একাত্তরের নরঘাতক ধর্ষক এবং যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবী নিয়ে যেই গণজোয়ার এবং আন্দোলন শুরু হয়েছে, সেটা এখন আর সাধারণ পল্টন ময়দান বা নয়াপল্টনের আটপৌরে আন্দোলনের পর্যায়ে নেই। এই আন্দোলন এখন যেই উচ্চতায় পৌঁছেছে, সেটাকে আমাদের সুবিধাবাদী চরিত্রহীন রাজনৈতিক দলগুলোর অন্যান্য আন্দোলনের সাথে এক করে দেখা যাবে না। আমরা কম বেশি সকলেই জানি রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে জনসমাবেশের আয়োজন করে, বিভিন্ন গ্রাম এবং বস্তি থেকে কীভাবে ট্রাকের পর ট্রাক হতদরিদ্র মানুষকে সামান্য টাকায় ভাড়া করে নিয়ে আসে। পক্ষান্তরে এই আন্দোলনে জনগণ একদমই নিজের ইচ্ছায় চলে আসছে পরিবার পরিজন সাথে নিয়ে, নিজেই রাস্তায় বসে পোস্টার বানাচ্ছে, নিজের বেতন থেকে একটা অংশ খরচ করে চিড়া মুড়ি আর গুড় কিনে আন্দোলনের অগ্নিকন্যা লাকি আক্তারের হাতে দিয়ে আসছে। এই স্বতঃস্ফূর্ত গণজাগরণ বাঙালির জীবনে খুব অল্প সংখ্যকবারই দেখা গেছে। আগে দেখা গিয়েছিল বায়ান্নতে, একাত্তরে, নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে এবং এখন শাহবাগের যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবীতে আন্দোলনে। উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে, বাঙালির সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক ঐক্য নানান খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে আসছে। একে ছোট করে দেখা আর সম্ভব নয়। এর ব্যপ্তি বিশাল এবং এর গভীরতা অনেক বেশি, যা চিনতে ভুল করলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
বাঙালির বাঙালিত্ব অথবা বাঙালির যেই মূল চেতনাগত অবস্থান, নানান ধরণের ঔপনিবেশিক এবং সাম্রাজ্যবাদী প্রচার প্রোপাগান্ডায় যা ক্রমশ চাপা পরে যাচ্ছিল, নানান সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক আগ্রাসনের যা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল, তা এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে একদমই সামনে চলে এসেছে। আমরা আবার পুনরুদ্ধার করতে যাচ্ছি আমাদের নিজেদের, শাহবাগে গিয়ে আমরা খুঁজে পাচ্ছি হারিয়ে যাওয়া আমাদের, আমাদের অস্তিত্বকে, আমাদের চেতনাকে। বাঙালির মধ্যে লালন ফকিরের যেই বীজ লুকিয়ে আছে, রবীন্দ্র নজরুল এবং বঙ্গবন্ধুর যেই চেতনা লুকিয়ে আছে, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা যে তাদের মূলে প্রথিত রয়েছে, সেটা নানান উৎসব বা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হয়ে পরে। এই আন্দোলনে কেউ কারো ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়, একজন হিন্দু এবং একজন মুসলিম এখানে একই প্লেটে খিচুরি ভাগ করে খাচ্ছে। এমনকি একজন টুপি পরা দাড়িওয়ালা ইসলাম-প্রেমী ইমামসাহেব এবং একজন কট্টর নাস্তিক একই টেবিলে বসে চা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছে। অথচ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং মৌলবাদী সংগঠনগুলোকে আমরা প্রায়শই দেখি একে অপরকে হত্যা করার রণহুংকার দিতে, একে অপরের উপরে চাপাতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরার প্রেরণার জোগান দিতে। যা আমাদের মধ্যে সৃষ্টি করা হয়েছে, বিভাজন জিয়িয়ে রেখে ফায়দা তোলা হয়েছে অনেক বছর ধরে।
