পর্ব-১, পর্ব-২, পর্ব-৩, পর্ব-৪, পর্ব-৫, আগের পর্ব,
পর্ব-৭ (ভাষান্তরিত)
প্রথম অধ্যায়
সামরিক আগ্রাসনের প্রথম মাস: কোচাং (Kochang) এবং সিনজু (Chinju)
১৯৫০ এর ২৫শে জুন, রোববার অতি প্রত্যূষে, উত্তর কোরীয় সেনাবাহিনী যখন অতর্কীতে দক্ষিন কোরিয়ায় সামরিক আগ্রাসন চালায় তখন আমি সিনজু উচ্চবিদ্যালয়ের (Chinju High School) প্রথম বর্ষের প্রথম মাসের ছাত্র (১৯৫০-এ নব আরোপিত কোরিয়ার বিদ্যালয় শিক্ষা-সংস্কার নীতির আওতায় গ্রেড ১০ থেকে ১২ পর্যন্ত উচ্চবিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলো) ছিলাম। আমি তখন কেবলমাত্র তিন বছর মেয়াদী সিনজু মাধ্যমিক স্কুলের (Chinju Middle School) পাঠ চুকিয়ে উচ্চবিদ্যালয়ের চৌকাঠে পা দিয়েছি। কিয়াংনাম প্রদেশের (Kyung-Nam Province) পশ্চিমাঞ্চলের একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ শহর ছিলো সিনজু। এখান থেকে প্রায় একশ’ মাইল পূর্বে সামুদ্রিক বন্দর শহর পুসান (Pusan) ছিলো এ-প্রদেশের সব চেয়ে বড় শহর। অঞ্চলটি প্রদেশের পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিনাঞ্চল, পূর্ব সাগর (East Sea) এবং কোরীয় ভূখন্ডের (Korean Strait) সমুদ্ররেখা হিসেবে চিহ্নিত ছিলো। সিনজু বিখ্যাত ছিলো অতিসুন্দর ‘নাম কাং’ (Nam Kang) এর জন্যে, এটি ছিলো ‘নাকটং কাং’ (Naktong Kang) প্রবাহের একটি শাখা। বিশেষ করে “ইয়াই য়াম” ( Yi Am) নামের একটি সুবিশাল প্রস্তরখন্ড [ইয়াই (Yi) মানে ন্যয়বিচার (Justice), য়াম (Am) মানে প্রস্তর (Rock)]; যা ছিলো উত্তর সাগরের কূল বরাবর এবং শহরের কেন্দ্রের খুব কাছেই, সিনজুর চিহ্ন স্বরূপ, এবং এ ছিলো কোরীয় ইতিহাসের এক ঐতিহাসিক পীঠস্থান। যাইহোক, এই ইয়াই-য়ামটি ছিলো স্থানচ্যুত বিশাল সতন্ত্র একটি পাথর যার উপরিভাগটা ছিলো সমতল এবং মসৃণ। মাঝে মাঝে এর উপড়ে আমরা খেলতাম। কিন্তু এতদসত্তেও এর আরোও একটি বিশেষত্ত্ব ছিলো এইযে, একজন কিসেং (Kisaeng) যার নাম ছিলো নান-গে (Non-Gae), ষোড়শ শতকে যখন জাপানী সেনাবাহিনী এদেশে অনুপ্রবেশ করে তখন এই স্বদেশী নারী নান-গে একজন জাপানী জেনারেলকে প্রেমালিঙ্গনের কৌশলে তার মৃত্যু নিশ্চিত করে। এই কিসেং-রা (Kisaengs) প্রকৃতপক্ষে জাপানে গেইসা (Geisha) হিসেবে পরিচিত ছিলো। সমাজের প্রতাপ-পুরুষদের মনোরঞ্জনই এদের প্রধান পেশা ছিলো। তাঁরা অত্যন্ত উঁচু দরের নৃত্যশিল্পী, গায়িকা, কিংবা অতি দক্ষ প্রচলিত বাদ্যযন্ত্র শিল্পী হিসেবে পরিচিত ছিলেন, যেমন দ্বিমুখী ঢোল, যার মাঝখানটা সরু এবং দেখতে অনেকটা বালি-ঘড়ির মতো, কোরিয়ান ভাষায় যাকে বলাহয় ‘জাং-গু’ (Jang-gu)। সমাগত অতিথিদের সম্মানে তাঁরা অবশ্য কবিতাও আবৃত্তি করতেন তাদের শুভকামনায়, অতিথিদের আলিঙ্গন করতেন, সরবরাহ করতেন তাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্রাদি এমনকি তাদের কোন কোন চাহিদাও সম্ভাব্য ক্ষেত্রে পূরণ করতেন, চাহিদা মাফিক অত্যন্ত সুস্বাদু খাবার, তাড়ি (Rice wine) এসবের সাথে সাথে। তাঁরা তাঁদের কৌশলী এবং চাতুর্য্যপূর্ণ বক্তব্যের মধ্যদিয়ে পরামর্শ দিতেন এমনকি কখনো কখনো কৌশলী ইঙ্গিতপূর্ণ কোন মন্তব্যের কৌশলী জবাবও দিতেন। তাঁরা অতি সাধারন ভ্রষ্টা চরিত্রের কোন নারী ছিলেন না, যদিও তাঁদেরকে সম্মানজনক পেশাদার হিসেবেও স্বীকৃতি দেওয়া হতো না। অতীতের দিন গুলোতে ধনাঢ্য ব্যক্তিরা অনেক সময় এদেরকে উপপত্নী বা দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে পরিগ্রহনও করতেন। সর্ব্বোপরি তাঁরা তাঁদের আকর্ষনীয় দেহসৌষ্ঠব ও সৌন্দর্যের জন্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন। যাইহোক, ব্যক্তিগত পেশার বাইরে একজন কিসেং হিসেবে নান-গে ছিলেন একজন উঁচুমানের জ্ঞানী বুদ্ধিমতি নারী এবং সম্মানিত হয়েছিলেন একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক নারী হিসেবে। যিনি শত্রু জেনারেলকে হত্যার সুচতুর পরিকল্পনা হাতে নিয়ে জেনারেল এবং তার সাঙ্গ-পাঙ্গদের সম্পূর্ন নিজ দায়িত্ত্বে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতেন। বিশেষ ভাবে তৈরী এক ধরনের অঙ্গুরীয় তিনি তাঁর প্রতিটা আঙ্গুলে পরতেন। ফলে জেনারেলের কোমড়কে তাঁর বাহু বন্ধনীতে আঁকড়ে ধরতে পারতেন। আর এই অবস্থায় জেনারেল সাহেবকে সাথে নিয়ে তিনি নিকটস্থ নদীতে জরকেলীচ্ছলে ডুব দিতেন! দেশের প্রতি তাঁর এই মমত্ব আর বীরোচিত ভুমিকার জন্যে আমাদের উপকূলবর্তী এলাকার এই মহীয়সী নারীকে অকুন্ঠচিত্তে সসম্মানে স্মরণ করা হয়।
জাপানীরা পুসানে (Pusan) রাজধানী স্থানান্তরের আগে আমাদের সিনজুই (Chinju) ছিলো এই অঞ্চলের প্রাদেশিক রাজধানী (Provincial Capital), বিশেষ করে ১৯১০ সালে জাপান কর্তৃক কোরিয়ার বিচ্ছিন্ন প্রদেশ গুলোকে আইন সিদ্ধভাবে একীভূত করে উপনিবেশিক বিস্তৃতির পরে। সিনজু মাধ্যমিক বিদ্যালয় (তখনকার প্রচলিত পদ্ধতি অনুযায়ী গ্রেড ৭ থেকে গ্রেড ১২ পর্যন্ত) তখন দেশের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান গুলোর মধ্যে লিবারেল আর্ট মাধ্যমিক বিদ্যালয় (Liberal Art Secondary School) হিসেবে অন্যতম বিবেচিত হতো। জাপানী আগ্রসনের সময় কোরীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয় গুলো গ্রেড ৭ থেকে ১১ পর্যন্ত প্রলম্বিত ছিলো। এর পরেই শিক্ষার্থীদের ঢুকতে হতো হয় প্রাক্ কলেজ প্রস্তুতিতে (College Preparatory Program), ভোকেশনাল স্কুলে (Vocational School) নতুবা সামরিক বিদ্যালয়ে (Military School)। কোরিয়াতে মাধ্যমিক বিদ্যালয় গুলোর স্বরূপ নির্ধারিত হতো সেই সব সফল শিক্ষার্থীর সংখ্যার উপড়ে ভিত্তিকরে যারা রাজধানী