উগো চাবেস এর অকালে মৃত্যুর পরে বাংলাদেশে অনেকে ন্যাযত: শোক করেছেন। কিন্তু তার অবদানের কথা বলতে গিয়ে যে তীব্র উচ্ছাস দেখা গেছে তার যুক্তি সংগতা নিয়ে প্রশ্ন খুব একটা আসে নি। স্বভাবগত ভাবে পশ্চিমবিদ্বেষী বাংলাদেশীদের কাছে চাবেস যে হিরো হবেন এটা স্বাভাবিক। বাংলাদেশীদের কাছে গাদ্দাফী, সাদ্দাম, আহমেদিনাজাদ এমনকি বিন লাদেন ও হিরো। আমি এখানে চাবেস এর নিন্দা করার জন্যে এই পোস্ট লিখছি না। শুধুমাত্র তার অবদানকে কিছুটা বাস্তবতার নিরীখে দেখার জন্যে এই ছোট পোস্ট টি। মূলত অর্থনীতির কিছু দিকই আমি উল্লেখ করবো।

বেনেসুয়েলা’র গত এক যুগের অর্থনীতি কে বুঝতে হলে সবচেয়ে ভালো হবে এর কাছাকাছি আরেকটি দেশের অর্থনীতির সাথে তুলনা করলে। ল্যাটিন আমেরিকার আরেকটি দেশ মেক্সিকো। কাছাকাছি দেশ ও ইতিহাস ছাড়াও এই দুটি দেশের মধ্যে বড়ো মিল হলো যে দুটি দেশই অন্যতম তেল রপ্তানীকারী দেশ। ২০০৯ সালে বেনেসুয়েলা ছিলো ১৩ তম তেল রপ্তানীকারক ( ১ দশমিক ৮ মিলিয়ন ব্যারেল প্রতিদিন) আর মেক্সিকো ছিলো ১৭ তম ( ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন ব্যারেল) [1] উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বেনেসুয়েলা তে পাওয়া গেছে পৃথিবীর সম্ভবত সবচেয়ে বড়ো তেলের ভান্ডার। নতুন হিসাব অনুসারে বেনেসুয়েলা’র পরিক্ষীত তেলের মজুদ সৌদী আরবের চেয়েও বেশী।

Oil Reserve By country

মেক্সিকো আর বেনেসুয়েলা তুলনা করা খুব উপযোগী একারনে যে গত একদশকে এই দুটি দেশ অর্থনীতির দিক দিয়ে সম্পূর্ন দুটি ভিন্ন দিকে যাত্রা করেছে। ৯০ এর দশকে আমেরিকা আর কানাডার সাথে মুক্ত বাজার নাফটা ( NAFTA) চুক্তির পর মেক্সিকো তার অর্থনীতিকে অনেকটাই উন্মুক্ত দেয় বিদেশী ইনভেস্টমেন্ট এর জন্যে। অনেক রাষ্ট্রীয় সেক্টরকে বিরাষ্ট্রীয়করন করা হয়। অন্যদিকে বেনেসুয়েলা’র অর্থনীতির দিকপথ তো মোটামুটি সবার জানা।
উল্লেখ করে নেয়া দরকার যে মেক্সিকোর বর্তনাম জনসংখ্যা সাড়ে এগারো কোটি আর বেনেসুয়েলার তিন কোটি। মেক্সিকোর জনসংখ্যার চাপ অনেক বেশী।

এখন এক যুগ পরে এই দুই অর্থনীতির কিছু সংক্ষিপ্ত তুলনা দেখা যাক। [2]

২০০০ ২০০১ ২০০৯ ২০১০ ২০১১
বাৎসরিক মাথাপিছু আয় (পিপিপি)
মেক্সিকো ৮৭৮০ ৮৮৯০ ১৩৫৩০ ১৪৩৫০ ১৫৩৯০
বেনেসুয়েলা ৮৩৮০ ৮৬৬০ ১২৩৩০ ১১৯৯০ ১২৪৩০
মোট রপ্তানীর মধ্যে তেল রপ্তানীর অংশ
মেক্সিকো ৯% ৮% ১৩% ১৪% ১৬%
বেনেসুয়েলা ৮০% ৮০% ৯৫% ৯৩%
তেল ছাড়া অন্য পন্য ও সার্ভিস এর
রপ্তানীর বৃদ্ধি
মেক্সিকো % ১৬% -৩% -১৩% ২১% ৬%
বেনেসুয়েলা ৫% -৩% -১% -১৩% -১২%

