মূল প্রবন্ধ

অনুবাদ: বিকাশ মজুমদার

সরকার ক্রমাগত অস্বীকার করার রাজনৈতিক খেলার মধ্যে বাংলাদেশ চোখের সামনে দিয়ে কী দ্রুত আল-কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেটের জিহাদি উৎপাদনের উর্বরভূমি হয়ে গেল! ২০১৩ সালে একজন ইসলাম্পন্থী রাজনৈতিক নেতার ফাঁসির পরেই দেশব্যাপী ইসলামী জঙ্গীবাদ ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা জঙ্গীবাদের সুযোগ নেয় আল কায়েদা আর ইসলামিক স্টেটের মত আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো। স্থানীয় সমমনাদের সাথে জোটবেঁধে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করতে চায়। বাংলাদেশের পুলিশ সন্দেহ করছে আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলাদেশ শাখা আল-কায়েদার শীর্ষ নেতৃত্বের পাকিস্তান অংশের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছে যারা মুক্তমনা ব্লগারদের উপর ক্রমিকভাবে হামলা চালিয়েছে। ইসলামিক স্টেটের বাংলাদেশ শাখার ক্রমোন্নতির একপর্যায়ে দৃঢ় সমর্থন বৃদ্ধির লক্ষ্যে তারা বিদেশী নাগরিক এবং মুক্তমনাদের উপর হামলা শুরু করে। আল-কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেট দুই পক্ষই ধর্মোন্মাদ মুসলিমদেরকে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করে। জঙ্গী সমস্যা সরকার যদি স্বীকার করে না নেয় তাহলে বর্তমান পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হতে বাধ্য।

বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে চতুর্থ মুসলিম বৃহত্তম মুসলিম প্রধান দেশ। কিছুটা দেরিতে হলেও মুক্তমনাদের লক্ষ্য করে ধর্মোন্মাদ ইসলামী জঙ্গীদের পরিচালিত হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় সন্ত্রাস প্রতিনিয়ত বেড়ে যাওয়ার কারনে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। বিগত তিন বছরে দেশে অসাম্প্রদায়িক শক্তি এবং ধর্মীয় মৌলবাদী শক্তি দুই মেরুতে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এক পক্ষে অসাম্প্রদায়িক মুক্তমনা অন্যদিকে ধর্মান্ধ উগ্র জনতা। ফলশ্রুতিতে বেড়ে যাচ্ছে ধর্মীয় উগ্রপন্থা এবং ধর্মীয় উগ্রপন্থীদলগুলো নিজেদের যোগাযোগ স্থাপন করে শক্তি সঞ্চয় করে ফেলেছে। স্থানীয় পরিপ্রেক্ষিতেই ব্যাখ্যা করা যায় সন্ত্রাসবাদ উত্থানের কারন। এই আর্টিকেল তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করবে, আল-কায়েদা এবং ইসলামী স্টেট স্থানীয় উগ্রপন্থী ছোট ছোট দলের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে ইসলামী মৌলবাদের নিরব সমর্থনকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে বাংলাদেশে খেলাফত কায়েম করার পাঁয়তারা করছে।

