উৎসর্গ- রায়হান আবীর
একজন- মেঘদলের অন্ধ ভক্ত এবং সদ্যপ্রয়াত মেধাবী যুবক 😛
মুক্তমনায় শেষ লেখাটা লিখেছিলাম প্রিয় ব্যান্ড ব্ল্যাক নিয়ে। সেই লেখাটার শুরুতে একটা কৈফিয়ত দিয়েছিলাম। যারা কষ্ট করে লেখাটি পড়েছেন তারা জানেন কৈফিয়ত দেয়ার কারণটা কী ছিল। আজকে যখন মেঘদল নিয়ে লিখতে বসেছি তখন এখানেও একটা ব্যাপার উল্লেখ করতে চাই, সেটা হচ্ছে ঠিক যে যে কারণে ব্ল্যাক সম্পর্কে লেখার আগে কৈফিয়ত দিয়েছিলাম সেইসব কারণের বিপরীতার্থক ধারণার জন্যেই মেঘদল হয়তো প্রিয় সব গানের দল থেকে আলাদা। আরও পরিষ্কারভাবে বললে শিল্পীর বা শিল্পর দায়বদ্ধতার যে জায়গাটা, সেখানে মেঘদলের যে অবস্থান- সেটাই মেঘদলকে অন্য যে কোন গানের দল থেকে আলাদা করে রাখে।
একজন সঙ্গীতপিপাসু মাত্রই কবীর সুমনের ‘নাগরিক কবিয়াল’ গানটা শুনেছেন। ভাবার্থে মেঘদলের সমার্থক শব্দ হতে পারে এই ‘নাগরিক কবিয়াল’ শব্দগুচ্ছ। সেটা কেন- তা তাদের দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘শহরবন্দি’ শুনলেই বোঝা যায় (এ ব্যাপারে বিস্তারিত পরে আলোচনা করার ইচ্ছা রইল)। আধুনিক কবিতার জনক বোদলেয়ারের একটা বিখ্যাত কবিতা থেকে নামটা চয়ন করা। কেন তারা এই ধরণের নাম নিলো বা আগ্রহ দেখাল তার উত্তরই হয়তো বলে দেয় কেন তারা ‘মেঘদল’। অথবা এই দশ বছরের পথচলায় তারা কোথায় হেঁটেছে, কেন বিষাদগ্রস্ত নির্লিপ্ততাকে সঙ্গী করে আস্তে আস্তে ধাবিত হয়েছে আশাবাদের দিকে, কিংবা অন্ধকার ভরা আলোর দিকে।
অনেকদিন ধরেই পরিকল্পনা ছিল মেঘদলকে নিয়ে লেখার। মেঘদলকে নিয়ে লেখার জন্যে ভেবেছি, গানগুলো শুনেছি বারবার। কোন এক সন্ধ্যায় হয়তো প্রথম শুনেছিলাম নেফারতিতির একটা লাইন- ‘যাবেই চলে নেফারতিতি, বিষণ্ণ চুল উড়ছে হাওয়ায়’। তারপর থেকে আমার সন্ধ্যাগুলো যেন মেঘদলের দখলে চলে গেল বিনা রক্তপাতে। এভাবে কিছু বিষাদ কখনো পাখি হয়ে যায় মেঘদলের সাথে সাথে, যে কণ্ঠ চেতনাকে প্রবলভাবে আচ্ছন্ন করে রাখে। করোটির ভেতর জমাট অন্ধকারে অক্ষরগুলো উড়ে বেড়ায়, উড়ে বেড়ায় রঙিন ফেরেশতারা।
ফেইসবুকে অনিয়মিতভাবে টুকটাক কথা হতো শিবু কুমার শীল ওরফে শিবুদার সাথে। লেখাটার প্রস্তুতি হিশেবে আমি তাকে বলে রেখেছিলাম কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবো তাকে। গতকাল কথা হচ্ছিল তার সাথে, আর মেঘদলের বেজিস্ট কিবরিয়ার সাথে। এই কথাবার্তার পালাটা এত বিশাল হয়ে গেল যে আলাদা করে দিতে বাধ্য হলাম। মেঘদলকে নিয়ে লেখার এটা প্রথম অংশ, দ্বিতীয় অংশে মেঘদলের অ্যালবাম লিরিক নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা রইলো।
জয়ঃ মেঘদল ব্যান্ডটা করার পরিকল্পনা কীভাবে আসলো? মানে মেঘদল নিয়ে যে আপনারা সবাই একত্রিত হবেন সেটার পরিকল্পনা কীভাবে শুরু হোল?