সিউলের (প্রকৃতপক্ষে উচ্চারণটি সউল) বিক্ষ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে উচ্চশিক্ষার্থী হিসেবে নিজেদের জায়গা করে নিতে পারতো ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে, যেমন সউল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাৎ কতো সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী কোন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে রাজধানী সউল এর মূখ্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সুযোগ পেয়েছে এর আনুপূর্বিক পরিসংখ্যানের উপড়ে ভিত্তি করে। এই সব বিশ্ববিদ্যালয় গুলো প্রায়শঃই সউলের কিংবা আশেপাশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের দ্বারাই প্রভাবিত থাকতো। কিন্তু দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সামান্য কয়েকটি প্রসিদ্ধ মাধ্যমিক বিদ্যালয় গুলোর মধ্যে সিনজু মাধ্যমিক বিদ্যালয়ই ছিলো অন্যতম যার উল্লেখ যোগ্য সংখ্যক সফল শিক্ষার্থীরা সউলের প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর অঙ্গন মুখরিত করতো। এই সিনজু মাধ্যমিক বিদ্যালয়টি এতোটাই গুরুত্ত্বপূর্ন ছিলো যে এর শিক্ষার্থীদের একটা আলাদা সামাজিক মূল্যায়নও ছিলো।
আমার নিজের বসতি-শহর (Hometown) কোচাং (Kochang) থেকে সিনজুর (Chinju) দূরত্ত্ব প্রায় ৫০ মাইল। আমাদের এই শহরটি মূলতঃ কৃষিপ্রধান, সুউচ্চ পাহাড় ঘেড়া ছোট্ট একটি এলাকা। সেই সময়ের দিন গুলোতে, কোচাং এর মতো ছোট্ট শহরের খুব স্বল্প সংখ্যক পরিবারই ছিলো যাদের ছেলে-মেয়েদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াবার জন্যে শহরের বাইরে অন্যত্র পাঠাতেন। বেশীরভাগ ছেলে-মেয়েরাই আমাদের শহরের মাধ্যমিক কৃষি বিদ্যালয়েই (Agricultural Middle School) পড়তো, কিন্তু আমার বাবা-মা মনে করলেন যে আমার আরোও ভালো পড়াশুনা দরকার আর তাই আমাকে লিবারেল আর্ট স্কুলে পাঠানো হলো। আমার বাবা-মা তাদের সন্তানদের পড়াশুনা আর ভবিষ্যতের ব্যপারে অত্যন্ত বেশী মনযোগী ছিলেন বরাবর। তাঁরা চাইতেন যে, তাঁদের ছেলে-মেয়েরা বড় বড় শহরের মাধ্যমিক স্কুল গুলোতে পড়াশুনা করুক আর বেশী বেশী করে এই বিশ্বটাকে দেখতে এবং বুঝতে শিখুক। এমনকি সেটা যদি প্রদেশের অপর প্রান্তেও হতো তাহলেও সম্ভবতঃ তাঁরা তাঁদের সাধ্যাতীত চেষ্টারও ত্রুটি করতেন না। বিশেষ করে আমার বাবা তাঁর সন্তানদের উচ্চশিক্ষার ব্যপারে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন কেননা তাঁর নিজের ক্ষেত্রে মাধ্যমিক স্কুলে পড়ার স্বপ্নটি তিনি বাস্তবায়ীত করতে পারেননি। এটি তাঁর অতৃপ্ততার পরিপূরক হিসেবে দীর্ঘদিনের বাসনা ছিলো যে সবক’টি ছেলে-মেয়েকে তিনি অন্ততঃপক্ষে মাধ্যমিক স্কুল থেকে শিক্ষিত করিয়ে আনবেন। আমার বাবা-মা