অত্যন্ত দ্রুতলয়ে ঘটে যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সামাজিক পরিবর্তন। ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর পরিবর্তনের সাথে সাথে বাংলাদেশে বর্তমানে ইসলামী আন্দোলন যাত্রা শুরু করেছে। ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলকে প্রতিহত করতে গিয়ে এখনকার আলোচিত হত্যাকাণ্ডের আবর্তন শুরু। শাহবাগ আন্দোলনে যুক্ত ছিল এদেশের অসাম্প্রদায়িক এবং আধুনিক মুসলিম জনতা। তারা ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানী আর্মির দোসর, গণহত্যাকারী রাজাকার, আলবদর যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করার দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ সেই সাথে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিচার দাবি করে। ২০১৩ সালের চলমান যুদ্ধাপরাধী বিচারের রায়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন মিরপুরের ‘কসাই কাদের’ আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলে ফাঁসির দাবীতে ছাত্র জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। প্রতিবাদী আন্দোলনের মুখে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবনের পরিবর্তে ফাঁসির আদেশ দেন। ইসলাম পন্থীদের ব্যাপক ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমকে অগ্রাহ্য করে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
অসাম্প্রদায়িক এবং প্রগতিশীল আন্দোলনকে রুখতে ভয়ংকরভাবে সংগঠিত হলো ‘হেফাজতে ইসলামের’ (ইসলামের রক্ষাকারী)। তারা ইসলামের নবী রাসুল, আল্লাহকে নিয়ে কটুক্তি প্রতিরোধে এবং দেশের ইসলামবিরোধী সংস্কৃতি বন্ধ করতে নাস্তিক এবং মুরতাদদের মৃত্যুদণ্ড দাবি করে রাস্তায় নামে। তাদের ক্ষোভের মূল লক্ষ্য ছিল দেশের অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগ লেখক।

শাহবাগ আন্দোলনের জোয়ার দেখে উগ্রপন্থীরা ভয় পেয়ে যায়, হয়ত দেশটা এবার পুরোপুরি অসাম্প্রাদিয়ক হয়ে যাবে। তখনই তারা দাবি করে বাংলাদেশের সংবিধানে ১৯৭৭ সালের “আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস” ধারাটি যুক্ত করতে হবে। তারা প্রধানত ইসলাম অবমাননাকারী মুক্তচিন্তার লেখক এবং ব্লগারদের মুখ বন্ধ করতে ব্লাসফেমি আইন পাশ করার দাবি করে।
এরকম ঘোলাটে আর মেরুকরণ পরিবেশে ইসলাম রক্ষার নামে উত্থান ঘটল ইসলামী মৌলবাদের। অত্যন্ত সুগঠিত কিন্তু লোকচক্ষুর অন্তরালে জামায়াত-উল-মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) এবং হরকাত-উল-জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি) এদের মত দেওবন্দি জঙ্গী গোষ্ঠীগুলো জামায়তে ইসলামীর সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে নিজেদেরকে আরও শক্তিশালী জঙ্গীদলে পরিণত করে। এদের সাথে যুক্ত হয় আনসার আল-ইসলাম এবং জুন্দ আল-তাওহীদ ওয়াল খলিফা যারা যথাক্রমে আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ এবং ইসলামিক স্টেটের সাথে গাঁটছড়া বেঁধেছে। বাংলাদেশকে বৈশ্বিক জিহাদের শক্তিকেন্দ্রে পরিণত করতে তারা উভয়েই রীতিমত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত এবং বদ্ধপরিকর।

বাংলাদেশে ইসলামিক চরমপন্থার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশঃ
বাংলাদেশে ইসলামিক চরমপন্থার অবাধ চারণভূমি হওয়ার পিছনে দুইটি ঐতিহাসিক কারণ আছে। প্রথমত, বিগত কয়েক দশক ধরে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এবং পৃষ্ঠপোষকতায় কয়েক ডজন উগ্রপন্থী ইসলামিক সংগঠনের জন্ম হয়েছে। দ্বিতীয়ত, দেওবন্দী সমর্থিত জামায়তে ইসলামের উত্থান এবং জঙ্গীগোষ্ঠীগুলোর মাঝে সমন্বয় ঘটিয়ে শুরু হয় বাংলাদেশে শরিয়া আইনের মাধ্যমে সরকার পরিচালনার আন্দোলন।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সাথে স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ী হয়ে ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্ম হয়। তারপর থেকেই দেশে চলতে থাকে রাজনীতি আর ধর্মের অভ্যন্তরীণ দড়িটানাটানি খেলা। এমনকি বাংলাদেশের সংবিধানের চারটি মৌলিক নীতিমালার একটা হলো ধর্মীয় নিরপেক্ষতা এবং অসাম্প্রদায়িকতা। সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল এবং দেশের স্বাধীনতার বিরোধীশক্তি জামায়াতে ইসলামী শরিয়া অনুশাসনে দেশের সরকার পরিচালিত হবে দাবী করে আন্দোলন শুরু করে। বর্তমানে জামায়তে ইসলামী দেশের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিধর রাজনৈতিক দল। বিগত দশকগুলোতে রাষ্ট্রপক্ষের নিরব সমর্থন এবং জামায়তে ইসলামের প্রত্যক্ষ মদদে দেশব্যাপী ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা জিহাদি গোষ্ঠীগুলোর সাথে জামায়তে ইসলামীর গোপন আঁতাত এবং ঘনিষ্ট সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। এইসব জিহাদি গোষ্ঠীগুলো জামায়তে ইসলামকে মনে করে তাদের ধর্ম এবং আদর্শের ঝর্ণাধারা।

বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং সন্ত্রাস কায়েম করার জন্য দুইটা জঙ্গী সংগঠন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাদের একটা হলো, ১৯৮০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আফগানিস্তানে যাওয়া বাংলাদেশের মুজাহিদ জিহাদি যোদ্ধাদের নিয়ে গোপনে গঠিত ‘হরকাতুল জিহাদ’। আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে গিয়েই তারা আল-কায়েদা এবং পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের সাথে শক্তিশালী যোগসূত্র স্থাপন করতে সক্ষম হয়। সেখানেই তারা ঠিক করে কিভাবে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের বীজবপন করবে। তারা আফগানিস্তানে বসেই সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশের আওয়ামীলীগের (আপাতত ধর্মনিরপেক্ষ এবং অসাম্প্রদায়িক দল, {আসলে ডাহা মিথ্যে} যারা বর্তমানে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে) নেতাকর্মী এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আঘাত করতে হবে। পরিকল্পনামাফিক ২০০৪ সালের আগস্টে আওয়ামীলীগের সমাবেশে ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক গ্রেনেড হামলা চালনা হয়। সেখানে ২৪ জন মানুষ নিহত হন। তারও আগে ২০০১ সালে রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখে বাংলা বর্ষবরণ উৎসবে হামলা চালিয়ে কমপক্ষে ১০ জন মানুষকে হত্যা করে।

১৯৯৮ সালে দেশে কট্টরপন্থী জঙ্গীগোষ্ঠী জামায়াত-উল-মুজাহিদিন (জেএমবি) আত্মপ্রকাশ করে যারা দেশব্যাপী সন্ত্রাসী আক্রমণকে এক উচ্চমাত্রায় নিয়ে যায়। জেএমবি ২০০৫ সালে সারাদেশের ৬৩টি জেলায় একযোগে বোমা হামলা চালায়। তারা সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, বিচারক, আইনজীবী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের উপর হামলা চালাতে শুরু করে। হুজি এবং জেএমবি উভয়েই দেশে ইসলামী শাসনতন্ত্র কায়েমের জন্য সন্ত্রাস এবং রাজনৈতিকভাবে চেষ্টা চালায়।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইসলামপন্থী জঙ্গীদের সন্ত্রাস নির্মুল করতে সেনাবাহিনী নিয়োগ দিলে মোটামুটি কয়েক বছর সন্ত্রাসীরা গা ঢাকা দিয়ে কোনরকমে আত্মরক্ষা করে। পরের বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসে। সরকার তখন জেএমবি’র সর্বোচ্চ নেতা শায়খ আবদুর রহমান, কমান্ডার সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলাভাই সহ বেশকিছু রাঘব বোয়ালদের গ্রেফতার করে, বিচারের আওয়তায় এনে ফাঁসি কার্যকর করে। সরকার এরপর লাগাতারভাবে হুজি এবং জেএমবি’র উচ্চ পর্যায়ের নেতা কর্মীদের গ্রেফতার করে, পুলিশের আগ্রাসী নজরদারি বাড়িয়ে, ইসলামী জিহাদিদের কার্যক্রম বন্ধ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু অপেক্ষাকৃত এই শান্ত সময়ের স্রোতে খুব দ্রুতই হিংসার ঝর্ণাধারা বইতে শুরু করে যখন ২০১৩ সালে ধর্মনিরপেক্ষ এবং অসাম্প্রদায়িক ব্লগার, লেখকদের বিরুদ্ধে উগ্র ইসলামপন্থীরা রাস্তায় নেমে এলে। তারা রাস্তায় সন্ত্রাসের রাজনৈতিক প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে।

