বিজ্ঞানকে অবশ্যই শ্রমজীবী বা প্রলেতারিয়েতের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে, তা নইলে চলবে না – এটাই বিজ্ঞান সম্পর্কে স্ট্যালিনীয় ঘরনার মানুষদের ‘বৈজ্ঞানিক থিওরি’[6]

চিত্র: বিজ্ঞানী জর্জ গ্যামো (১৯০৪ – ১৯৬৮)

কেবল জীববিজ্ঞানী কিংবা বংশগতিবিদেরা নয়, সোভিয়েত পদার্থবিদরাও  সে সময় আগ্রাসন থেকে রেহাই পাননি[7]। আইনস্টাইন আপেক্ষিক তত্ত্ব প্রদান করার পর, ব্যাপারটা মার্ক্সিজমের সাথে ‘সংগতিপূর্ণ’ মনে না করায় ‘সোভিয়েত এনসাইক্লোপিডিয়া’ প্রকাশ করা হয় রিলেটিভিটিকে ‘নস্যাৎ’ করে। রাশিয়ার একজন বিখ্যাত মার্ক্সবাদী দার্শনিক তার তখনকার লেখায় বলেছিলেন –

‘আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ এটা প্রোলেতারিয়েতদের কাছে গ্রহণীয় নয়’।

এই নির্বোধ মন-মানসিকতা জর্জ গ্যামোর সহ্য হয়নি। তা হবেই বা কেন। কিছুদিন আগেই নিলস বোরের গবেষণাগারে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার উপর হাতে কলমে কাজ করে এসেছেন। অথচ দেশে এসে দেখলেন, সেখানে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা আর আপেক্ষিক তত্ত্বকে দেখা হচ্ছে ‘অপবিজ্ঞান’ আর ‘মার্ক্সিজম-লেনিনিজম’ এর সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ বিষয় হিসেবে[8]।  এই সব কূপমণ্ডূকতার প্রতিবাদ করায় জর্জ গ্যামো স্ট্যালিনীয় বাহিনীর কোপানলে পড়লেন। হয়তো মারাই পড়তেন ভাভিলভের মত, কিংবা বছরের পর বছর থাকতে হত শ্রম-শিবিরে, কিন্তু তার আগেই তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন ছেড়ে  সস্ত্রীক পালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।

চিত্র: এ ধরণের একটি কায়াকে করেই স্ত্রীকে নিয়ে কৃষ্ণ সাগর পাড়ি দিয়ে রাশিয়া থেকে পালাতে মনস্থ করেছিলেন গ্যামো।

 

কিভাবে পালালেন সেও এক ইতিহাস। শুনলে মনে হবে যেন কোন হিন্দি মুভির প্লট।  তিনি কয়েকটা ডিম, চকলেট, স্ট্রবেরি এবং দুই বোতল ব্র্যাণ্ডি বগলদাবা করে সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে একটা ছোট নৌকায় (এ নৌকাগুলো কায়াক নামে পরিচিত) উঠে পড়লেন। উদ্দেশ্য কৃষ্ণ সাগরে ১৭০ মাইল পাড়ি দিয়ে তুরস্ক পৌঁছবেন।  প্রায় ৩৬ ঘণ্টা প্যাডেল করে সাগরের বিশাল বিশাল ঢেউ এর সাথে যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত নাকানি চুবানি খেয়ে মাঝপথে তীরে এসে আছরে পড়লেন। হাসপাতালেও থাকতে হয়েছিল দিন কয়েক। সে যাত্রা দেশ ছেড়ে পালাতে না পারলেও এক সময় ঠিকই সুযোগ বুঝে  ব্রাসেলস হয়ে আমেরিকা চলে আসলেন। যোগ দিলেন জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে, শিক্ষক হিসেবে।

 

সেখানেই রালফ আলফারের সাথে তার পরিচয়। আলফার ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন পিএইচডি করার জন্য। আলফারের সাথে সাথে মিলে ‘বিগ-ব্যাং’র ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করেন গ্যামো। হাবলের মহাবিশ্বের প্রসারণ সূচক বিখ্যাত আবিষ্কারের সাথে তিনি পরিচিত তো ছিলেনই। সেই প্রসারণের ভিডিও টেপটিকে যদি পেছনের দিকে চালানো যায়, তবে সেটা নিশ্চয় একটা আদিম অবস্থায় এসে থামবে। তিনি এর নাম দিলেন ‘ইয়েল্‌ম’। সেই আদিম অবস্থারই গাণিতিক সিমুলেশন করবেন বলে তারা ঠিক করেন।

 

মজার ব্যাপার হচ্ছে গ্যামো বা আলফার কেউ নিজে থেকে ‘বিগ ব্যাং’ শব্দটি চয়ন করেন নি। গ্যামোর ধারণাকে খণ্ডন করতে গিয়ে আর এক প্রখ্যাত তাত্ত্বিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রেডারিক হয়েল সর্ব প্রথম এই বিগ-ব্যাং শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। হয়েল ছিলেন বিগ-ব্যাং তত্ত্বের বিপরীতে স্থিতিশীল অবস্থা (Steady State) নামে মহাবিশ্বের অন্য একটি জনপ্রিয় মডেলের প্রবক্তা। হয়েলের তত্ত্বের সাথে প্রথম দিকে যুক্ত ছিলেন কেম্ব্রিজ কলেজের হারমান বন্দি, থমাস গোল্ড আর পরবর্তীকালে একজন ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী, তাঁর নাম জয়ন্ত নারলিকর। ১৯৪০ সালে একটি রেডিও প্রোগ্রামে হয়েল গ্যামো আর তাঁর অনুসারীদের ধারণাকে খণ্ডন করতে গিয়ে বেশ বাঁকা সুরেই অধ্যাপক হয়েল বলেছিলেন, ‘হাঃ সেই উত্তপ্ত বিগ ব্যাং’ – এই বিস্ফোরণের ধারণা যদি সঠিকই হবে, তবে তো এর ছাই-ভস্ম এখনও কিছুটা থেকে যাওয়ার কথা। আমাকে ‘বিগ ব্যাং’ এর সেই ফসিল এনে দেখাও, তার পর অন্য কথা।’ এর পর থেকেই বিগ-ব্যাং শব্দটি ধীরে ধীরে বিজ্ঞানের জগতে স্থায়ী আসন করে নেয়। সে যাই হোক, আলফারের পিএচডি’র শেষ পর্যায়ে আলফার ও গ্যামো যুক্তভাবে ‘Physical Review’ জার্নালের জন্য ‘Origin of the Chemical Elements’ শিরোনামে একটি গবেষণা নিবন্ধ লিখতে শুরু করলেন। আর এখানেই রসিকরাজ গ্যামো বিজ্ঞান জগতের সবচাইতে বড় রসিকতাটি করে বসলেন। জার্নালে ছাপানোর আগে তিনি তাঁর বন্ধু আর এক স্বনামখ্যাত পদার্থবিদ হ্যানস বিথের (কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়, নিউইয়র্ক) নাম তাঁকে না জানিয়েই প্রবন্ধটির লেখক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে নেন। পরে কারণ হিসেবে বলেছিলেন, “ ‘আলফার’ আর ’গ্যামো’- এই দুই গ্রীক ধরণের নামের মাঝে ‘বিটা’ জাতীয় কিছু থাকবে না, এ হয় নাকি? তাই বিথেকে দলে নেওয়া!”   সত্য সত্যই ১৯৪৮ সালের ১লা এপ্রিলে এই তিন বিজ্ঞানীর নামে প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল, আর গ্যামোর রসিকতাকে সত্যি প্রমাণিত করে পেপারটি এখন ‘আলফা-বিটা-গামা পেপার’ ( α-β-γ paper) নামেই বৈজ্ঞানিক মহলে সুপ্রতিষ্ঠিত।

