আমি একজন সাম্প্রদায়িক বলছি। হ্যাঁ, আমি একজন ধর্মীয় সংখ্যালঘুর প্রতিনিধি হিসেবে সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি বলছি। তবে আমার মনের এ ধারণাটিকে কেউ কেউ আমার ক্ষোভের ও হতাশা্‌র বহিঃপ্রকাশ, কিংবা অলস মস্তিষ্কের অনুর্বর ভাবনা, অথবা সাম্প্রদায়িক মনোভাবের প্রতিফলন মনে করতেই পারেন। আমি অবশ্য মনে করি এটা আমার জীবনাভিজ্ঞতার ফসল। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আমরা প্রত্যেকে সাম্প্রদায়িক এবং আমি নিজেও। তা না হলে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন হলে আমি অসহায় বোধ করি কেন? নারী নির্যাতন হলেও, মানবাধিকার লংঘন হলেও অসহায় বোধ করি। তবে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন হলে আরও বেশি করি।

কারণ কি? কারণ তখন যে আমার দিকেও আঙ্গুল থাকে। দৃষ্টি থাকে।আমি যে জন্মসূত্রে হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত।বাংলাদেশে যে সম্প্রদায়ে জন্ম সে পরিচয় মুছা অসম্ভব ও অকল্পণীয়।থাবা বাবা নাম নিয়েও রেহাই নেই।নিজেই এখন ধর্মের, ধর্মীয় উন্মাদনার থাবার নীচে।তাছাড়া, প্রত্যেকেই কোন না কোনভাবে, কোন না কোন সময় সাম্প্রদায়িক– এমন সরলীকরণ না করলেও বলাযায় সংখ্যালঘু মাত্রই সাম্প্রদায়িক। দুর্বল অবস্থানের সংকুচিত মন। দড়িতেও সাপ দেখে। কারণ, চুন খেয়ে মুখ তেতেছে বলে দই দেখেও ভয় পায়।

আমার সংখ্যালঘুত্বকে জিইয়ে রাখে শুধু শত্রুপক্ষের লোকেরা নয়, আমি নিজেও।নিজের বলয় থেকে বের হওয়া কঠিন।নিজের মনের পর্দা, পারিবারিক দেয়াল, আত্মীয় পরিজনদের আবরণ, সমাজের বেড়া আর সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে নিজেকে ভাবাপন্নদের সংখ্যালঘুদের প্রতি তির্যক দৃষ্টি, আচরণ, আক্রমণ ও আঘাত আমাকে সংখ্যালঘু করে রাখে।

বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে কিছু ঘটলে বন্ধুরা বেশি বেশি খোঁজ খবর নেয়। তখন যেন অসহায়ত্ব অনুভবের মনের তারটি আরও সংবেদনশীল করে রাখে। সাহসও পাই। অবশ্য রাঙামাটিতে সেপ্টেম্বরের ঘটনায় আমিও আমার রাঙামাটির জাতিগত সংখ্যালঘু বন্ধুদের খবর নিয়েছিলাম। রামুতে অফিসের এক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী নারী ড্রাইভারের বাড়ী এবং মাতৃত্বকালীন ছুটিতে তখন সে বাড়িতে ছিল বলে তার অবস্থান নিয়েও উদিগ্রীব ছিলাম। এটাই মানবিকবোধ। এ বোধের তাড়নায়ই মানুষ মানুষের জন্য। আমি যা করেছি বা আমার বন্ধুরা যা করে তা আরোপিত কিছু নয়। স্বঃতস্ফুর্ত মানবিকবোধের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

তেমনি এখনকার পরিস্থিতিতে বিএন পি নেত্রী নেতা ও জামাতের কর্মীদের কান্ড কলাপও তাদের পৈশাচিক চরিত্রের স্বাভাবিক আচরণ। বাংলাদেশে যিনি দুই দুইবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি যদি বাংলাদেশের ইতিহাস বিবেচনা না করে গণহত্যা, ফ্যাসীবাদ আর হানাদার বাহিনী এর মত শব্দকে ধর্ষন করেন তখন তাকে ধিক্কার দেয়া ছাড়া আর উপায় কি!

