আজকের জেনেটিক্সের এই জয়জয়কারের পিছনে একটা পাবলিকলি ফান্ডেড প্রজেক্টের বিশাল অবদান – “হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট”। ৬ বিলিয়ন অক্ষরে লেখা আমাদের মানবদেহের ডিএনএ পড়ার কাজটি প্রথম করেছে এই প্রজেক্ট। ১৯৯০ সালে শুরু হয়ে ১৩ বছর ধরে চলা ৩ বিলিয়ন ডলারের এই প্রজেক্টই আজকের ডিএনএ-কেন্দ্রিক গবেষণার ভিত্তি গড়ে দেয় সকল তথ্য বিনামূল্যে উন্মুক্ত করে দিয়ে। মানবদেহের ডিএনএ সিকোয়েন্স যদি তখন উন্মুক্ত না হতো, তাহলে পাবলিক গবেষণা এভাবে বিস্তৃত হতে পারতো না, আমাদের ডিএনএ জিম্মি হয়ে পড়তো ব্যবসায়িক কোম্পানির কাছে, আজকে ও ভবিষ্যতে আমরা চিকিৎসাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর সুফল ভোগ করতে পারতাম না। এই সুফল কি এমনি-এমনি এসেছে? কোম্পানিগুলো কি এই চেষ্টা করেনি ডিএনএ বাণিজ্যকে তাদের কব্জায় নিয়ে যেতে?

‘সেলেরা জিনোমিক্স’ নামের এক প্রাইভেট কোম্পানি ‘হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট’-এর সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষের জিনোম (মানুষের সম্পূর্ণ ডিএনএ সিকোয়েন্স) বের করার প্রজেক্ট হাতে নেয় ১৯৯৮ সালে। তাদের বাজেট ছিলো ৩০ কোটি ডলার – হিউম্যান জিনোম প্রজেক্টের ১০ ভাগের ১ ভাগ। সেলেরাকে এক্কেবারে শুরু থেকে শুরু করতে হয়নি, কারণ ততদিনে হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট যেসব কাজ করেছিলো সেগুলো উন্মুক্ত ছিলো সবার জন্য। তখনো মানুষের ডিএনএ পুরোটা পড়ার প্রযুক্তি বের হয়নি। সেলেরা জিনোমিক্স যদি এ কাজটুকু সবার আগে করতে পারে, তবে তারা হিউম্যান সিকোয়েন্স পেটেন্ট করে নিবে। এরপর যারাই এই সিকোয়েন্স ব্যবহার করুক না কেন, তাদেরকে টাকা দিতে হবে। চিকিৎসা, কৃষি, শিল্প, নিরাপত্তাসহ যেকোন ক্ষেত্রেই এই সিকোয়েন্সের ব্যাপক চাহিদার কথা চিন্তা করে এই কোম্পানি আদা জল খেয়ে লাগে। তারা ভাল এক প্রযুক্তি আবিষ্কারও করে (Whole Genome Shotgun Assembly), যা দিয়ে দ্রুত সিকোয়েন্সিং করা যায়। এদিকে সেলেরা যাতে এই প্রযুক্তি দিয়ে হিউম্যান জিনোম প্রজেক্টের আগে মানুষের জিনোম বের করতে না পারে, সেজন্য হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট তড়িঘড়ি করে ২০০০ সালের জুলাই মাসে তখন পর্যন্ত তাদের হাতে থাকা মানুষের জিনোমের খসড়া প্রকাশ করতে বাধ্য হয়। এর ফলে সেলেরা আর মানুষের জিনোমের পেটেন্ট দাবি করতে পারলো না। পরে অবশ্য সেলেরা তাদের জিনোম দান করেছিলো হিউম্যান জিনোম প্রজেক্টে। এ প্রজেক্ট মানব ডিএনএ’র প্রায় ৯৯ ভাগ জিনোম সন্তোষজনক শুদ্ধতার সাথে প্রকাশ করে ২০০৩ সালে। হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট যদি তখন সফল না হতো, এর প্রভাব কী হতো তা কল্পনা করাও কষ্টকর, মানবজাতির ইতিহাসই হয়তো আলাদা হতো।