 

কিন্তু সেই প্রবন্ধটিতে কি বলেছিলেন গ্যামো? তিনি ধারণা করেছিলেন যে, একটি মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে যদি মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে সেই ভয়ঙ্কর বিকিরণের কিছুটা স্বাক্ষর, মানে বিকিরণ-রেশের কিছুটা এখনও বজায় থাকার কথা। গ্যামো হিসেব কষে দেখালেন যে, সৃষ্টির আদিতে যে তেজময় বিকিরণের উদ্ভব হয়েছিল, মহাবিশ্বের প্রসারণের ফলে তার বর্ণালী তাপমাত্রা হ্রাস পেতে পেতে সেটা এখন পরম শূন্য তাপমাত্রার উপরে ৫ ডিগ্রি কেলভিনের মত হওয়া উচিত। এই তেজময় বিকিরণের অবশেষকেই বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘মহাজাগতিক পশ্চাৎপট বিকিরণ’ বা ‘cosmic back ground radiation’। মহাশূন্যে এই বিকিরণের প্রকৃতি হবে মাইক্রোওয়েভ বা ক্ষুদ্র তরঙ্গ। সহজ কথায় বিষয়টি বুঝবার চেষ্টা করা যাক। সৃষ্টির আদিতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ছিল যেন একটি উত্তপ্ত মাইক্রোওয়েভ চুল্লি যা এখন ঠাণ্ডা হয়ে ৫ ডিগ্রি কেলভিনে এসে পৌঁছেছে। এই ব্যাপারটিই ধরা পড়ল ১৯৬৪ সালে আর্নো পেনজিয়াস আর রবার্ট উইলসনের পরীক্ষায়, গ্যামোর গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হবার ১৬ বছর পর। গ্যামোর সেই গবেষণাপত্রটির কথা ততোদিনে ভুলেই গিয়েছিল সবাই। কিন্তু সেখানে যাবার আগে আমাদের আরেকজন জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানীর  কথা  জেনে নেওয়া প্রয়োজন।

 

জর্জ লেমিত্রি এবং তাঁর ‘আদিমতম কণা’

বিগ ব্যাং-এর কথা বললে এর পেছনে আরেকজন ব্যক্তির অবদানের কথা উল্লেখ না করলে তাঁর প্রতি নিতান্তই অবিচার করা হবে। তিনি হলেন জর্জ হেনরি লেমিত্রি (Georges Lemaître), বিগ ব্যাং তত্ত্বের আর একজন প্রবক্তা- যিনি ছিলেন একাধারে পদার্থবিজ্ঞানী এবং সেই সাথে ধর্মযাজক।   নাস্তিক গ্যামোর মত ধর্মযাজক লেমিত্রিও কিন্তু  বিগ ব্যাং-এর পিতা খেতাব পাবার যোগ্য দাবীদার,এবং অনেকে সেটা তাকে ডাকেনও।

আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা থেকে প্রাপ্ত ক্ষেত্র সমীকরণের একটা সমাধান হাজির করেছিলেন লেমিত্রি, বিজ্ঞানী ফ্রিডম্যানের মতোই।  গ্যামোর মতো তিনিও ছিলেন মহাজাগতিক কালপঞ্জির এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তিনি তার শিক্ষাজীবন শুরু করেছিলেন প্রকৌশলী (পুরকৌশলী) হিসেবে, বেলজিয়ামের ক্যাথলিক লুভেন বিশ্ববিদ্যালয়ে।  কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময় জার্মান সৈন্যরা বেলজিয়াম আক্রমণ করলে তার পড়াশোনায় সাময়িক ছেদ পড়ে।  তিনি ‘আর্টিলারি অফিসার’ হিসেবে বেলজীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন আর সেখানে কাজ করেন চার বছরের জন্য। বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি সিভিল ইঞ্জিয়ারিং-এ আর না ফিরে গিয়ে পদার্থবিদ্যা এবং গণিত নিয়ে উৎসাহী হয়ে পড়েন তিনি। ১৯২০ সালে অর্জন করেন পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি।  পাশাপাশি ধর্মযাজকের পেশায়ও উৎসাহী হয়ে পড়েন তিনি।  তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘সত্যে পৌঁছনোর দুইটি পথ। আমি দুটোই অনুসরণ করতে মনস্থ হলাম’।

 

পরবর্তী বছরগুলোতে তিনি সে সময়কার বিখ্যাত বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটনের সাহচর্য লাভ করেন কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এডিংটন তার গাণিতিক দক্ষতা এবং পদার্থবিজ্ঞানের জ্ঞানে মুগ্ধ হয়েছিলেন। এডিংটন তার সম্বন্ধে বলেছিলেন, ‘তুখোড় এক ছাত্র –  করিৎকর্মা, স্বচ্ছ দৃষ্টিসম্পন্ন এবং গনিতে দক্ষ’।  লেমেত্রি এক সময় কেম্ব্রিজের পাঠ চুকিয়ে চলে গেলেন আমেরিকায়।  এমআইটিতে করলেন পদার্থবিজ্ঞানে দ্বিতীয় বারের মতো পিএচডি।

 

১৯২৫ সালে তিনি বেলজিয়ামে ফিরে গিয়ে তার পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে যোগ দিলেন। সেখানেই তিনি আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বের সমীকরণের উপর ভিত্তি করে নিজের মহাজাগতিক মডেল তৈরি করে ফেললেন।  তার সমাধান ছিল অনেকটা পূর্বসূরি ফ্রিডম্যানের মতোই। এ সমাধানে মহাজাগতিক ধ্রুবক গোনায় ধরার দরকার পড়েনি তার।  তার সমাধান থেকে বেরিয়ে আসলো মহাবিশ্ব ক্রমশঃ প্রসারিত হচ্ছে।  শুধু তাই নয়, সময়ের ঘড়িকে পেছনের দিকে চালিয়ে তিনি একদম শুরুর মানে ব্রাহ্ম-মুহূর্তের একটা ছবিও আঁকলেন তার গণিত আর বিজ্ঞানের কল্পনায়,  কাব্যিক ভাবে সে সময়টাকে অভিহিত করলেন ‘A Day without  yesterday’ হিসেবে। তিনি এই মহাবিশ্বের সমস্ত গ্রহ, নক্ষত্র, নীহারিকাকে চেপে ঠেসে ঘন সন্নিবদ্ধ এক ছোট্ট মহাবিশ্বে পরিণত করলেন, আর তার নাম দিলেন  ‘প্রাইমিভাল এটম’  বা আদিম কণা নামে।  লেমেত্রির কাছে মহাবিশ্ব সৃষ্টির ব্যাপারটা ছিল সেই আদিম কণা নামের শক্তিশালী তেজস্ক্রিয় কণাটির অবক্ষয়, যা থেকেই তৈরি  তৈরি হয়েছে এই বিশ্বজগত[9]

 