গত শনিবার রাতে বন্ধু রীতা দাশরায় সহ্য করতে না পেরে বাসায় এসে অসহায় গোষ্ঠির প্রতিনিধি হিসেবে নিজের অস্বস্থির কথা জানাল।আমার অনুজা রীতা দাস আমাকে বাসা থেকে বের হতে নিষেধ করে নিজে শনিবার দিন মেয়েকে নিয়ে ভিকারুন্নেছা স্কুলে গেছে হাতের শাখা খুলে।নিজের পরিচয় গোপন করে রাস্তায় অপমান বা আক্রমণ হতে রক্ষা পাবার কৌশলী পদক্ষেপ, এ পরিস্থিতিতে সাহসী হওয়া তো আত্মহত্যার সামিল।

এক ননদের হাজব্যান্ড। নাখাল পাড়ায় থাকেন। রাস্তায় কয়েকজনের কথোপকথন শুনে নিজের পরিচয় গোপন করে জানতে চাইল, আচ্ছা, হিন্দুদের ওপর আক্রমণ কেন? সাঈদীর ফাঁসির জন্য হিন্দুদের ওপর এ নির্যাতন কেন? স্পষ্ট উত্তর, হিন্দুরাই তো তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছে।

আমার এক সহকর্মী এবারের সংঘাতময় পরিস্থিতিতে কক্সবাজারে আটকে গেছেন। আমিও কক্সবাজার জেলা থেকে ২৭ ফেব্রুয়ারি অফিসের কাজ শেষ করে চলে এসেছি। আর আমার সহকর্মিটির ২৮ তারিখে আসার কথা। বিকালে হরতালের জন্য আর ফিরতে পারেনি। শুক্রবার রাস্তা বন্ধ। আসতে পারেনি। শনিবারদিন বিশেষ গাড়িতে, পুলিশের পাহারায় সরকারি কর্মচারিদের সাথে চট্টগ্রাম পৌঁচেছে। একটা নামী দামী হোটেলে ছিল। সে জানাল, হোটেলের এক দারোয়ান অন্য আরেকজনকে বলছে, জানেন, আমাদের সাঈদী তো লাদেনের চেয়েও বড় মুসলমান। সাচ্চা মুসলমান, সাহসী মুসলমান।

শ্রোতা প্রশ্ন করল, কীভাবে?

আরে উনিতো কাফেদেরকে মুসলমান করতে পেরেছে একাত্তর সালে।এ জনগোষ্ঠী চাঁদে সাঈদীর মুখ দেখে।

দেলু রাজাকারের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ সাচ্চা মুসলমানের সঠিক পদক্ষেপ বলে বিবেচিত। এই হল সাধারণ জনগোষ্ঠীর সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক ভাবনার নমুনা।

যে কোন অপ্রীতিকর সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ এ উপমহাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিয়তি। এবার যুদ্ধপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে তাদের যে আর্থিক, সামাজিক অবস্থান ও মানসিক ক্ষতি হয়েছে তা পুরণ হবার নয়। তবুও সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে রোববার ( ৩ মার্চ ২০১২) বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি মাহমুদুল হকের বেঞ্চে স্বপ্রণোদিত হয়ে আক্রান্ত হিন্দু পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিতের আদেশ দেয়।একইসঙ্গে হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুদের বাড়িঘর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছে আদালত।(বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)। এটাও একটা পাওয়া।

বন্ধু মাহীন সুলতান ফোন করে আমার মনের অবস্থা নিয়ে তার সহমর্মিতার কথা জানাল। লীনা আপা(মাহবুবা মাহমুদ) ই মেইলে সাহস যোগাল। তাছাড়া, আপনারা, মুক্ত-মনার সাথে সংশ্লিষ্টদের মত কেউ কেউ আশেপাশেই আছেন, সর্বোপরি শাহবাগ, শাহবাগের শুদ্ধ রক্ত, শুভ চেতনা ও সাহসী সমর্থন তো কাছেই আছে, হ্যাঁ, এ সব ভেবেই ভাল থাকার সংগ্রাম করা যায়। ভাল থাকবেন।