জিনোম গবেষণায় এ ঘটনাই কিন্তু একমাত্র পেটেন্ট-ভূত নয়। জিনোম সিকোয়েন্সের, বিশেষ করে মানুষের জিনোমের বিশেষ বাণিজ্যিক গুরুত্ব আছে। কারণ এই সিকোয়েন্স আমাদের অনেক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। জিন হল জিনোমের একটা অংশ। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রোগ (যেমন- ক্যান্সার) এর সাথে কিছু জিন সম্পর্কিত। এমনই দুইটা জিন হল – BRCA1 ও BRCA2। এই দুইটা জিন স্তন আর জরায়ু ক্যান্সারের সাথে সম্পর্কিত। BRCA নামই এসেছে BReast CAncer থেকে। ডিএনএ থেকে এই দুইটা জিন আলাদা করেছে মিরিয়াড জেনেটিক্স নামের এক কোম্পানি। আলাদা করার পর এই জিন দু’টিই পেটেন্ট করে নেয় তারা। এর মাধ্যমে স্তন ক্যান্সার পরীক্ষার পদ্ধতি বের করেছে তারা। মনে রাখতে হবে – বিশ্বে স্তন ক্যান্সারের হার অন্য সব ক্যান্সারের চেয়ে বেশি। ২০০৮ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বে প্রতি বছর ১.৪ মিলিয়ন মানুষ স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ৪.৫ লাখ মানুষ এ কারণে মারা যায়। বিপুল সংখ্যক মানুষ স্তন ক্যান্সারের পরীক্ষার জন্য তাই মিরিয়াড জেনেটিক্সের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। মিরিয়াডের এই একাধিপত্যের অনিবার্য প্রভাব হল – এ টেস্টের দাম মাত্রাতিরিক্ত বেশি হওয়া। ২০ হাজারেরও বেশি জিন-সমৃদ্ধ পুরো জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে যেখানে খরচ পড়ে মাত্র ৪০০০ ডলার, সেখানে মাত্র কয়েকটা জিন সিকোয়েন্সিংয়ের জন্য দাম নেয় ৩০০০-৩৫০০ ডলার। শুধু তাই না, স্তন ক্যান্সারের এসব টেস্টের সকল ডাটা এখন মিরিয়াডের কাছে। মিরিয়াড যেখানে এসব ডাটার উপর ভিত্তি করে ঔষধ তৈরি করছে, অন্য কোন গবেষকের পক্ষে এ ডাটা নিয়ে কাজ করা সম্ভব না, এমনকি মিরিয়াডের অনুমতি ছাড়া এ জিন নিয়ে কাজ করাও সম্ভব না। একারণে ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভানিয়ার জেনেটিক ডায়াগনস্টিক ল্যাবরেটরিকে মিরিয়াডের কাছ থেকে পেটেন্ট আইন লঙ্ঘন করার উকিল নোটিশও পেতে হয়েছে ১৯৯৮ সালে। এভাবে স্তন ও জরায়ু ক্যান্সারের জগতে তাই মিরিয়াডেরই আধিপত্য এবং মানুষজন এদের হাতে জিম্মি।