লেমেত্রি তার  আদিম কণা তত্ত্ব আর মহাবিশ্বের প্রসারণের ব্যাপারে মহা উৎসাহী হয়ে উঠলেলেও তার উৎসাহের বেলুন কিন্তু রাতারাতি চুপসে গেল।  আর চুপসে দিয়েছিলেন আইনস্টাইন স্বয়ং।  আইনস্টাইনের মাথায় তখন ‘স্থিতিশীল মহাবিশ্বের’ ভুত। তার নিজের সমীকরণেই মহাবিশ্বের প্রসারণের ইঙ্গিত লুকিয়ে থাকলেও  মহাজাগতিক ধ্রুবক ঢুকিয়ে সেটাকে স্থিতিশীল রূপ দিয়ে রেখেছেন তিনি। ফ্রিডম্যান কিংবা লেমেত্রি, যারাই  মহাজাগতিক ধ্রুবকের বাইরে গিয়ে সমাধান হাজির করছেন, তাদেরকে কান মলে দিয়ে বাতিল করে দিচ্ছেন। তাই ১৯২৭ সালে ব্রাসেলসের একটা সেমিনারে লেমিত্রি যখন তার মহাজাগতিক মডেল আইনস্টাইনের সামনে তুলে ধরলেন, আইনস্টাইন বিনা বাক্য ব্যয়ে বাতিল করে দিলেন এই বলে – ‘তোমার ক্যালকুলেশন ঠিকি আছে, কিন্তু তোমার ফিজিক্সটা তো বাপু জঘন্য’।

চিত্র: আইনস্টাইন এবং লেমিত্রি

 

কিন্তু আইনস্টাইনের ভুল ভাঙতে সময় লাগেনি। ১৯২৯ সালে হাবল যখন মাউন্ট উইলসন মানমন্দির থেকে সে সময়কার ১০০ ইঞ্চি ব্যাসের সবচেয়ে বড় টেলিস্কোপের (হুকার প্রতিফলক) সাহায্যে প্রমাণ হাজির করলেন যে মহাবিশ্ব আসলে প্রসারিত হচ্ছে,  তখন কিন্তু আইনস্টাইনই ভুল প্রমাণিত হলেন, আর লেমেত্রি হলেন সঠিক।

 

লেমেত্রি নিঃসন্দেহে খুশি হয়েছিলেন। নিজের তত্ত্বের স্বপক্ষে প্রমাণ পেলে কার না খুশি লাগে। কিন্তু লেমেত্রি যত না খুশি হলেন, ধর্মের চিরন্তন ধ্বজাধারীরা মনে হয় খুশি হলেন তার চেয়েও ঢের বেশি। তারা বাইবেলের জেনেসিস অধ্যায়ের সাথে এর মিল খুঁজতে শুরু করলেন, আর ‘বিগ ব্যাং’ কিংবা আদি কণাকে হাজির করলেন  ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে।  যেমন ১৯৫১ সালে  পোপ (Pope Pius XII) বলেছিলেন –

‘আজকে বিজ্ঞান শতাব্দী পাড়ি দিয়ে একটি জায়গায় পৌঁছেছে যখন সেই আদিম ফিয়াট লাক্স (লেট দেয়ার বি লাইট)কে অবলোকন করার মত পরিস্থিতি এসেছে – যে আদিম অবস্থা থেকে  আলো এবং শক্তির বিকিরণ ঘটেছে, আর উৎক্ষিপ্ত কণাগুলো দ্বিখণ্ডিত আর চূর্ণ হয়ে লক্ষ কোটি ছায়াপথে পরিণত হয়েছে।  কাজেই সুদৃঢ় বৈজ্ঞানিক কাঠামো থেকে পাওয়া ফলাফলের মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত যে, এই মহাবিশ্বের শুরু  হয়েছিল সৃষ্টিকর্তার হাতে। যদি সৃষ্টির শুরু থাকে, তবে অবশ্যই এই সৃষ্টির একজন স্রষ্টাও রয়েছে, আর সেই স্রষ্টাই হলেন ঈশ্বর’।

 

লেমেত্রি যেহেতু ধর্মযাজক ছিলেন, ছিলেন খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসী একজন বিজ্ঞানী, সেহেতু কেউ হয়তো ভাবতে পারেন যে পোপের এই উক্তিতে লেমেত্রি যার পর নাই খুশি হয়ে বগল বাজাবেন।  তা হয়নি। লেমেত্রি ধার্মিক হলেও তিনি ছিলেন বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিনিষ্ঠ এক মানুষ। আদিম কণার ধারনা যেটাকে আধুনিক বিগ ব্যাং এর সার্থক প্রতিভাস বলে মনে করা হয়, সেটা তিনি পেয়েছিলেন নিগূঢ় গণিত আর বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রয়োগে, কোন ধর্মীয় ঐশী মন্ত্রে নয়। তিনি সেটা সোজাসুজি বলতেনও – ‘কোন ধর্মীয় চেতনা আমাকে মহাজাগতিক মডেল নির্মাণে কখনোই অনুপ্রাণিত করেনি’।  তিনি কূপমণ্ডূক ধর্মবাদীদের মত বাইবেলের আয়াতে বিজ্ঞান খোঁজা কিংবা বিজ্ঞান আর ধর্মের গোঁজামিল দেয়াকে  সবসময়ই অপছন্দ করতেন।  তাই পোপ যখন বাইবেলকে ঐশী-গ্রন্থ বানাতে বিগব্যাংকে সাক্ষীগোপাল হিসেবে হাজির করলেন, তখন তিনি এর জবাবে বললেন, ‘আমি যতদূর দেখছি, এই তত্ত্ব অধিপদার্থবিদ্যা আর ধর্মের চৌহদ্দির বাইরের জিনিস’।  শুধু তাই নয় পোপ যেন ভবিষ্যতে এ ধরণের ‘ছেলেমানুষি’ আর না করেন, সেজন্য তিনি ভ্যাটিকান মানমন্দিরের পরিচালক ড্যানিয়েল ও’কনেলের সাথে দেখা করলেন। ভবিষ্যতে পোপ যেন মহাজাগতিক ব্যাপারে তার লম্বা নাকটা আর না গলান – ব্যাপারটা দেখতে পরিচালক মশাইকে অনুরোধ করে আসেন লেমিত্রি।

 

পরবর্তী ইতিহাস থেকে দেখা যায়, পোপ কিন্তু লেমেত্রির অনুরোধ ঠিকই রেখেছিলেন। বিগ ব্যাং এর ব্যাপারে তিনি আর কখনোই কোন অভিমত দেননি, করেননি ‘আম গাছে নিমের সন্ধান’[10]।  আজকের দিনে জাকির নায়েক আর হারুন ইয়াহিয়ার অনুসারীরা যারা সুযোগ পেলেই তাদের শতাব্দী-প্রাচীন  ‘বিজ্ঞানময় ধর্মগ্রন্থ’ গুলোর মধ্যকার নানা আয়াতের সাথে বিগ ব্যাং এর মিল খুঁজে পান, তারা ধর্মযাজক লেমেত্রির এই অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা নিতে পারেন[11]

 

 