শুধু তাই নয়, একজন রিকশাওয়ালা গতকাল শাহবাগে আসা কয়েকজন তরুণকে বিনা পয়সায় শাহবাগে দিয়ে গেছে। অথচ এই রিকশাওয়ালা কোন ধনী ব্যক্তি নয় যে বিনা পয়সায় সে মানুষকে আনা নেওয়া করবে। তার ঘামটুকু হচ্ছে বাঙালির চেতনার নির্যাস, তার কষ্টটুকু হচ্ছে বাঙালির আদর্শিক অবস্থান। এই চেতনা কোন মূল্যহীন বস্তু নয়, এটি আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস থেকে উঠে আসা আমাদের মুল সুর-সহমর্মিতার, একাত্মবোধের। এই আন্দোলনকে যারা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অলস পিকনিক বা নাটক বলে মনে করছেন, তাদেরও ইতিহাসের কাছে জবাব দিতে হবে।
শুধু বাঙালিই নয়, এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে চাকমা মারমা সহ আদিবাসীরা, তারাও রক্ত দিয়েছিল-নির্যাতিত হয়েছিল একাত্তরে। পশ্চিম বাঙলা থেকে গান লিখেছেন আমাদের প্রিয় কবির সুমন। শুধু শাহবাগে নয়, আন্দোলন ছড়িয়ে পরেছে দেশের আনাচে কানাচে, বাঙলাদেশের বাইরেও নানা দেশে বাঙালি এই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করছেন। তাই এই আন্দোলন আর ছোট পরিসরে নেই, তা ছড়িয়ে যাচ্ছে, ক্রমশ শাখা প্রশাখা বিস্তার করছে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে যেই বিষয়গুলো আমরা ফিরে পেয়েছি তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জয় বাঙলা স্লোগানটি, স্লোগানটি আমরা পুনরুদ্ধার করতে পেরেছি একটি দলের কাছ থেকে, একাত্তরে যেই স্লোগানটি ছিল আমাদের সকলের। শুধু জয় বাঙলা স্লোগানই নয়, আমরা পুনরুদ্ধার করতে চাচ্ছি এই রাষ্ট্রে আমাদের মালিকানা, এই রাষ্ট্রে আমাদের অংশ যা জয় বাঙলা স্লোগানের মতই রাজনৈতিক লুটেরা আর সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে চলে গিয়েছিল। সেখান থেকে আমরা তরুণ প্রজন্ম পুনরুদ্ধার করতে চাচ্ছি সমগ্র বাঙলাদেশকে, আমাদের হারিয়ে যাওয়া চেতনাকে।
জয় বাঙলা স্লোগানটি আমরা একটি রাজনৈতিক দলের কাছে হারিয়ে ফেলেছিলাম, চুরি হয়ে গিয়েছিল যেই স্লোগানটি শুনলে রাজাকার আর পাক বাহিনীর হার্ট এট্যাক হয়ে যেত। জয় বাঙলা, যে স্লোগানটি দিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরে আমরা সাধারণ মানুষ কেন জানি এই স্লোগানটি দিতে বড় বিব্রত বোধ করতাম। কিন্তু এই আন্দোলনের ফলে আমরা জয় বাঙলাকে আবার নিজেদের করে নিয়েছি। এখন থেকে আমরা সবাই আবার জয় বাঙলা স্লোগান দেবো, জয় বাঙলাকে আমরা সকলে গ্রহণ করে নিয়েছি আবারো। এখন এই জনস্রোত সমগ্র বাঙলাদেশকে পুনরুদ্ধার করতে যূথবদ্ধ হচ্ছে।
শাহবাগে এখন প্রতি রাতে শত শত নারী অবস্থান করছে। প্রতিটি রাতে এক একটি মেয়ে খুব স্বাধীনভাবে শাহবাগে লাঠি হাতে পাহারা দিচ্ছে, হেঁটে বেড়াচ্ছে। একটাও নারী অবমাননার ঘটনা ঘটেনি, এমনকি একটি নারীকেও কেউ কোন কটূক্তি করেনি। অথচ বাঙলাদেশ চিত্র এমন নয়। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েদের বাসা থেকে দিনের বেলাতেই বাবা মা বের হতে দিতে চান না। সেই মেয়েটিই সারারাত অবস্থান করছে শাহবাগে শত শত তরুণের সাথে, একটা তরুণও তাকে নাজেহাল করছে না। প্রতিদিন অগণিত ধর্ষণের বাঙলাদেশে এমন অবস্থা আসলে কল্পনা করাই কষ্টকর। এই ঘটনাকে খুব স্থূল দৃষ্টিতে দেখলে চলবে না। এর পিছনে বাঙালির বিশাল চেতনাগত, আদর্শগত শক্তি রয়েছে। মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কখনই নারীর পক্ষে থাকে নি, কখনই মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলোকে ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে দেখা যায় নি। বরঞ্চ তারা একাত্তরে লক্ষ লক্ষ নারীর সম্ভ্রম লুটে নিতে ব্যস্ত ছিল, তারাই আবার এই সময়ে নারীকে কালো কাপড়ের বস্তায় বন্দি করতে চায়, ধর্ষণ বা ইভ টিজিং এর ঘটনায় নানা ভাবে নারীকেই দোষী সাব্যস্ত করে, তাদের ঢেকে-ঢুকে চলার নসিহত দেয়! যেই চেতনা বাঙালির চেতনা নয়, এই চেতনা মৌলবাদী চেতনা যা এই আন্দোলনে এসে দেখা যাচ্ছে, বাঙালি তার স্বরূপে ফিরে এসেছে। একজন নারী মাঝরাতেও শাহবাগের রাস্তায় ততটাই নিরাপদ যতটা নিরাপদ সে তার নিজের বাসাতে। এটিই নারীর বিষয়ে বাঙালির আদর্শিক অবস্থান। মৌলবাদ এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বাঙালি নারীকে যেই জায়গা দেয় সেটা বাঙালির নয়, সেটা আমাদের উপরে চাপিয়ে দেয়া।