শিবুঃ. শুরুটা চারুকলা থেকেই। আমি উজ্জ্বল আর সুমন মূলত এই তিনজনই মূলত শুরু করি।
জয়ঃ সুমন উজ্জ্বল ভাইয়ের সাথে পরিচয় কি আগে থেকেই? না চারুকলা থেকে?
শিবুঃ আমাদের পরিচয়ও চারুকলা থেকেই। আমরা এক সাথেই ভর্তি পরীক্ষা দেই এবং এরপর বন্ধুত্ব। আমরা আজিজের আণ্ডারগ্রাউন্ডে আড্ডা দিতাম একটা দোকানে, গ্রাফিকাল ইকো নামের। সেখানেই প্রথম মিউজিকাল আড্ডা শুরু। অনেক চেনা অচেনা বন্ধু সেখানে আসতেন, উৎসাহিত করতেন। তবে আমাদের শুরুটা খুব অল্প সময়ের। ‘ওম’ গানটা আমরা প্রথম চিন্তা করি, সেটার সাথে উজ্জ্বল যুক্ত করে লিরিক। তারপর টিউন। আমরা তিনজন মিলেই কাজটা দাঁড়া করাই। এর আগেই আমি আমার প্রথম এ্যালবামটা টিউন করে ফেলেছি, নাম ‘মেঘ’। অসম্ভব একটা অনুভূতি। এভাবেই আগাচ্ছিল। আমাদের মধ্যে উজ্জ্বল ভালো কবিতা লিখত আর মৌলিক গানের চর্চা করতো। সুমনও করতো। আমি পরে যুক্ত হই। বলা যায় আমার গানের সরাসরি অনুপ্রেরণা ওরা দুজন। যাই হোক, এভাবেই চারুকলার এক কোচিং এর সমাপনিতে গান গাওয়ার আমন্ত্রণ পাই। সেটাই আমাদের অভিষেক। শোয়েব শোতে বেজ বাজায়। এই শো তে বাজানোর জন্যেই আমরা শোয়েবকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। সেই শো তে ব্ল্যাকের জাহান লিড গিটার বাজিয়েছিল এবং প্রথম আমরা কবীর সুমনের একটা গান কাভার করি। উজ্জ্বলের সুবাদেই কিবু এসেছিল, ও আমাদের প্রথম শোতে ছিল না।
জয়ঃ মানে শোয়েব ভাই প্রথমে বেজ বাজাতো? আর কবির সুমনের কোন গান কাভার করেছিলেন?
শিবুঃ সুমনের ‘সহজে স্বস্তি দেবো না কাউকে আমি’। শোয়েব ঐ শোতে বেজ বাজানোর জন্যেই এসেছিল। আমরা ওকে চিনতাম না।
জয়ঃ শোয়েব ভাইকে জাহান এনেছিল? জাহান আমার খুব প্রিয় একজন গিটারিস্ট।
শিবুঃ হ্যাঁ। ও অসাধারণ সেতার বাজায়। আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছে ও নানাভাবে। বলা যায় ওর শুরুর দিকে মিউজিকাল আড্ডাগুলো আমাদের সাথেই হতো।
জয়ঃ কিবরিয়া ভাই, আপনি কীভাবে মেঘদলের সাথে যুক্ত হলেন?