উপরের চার্ট টিতে যদি কারও বুঝতে কিছু অসুবিধা হয় তবে আরও একটি সহজ পরিসংখ্যান দিচ্ছি, সৌদি আরবের বাৎসরিক রপ্তানীর ৯০% আসে তেল গ্যাস থেকে, বেনেসুয়েলার ৯৫% ।
এই অগাধ তেলের রিজার্ভ এর কারনে চাবেস এর অন্তর্ধান এর পরেও বেনেসুয়েলা যে অচিরেই পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ এ পরিনত হবে এব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই।

অন্যদিকে বর্তমানে মেক্সিকোর রপ্তানীর প্রধান তিন পন্য হলো ইলেকট্রনিক্স, গাড়ী এবং মেশিনারী। এই তিন ক্যাটেগরীতেই সর্বমোট রপ্তানীর প্রায় ৬০%।
বর্তমানে মেক্সিকোর ম্যানুফ্যাকচারিং এতোটাই শক্তিশালী যে মেক্সিকোর রপ্তানী বানিজ্য বিশ্বের রপ্তানী সুপারপাওয়ার চীনকে তীব্র প্রতিদ্বন্দিতা করছে।
Mexico: China’s unlikely challenger
By Adam Thomson
Latin America’s second-largest economy has emerged as a powerful exporter
http://www.ft.com/cms/s/0/9f789abe-023a-11e2-b41f-00144feabdc0.html#axzz2N6BlnKmu

মেক্সিকোর অর্থনীতি বেনেসুয়েলার তুলনায় অনেক ডাইভার্সিফাইড ই শুধু নয় অনেক এফিশিয়েন্ট ও। অর্থনীতি তে একটা দক্ষতার হিসাব আছে GDP per unit of energy use যেটা হিসাব করে যে একটি অর্থনীতি এক কেজি সমপরিমান তেল এর এনার্জি খরচ করে অর্থনীতে কি পরিমানে সম্পদ সৃষ্টি করে। এই হিসাবে দেখা যায় যেখানে মেক্সিকো এক কেজি তেল থেকে ৮ ডলারের মতো জিডিপি সৃষ্টি করে সেখানে বেনেসুয়েলা করে ৪ ডলার মাত্র। এখানে এটা উল্লেখ করাও দরকার যে গত এক দশকে মেক্সিকো’র অর্থনীতির বৃদ্ধির এক বড়ো কারন হলো আমেরিকার সাথে ফ্রী ট্রেড চুক্তি এবং মেক্সিকোতে আমেরিকান ইনভেস্টমেন্ট। ২০০১ সালে আমেরিকা নাফটা চুক্তিকে সম্প্রসারন করে পুরো দক্ষিন আমেরিকা (কিউবা বাদে) কে এর আওতায় আনতে উদ্যোগ নেয়। প্রধানত চাবেস এর তীব্র বিরোধিতার কারনেই এই সম্প্রসারন সফল হয় নি।

উগো চাবেস বেনেসুয়েলার জন্যে অনেক অবদান রেখেছেন এব্যাপারে সন্দেহ নেই। যারা ল্যাটিন আমেরিকার ইতিহাস সম্পর্কে জানেন তারা জানেন যে পৃথিবীতে মধ্যপ্রাচ্যের পর সম্ভবত এই অন্চলটিই অর্থনীতির বিবর্তনে সবচেয়ে পিছিয়ে ছিলো। ৫০০ বছর আগে স্পেনিশ-পর্তুগীজ কলোনীর পত্তনের পর থেকেই এই অন্চলের অর্থনীতিগুলো মোটামুটি ভাবে বড়ো বড়ো অভিজাত পরিবারগুলির কুক্ষিগত ছিলো। এই অভিজাততন্ত্রের হাত থেকে মুক্তির জন্যে গত ২০০ বছর ধরেই সংগ্রাম চলছে। কোন কোন দেশ এই অর্থনীতির পরিবর্তনে এখনো অনেক পিছিয়ে আছে অন্যদিকে কোস্টারিকা, চিলি এসব দেশ অনেক এগিয়ে গেছে বেশ আগেই। বেনেসুয়েলার অভিজাত তন্ত্রে আঘাত হানা চাবেস এর বড়ো সাফল্য সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই।

তবে চাবেস এর অর্থনীতিকে সফল বলতে গেলে গাদ্দাফী, সৌদী বাদশাহ এদেরকেও সফল অর্থনীতির দিকপাল বলতে হবে। পায়ের নীচে তেলের অগাধ সাগর থাকলে পৃথিবীর সবচেয়ে উদ্ভট তন্ত্রও ব্যর্থ হতে অনেক সময় লাগে।

References:

[1]http://en.wikipedia.org/wiki/List_of_countries_by_oil_exports

[2] http://www.worldbank.org/

http://www.ft.com/cms/s/0/9f789abe-023a-11e2-b41f-00144feabdc0.html#axzz2N6BlnKmu