আমরা এমন বাঙলাদেশই চেয়েছিলাম, আমরা এমন বাঙলাদেশেরই স্বপ্ন দেখেছিলাম। যেখানে ধর্মের নামে বিভেদ সৃষ্টি করা হবে না, সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাষ্প থাকবে না, সংখ্যালঘুদের উপরে অত্যাচার থাকবে না, আদিবাসীদের উপরে নির্যাতন থাকবে না, যেখানে ধনী দরিদ্রের বৈষম্য থাকবে না, যেখানে একজন নারী মাঝরাতে আমাদের রাজপথে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতে চাইলেই পারবে-কেউ তাকে কিছু বলবে না। কিন্তু এতদিন আমরা যেই বাঙলাদেশ দেখছিলাম, তা এমন ছিল না। এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে আমরা আসলে বাঙলাদেশকে ফিরে পেয়েছি, আমাদের মূল চেতনাগত অবস্থান চিনতে পেরেছি, পুনরুদ্ধার করতে পারছি নিজেদের- নিজেদের চেতনাকে, আমাদের এই চেতনাটুকু আবার আমরা হারাতে চাই না।

সকল আন্দোলনেই কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়, তারুণ্যকে নিয়ন্ত্রন করা এবং একটি দার্শনিক এবং আদর্শিক জায়গা থেকে তাদের দিক নির্দেশনা দেয়া গণ আন্দোলনে অনেক সময়ই সম্ভব হয় না। তাই এই আন্দোলনে “একটা একটা শিবির ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর” ধরণের স্লোগানের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। যেখানে ধরে ধরে জবাই করা পরিষ্কারভাবেই রাজাকারী চেতনা, এটা কোনভাবেই বাঙালির নিজস্ব নয়। বাঙলি এই আন্দলনে ন্যায় সংগতভাবে বিচার প্রার্থী, তাদের অবস্থান একেবারেই আদর্শিক এবং নৈতিক। সেখানে ধরে ধরে জবাই করার স্লোগান বাঙালির আবহমান চেতনাকে উপস্থাপিত করে না। একই সাথে, শাহবাগে স্লোগান দেয়া হচ্ছে “গোলাম আজম সাইদী, বাঙলার ইহুদি”, এই স্লোগানও অত্যন্ত আপত্তিকর; সাম্প্রদায়িক এবং জাতিবিদ্বেষী এই স্লোগানগুলোকে কিছুতেই থামানো সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু এই প্রচার প্রচারণা থামাতেই হবে। কারণ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে যদি এই স্লোগানগুলো সামনে চলে আসে, তবে এই আন্দোলন পরিষ্কারভাবেই এন্টি সেমেটিক, রেসিস্ট, ফ্যাসিস্ট আন্দোলন হিসেবে পরিচিতি পাবে। এই আন্দোলন এখন আর ক্ষুদ্র গলাবাজি নেই, সমস্ত পৃথিবী তাকিয়ে আছে এই আন্দোলনের দিকে। তাই এখনও এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব না দিলে হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।

কীভাবে শুরু হল এই আন্দোলন? এই আন্দোলনের পেছনে কারা মূল ভূমিকা পালন করেছে? এই প্রশ্নের উত্তরের সাথে জড়িত আছে ব্যক্তিগত এবং নানান রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের প্রশ্ন। এই আন্দোলন হুট করে কয়েকজন তরুণের ডাকে শুরু হয় নি, এই আন্দোলন কোন নির্দিষ্ট দলের ডাকেও এমন সাড়া ফেলে নি। এই আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে আছে অনেক সংগ্রাম এবং অনেক দিন ধরে তিলে তিলে তৈরি করা একটি প্রজন্মের অঙ্গীকার। যারা অনলাইনে দিনের পর দিন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান শক্ত করেছেন, মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে লিখে গেছেন বিনা পারিশ্রমিকে, মুক্তবুদ্ধির চর্চা আর বাক-স্বাধীনতার পক্ষে যুদ্ধ করেছেন, সেই