কিবরিয়াঃ আমি ২০০৫ এ যোগ দেই। আমার দোস্তো উজ্জলের অনুরোধে। ওরা তিন জনই গান লেখা সুর করা আর গাওয়ায় পারদর্শী ছিলো। বিচ্ছিন্নভাবে চর্চা করে যাচ্ছিল। চারুকলায় পড়ার সুবাদে বন্ধুত্ব এবং পরবর্তীতে গানের দল করার চিন্তা। আমি এ সময় ছিলাম সাস্টে। অঙ্ক নিয়ে পড়াশুনা করেছি। পড়াশুনা না ছাই!!! ইউনিভার্সিটির একটা দলের সাথে বাজাতাম।
জয়ঃ উজ্জ্বল ভাই- উনি তো মেঘদলের সাথে নেই এখন।
কিবরিয়াঃ না, উজ্জল এখন মেঘদলে নেই। পরবর্তীতে সম্ভবত ২০০৩ কোন এক সেমিস্টার শেষে ঢাকা এসে এক বন্ধুর মাধ্যমে মাহমুদুজ্জামান বাবু ভাই এর সাথে পরিচয় হয়। বাবু ভাই তখন মৃত্তিকা গড়ে তুলেছেন। মৃত্তিকার কোনো প্রোগ্রাম থাকলে আমি রাতের ট্রেনে ঢাকা চলে আসতাম। বাবু ভাইয়ের ওখানে প্রাক্টিস হোতো। বাবু ভাই এর মাধ্যামে উজ্জলের সাথে বন্ধুত্ব। আমার অনার্স শেষ হওয়ার পর ঢাকা এসে প্রেমে পড়ি। সারাদিন তখন টিএসসি আর চারুকলা। এরকম কোনো একদিন উজ্জল আমাকে মেঘদলে বাজাতে বললো। মেঘদল আর মৃত্তিকা একটা প্রোগ্রাম করার চিন্তা করে পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে। সেখান থেকেই পরিচয়ের শুরু, তার কিছুদিন পর মেঘদলে যোগ দেই। এভাবেই শুরু হয় পথচলা। আমার মাস্টার্স বাকী ছিলো। আর সিলেট ফেরা হয়নি। মেঘদলের প্রথম এ্যালবাম রিলিজ হওয়ার এক বছর আগে থেকে আমি মেঘদলে আছি।
জয়ঃ প্রথমে যখন ব্যান্ডের পরিকল্পনা করলেন কোন ধরণের মিউজিক করবেন- এ ধরণের পরিকল্পনা ছিল? মানে প্রভাব? পিঙ্ক ফ্লয়েড বা জিম মরিসন, ডোরস, নির্ভানা ? এরকম কারো দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন? অনুপ্রেরণা যাকে বলে। শিবু দা তো সুমন ভাই আর উজ্জ্বল ভাইয়ের কথা বললেন- এর বাইরে?