শুনে অত্যন্ত খুশী হয়ে ছিলেন যে আমি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভর্তি-পরীক্ষায় (Entrance Examination) সফলতার সাথে উত্তীর্ন হয়েছি, কিন্তু আমি জানতাম যে আমাকে শহরের বাইরে কোন একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াবার এবং সেখানে থাকা-খাওয়ার খরচ বহনে তাঁরা সক্ষম হবেননা। আমাদের একটি ছোট্ট কৃষি খামার ছিলো, যেখান থেকে আমরা হেমন্তে ধান আর বসন্তের শেষে বার্লি ঘরে তুলতাম। কিন্তু হেমন্তে তোলা ধানে আমাদের বড়োজোড় পরবর্তী মার্চ এর শেষ পর্যন্ত চলতো। যাইহোক, আমার মা কোন ভাবে আমাদের পারিবারিক ব্যয় নির্বাহ করতেন এবং সব কিছু সামলাতেন। সুতরাং কোনক্রমে অত্যন্ত দীনহীন ভাবে আমাদের সংসার টিকে ছিলো আমার বাবার সামান্য বেতনে আর আমাদের সব্জি বাগানের উৎপাদনে, যা কখনোই সুখকর ছিলো না বলাই ভালো। আমার বাবার স্থানীয় সরকার প্রশাসনের (County Civil Service) চাকুরীর বেতনে আমাদের সাংসারিক ব্যয় নির্বাহ প্রায় অসম্ভব ছিলো ফলে আমার বাবা-মা কে আমার পড়াশুনার ব্যয়ভার মেটানোর জন্যে সম্ভাব্য অন্যান্য উপায়ের অনুসন্ধান করতে হতো। তখন তাঁরা আমার বড় ভাইয়ের অন্য শহরের একটি বিদ্যালয়ে পড়াশুনার যাবতীয় ব্যায়ভার বহন করছিলেন। আমার বড় ভাই তখন সিনজু থেকে প্রায় ৪০ মাইল পূর্বে মাসানের (Masan) একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ছিলেন। আমার আরো পাঁচজন ছোট ভাই-বোন ছিলো, তাদের মধ্যে তিনজন তখন কোচাং এর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (Kochang Elementary School) পড়ছিলো। আমার ছোটবেলার কষ্টের দিন গুলোর একটি আজও স্পষ্ট মনে করতে পারি, একদিন সকালে অফিসে যাবার পূর্বমুহূর্তে আমার পড়াশুনার খরচ যোগার করতে পারছিলেন না বলে বাবা চোখের জল মুছছিলেন! শেষ পর্যন্ত আমাদের পরিবার সিদ্ধান্ত নিলো যে আমাদের পারিবারিক খামারটি বিক্রি করে দেবেন যেটি বংশ পরম্পরায় কয়েক পুরুষ ধরে আমরা ব্যবহার করে আসছিলাম। আমি অত্যন্ত বেদনাহত হয়েছিলাম আমাদের পারিবারিক খামারটি হাতছাড়া হবার জন্যে কিন্তু সাথে সাথে বাবা-মায়ের প্রতি অত্যন্ত কৃতজ্ঞও ছিলাম তাঁদের সিদ্ধান্তের জন্যে। এই খামারটিকে ঘিড়ে আমার অনেক অনেক সুখময় স্মৃতি আছে কাজের, যখন আমি কোচাং-এ বালক থেকে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছিলাম। এই খামারটিতে আমি ধানের চাড়া রোপন করতাম, ধানের খেতে সেচের খাল থেকে নালা কেটে জল দিতাম, ধান পাকলে কেটে আঁটি বেঁধে ঘরে তুলতাম। এমনকি আমি এখনো মনে করতে পারি আমার সেই ভালোলাগা দিন গুলোর কথা যখন রাতের ঘুম শিকেয় তুলে মশক কবলিত সেচের খালের ধারে মশাদের শত্রুতা উপেক্ষা করে অপেক্ষা করতাম যাতে আমাদের ধানের খেতে সেচের জলের সময় অতিক্রান্ত হয়ে না যায়!
সিনজুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ব্যপারে আমার ভেতরে ভেতরে দারুন এক উত্তেজনা কাজ করছিলো, অথচ কোচাং ছেড়ে চলে যেতে হবে ভেবে মনটা ভারাক্রান্ত হতো। কোচাং একটা ছোট শহর হলেও ছোটদের ঘুড়ে বেড়াবার মতো আর দেখার মতো প্রচুর জায়গা ছিলো, ছিলো বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করার এক সীমাহীন প্রান্তর। গ্রীষ্মের তপ্ত-বিকেলে প্রায়ই আমাদের আশে-পাশের প্রতিবেশী বন্ধুদের সাথে সাঁতার কাটতে যেতাম, সময় কাটাবার এটাই ছিলো আমাদের মোক্ষম উপায়। কোচাং-এ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিন গুলোতে বন্ধুদের সাথে বন্য ফুল আর গাছ-গাছালীতে সাজানো নদীর ধার গুলোতে আড্ডা মেরে দীর্ঘ বিকেল গুলো আমরা উজার করে দিতাম, কখনো শহরের সীমানায় খুঁজে বেড়াতাম সাঁতার কাটার নিরুপোদ্রব-নিরিবিলি জায়গা, কিংবা চলে যেতাম কাছে-ধারের নদীতে দুপুর থেকে বিকেল অবধি সুদীর্ঘ সময় থাকতাম জলে, সে যে কি আনন্দময় আর উত্তেজনাকর দিন ছিলো কারো অতীতের অভিজ্ঞতাতেই কেবল তা উপলব্ধি করা সম্ভব। আমরা জলে-স্থলে দাপিয়ে বেড়িয়ে খেলতাম, শুনতাম নদীর কূল সংলগ্ন বনাঞ্চল থেকে ভেসে আসা তীক্ষ্ম-তীব্র মেমি-র (Cicada, বৃক্ষ কিংবা ঝোপঝাড়-এ বসবাস রত এক ধরনের মাছি সদৃশ্য বড় আকারের ফড়িং। এদের কে প্রাচীন গ্রীস, চীন, মালেশিয়া, বার্মা, ল্যটিন আমেরিকা এবং কঙ্গোতে খাদ্য হিসেবে গ্রহন করা হতো।) ডাক কিংবা জলে ঝাপ দিয়ে পাথরের নীচে লুকিয়ে থাকা মাছ ধরতাম। তখন আমাদের পরিধানে কিছুই থাকতোনা, একেবারেই উদ্দাম উদোম! জলের মধ্যে নিজেদের আড়াল করতাম যখন পাশ দিয়ে কেউ যেতো বিশেষ করে মেয়েরা যদি চলে আসতো আশে-পাশে। কখনো কখনো মেয়েদের সলজ্জ হাসির শব্দও আমরা শুনতাম একটু দূরের বনানীর আড়ালে। যখন বাড়ির পথে ফিরতাম, দীর্ঘ সময়ের আনন্দ-উত্তেজনার রেশটুকু সাথে নিয়ে পরিচিত মেয়েদের প্রতি অনুরক্ততার বিষয়ায়াবলীর আলাপচারিতায় আমরা থাকতাম মশগুল। কখনো কখনো সেই সব মেয়েদের নিয়েও আলোচনা করতাম যারা বুনোপথের আড়ালে যেতে যেতে হাসতো আমাদের নিয়ে অথবা আমরা পালিয়ে যাওয়া মাছেদের নিয়ে করতাম হাসাহাসি। উঁচু পাহাড়ের ওপাশে অস্তগামী অরুণের বিচিত্র আভায় আমরা বিমোহিত হতাম। শেষ পর্যন্ত আমরা বার বার ফিরে পেতাম আমাদের গুরু-গম্ভীর মৌন পাহাড়-পর্ব্বতে ঘেড়া অত্যন্ত সুন্দর ছোট্ট শহরটিকেই।
শীত যখন আসে তখন জমে যাওয়া নদীর প্রশস্ত বুকে আমরা এসে জড়ো হই, শীতের ছুটি কাটাবার এক অনিন্দ্য সুন্দর জায়গা। আমাদের বাড়ির উঠোন পার হলেই যেহেতু নদী তাই শীতের ছুটির প্রায় সবটুকু জুড়েই আমি বন্ধুদের সাথে জমে যাওয়া নদীর বুকে স্কেটিং (Skating) করে বেড়াতাম। ছোট ছোট বাচ্চারা সাধারনতঃ বাড়িতে তৈরী স্লেডের উপড়ে বসে পিছলে বেড়াতো, হাতে থাকতো আগার দিকে একটা পেরেক লাগানো লাঠি সেটা হাতে ঠেলে ঠেলেই তাদের চলতে হতো। বড়ো ছেলেরা প্রায়ই স্টীলের পাতে স্কেটিং করতো যার উপড়ে একটা কাঠের খড়ম (খানিকটা জুতোর আকৃতিতে) জোড়া থাকতো। সত্যিকারের প্রকৃত একজোড়া স্কেটিং জুতো সহ স্কেট করতে খুবই কম দেখা যেতো। তবে যখনই কোন স্কেটারকে আমরা দেখতাম পায়ে ঝক্ ঝকে চামড়ার জুতোওয়ালা স্কেট-জুতো (Skates) পড়ে বরফের উপড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে, আমাদের নিজেদের স্কেটিং বন্ধ করে সার বেধে তার পাশে দাঁড়িয়ে বিষ্ময়াভিভূত হয়ে তার পায়ের কাজ দেখতাম, চলার মধ্য কি এক অদ্ভূত গতি আর ছন্দ! স্ক্লাজ্ স্ক্লাজ্ স্ক্লাজ্ ……….! শীতের শেষে যখন বরফ গুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে যেতে থাকতো তখন আমরা প্রমান আকারের একটা টুকরো কেটে নিতাম যেটা সহযেই আমাদের ভার বহনে সক্ষম হতো, তার পরে খোলা নদীতে উদ্দাম ভেসে বেড়ানো ছিলো আমাদের এক ধরনের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। এসময় লম্বা বাঁশের লাঠি আমরা লগী হিসেবে ব্যবহার করতাম। নদীর ধারে আগুনের কুন্ডলী (Campfire) জ্বালিয়ে সাধারনতঃ আমরা আমাদের ভেজা কাপড়-চোপড় শুকিয়ে নিয়ে তবে বাড়ি ফিরতাম। বরফের উপড়ে মজা করে ভাসতে ভাসতে এক সময় আমাদের সব কাপড়-চোপড়ই ভিজে যেতো। কাপড় গুলো পুরোপুরি শুকোবার পরেই সেগুলো আমরা পড়তাম আর ততক্ষন অগ্নীকূন্ডের পাশে দাঁড়িয়ে আর্দ্র-উত্তাপটুকুও আমরা উপভোগ করতাম। এভাবে আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে আড্ডাচ্ছলে কাপড় শুকাতে গিয়ে যে ঠিক কতোবার আমার নতুন নতুন কাপড় গুলো ছ্যাঁকা লাগিয়ে ফুটো করেছি ঠিক মনে নেই আর প্রতিবারই বাড়ি ফিরে এর জন্যে অনেক সমস্যা-পীড়িত হয়ে মূল্য গুনতাম। বকাবকি থেকে মার-পিট পর্যন্ত সবই মাঝে মাঝে বেশ নিখাদভাবে হজম করে ফেলতাম!