প্রতিটি লেখকের, প্রতিটি পাঠকের অবদান রয়েছে এই আন্দোলনে। এই আন্দোলনে অবদান রয়েছে সেই সব তরুণের, যারা দিনের পর দিন অনলাইনের নানান কর্মসূচি এবং আন্দোলনকে মাঠ পর্যায়ে নিয়ে যেতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। স্বাধীনতার ঘোষকের মতই আরেকটি বিতর্কের শুরু আমরা দেখতে চাই না, এই আন্দোলনের মাধ্যমে কয়েকজন সংসদ সদস্যপদপ্রার্থীকে কামনা করি না। কারণ এই সকল বিতর্ক এবং ব্যক্তিগত লাভ লোকসানের হিসেব নিকেশের মধ্যেই লুকিয়ে থাকবে আবারো ভাঙনের সুর, আরো বেশি নোংরামি।
এই আন্দোলনের নেতা কে? কে এই অসাধারণ আন্দোলনের ডাক দিল? কে মূল ভূমিকা পালন করেছে? এই আন্দোলনের নেতা হচ্ছেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, আমাদের আম্মা। আমরা সবাই তার সন্তান এবং এই আন্দোলনের এক একজন কর্মী। এই কথার পরে আর কোন বিতর্কের প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।

ধর্ম সবসময়ই মানুষের অত্যন্ত অনুভূতিপ্রবণ একটি চেতনা, একটি আধ্যাত্মিক জীবন দর্শন। সাধারণ মানুষ ধর্ম পালন করেন, সাধারণ মানুষ ধর্মকে যুক্তিহীনভাবে বিশ্বাস করেন, আস্থা রাখেন এবং হৃদয়ের একটি বিশেষ জায়গাতে ধর্মকে সংরক্ষণ করেন। আমাদের দেশের মানুষ প্রাচীনকাল থেকেই ধর্মের পাশাপাশি আমাদের লোকজ সংস্কৃতি এবং আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য একই সাথে লালন পালন করে এসেছেন। ধর্ম বা ধর্মগ্রন্থসমূহকে যারা আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করেন এবং ধর্মের মূল সুরটুকু অবহেলা করে শুধুমাত্র ধর্মকে উপজীব্য করে বেঁচে থাকতে চান, সেই কট্টর ধর্মীয় অনুভূতির সাথে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের সম্পর্ক খুবই অল্প। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হবার পর থেকেই আমাদের এই অঞ্চলে কট্টর ধর্মব্যবস্থাকে নানাভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে, ধর্মের মূল আধ্যাত্মিক সুরটুকুকে বাদ দিয়ে ধর্মের আক্ষরিক নিয়ম কানুনের উপরে বেশি জোর দেয়া হয়েছে, ধর্মকে মানুষের ব্যক্তিগত শ্রদ্ধার জায়গা থেকে টেনে বের করে রাজনীতি নোংরা ময়দানে নামিয়ে দেয়া হয়েছে, এবং ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ভোট এবং শোষণের রাজনীতি পাকাপোক্ত করা হয়েছে।

ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতা আমাদের দেশে খুব কৌশলেই প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়েছে এবং প্রয়োজন-মাফিক সেগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত হেরি কে টমাস আমাদের দেশে এসে বলেছিল, এই দেশের নিম্নবিত্ত জনগণের ছেলেপেলেরা পড়বে মাদ্রাসায়, মধ্যবিত্ত ছেলেপেলেরা পড়বে বাঙলা মাধ্যমে এবং উচ্চবিত্তরা পড়বে ইংরেজি মাধ্যমে। ব্রিটিশরা আমাদের এই অঞ্চলে যেই সাম্প্রদায়িকতার বিষ এবং বিভাজনের বীজ বপন করে গিয়েছিলেন, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বর্তমানে সারাবিশ্বে সেই একই পদ্ধতিতে শোষণ এবং আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতি করে যাচ্ছে। হেরি কে টমাস আমাদের বুঝিয়ে গিয়েছেন, কীভাবে মাদ্রাসা শিক্ষা চালুর মাধ্যমে, অশিক্ষা আর কুসংস্কার জিয়িয়ে রাখার মাধ্যমে ধর্মান্ধতা এবং মৌলবাদ নামক বিষবৃক্ষটিকে লালন পালন করতে হয়, এবং প্রয়োজন-মাফিক কীভাবে ব্যবহার করে ফায়দা হাসিল করতে হয়। সমাজের সুবিধা বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে কীভাবে ধীরে ধীরে ধর্মান্ধ মৌলবাদীতে পরিণত করতে হয়, তার প্রেসক্রিপশনই ছিল তার বক্তব্য। কারণ হচ্ছে ধর্মান্ধ মৌলবাদীরা যেমন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের গুটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তেমনি ব্যবহৃত হয় দেশে অশিক্ষা কুশিক্ষা আর দেশকে ক্রমশ মধ্যযুগে টেনে নিয়ে যাওয়ার বাহন হিসেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি আরব-পাকিস্তান এই রাষ্ট্রগুলোর রাষ্ট্রীয় চরিত্র প্রায় অভিন্ন, এবং তারা বাঙলাদেশের স্বীকৃত শত্রু হিসেবেই বাঙলাদেশের জন্মের সময় এই রাষ্ট্রটি গর্ভে থাকা কালীন সজোরে লাথি মেরেছিল, গণহত্যা চালিয়েছিল।

একাত্তরে পাকবাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী জামাত শিবির এই দেশে ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়েছিল। লক্ষ লক্ষ বীর মুক্তিযোদ্ধাকে তারা হত্যা করেছে, আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে এই দেশকে মেধাশুন্য করে ফেলার অশুভ পরিকল্পনাও তারা করেছিল। শুধু তাই নয়, লক্ষ লক্ষ নারীকে তারা ধর্ষণ করেছে সেই সময়ে, সেসব স্মৃতি ভোলা যায় না। বিভিন্ন কায়দায় একের পর এক দিনের পর দিন তারা ধর্ষণ করেছে আমাদের শিশুকন্যা থেকে শুরু করে আমাদের মমতাময়ী মাকে। জানা যায়, একটি কক্ষের ভেতরে নগ্ন করে আমাদেরই আদরের, আমাদেরই অনেক স্নেহের মেয়েদের রাখা হত, যেন তারা জামা দিয়ে গলার ফাঁস বানিয়ে আত্মহত্যা করতে না পারে। প্রতিটি রাতে প্রতিটি দিনে প্রবল ধর্ষণ আর অত্যাচারে আমাদের মা এবং বোনেরা আত্মহত্যার চেষ্টা করতো, কিন্তু পাকবাহিনী তাদের মরে যেতেও দিতো না, কারণ মৃত মেয়েরা ধর্ষণের উপযোগী নয়। আমাদের দেশের সমস্ত রাস্তাঘাট ভরে উঠেছিল মানুষের লাশে, ধর্ষিতা রমণীদের ক্ষতবিক্ষত শরীরে। সেই সব দৃশ্যের ভয়াবহতার ছবিগুলো দেখলে গা শিউরে ওঠে। মানুষ কীভাবে এই কাজগুলো করেছে ভাবতেই প্রবল ঘৃণায় সমস্ত সত্ত্বায় কাঁপন ধরে যায়!

আর যাদের পরিবারের সদস্যদের লাশ পুকুরে, ডোবায়, নদীতে পরে ছিল, তাদের নিদারুণ কষ্টের কথা, যন্ত্রণার কথা, সেই দৃশ্য কল্পনা করে দুঃস্বপ্নের ঘোরে জেগে ওঠার ভয়াবহ স্মৃতি তাদের বয়ে বেড়াতে হয়েছে অনেকগুলো বছর। আমরা হয়তো এখন আর সেসব দিনের কথা আর মনে রাখি নি, কিন্তু যাদের বাবা নিহত হয়েছেন, যাদের মাকে কয়েকটি নরপশু মিলে ছিন্নভিন্ন করেছে, তাদের সেই দুঃসহ স্মৃতি তারা কীভাবে ভুলে যাবে? ধর্ষিতা মুখগুলো আর রাস্তায় পরে থাকা অসংখ্য মৃতদেহগুলো এখন পরিসংখ্যানের এক একটা সংখ্যা হয়ে বইপত্রে জমা হয়ে আছে, তাদের আর কোন আর্তনাদ নেই, তাদের আর কোন রক্ত নেই, আর কোন কান্না নেই। তাদের ট্যাক্সের টাকাতেই কাদের মোল্লার মত অপরাধীরা জেলে বেঁচে থাকবে, এই কষ্ট মেনে নেয়া যায় না।

আমরা সাধারণ মানুষও যার যার মত বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পরেছিলাম, কেউ স্বাধীনতার মাসে একটু হা পিত্যেস করেই ব্যাপারগুলো ভুলে যাবার চেষ্টা করছিলাম। এখন অনেক বছর কেটে গেছে, তাই আমাদের কারোরই আর তেমন কিছু যায় আসে না। আমরা এখন এই দেশকে নতুন করে পাকিস্তান বানাবার স্বপ্নও দেখছিলাম। যেই পাকিস্তানকে আমরা এক সময় বিদায় জানিয়েছিলাম, সেই পাকিস্তানের ভুত এখন আর আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে ছিল না, সেই ভুত প্রবেশ করেছিল আমাদের খাদ্যে, আমাদের চিন্তায়, আমাদের রক্ত কণিকায়, আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রে, আমাদের সংবিধানে, আমাদের বিশ্বাসে, আমাদের অস্তিত্বের অংশ হয়ে উঠেছে সেই পাকিস্তান। আমরা এখন ইসলামিক টিভিতে রাজাকারদের ওয়াজ শুনি, তারা বেমালুম আমাদের বেডরুমে ঢুকে পরেছে ইসলামের ঝাণ্ডা নিয়ে। তারা আমাদের