২০১৩ সালে হুজি এবং জেএমবি নতুন মাত্রায় নতুন আঙ্গিকে ইসলামিক জঙ্গীবাদের সূচনা করে। বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে হুজি এবং জেএমবি জঙ্গীরা মিলেমিশে নতুন কায়দায় হামলার আয়োজন করে। হুজি ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে কাজ শুরু করে। হুজির সর্বশেষ দলের নাম তানজিম – ই – তামিরুদ্দিন। ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে তানজিম – ই – তামিরুদ্দিন জঙ্গীদলের নেতা খলিলুর রহমান কয়েকজন সঙ্গীসহ গ্রেফতার হয়। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করে হুজিকে পুনর্গঠিত করতে তারা কাজ করছে। খলিলুর রহমানের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী একই মাসে নিরাপত্তা বাহিনী তানজিম – ই – তামিরুদ্দিন সংগঠনের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ আগ্নেয়াস্ত্র এবং গোলাবারুদ আটক করে। তানজিম – ই – তামিরুদ্দিনের শক্তি এবং ব্যাপ্তি কতদূর সেটা জানতে এখনো কোন কার্যকর তদন্ত হয়নি।

জেএমবি’র পুনর্জন্ম হয়েছে বিইএম নামে। ২০০৭ সালে শীর্ষনেতাদের বিচার এবং ফাঁসির পরে জঙ্গী গোষ্ঠীটি পুরোপুরি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সেই ভাঙাচুরা অবস্থা থেকেই অবশিষ্ট নেতারা গোষ্ঠীটিকে পুনরায় সংগঠিত করতে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ২০১৩ সালের আগস্টে বগুড়া শহরে নিরাপত্তাবাহিনীর হাতে কয়েকজন সশস্ত্র জিহাদি জঙ্গী ধরা পড়লে বিইএম আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। এক্ষেত্রেও জঙ্গী গোষ্টীটির শক্তিমত্তা, ধ্বংস ক্ষমতা, জনবল, সমর্থনের বিস্তৃতি কতটুকু সে বিষয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায় না।

তানজিম – ই – তামিরুদ্দিন এবং বিইএম’র কিছু সদস্য জামায়াতে ইসলাম এবং হেফাজতে ইসলামের (ইসলামের ত্রাণকর্তা) সাথে নিজেদের সমর্থন জ্ঞাপন করে এবং গড়ে তোলে ছাতার মত চতুর্দিকে ছড়ানো জঙ্গীগোষ্টীর বলয়। আশ্চর্যজনকভাবে তাদের মাঝে পারস্পারিক নির্ভরতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০১৩ সালে এককালের জেএমবি’র জঙ্গী সদস্য মশিউর রহমান কয়েকজন হুজি সদস্যের সাথে ঝালকাঠিতে ধরা পড়লে হুজি আর জেএমবি’র আন্তঃসম্পর্কের গোপন খবর বেরিয়ে পড়ে। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে তারা স্বীকার করে, তারা হুজিকে পুনর্গঠিত করার চেষ্টা করছে। ২০১৫ সালে প্রকাশ পায় জেএমবি’র ছোট দল আল-মুজাহিদ বাংলাদেশ। ঢাকার মতিঝিলে একজন সূফী পীরকে হত্যার পরিকল্পনা করার সময় আল-মুজাহিদের ছয়জন জঙ্গী ধরা পড়ে। তার আগে বাংলাদেশের পুলিশ জানতই না এমন জঙ্গীদলের অস্তিত্ব।