প্রমাণ মিললো বিগ ব্যাং এর

গ্যামোর সেই বিখ্যাত আলফা-বিটা-গামা পেপারের কাহিনিতে আরেকবার ফিরে যাওয়া যাক। গ্যামো আর আলফার বুঝেছিলেন, মহাবিস্ফোরণের পর থেকে শুরু করে তিন লক্ষ আশি হাজার বছর পর্যন্ত মহাবিশ্ব অস্বচ্ছ গোলকের মত ছিল অনেকটা। প্লাজমা অবস্থায় অণুরা জোড় বাধতে পারেনি। প্রায় চার লক্ষ বছর পরে তাপমাত্রা খানিকটা কমে তিন হাজার ডিগ্রি কেলভিনে নেমে আসল। ঐ সময়টার পরই কেবল স্থায়ী অণু গঠিত হবার মত পরিবেশ তৈরি হতে পেরেছে।  এই সময়টাকে বলে রিকম্বিনেশন বা পুনর্মিলনের যুগ। এ সময়ই মহাবিশ্ব ক্রমশঃ স্বচ্ছ হয়ে আসে। আর আলোক কণা প্লাজমার খাঁচায় আটকে না থেকে পাড়ি দিতে শুরু করে অন্তবিহীন পথ। গ্যামো, আলফার আর আলফারের আরেক সঙ্গী হারমান তাদের গবেষণায়  দেখিয়েছিলেন, বিগ ব্যাং যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে সেই আলোর অপভ্রংশ  আমাদের এখন খুঁজে পাবার কথা। সেটাই হবে বিগ ব্যাং এর ফসিল, যেটার জন্য হয়েল আর গোল্ডেরা উৎসুক ছিলেন, আর ওটার অনুপস্থিতির সুযোগে মহাবিস্ফোরণের সমর্থকদের দেদারসে ব্যাঙ্গ করেছেন । গ্যামোরা জানতেন, বিগ ব্যাং এর পর থেকে মহাবিশ্ব হাজার গুণ  প্রসারিত হয়েছে। তাই যে আলোক তরঙ্গ দেখবার প্রয়াস নেয়ার কথা বলা হচ্ছে সেটা আজকের দিনে হবে মোটামুটি ১ মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের কাছাকাছি কোন তরঙ্গ।    অর্থাৎ, তড়িচ্চুম্বকীয় পরিসীমায় যাকে সনাক্ত করা যাবে বেতার তরঙ্গ হিসেবে। আর এই বিকিরণের তাপমাত্রা হবে পাঁচ ডিগ্রি কেলভিনের মত।

 

মুশকিলটা হল পেপারটা প্রকাশিত হবার কিছুদিন পরেই এই গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার কথা ভুলেই গিয়েছিল সবাই। আসলে গ্যামোর সময়ে মহাবিশ্বের প্রান্তিক বিষয় নিয়ে গবেষণাগুলোকে পদার্থবিজ্ঞানের মূল ধারা হিসেবে না দেখে দেখা হত পাগলাটে বিজ্ঞানীদের কল্পনাবিলাস হিসেবে। আরেকটা মূল কারণ অনেকে মনে করেন জর্জ গ্যামোর স্বভাবসিদ্ধ ভাঁড়ামি  আর রঙ্গপ্রিয়তা[12]। আলফা-বিটা-গামা নামের পেপার বানানোর জন্য বিথের নাম তাকে না জানিয়েই লেখক তালিকায় ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন গ্যামো, আমরা সেটা আগেই জেনেছি। এ ধরণের অনেক কিছুই গ্যামো করতেন, যার কারণে গ্যামোকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতেন না তার সহকর্মীরা কিংবা অন্যান্য রাশভারী গবেষকেরা। গ্যামো একবার গণনা করে দেখালেন ঈশ্বর মশাই নাকি পৃথিবী থেকে ৯.৫ আলোকবর্ষ দূরে থাকেন। গণনার হিসেবটা এসেছিল ১৯০৪ সালে জাপান-রাশিয়া যুদ্ধের সময়, রাশিয়ার কিছু চার্চ নাকি যুদ্ধের ভয়াবহতা কমানোর জন্য বিশেষ গণপ্রার্থনার ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু সে প্রার্থনায় তাৎক্ষণিক কোন ফল না হলেও বেশ ক’বছর পর – ১৯২৩ সালের দিকে  ক্যান্টো ভূমিকম্পে জাপানের বিরাট ক্ষয় ক্ষতি হয়েছিল।  এ থেকে রসিকরাজ গ্যামো সিদ্ধান্তে আসেন, ঈশ্বরের অভিশাপ আলোর বেগে এসে পৌঁছাতে যে সময় লেগেছে তাতে করে পাওয়া যায় ঈশ্বর থাকেন পৃথিবী থেকে ৯.৫ আলোকবর্ষ দূরে! তিনি একটা সময় বিজ্ঞানী হয়েলকে নিয়ে বাইবেলের জেনেসিসের আদলে নিজস্ব এক নতুন জেনেসিসও লিখেছিলেন।  এর পাশাপাশি ছিল তার শিশু কিশোরদের জন্য লেখা মজাদার ‘মিস্টার টম্পকিন্স’ সিরিজ।  বিজ্ঞানের ফ্যান্টাসি মিশিয়ে নানা ধরণের গালগপ্প বানাতেন গ্যামো। এমনি একটা বইয়ে (মিস্টার টম্পকিন্স ইন ওয়াণ্ডারল্যনাড) তিনি এমন একটা রাজ্যের কল্পনা করলেন যেখানে আলোর গতি প্রতি ঘণ্টায় মাত্র কয়েক কিলোমিটার। ফলে সেই রাজ্যের সাইকেল  আরোহীরা সাইকেল চালাতে চালাতেই সময়ের শ্লথতা কিংবা দৈর্ঘ্যের সংকোচনের মত আপেক্ষিকতার প্রভাবগুলো চোখের সামনে দেখতে আর অনুভব করতে পারেন।  বিজ্ঞানের গল্পপ্রিয় শিশু কিশোর আর কল্পনাবিলাসী পাঠকেরা এগুলোতে নির্মল আনন্দ পেলেও গ্যামোর প্রতিপক্ষদের  কাছে এগুলো ছিল স্রেফ ছেলেমানুষি, আর তুচ্ছ।  তার ছাত্র আলফারের সমস্যা হয়েছিল আরো বেশি।  গ্যামোর  তদারকিতে পিএইচডি করায় অনেকেই আড়ালে আবডালে বলতেন, ‘জোকারের আণ্ডারে’ পিএইচডি করছেন আলফার। যদিও মহাজাগতিক বিকিরণের মূল গণনাগুলো করেছিলেন আলফারই।

 

অবশ্য তাদের গবেষণাকে ভুলে যাবার পেছনে গ্যামোর স্বভাবজাত তারল্যই একমাত্র কারণ ছিল না। গ্যামো নিজেও একটা সময় পদার্থবিজ্ঞানের বিশেষতঃ মহাবিশ্বের প্রান্তিক গবেষণা বাদ দিয়ে রসায়ন এবং জীববিজ্ঞানে উৎসাহী হয়ে পড়েন, এবং ডিএনএ র রহস্যভেদ করা নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজও করেন। আলফারও একাডেমিয়া ছেড়ে দিয়ে আমেরিকার অন্যতম বৃহৎ কোম্পানি জেনেরাল ইলেকট্রিকে (GE) গবেষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন।  এভাবেই ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলো বিগ ব্যাং নিয়ে গ্যামোর গবেষণা, এক সময় পড়ল বিস্মৃতির ধুলোর পুরু স্তর।  ‘আউট অব সাইট, আউট অব মাইণ্ড’ বলে কথা!