নানাভাবে নসিহত করেন, তারা আমাদের নানা শলা পরামর্শ দেন, আমরা সেসব শ্রদ্ধার সাথে শুনি, পালন করি। আমরা ইসলামী ব্যাংকে টাকা জমা রাখি, আমাদের প্রথম সারির পত্রিকাগুলো ইসলামী ব্যাংকের বিজ্ঞাপন ছাপায়। তারা আমাদেরই এলাকাগুলোতে ধর্মীয় আসর বসায়, আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত তাদের কথা শুনি, কীভাবে মালাউনদের(!) এদের থেকে বিতাড়িত করতে হবে, কীভাবে মালাউন নারীদের গর্ভে ইমানদার মুমিন বাচ্চা প্রবেশ করিয়ে দিতে হবে, কীভাবে দেশে ইসলাম কায়েম করতে হবে, এসব শুনতে শুনতে আমাদের শরীরে জিহাদি জোশ জেগে উঠতো। আমাদের রক্তে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তকণিকাগুলো ক্রমশ মরে যাচ্ছিল, সেখানে জেগে উঠছিল রাজাকারের রক্ত, সেখানে জেগে উঠছিল প্রতিক্রিয়াশীলতার নেশা, জিহাদের স্বপ্ন।
আমাদের পতাকায় যেই গোল লাল রঙের বৃত্তটি রয়েছে, সেটা রক্তের বিনিময়ে কেনা স্বাধীনতার সূর্যের প্রতীক। আমাদের সেই রক্তে কেনা পতাকা এই সেদিনও তারা নিজেদের গাড়িতে উড়িয়ে সদর্পে ঘুরে বেড়িয়েছে, আমরা তা দেখেও অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি, যেন আমাদের কিছু যায় আসে না! আমাদের দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কাছে নিজেদের বিক্রি করে দিয়েছে। একটি দল তাদের ক্ষমতায় নিয়ে গেছে, আরেকটি দল তাদের রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করেছে। অথচ আমাদের যেন কিছুই করার নেই, আমরা শুধু পাশ কাটাতে শিখছিলাম, আমরা শুধু ভুলে যেতে শিখছিলাম।
রাজনীতির সাথে যখনই ধর্মীয় প্রেরণা যুক্ত হয়, পারলৌকিক সুখ সুবিধাও যুক্ত করে দেয়া হয়, এর চাইতে ভয়াবহ আর কিছুই হতে পারে না। একজন আওয়ামী লীগ বা বাম দলের সমর্থক ছাত্র হয়তো আন্দোলন করতে গিয়ে একবার ভাববে, তার বাসায় তার বৃদ্ধা মা রয়েছে, স্কুলশিক্ষক বাবা রয়েছে, কিন্তু একজন জামাত ইসলামী সদস্য তা কখনই ভাববে না। তার উপরে রয়েছে আল্লাহ, উপরে রয়েছে বেহেশতের হাতছানি। মৃত্যু তাকে দমন করতে পারবে না, ভয় তাকে আতংকিত করতে পারবে না। তাই ভয়াবহতার দিক দিয়ে সে পুরো পৃথিবীর জন্যেই ক্ষতিকর। সেই সাথে ভয়ংকর পৃথিবীর সব দেশে ধর্মীয় প্রেরণাকে উপজীব্য করে রাজনীতি করা, সোজা কথায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতির চরিত্রই নষ্টামি আর নোংরামিতে পরিপূর্ণ।
জামাত শিবির কারা করে? একাত্তরে যেই ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠীকে আমরা হারিয়ে দিয়েছিলাম, আজকে এই স্বাধীন বাঙলাদেশে তাদের এত প্রভাব প্রতিপত্তির কারণ কী? তারা কীভাবে এত ক্ষমতাশালী হল? তারা কীভাবে এত শক্তি সঞ্চয় করলো?
সমস্যাগুলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এমনভাবে ঢুকে আছে যে, আমরা কিছুতেই এই বিষ থেকে রেহাই পাচ্ছি না। মাদ্রাসা শিক্ষার নামে এক মধ্যযুগীয় জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চা করা হচ্ছে এখনও, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে দেশের তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত, যার ফলে সাম্রাজ্যবাদ এবং মৌলবাদের এক অশুভ বলয়ের মধ্যে চাপা পরে গেছি আমরা। অর্থনীতি থেকে শুরু করে রাজনীতি, শিক্ষানীতি সবকিছুতেই তারা নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় বসে গেছে। ধর্মান্ধ মৌলবাদী জামাত শিবির এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র যে এক এবং অভিন্ন, তা জামাতের হরতালের সময় ভুল করে মার্কিন দূতাবাসের গাড়িতে একটি ইট ছোড়ার জন্য বারবার ক্ষমা প্রার্থনাতেই স্পষ্ট হয়ে যায়!