সন্ত্রাসের দামামাঃ
গত তিন বছরে বাংলাদেশের মানুষকে দেখতে হয়েছে ত্রিশের বেশি সংখ্যক চাপাতি আক্রমণে মানুষ খুন, গুলি করে এবং বোমার আঘাতে মানুষ হত্যা। বেড়ে গেছে ধর্মীয় গোঁড়ামির সমালোচনাকারীদের উপর ইসলামপন্থীদের আক্রমণ। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে অমর একুশে বইমেলায় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায়কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় প্রকাশ্যে উপর্যুপরি চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সরকারের সদিচ্ছার অভাব, কচ্ছপ গতির তদন্ত এবং তদন্তে অস্বচ্ছতার কারণে সুনির্দিষ্ট করে বলা কঠিন কারা অভিজিৎ রায়কে হত্যা করেছে। সরকারের উর্ধতন কর্তৃপক্ষ দোষারোপ এবং দায়মুক্তির খেলায় ব্যস্ত। কোন অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু ঘটলেই দেশীয় জঙ্গী হুজি বা জেএমবি অথবা জামায়তে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের উপর দায় চাপানোর সংস্কৃতি চালু হয়েছে। যদিও চলমান সব হামলার পরেই আল-কায়েদা এবং ইসলামিক স্টেট বাংলাদেশ শাখার পক্ষ থেকে হত্যার দায় স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু সরকার এইসব আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী জিহাদি সংগঠনের অস্তিত্ব অস্বীকার করে আসছে।

আল-কায়েদার সমর্থক বাংলাদেশি জঙ্গীদলগুলো যখন ২০১৩ সালের “গণজাগরণ মঞ্চ” শাহবাগ আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ধর্মীয় গোঁড়ামির সমালোচক অসাম্প্রদায়িক ব্লগারদের লক্ষ্য করে খুন করছিল তখন ইসলামিক স্টেটের সমর্থক জঙ্গীদলগুলো বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশী নাগরিক, দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী এমনকি নিরাপত্তাবাহিনীর উপর হামলা চালায়।

বাংলাদেশ সরকারের সমালোচকেরা বিভিন্ন দেশে জঙ্গী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অভিজ্ঞ জঙ্গীদের আমলে না নিয়ে শুধুই দেশীও জঙ্গীদের উপর একতরফা দোষারোপের নীতির সমালোচনা করে থাকে। জঙ্গীদের প্রকৃতি না বুঝে ঢালাওভাবে জঙ্গীবাদের জন্য দায়ী করলে প্রকৃত জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করাটা দুরূহ হয়ে পড়ে এবং রাজনৈতিক ইসলমের প্রতিপক্ষ দুর্বল হয়ে যায়। প্রতিটি জঙ্গী হামলার পরে সরকারের অস্বচ্ছতার কারণে হুজি বা জেএমবি’র ক্ষমতা, জঙ্গীবাদের শিকড় কতদূর বিস্তৃত হয়েছে জানা যায় না এবং জঙ্গীবাদের আপাতত নিরব সমর্থকদের নিয়ে আল-কায়েদা বা ইসলামিক স্টেট বাংলাদেশে পুনরায় জঙ্গীদল গঠন করতে পারে। কিন্তু এই লেখকের সাথে সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তা বলেছেন, “দেশের সবথেকে দুর্ধর্ষ জঙ্গী সংগঠন জেএমবি’র উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য এখনো বিদ্যমান এবং তারা মুক্তভাবে চলাচল করে। তারাই এখন ইসলামিক স্টেটের নামে দেশে জঙ্গীবাদ চর্চা করে যাচ্ছে। অপরপক্ষে হুজির সাথে আল-কায়েদার সম্পর্ক সেই আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধ থেকে। এখন হুজির সদস্যরা ভারতীয় উপমহাদেশের আল-কায়েদার বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে জঙ্গীবাদ ছড়াচ্ছে।”