জিন আছে আমার দেহে। একটা কোম্পানি আমার ডিএনএ থেকে একটা বিশেষ জিন আলাদা করেছে। খেয়াল করে- তারা কিন্তু জিন তৈরি করেনি। আর এই কারণে আমি এবং আমরা সবাই তার উপর নির্ভরশীল হয়ে যাবো? এ সংক্রান্ত সকল গবেষণা তাদের হাতে জিম্মি হয়ে যাবে? এর উলটো একটা যুক্তিও আছে। কপিরাইট বা মেধাস্বত্ব আইন একজন মানুষকে তার প্রকৃত কাজের পূর্ণ অধিকার দেয়, সেই মানুষটা যেন তার কাজের স্বীকৃতি এবং সংশ্লিষ্ট অর্থোপার্জন করতে পারে সেই অধিকার সংরক্ষণ করে। সাংঘর্ষিক এ ব্যাপার তাই আদালত পর্যন্ত গড়ায়। অ্যাসোসিয়েশন অফ মলিকিউলার প্যাথোলজি এধরনের জিন পেটেন্ট নিষিদ্ধ করার জন্য আদালতের দারস্থ হয়। জিন পেটেন্টের পক্ষের লোকের দাবি – এই পেটেন্টগুলো বায়োটেকনোলজি সংক্রান্ত গবেষণায় বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে। আর অন্য পক্ষের দাবি – এগুলো ক্যান্সারসহ বিভিন্ন গবেষণায় অন্যদের জন্য বাধা সৃষ্টির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট গবেষণাকে সীমিত করে দেয়, অথচ জিনে এবং জেনেটিক তথ্যাদি প্রকৃতির তৈরি, কোন কোম্পানির নয়। ২০১০ সালের মার্চে ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট এ ধরনের জিন পেটেন্টকে অবৈধ বলে ঘোষণা করে এই বলে যে,

‘আলাদা করা’ ডিএনএ অংশটুকু প্রকৃতিতে প্রাপ্ত ডিএনএ থেকে অভিন্ন, আর প্রকৃতিতে প্রাপ্ত কোন বস্তু পেটেন্টের আওতার বাইরে।

পরে মিরিয়াড এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে এবং এ রায়ের অংশবিশেষ তাদের পক্ষেও যায়। এ নিয়ে অনেকদিন ধরে আদালতের নানান পর্যায়ে শুনানি চলতে থাকে। সব শেষে গত ১৩ জুন ২০১৩ তারিখে আমেরিকার সুপ্রীম কোর্ট রায় দেয় –

প্রকৃতিতে প্রাপ্ত সকল ডিএনএ সেগমেন্ট প্রকৃতির অংশ, তাই কেবল প্রকৃতি থেকে আলাদা করেছে বলে সেই ডিএনএ সেগমেন্ট কেউ পেটেন্ট করার অধিকার রাখে না। তবে যেসব সেগমেন্ট প্রকৃতিতে সরাসরি পাওয়া যায় না (যেমন cDNA বা কমপ্লিমেন্টারি ডিএনএ) সেগুলো পেটেন্ট করা যেতে পারে।

রায়ে বিচারকগণ এটাও উল্লেখ করেন যে, মিরিয়াড ডিনএ’র অংশটুকু আলাদা করার প্রযুক্তিটুকু পেটেন্ট করতে পারতো, কিন্তু সেটুকুও মিরিয়াড নিজেরা আবিষ্কার করেনি, বরং সে প্রযুক্তি আগে থেকেই বহুল ব্যবহৃত।

প্রকৃতিতে প্রাপ্ত জিন পেটেন্টের আওতাভূক্ত নয় বলে দেয়া রায়কে স্বাগত জানায় সকল গবেষক, ডাক্তার ও সংশ্লিষ্টরা। একটা গ্রুপ অবশ্য এর বিরোধিতাও করে এই বলে যে, বায়োটেকনোলজিতে বিনিয়োগের পরিমাণ কমে যাবে। আমার মতামত অবশ্য এর উলটো – এটা বরং বায়োটেকনোলজিতে বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে। কারণ – একটা রোগ বা একটা বৈশিষ্ট্য কেবল একটা জিনের উপর নির্ভর করে না, বরং অনেকগুলো জিনের উপর নির্ভর করে। তাই একটা রোগের চিকিৎসা বের করতে গেলে বা একটা জেনেটিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন গেলে আগে আরো অনেক জিনের পেটেন্টের বাধার সম্মুখীন হতে হতো, এখন যার দরকার হবে না।

স্বাগত জানাই প্রাকৃতিক জিনোমকে পেটেন্টের আওতা বহির্ভূত করার এ রায়কে।