অথচ এই জামাত শিবির কখনও ক্ষমা চায় নি এদেশে গণহত্যা চালাবার জন্য, তারা কখনও ক্ষমা চায় নি অগণিত নারীকে ধর্ষণের জন্য, তারা ক্ষমা চায় নি এই দেশের স্বাধীনতার বিরোধিতার জন্য। মার্কিন দূতাবাসের গাড়িতে একটি ইট যেন আমাদের লক্ষ লক্ষ নারীর সম্মান এবং লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্ত থেকেই বেশি ভয়াবহ, নাহলে একটি ইটের জন্য ক্ষমা চাওয়া গেলেও দেশের মানুষের সাথে করা অপকর্মের জন্য কেন একবারও ক্ষমা চায় নি?
বাঙালির ইতিহাসে খুব বড় কোন অর্জন খুব বেশি নেই, ঘুরে ফিরে সেই বায়ান্ন আর একাত্তরের কথাই। বায়ান্নতে হঠাৎ করে আমরা একদিন বুঝতে পেরেছিলাম, আমাদের অস্তিত্ব এখন সংকটের মুখে, আমাদের ভাষা না থাকলে আমাদের জাতিসত্তা বিলীন হয়ে যাবে। তাই ঘুরে দাঁড়িয়েছিলাম সর্বশক্তি নিয়ে। আবার একাত্তরে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, আমাদের আর পিছু হটার সুযোগ নেই, তাই আমরা জীবন বাজি রেখে নেমে পরেছিলাম যুদ্ধে। আমরা এই দেশ স্বাধীন করেছি। এই যুদ্ধে সে সময়ে আমাদের এই সব অত্যাচারই সহ্য করে যেতে হয়েছে একটি নতুন দিনের স্বপ্নে, একটি নতুন দেশের আকাঙ্ক্ষায়। সেই পাকবাহিনীর বিচার আমরা করতে পারিনি, তাদের সেনাবাহিনী আমাদের দেশে গণহত্যা চালিয়ে অক্ষত অবস্থায় ভারত চলে গেছে, এবং তাদের এদেশীয় চামচা রাজাকার আলবদরদের সীমাহীন অত্যাচার নির্যাতনের পরেও আজও আমরা কেমন জানি অসহায় তাদের ক্ষমতার কাছে, তাদের রাজনীতির কাছে। তারা প্রকাশ্যে আমাদের হুমকি দেয়, তারা প্রকাশ্যে আমাদের রক্তচক্ষু দেখায়, তারা আমাদেরই রক্তে কেনা পতাকা তাদের গাড়িতে লাগিয়ে বীর-দর্পে ঘুরে বেড়ায়, এ যেন আমাদের ধর্ষিতা মা বোনদের রক্তাক্ত শাড়ির উপরেই তারা দাঁড়িয়ে আছে, এ যেন আমাদের মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের কবরের উপরেই তারা পা তুলে দিয়ে আছে।
আজকেও আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, আজ যদি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে ভোটের রাজনীতি করা হয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে আপোষ বা নমনীয়তা দেখানো হয়, তাহলে জাতি হিসেবে আমাদের আর কোন অর্জন থাকবে না, আর কোন ভবিষ্যত থাকবে না। সেই সাথে এই অপরাজনীতিরও অবসান ঘটাতে হবে, বিলুপ্তি ঘটাতে হবে ধর্মান্ধ মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মত কালো সাপকে দুধ কলা দিয়ে লালন পালন করার সংস্কৃতিকে।

আমরা পাকিস্তানীদের বিচার করতে পারি নি, এ আমাদের ব্যর্থতা অবশ্যই। কিন্তু এই ব্যর্থতা আরও প্রকট হয়ে যখন আমরা ভাবি, আমরা এদেশের কুলাঙ্গার রাজাকার আলবদরদেরও বিচার করতে পারি নি। আজকে যখন এই বিচার প্রক্রিয়া চলছে, তারা আমাদের জিম্মি করছে। তারা রাজপথ কাপিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, আমাদের জানান দিচ্ছে যে তারা শক্তিশালী, তাদের ক্ষমতা আছে। আর আমরা নপুংসকের মত তাদের তাণ্ডব চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম। এখন আমরা এক হতে পেরেছি, আবার সেই একাত্তরের মতই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গণহত্যা চালানো জার্মানির নাৎসি বাহিনীর যেই বিচার হয়েছিল, সেখানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সাথে সাথে নাৎসি বাহিনীকে শুধু নিষিদ্ধই করা হয় নি, নিষিদ্ধ করা হয়েছিল নাৎসিদের উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রচার প্রোপাগান্ডা, তাদের সংগীত, তাদের পুস্তক, এমনকি তাদের চিহ্নও। তারা আর কখনও রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারবে না, তারা আর কখনও কোন কর্মকাণ্ড পরিচালনাও করতে পারবে না। তাহলে আমরা কেন জামাত ইসলাম সহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল সমূহ, যারা একাত্তরে রাজাকার আলবদর আলশামসের মত বাহিনী গঠন করে গণহত্যা চালিয়েছিল, তাদের চিরতরে নিষিদ্ধ করতে পারবো না?

ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি শক্তিশালী হয় সেনাশাসন এবং সেনাসমর্থিত শক্তিগুলোর সাহায্যে। মূলত বাঙলাদেশে বন্দুক বা বোমা হামলা ছাড়া, আতংক সৃষ্টি করা ছাড়া ধর্মভিত্তিক রাজনীতির কোন উপায় নেই। তারা গাড়িতে বোমা মারে, তারা জনগণের রগ কাটে এবং জনগণকে আতংকিত করে রাখে। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সেনাবাহিনীর সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে, এবং জনগণকে জিম্মি করে। মূলত উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া আদর্শ বন্দুকের নল দিয়ে রক্ষা করা যেকোন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের মেরুদণ্ড। বাঙালি এই সকল শক্তিকে ভয় পেলেও তারা একসময় না একসময় ঘুরে দাঁড়াবেই, রুখে দাঁড়াবেই, এবং তখনই তাদের অবস্থান, তাদের শেকড়ে প্রথিত অসাম্প্রদায়িকতার সুর বেজে উঠবে। আর এই সুর বেজে উঠেছে এখন, এই সুরকে কিছুতেই নষ্ট হতে দেয়া চলবে না। এদের এখন ভাতে মারতে হবে, এদের এখন পানিতে মারতে হবে। এদেরকে রাষ্ট্রীয় ভাবে এবং সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। আমাদের বয়কট করতে হবে দিগন্ত টিভি আর ইসলামিক টিভিকে; আমাদের বয়কট করতে হবে দৈনিক সংগ্রাম, দৈনিক নয়া দিগন্ত, দৈনিক ইনকিলাব, সাপ্তাহিক সোনার বাংলাকে; আমাদের বয়কট করতে হবে ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড, ইসলামিক ফাইন্যান্স এন্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্সুরেন্স, ইসলামী ইন্সুরেন্সকে; আমাদের বয়কট করতে হবে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল এবং ইবনে সিনা হাসপাতালকে। এদের অর্থনৈতিক শক্তির পাইপলাইন কেটে না দিলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়ে উঠবে ধর্মান্ধ বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। আর তার জন্য প্রয়োজন আমাদের আরো বেশি সংগঠিত হবার, আরো বেশি একতাবদ্ধ হবার। আর এই আন্দোলনকে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেবার। গ্রামে গ্রামে জেলায় জেলায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো কোনঠাসা করতে হবে, তাদের বিলুপ্তি ঘটাতে হবে। কারণ এগুলোর হাত ধরেই আসে নারীর প্রতি অবমাননাকর মানসিকতা, এদের হাত ধরেই আসে সংখ্যালঘুদের উপরে নির্যাতন, এদের হাত ধরেই আসে সেনাশাসন, এদের হাত ধরেই আসে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর বিস্তার, এদের হাত ধরেই আসে অশিক্ষা কুশিক্ষা আর কুপমণ্ডুকতা, সর্বপরি এদের হাত ধরেই আসে অপরাজনীতি।

এই আন্দোলন শুধু কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবীর আন্দোলন হিসেবে এখন আর সীমাবদ্ধ নেই। এই আন্দোলন পরিণত হয়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং ধর্ম নিয়ে ব্যবসার বিরুদ্ধে বাঙালির শক্ত অবস্থানের আন্দোলনে, এই আন্দোলন পরিণত হয়েছে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলনে, আমাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াপনার বিরুদ্ধে, জামাত শিবিরকে মূলধন করে ভোট আদায়ের অশুভ রাজনীতির বিরুদ্ধে, জামাত শিবিরকে টিকিয়ে রেখে তাদের নাম ভাঙ্গিয়ে ভোটের বাক্স ভর্তি করার রাজনীতির বিরুদ্ধে, এই আন্দোলন পরিণত হয়েছে ধর্ষণের বিরুদ্ধে-নারী অবমাননার বিরুদ্ধে বাঙালির শক্ত অবস্থানের আন্দোলনে। সর্বোপরি এই আন্দোলন, এই জনস্রোত এখন আর শুধুমাত্র কাদের মোল্লাকে নিয়ে নয়, সকল যুদ্ধাপরাধী, জামাত শিবির সহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল সমূহের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান সমূহ, ধর্মভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবং গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ বাঙলাদেশের পক্ষে, যেখানে ন্যায় বিচার এবং আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত। একে কিছুতেই রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি আর আপোষের চাকায় পিষ্ট করে নষ্ট হতে দেয়া যাবে না, কারণ একে নষ্ট হতে দিলে আমাদের আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না।

জয় বাঙলা।