 

এর পরের দশ বছর এভাবেই চলেছিল। এর মধ্যে ১৯৬০ সালে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ রবার্ট ডিকি এবং জিম পিবলস স্বাধীনভাবে গবেষণা করে সিদ্ধান্তে আসেন যে বিগ ব্যাং এর প্রমাণ যদি কিছু থেকে থাকে তা থাকবে সেই  মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণের মধ্যেই। তারাও গ্যামোর কাছকাছিই ফলাফল পেয়েছিলেন। তাদের হিসেব ছিল, বিকিরণের তাপমাত্রা হবে ১০ ডিগ্রী কেলভিন বা তার নীচে, আর বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য কয়েক সেন্টিমিটার। তারা গ্যামো আর তার দলের মতোই একটা গবেষণাপত্র প্রকাশ করার চিন্তা করছিলেন এ নিয়ে।  কিন্তু গবেষকদের গবেষণাপত্রে যাই থাকুক না কেন, বাস্তবে এর খোঁজ তখনো পাওয়া যায়নি।

 

আসলে মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণের খোঁজ পাওয়াটা একটা সৌভাগ্যপ্রসূত ঘটনাই বলতে হবে। ১৯৬৫ সালের দিকে আমেরিকার নিউ জার্সির বিখ্যাত বেল ল্যাবে আর্নো পেনজিয়াস এবং রবার্ট উইলসন বেতার যোগাযোগের মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গ নিয়ে কাজ করছিলেন। এমন নয় যে কোন তরঙ্গ ফরঙ্গ খোঁজার মত কোন কিছু তাদের মাথায় ছিল। তাদের লক্ষ্য আসলে ছিল উপগ্রহ যোগাযোগব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ করা। বেল ল্যাবের অনতিদূরে ক্রেফর্ড হিল বলে একটা জায়গায়  ৬ মিটার (প্রায় ২০ ফুট)  লম্বা একটা ‘হর্ন এন্টেনা’ পড়ে ছিল। এই একসময় বেল ল্যাবের ‘ইকো প্রজেক্ট’ বলে একটা প্রকল্পে এটা ব্যবহার করার কথা ছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য নানা কারণে সেই প্রকল্প থেকে যন্ত্রটাকে অব্যাহতি দেয়া হয়। তারপর থেকে ওটা ওভাবেই পড়ে ছিল। পরিত্যক্ত এই এন্টেনাকে রেডিও টেলিস্কোপের মতো কোন কিছুতে স্থানান্তরিত করা যায় কিনা, এ নিয়ে কাজ করতেই মূলতঃ উদ্যোগী হন পেনজিয়াস আর উইলসন। তারা বেল ল্যাব থেকে অনুমতি নিয়ে আসলেন যাতে এই এন্টেনা ব্যবহার করে তারা অন্তত কিছুদিন আকাশের দিকে তাক করে বেতার তরঙ্গ অনুসন্ধান করতে পারেন।

 

কিন্তু অনুসন্ধান করতে চাইলে কি হবে, আকাশের যেদিকেই এন্টেনা তাক করেন না কেন, তারা দেখেন এক অপ্রীতিকর আওয়াজ বা নয়েজ এসে সব ভজকট লাগিয়ে দিচ্ছে। এই নয়েজের মাত্রা এমনিতে খুবই কম, কিন্তু এই নয়েজ থেকে কোনভাবেই মুক্তি পাওয়া যাচ্ছে না যে!  এমন নয় যে এই আওয়াজ তাদের কাজে খুব বেশি সমস্যা করছিল।  সাধারণত জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা এ ধরণের নয়েজকে  সিস্টেমের ভ্রান্তি ধরে নিয়ে মূল কাজে এগিয়ে যান, কিন্তু পেনজিয়াস আর উইলসন নাছোড়বান্দা হয়ে পড়েই রইলেন – তারা এই আওয়াজের উৎস খুঁজে বের করবেন বলে।

 

এ ধরণের ক্ষেত্রে নয়েজের উৎস এবং প্রকৃতি হয়ে থাকে দুই ধরণের।  এই নয়েজ আসতে পারে কোন বহির্জাগতিক উৎস থেকে, কিংবা হতে পারে কোন যন্ত্রের নিজস্ব ত্রুটির কারণে।  প্রথমে বহির্জাগতিক কোন উৎস ঝামেলা পাকাচ্ছে কিনা সেটা সন্ধান করলেন এই দুই বিজ্ঞানী। হর্ন এন্টেনার  কাছাকাছি অবস্থিত কোন বৃহৎ তড়িৎ-আবিষ্ট ল্যান্ডমার্ক কিংবা কোন  বৈদ্যুতিক যন্ত্রের কারণে  এই বৈদ্যুতিক সঙ্কেত তাদের এই হর্ন এন্টেনায় ধরা পড়ছে কিনা তার খোঁজ করলেন। ফলাফল সেই শূন্য। এমনকি একসময় আকাশ পর্যবেক্ষণ বাদ দিয়ে নিউইয়র্কের দিকেও তাদের টেলিস্কোপ তাক করলেন। সঙ্কেতের কোন তারতম্য হল না।  যেদিকেই যন্ত্র তাক করেন সেদিকেই তারা শুনতে পান সেই একই মৃদু  ‘হিস্‌ হিস্‌’ শব্দ।

 

ঝামেলাটা যন্ত্রের নিজস্ব ত্রুটির কারণে হচ্ছে কিনা সেটাও অনুসন্ধান করলেন তারা। তারা যন্ত্রের এমপ্লিফায়ার, স্পিকারগুলো খুঁটিয়ে দেখলেন, আর সবচেয়ে বেশি দেখলেন বৈদ্যুতিক বর্তনী এবং বর্তনীর সংযোগস্থানগুলো। কোন শিথিল বা নড়বড়ে বৈদ্যুতিক সংযোগ  সমস্যা সৃষ্টি করছে নাকি, সেটাও আগাপাশতলা পরীক্ষা করলেন বহুবার। এমনকি যে সংযোগগুলো প্রথম দৃষ্টিতে ভালই মনে হচ্ছিল, সেগুলোকেও তারা অ্যালুমিনিয়ামের টেপ দিয়ে মুড়লেন পুনর্বার।  সাবধানের তো মার নেই।

 

কিন্তু কোন কিছু করেই এই ‘গায়েবী আওয়াজ’ সরানো যাচ্ছিল না।  এমন সময় তাদের নজরে পড়ল তাদের সাধের এন্টেনায় কোত্থেকে একজোড়া কবুতর এসে বাসা বেঁধেছে। কে জানে অনেকদিন ধরেই হয়তো তারা সেখানে ঘাপটি মেরে ছিল।   পেনজিয়াস আর উইলসন ভাবলেন, যাক এইবার হতচ্ছাড়া সংকেতের  উৎস খুঁজে পাওয়া গেছে।  ২০ ফুট এন্টেনা বেয়ে উপরে উঠে গিয়ে কবুতরের বর্জ্য পরিষ্কার করলেন, কারণ তারা ভেবেছিলেন এন্টেনায় জমা হওয়া এই ‘White dielectric material’ গুলোই যত নষ্টের গোঁড়া। কিন্তু সেগুলো সাফসুতরো করেও লাভ হল না, এমনকি দুই দফা কবুতর তাড়িয়েও না।

 

প্রায় হাল ছেড়ে দেয়া অবস্থা যখন, তখনই পেনজিয়াস এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্নার্ড ব্রুকের কাছ থেকে একটা টেলিফোন কল পান।  ব্রুক তাকে বলেন যে তিনি প্রিন্সটনের দুই গবেষক – ডিকি আর পিবলসের একটা গবেষণাপত্রের ড্রাফট কপি পেয়েছেন, যেখানে তারা বিগ ব্যাং এর মডেলের ক্ষেত্রে বিস্ফোরণ পরবর্তী অণুতরঙ্গ দৈর্ঘ্যের একটা মাপজোক করেছেন। ব্রুকের কেন যেন মনে হচ্ছে ডিকি-পিবলসের গবেষণার  সাথে  পেনজিয়াস -উইলসনের এন্টেনায় ধরা পড়া আওয়াজের কোথাও একটা সম্পর্ক আছে। ব্রুক বললেন, ‘ইউ শুড প্রোবাবলি কল ডিকি অ্যাট প্রিন্সটন’[13]

 