তার পরেও আমাদের বাবা-মায়েরা এই সময় সারাদিন আমাদের বাইরে খেলাধুলা করার জন্যে স্বানন্দে অনুমতি দিতেন। এই সময় আমাদের বিদ্যালয়ের সেশন গুলো থাকতো বন্ধ (শীতকালীন ছুটি) আর সংশ্লিষ্ট সেশনের পরীক্ষা গুলোও আগেই শেষ হয়ে যেতো। আমরা যাবার আগে অবশ্য সবসময়ই আমাদের বাবা-মা কে বলে যেতাম যে কোথায় যাচ্ছি এমনকি ফিরে আসার সম্ভাব্য সময়টাও মোটামুটি নিশ্চিন্ত করে তবেই বের হতাম। আমাদের কারো কাছেই ঘড়ি ছিলোনা তবে আমরা ঠিক জানতাম যে কখন ফিরতে হবে। আমাদের অভিভাবকেরা জানতো যে কখন আমরা ফিরবো আর ঠিক কখন আমরা ক্ষুধার্ত। তাঁরা আমাদের খুবই বিশ্বাস করতেন এবং যা আমরা করতে চাই নির্দ্দিধায় তা করতে অনুমতি দিতেন। আমরাই ঠিক করতাম কবে কোথায় আমরা কি করবো। আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে তাঁদের মধ্যে কখনো কোন উদ্বিঘ্নতা ছিলো না, এমনকি আমার বড় হওয়া অবধি শহরের ভেতরে তেমন কোন বড় রকমের অপরাধ মূলক তৎপরতাও চোখে পরেনি। এটি ছিলো অত্যন্ত নিরাপদ এক ছোট্ট আবাসিক শহরের প্রান্তিক জনসমাজ (Rural Community)। আমার একটা খুবই সুখী স্বেচ্ছাধীন ছোটবেলা ছিলো অগনিত চমৎকার সহপাঠী-বন্ধু সহ। আর সাথে ছিলো দারুন উদ্দোমী বাবা-মা। আমাদের বাবা-মায়েরা আমাদের গড়েছেন বলতে গেলে সময়ের বাঁধনহীন মুক্ত এক প্রাকৃতির নিবীড়তার ছোঁয়ায়। যেখানে আমরা প্রাকৃতিক নিয়মেই জেনেছি বুঝেছি সব, গুরুত্ত্বপূর্ণ হলো নিজস্ব বোধের ব্যাপ্তীতে নিজেরাই ঠিক করতে পেরেছি আমাদের অর্থপূর্ণ কৌশল আর সংশ্লিষ্ট কার্যকলাপ।
পড়ছি।
এ জায়গাটুকু বুঝিনি! কিভাবে মারলেন জাপানি সেনা কর্মকর্তাকে?
আপনি অনেক ভাল একটা অনুবাদ উপহার দিচ্ছেন আমাদের। আনার শ্রম ও নিষ্ঠাকে শ্রদ্ধা জানাই। ভাল থাকুন।
@কাজি মামুন,
ডুবিয়ে। শুনেছি, সেই সব অঙ্গুরীয়র অন্যপ্রান্তে লম্বা শক্ত দড়ির মতো বাহারী ঝুলমো মতো ছিলো। যা তখনকার পরিধেয় বস্ত্রের সাথে ছিলো সঙ্গতি সম্পন্ন। জলের নীচে জেনারেল সাহেবকে পাথড়ে লটকে দিয়ে তিনি বহু দূরে সরে পড়তেন সাঁতরে। অতঃপর নিজেই জলের মধ্যে খুঁজে বেড়াতেন জেনারেল সাহেবকে। বিষয়টি নিছক দুর্ঘটনা হিসেবেই জাপানীদের কাছে প্রকাশিত হতো। যে অঙ্গুরীয় তিনি ব্যবহার করতেন তা গোপনে, এবং তিনি জেনারেল সাহেবকে নিয়ে জলের নীচে যাবার পরে জেনারেল সাহেবের কোমরের বেল্টের বাঁশীর হুকের সাথে সামঞ্জস্য রেখে যাবতীয় ব্যবস্থা নিয়েই এই কাজটি তিনি করতেন।
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্য আর আগ্রহের জন্যে, আরোও বিস্তারিত জানতে পেলে আমি আপনাকে মেইল করে জানাবো।