এর পরদিনই প্রিন্সটনে ফোন করলেন পেনজিয়াস, আর ফোন ধরলেন ডিকি। ডিকির সাথে ফোনে কথা বলতে বলতেই প্রথম বারের মত পেনজিয়াস বুঝতে পারলেন কী গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করে ফেলেছেন তারা নিজেদের অজান্তেই। এন্টেনায় ধরা আওয়াজের সাথে নিউইয়র্কের দিকে এন্টেনা তাক করা, বর্তনীর শিথিল সংযোগ কিংবা কবুতরের বিষ্ঠা – কোন কিছুরই কোন সম্পর্ক নেই। তারা আসলে খুঁজে পেয়েছেন মহাবিস্ফোরণের প্রাচীনতম ফসিল। মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন যাকে বলে।  পশ্চাৎপট বিকিরণের তীব্রতা মেপে ডিকি-পিবলসদের গণনার কাছাকাছি ফলাফল পেয়েছেন তারা। পরম শূন্যের উপর ৩ ডিগ্রি। আর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য পাচ্ছেন দুই মিলিমিটারের সামান্য কম।  পেনজিয়াসের এই সব কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন ডিকি । ফোন রেখে তার ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘বৎসরা, পাঙ্গামারা সারা’  (‘বয়েস, উই হ্যাভ বিন স্কুপড’)।

চিত্র: পেনজিয়াস এবং উইলসন বেল ল্যাবের বিখ্যাত সেই হর্ন এন্টেনার সামনে

 

এর পরদিনই ডিকি তার সাথে আরো দু’জন পদার্থবিদকে নিয়ে প্রিন্সটন থেকে ৩০ মাইল গাড়ি চালিয়ে নিউজার্সির হোলম্যান টাউনশিপে পৌঁছালেন। সেখানেই বেল ল্যাবের রিসার্চ সেন্টার। সেখানে  পেনজিয়াস আর উইলসনের পরীক্ষা নিরীক্ষার ফলাফলগুলো হাতে কলমে দেখে নিশ্চিত হলেন, হ্যাঁ যে সিগনাল তারা অ্যান্টেনায় পাচ্ছেন, সেটা  মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণই বটে।  তখনই দুই দল মিলে তাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করতে মনস্থ করলেন  অ্যাস্ট্রোফিজিকাল জার্নালে। তাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশের পর পেনজিয়াস আর উইলসনের এই আবিষ্কারটিকে বিজ্ঞানের জগতে অন্যতম সেরা আবিষ্কার হিসেবে স্বীকৃত হয় প্রায় সর্বত্রই। নাসার নভোচারী রবার্ট জ্যাস্ট্রো বলেছিলেন, ‘পেনজিয়াস আর উইলসন আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের বিগত পাঁচশ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে সেরা আবিষ্কারটি করছেন’। হার্ভার্ডের পদার্থবিদ এডওয়ার্ড পার্সেল ছিলেন আরো এককাঠি বাড়া। তিনি বলেছিলেন, ‘যে কোন কারো দেখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস এটি’।

 

এই মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বা সিএমবি আবিষ্কারের জন্য পেনজিয়াস ও উইলসন নোবেল পুরস্কার পান ১৯৭৮ সালে- গ্যামোর মৃত্যুর দশ বছর পরে। লেমিত্রিও মারা গিয়েছেন ততদিনে। মরণোত্তর নোবেল পুরস্কার প্রদানের কোন রীতি নেই, থাকলে গ্যামোকে চোখ বন্ধ করে বোধ হয় তখন নির্বাচিত করা হত, যিনি প্রায় একক প্রচেষ্টায় বিগ-ব্যাং’র ধারণাকে বিজ্ঞানের জগতে প্রতিষ্ঠা করেছেন। বোধ হয় কিছু বৈজ্ঞানিক অবদান সব সময় থেকে যাবে যা নোবেল প্রাইজের চেয়েও বেশি দামী আর গুরুত্বপূর্ণ।

 

বিগ ব্যাং এর ফসিল আনলো কোবে

পেনজিয়াস আর উইলসন  মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণের হদিস দিলেও সেটা খুব নিখুঁত ছিল না। কারণ বিজ্ঞানীরা জানতেন, মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ বড় স্কেলে সুষম মনে হলেও ছোট স্কেলে কিছুটা হলেও ‘ফ্লাকচুয়েশন’ বা অস্থিতি বজায় থাকতে হবে। এই অস্থিতিটুকুই কাজ করবে ভবিষ্যৎ-গ্যালাক্সি তৈরির বীজ হিসেবে।

কিন্তু এই অস্থিতি ধরে ফেলা কোন সহজ ব্যাপার নয়। অনেক সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির দরকার। সত্তুরের দশকে যে সমস্ত যন্ত্রপাতি ছিল তা দিয়ে একশ ভাগের এক ভাগ মাত্রায় ফ্লাকচুয়েশন পরিমাপ করা সম্ভব ছিল। কিন্তু এতে কোন অস্থিতি ধরা পড়েনি। আবহমণ্ডলের মধ্যকার রশ্মিগুলো ঝামেলা করছে ভেবে  বেলুন ফেলুন উপরে পাঠিয়ে নানা পরীক্ষা করা হল, তাতেও কোন ভাল ফলাফল এলো না।

 

সাফল্য এলো অবশেষে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে। বহু খরচাপাতি করে নাসা একটা  কৃত্রিম উপগ্রহ বানিয়েছিল কোবে (COBE) নামে ১৯৮৯ সালে। এই মহাজাগতিক বিকিরণ কব্জা করার লক্ষ্যেই বানানো হয়েছিল সেটা।  সেই কোবে আদিম সদ্যজাত মহাবিশ্বের এক দুর্লভ ছবি আমাদের কাছে এনে দিল – যার মধ্যে পাওয়া গেল অস্থিতির সুস্পষ্ট চিহ্ন। ব্যাপারটা চিন্তা করা যাক। আমাদের আজকের এই মহাবিশ্বের বয়স ১৪ শ কোটি বছরের বলে বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আর এই কসমিক ব্যাকগ্রাউন্ড রেডিয়েশন বা সিএমবির যে ছবিটা আমরা দেখি সেটা মহাবিশ্ব জন্মানোর মাত্র চার লক্ষ বছরের।  মানবিক স্কেলে চিন্তা করলে অনেকটা এরকমের শোনাবে – আমাদের মহাবিশ্বকে  যদি সত্তর বছরের বৃদ্ধ হিসেবে আমরা কল্পনা করি, তবে কোবের সংগৃহীত এই মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ বা সিএমবির ছবিটা মাত্র কয়েক ঘণ্টার সদ্যজাত শিশুর। আর সেই শিশুবেলাকার ছবির মধ্যেই রয়েছে নক্ষত্র তৈরি হবার সম্ভাবনাময় বীজ।

 

১৯৯২ সালে আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির সেমিনারে যখন এই ফলাফল প্রকাশ করা হল, আর সে সভায়  উপস্থিত ১৫০০ জন বিজ্ঞানীর সবাই যখন  হতবাক হয়ে দেখলেন কোবের মাইক্রো তরঙ্গ পটভূমি বিকিরণের উপাত্ত ২ দশমিক ৭৩ ডিগ্রি কেলভিনের কৃষ্ণকায়া বিকিরণের তত্ত্বীয় রেখার সাথে প্রায় পুরোপুরি মিলে গেল, তখন মুহুর্মুহু করতালিতে ফেটে পড়ল পুরো সভাঘর।

চিত্র: কোবের পাঠানো মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ থেকে প্রাপ্ত উপাত্ত ২ দশমিক ৭৩ ডিগ্রি কেলভিনের কৃষ্ণকায়া বিকিরণের তত্ত্বীয় রেখার সাথে প্রায় পুরোপুরি মিলে গিয়েছিল (ছবির উৎস : স্টিফেন হকিং, ইউনিভার্স ইন এ নাটশেল)।

 

প্রিন্সটনের জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী অস্ট্রিকার মন্তব্য করলেন,

‘যখন পাথরের খাঁজে ফসিল পাওয়া যায় তখন আমাদের চোখে প্রজাতির উদ্ভবের ছবিটা স্পষ্ট হয়ে উঠে। কোবে আমাদের জন্য মহাবিশ্বের ফসিল নিয়ে এসেছে’।

 

কথাটা মিথ্যে নয়। এই সিএমবি সদ্যজাত মহাবিশ্বের ফসিলই তো। কিন্তু তারপরেও একটা ব্যাপার হল, কোবের পাঠানো ছবি খানিকটা হলেও ঝাপসা ছিল। আর কোবের সংবেদনশীলতা ছিল কেবল ৭ ডিগ্রি কোনের চেয়ে বড় ফ্লাকচুয়েশনগুলো কব্জা করার মতো পর্যায়ের। কিন্তু এর চেয়েও  সূক্ষ্ম ফ্লাকচুয়েশন ধরার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে ২০০৩ সালে ডব্লিউ-ম্যাপ (WMAP) উপগ্রহের পাঠানো উপাত্তের জন্য।

 

চিত্র: পেনজিয়াস –উইলসন, কোবে এবং ডব্লিউ ম্যাপ থেকে পাওয়া মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণ।

 

কোবে এবং ডব্লিউ ম্যাপের পাঠানো মহাজাগতিক বিকিরণের ফসিলই বিগ ব্যাং বনাম স্থিতি তত্ত্বের দ্বন্দ্বের যবনিকা ফেলে দেয়। মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে তত্ত্বের দ্বন্দ্বে বিগ ব্যাং বেরিয়ে আসে একমাত্র ‘সুপার পাওয়ার’ হিসেবে।

 

অতঃপর…

‘বিগ ব্যাং’ তত্ত্বের গৌরবময় সাফল্য বিজ্ঞানীদের একেবারে সম্মোহিত করে রেখেছিলো বেশ অনেক দিন।  সবকিছুই সেই উত্তপ্ত মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে একসাথে সৃষ্টি হয়েছে, আর তার আগে কিছুই ছিলো না, এমন ভাবনা যেন বিজ্ঞানীরা অনেকটা স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিলেন কয়েক দশক ধরে।  মহাজাগতিক অণুতরঙ্গ পটভূমি বিকিরণের প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়ে অনেকে আবার বিগ-ব্যাং তথা মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের মধ্যে একেবারে ‘ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি’ পর্যন্ত দেখতে পেয়েছিলেন। এমনকি নিউজ উইকের মত ম্যাগাজিন ১৯৯৮ সালের ২০ এ নভেম্বর সম্পাদকীয় ছেপেছিলো এই বলে বিজ্ঞান নাকি ঈশ্বরকে পেয়ে গেছে!

চিত্র: (ক) স্ট্যান্ডার্ড বিগ-ব্যাং মডেল :  যেটি মনে করে অতি ঘন, উত্তপ্ত এক অদ্বৈতবিন্দুর মধ্যে দিয়ে আমাদের মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছে। (খ) ‘বিজ্ঞান ঈশ্বরকে পেয়ে গেছে’- দাবী করে নিউজ-উইকের একটি কুখ্যাত প্রচারণা।

 

তারপর যতদিন গেছে উত্তেজনা আর ‘সম্মোহনের ভাব’ ধীরে ধীরে থিতিয়ে এসেছে। একটা সময় পরে বিজ্ঞানীরা নিজেরাই দেখেছেন বিগ ব্যাং -এর প্রমিত মডেল আসলে সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে না।  এরও অনেক সমস্যা আছে। বিজ্ঞান লেখক ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী প্রায়ই তার লেখায় বলেন, ‘স্বর্গোদ্যানে ঘাসের নীচে সাপের অবস্থান যেমন রসভঙ্গ করে, মহাবিস্ফোরণ বা বিগ ব্যাং তত্ত্বও একইভাবে সর্বৈব সুন্দর নয়। এরও সমস্যা আছে।[14]’   যেমন, বিজ্ঞানীরা আজকের মহাবিশ্বের প্রকৃতি অনুসন্ধান করে দেখেছেন প্রায় ১৪শ কোটি বছর আগে ঘটা মহা বিস্ফোরণ অনেক বড় স্কেলেও প্রচণ্ড সমসত্ত্ব ছিল। কিন্তু কেন যে ছিল এর কোন ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারেনি।  বলতে পারেনি এত বিশালকায় এই মহাবিশ্বের দুইপ্রান্তের  দুই অঞ্চলের তাপমাত্রা কিভাবে সমান হয়? এ সমস্যাটি দীর্ঘদিন ধরে বিজ্ঞানীদের মাঝে পরিচিত ছিল ‘দিগন্ত সমস্যা’ হিসেবে।  দিগন্ত সমস্যার পাশাপাশি  ছিল মহাবিশ্বের ‘সামতলিক সমস্যা’।  ‘প্রমিত বিগ ব্যাং এর মডেল কখনোই বলতে পারেনি কেন আমাদের মহাবিশ্ব অতিমাত্রায় ফ্ল্যাট বা সমতল (১০২৮ সেন্টিমিটার স্কেলে)। এরকম সমতল মহাবিশ্ব তৈরি করতে গেলে মহাবিশ্বের মোট ঘনত্ব আর সন্ধি ঘনত্বের অনুপাত হতে হবে টায়ে টায়ে ১। মহাবিশ্বের উষালগ্নে কীভাবে এই ‘সূক্ষ্ম সমন্বয়ের’ মত ব্যাপার ঘটেছিল? জবাব পাওয়া যায়নি। এর উপর মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল ‘ম্যাগনেটিক মনো-পোল’ সমস্যা।  মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের প্রমিত মডেল বৈদ্যুতিক-চুম্বকীয় আধানযুক্ত অতি ভারী একক মেরুবিশিষ্ট কিছু কণিকার প্রাচুর্য থাকবার ভবিষ্যৎবাণী করেছিলো, যা আমরা কখনোই দেখতে পাই না।  এমনকি আমাদের মহাবিশ্ব বাড়তে বাড়তে কেন এতো বড় হল – এ সমস্যারও কোন সমাধান হাজির করতে পারেনি এ তত্ত্ব। স্ট্যান্ডার্ড বিগ ব্যাং তত্ত্ব অনুযায়ী অতি ঘন, উত্তপ্ত এক অবস্থার মধ্যে দিয়ে যদি আমাদের মহাবিশ্বের জন্ম হয়ে থাকে, তবে গণনা করে দেখা গেছে  এটি খুব বেশী হলে মাত্র দশটি প্রাথমিক কণিকা তৈরি করার মত ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। আর তা দিয়ে একজন মুক্তমনা পাঠকেরও মাথা গুঁজবার ঠাঁই হবে না, তাদের একেক জনের দেহেই যে রয়েছে প্রায় ১০২৯ টি অমনতর প্রাথমিক কণিকা!তার চেয়েও বড় কথা হল, বিগব্যাংকে মহাবিশ্বের উৎপত্তির ‘আলাদীনের চেরাগ’ হিসেবে অনেকে দেখাতে চাইলে কি হবে  এটিকে আসলে উৎপত্তির সর্বশেষ তত্ত্ব বলা যায় না।  আদপে এটা বিস্ফোরণ বিষয়ক তত্ত্বই নয়।  এর মাধ্যমে একটি বিস্ফোরণের বেশ কিছু ফলাফল ব্যাখ্যা করা যায় বটে কিন্তু বিস্ফোরণের মূল প্রকৃতি সম্বন্ধে সে কিছুই বলতে পারে না। কি এই বিস্ফোরণ, এই বিস্ফোরণের আগে কি ছিল, কিংবা কেনই বা এই মহাবিস্ফোরণ ঘটেছিল, এ বিষয়ে এই মডেল একেবারেই নীরব।

 

আসলে এই নিঃসীম নীরবতা ভেঙ্গে উত্তর হাজির হওয়ার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল আশির দশকে অ্যালেন গুথ নামে এক বিজ্ঞানীর আগমনের জন্য; ‘স্ফীতিতত্ত্বের জনক’ হিসেবে পরিচিত এই প্রতিভাধর বিজ্ঞানীর কাজের মাধ্যমেই এইসব কঠিন কঠিন প্রশ্নের উত্তর ক্রমশ আমরা জানতে পেরেছি। এ নিয়ে আলোচনা করা যাবে আগামী পর্বে …

চলবে

 


তথ্যসূত্র –

[2] Lawrence M. Krauss, A Universe from Nothing: Why There Is Something Rather than Nothing, Free Press, 2012, p 17.

[3] George Gamow, My World Line : An Informal Autobiography, Viking Adult; 1970

[4] অভিজিৎ রায়, মার্ক্সবাদ কি বিজ্ঞান?,  মুক্তমনা, সেপ্টেম্বর ০৩, ২০০৮ দ্রঃ।  মুক্তমনা এবং সচলায়তন ব্লগে সে সময় (২০০৮) প্রকাশিত এ লেখায় স্ট্যালিনীয় জামানায় সাহিত্যিক এবং বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকদের উপর লাগাতার অত্যাচারের নমুনা পেশ করে বাম ঘরণার দেশীয় সৈনিকদের ভয়ঙ্কর তোপের মুখে পড়েছিলাম। যথারীতি ‘পুঁজিবাদের দালাল’ , ‘শোধনবাদী’ থেকে শুরু করে ‘ছাগল’ ‘পাগল’ সহ নানা উপাধি হজম করতে হয়েছিল।আমি দিন কয়েক পরে একটি প্রত্যুত্তর দিয়েছিলাম ‘মার্ক্সবাদ কি বিজ্ঞান?’ প্রবন্ধের সমালোচনার উত্তরে’ শিরোনামে।  অবশ্য তাতে খুব একটা লাভ হয়েছিল বলা যাবে না। এ লেখাটি এখনো অনেকের কাছে বাংলা ব্লগে মার্কসবাদ নিয়ে তর্ক বিতর্কের আদি অকৃত্রিম উৎস।

[5] অভিজিৎ রায়, লাইসেঙ্কোইজম, মুক্তমনা, নভেম্বর ০১, ২০০৮।

[6] স্টালিনীয় আমলে বিজ্ঞানীদের উপর লাগাতার অত্যাচার এবং বিজ্ঞানের নামে অপবিজ্ঞান প্রচারের সাথে পাঠকেরা আরো বিস্তৃতভাবে পরিচিত হতে চাইলে অনন্ত বিজয় দাশের লেখা ‘সোভিয়েত ইউনিয়নে বিজ্ঞান ও বিপ্লব : লিসেঙ্কো অধ্যায়’ (শুদ্ধস্বর)বইটি পড়ে দেখতে পারেন।

[7] জেনেটিক্সকে যেমন ‘পুঁজিবাদী বিজ্ঞান’ হিসেবে অভিহিত করে হটানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, ঠিক তেমনি আবার একটা সময় বিগ ব্যাং এরও বিরুদ্ধাচরণ করা হয়েছিল কমিউনিস্ট রাশিয়ায়। বলা হয়েছিল বিগ ব্যাং এর ধারণা মার্ক্সিস্ট ভাবধারার সাথে একেবারেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়, ওটা ‘বুর্জোয়া বিজ্ঞান’। যে সমস্ত বিজ্ঞানীরা বিগ ব্যাং তত্ত্বের পক্ষে কথা বলতেন তাদের উপর নেমে এসেছিল রাস্ট্রীয় নির্যাতন। যেমন, ১৯৩৭ সালে নিকোলাই কোজারভ নামের এক বিজ্ঞানী ছাত্রদের মাঝে বিগ ব্যাং মডেল নিয়ে আলোচনা করায় তাকে ধরে শ্রমশিবিরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। অত্যাচার করা হয়েছিল ভসেভলদ ফ্রেডরিকস এবং মাতভেই ব্রনস্টেইন নের মত বিজ্ঞানীদের উপরেও, করণ তারা বিগ ব্যাং তত্ত্বের সমর্থক ছিলেন।  গ্যামো রাশিয়া ছেড়ে পালানোর পর তাকে বিশ্বাসঘাতক ‘আমেরিকান মুরতাদ’ (Americanized apostate)  হিসেবে চিহ্নিত করে বিচারের প্রহসনও করা হয়েছিল।

[8] Alex Vilenkin, Many Worlds in One: The Search for Other Universes, Hill and Wang, 2007

[9] Lemaître later summarized his theory as thus:  “The primeval atom hypothesis is a cosmogenic hypothesis which pictures the present universe as the result of the radioactive disintegration of an atom”.

[10] ধর্মগ্রন্থে বিজ্ঞান অনুসন্ধানের অপচেষ্টা নিয়ে আমি বহু আগে একটা লেখা লিখেছিলাম ‘বিজ্ঞানময় কিতাব’ নামে।  লেখাটি আরেকটু বিবর্ধিত আকারে অন্তর্ভুক্ত হয় রায়হান আবীরের সাথে যুগপৎভাবে লিখিত ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ (শুদ্ধস্বর, ফেব্রুয়ারি, ২০১১) বইয়ে। সহব্লগার নাস্তিকের ধর্মকথাও এই বিষয় নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন ব্লগে। ধর্মে বিজ্ঞান খোঁজার প্রয়াসকে  তিনি অভিহিত করেছেন ‘আম গাছে নিমের সন্ধান’ হিসেবে। লেখাটি মুক্তমনার সংকলনগ্রন্থ ‘বিশ্বাস ও বিজ্ঞান’ (চারদিক, ২০১২) এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।

[11] এখানে উল্লেখ্য, মুসলিম বিশ্বের একমাত্র নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আব্দুস সালামও লেমিত্রির মতোই বিগ ব্যাং তত্ত্বকে কোরআনের আয়াতের সাথে মিশাতে  বারণ করতেন।  তিনি বলতেন,

‘বিগব্যাং তত্ত্বের সাম্প্রতিক ভাষ্যটি বর্তমানে মহাবিশ্বের উৎপত্তির সর্বোৎকৃষ্ট ব্যাখ্যা প্রদান করছে। কিন্তু আগামীকাল যদি এর চাইতেও কোন ভাল ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, তাহলে কি হবে?  তাহলে কি নতুন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে তাল মেলাতে গিয়ে ধর্মগ্রন্থের আয়াত বদলে ফেলা হবে?’

[12] Simon Singh, Big Bang: The Origin of the Universe, HarperCollins; 2005

[13] Richard Panek, The 4 Percent Universe: Dark Matter, Dark Energy, and the Race to Discover the Rest of Reality, Houghton Mifflin Harcourt; 1ST edition , January 10, 2011

[14] এ এম হারুন-অর-রশীদ এবং ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, অপূর্ব এই মহাবিশ্ব, প্রথমা, ২০১১। অথবা, সৈয়দা লাম্‌মীম আহাদ এবং ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, সবার জন্য জ্যোতির্বিদ্যা, তাম্রলিপি, ২০১২ দ্রষ্টব্য।