শিবুঃ আমি বলেছি সরাসরি প্রভাব ছিল সুমন আর উজ্জ্বলের। ওরা বলতে গেলে হাতে ধরেই আমাকে উৎসাহিত করেছে। আমি সবসময় তাদের শ্রদ্ধা করি। কিন্তু সঙ্গীত নিয়ে আমার আদর্শিক প্রেরণা অনেক বিস্তৃত আর লম্বা। আমার মা লোকগান করেন। আমি আমার মায়ের কাছে থেকেই গানের প্রতি ভালোবাসা পাই। এরপর বড় হয়ে ছাত্ররাজনীতি করেছি । আমি স্কুলেই ছাত্র ইউনিয়ন করতাম, ক্লাস টেনে থাকতে যোগ দেই। আমার স্কুল ছিল পোগজ স্কুল, পুরনো শহরে। আমার জীবনের এই অংশটা আমাকে অনেক কিছু ভাবতে শিখিয়েছে। গানে তার প্রভাব পড়েছে। এখন সেই চিন্তা আরও পরিশোধিত হয়েছে। তো সব মিলে একটা সমাজতাত্ত্বিক বোঝাপড়ার গানের ভেতর দিয়ে তৈরি হয়েছিল। আমি যেদিন কবির সুমন শুনলাম, বা মহীনের ঘোড়াগুলি বা প্রতুল বা পিঙ্ক ফ্লয়েড- আমি ভেবেছি এই কথাগুলো আমারও। আমিও এই কথাগুলো বলতে চাই। আমি গাইতে পারবো এমন একটা আত্মবিশ্বাস আমার ছিল কিন্তু লিখতে পারবো সেটা ভাবি নি। সুমন আর উজ্জ্বল আমাকে সেই অনুপ্রেরণা দিলো, আমি আমার কথাই লিখলাম গানে। আর আরও বিস্তৃতভাবে দেখলে দুনিয়ার সঙ্গীত বিষয়ক তাবৎ জিনিশই আমার অনুপ্রেরণা।
কিবরিয়াঃ আমার বয়স বেড়েছে মহীনের ঘোড়াগুলো আর সুমনের গান শুনে শুনে। আমার ধারণা এটা একটা কারণ মেঘদলের সাথে প্রথম দিন থেকেই মিশে যেতে পারার। পিঙ্ক ফ্লয়েডটয়েড তো আছেই।
জয়ঃ কিন্তু প্রতুল মুখোপাধ্যায় কিংবা কবির সুমনের সাথে মনে হয় আপনার গানের একটা ফারাক আছে। মানে মেঘদলের গান নিয়ে একটা অভিযোগ অনেকেই করেন- সেটা হচ্ছে লিরিক খানিকটা দুর্বোধ্য। অনেক মেঘদল ভক্তর কাছেই এটা শুনেছি। গান আর কবিতার মধ্যে খানিকটা পার্থক্য আছে। যেমন ধরুন ‘কোজাগরী চাঁদ” এর কথাই বলি। এই শব্দচয়নটা কি ইচ্ছাকৃত? না কী শ্রোতাদের ভিন্ন একটা কিছু দেয়ার জন্যে, ভিন্ন রকমের কিছু? নিরীক্ষাধর্মী?
শিবুঃ কঠিন বা সহজ- এই তত্ত্বটার উত্তর বেশ কঠিন। তবে যখন কোন কিছু ঠিকমতো কাজ করে না তখন সেটা বেখাপ্পা, সেটা দুর্বোধ্য। আমি জানি না কোজাগরীর ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে কী না। তবে সহজ লিরিক লিখবো কী কঠিন লিরিক লিখবো দুটোই আরোপিত। লিরিক আর কবিতায় প্রধান ফারাক কবিতার গান হওয়ার দরকার নাই, লিরিকের আছে। সে কবিতা হিশেবে খারাপ হলেও গান হিশেবে তাকে দাঁড়াতে হয়।
জয়ঃ বেখাপ্পা? এটার সাথে একটু দ্বিমত পোষণ করছি, মানে সেটা বুঝাতে চাই নি। শ্রোতাদের দিক থেকে প্রশ্নটা করেছি। যেমন জীবনানন্দ দাশ আর সুধীন্দ্রনাথের কথাই ধরুন। আধুনিক কবিদের মধ্যে মানুষ কিন্তু সুধীন্দ্রনাথকে সেভাবে নেয় নি, যতোটা জীবনানন্দকে নিয়েছে।
শিবুঃ না, আমি বলছি কোথায় আমি আরোপিত শব্দ ঢুকিয়ে দিচ্ছি বা কোথায় আমি স্বতঃস্ফূর্ত। মানুষ যার যার বিবেচনা দিয়েই কিন্তু বলছে। শিল্পের সার্বজনীন হওয়াটাই আরোপিত বিষয়। একটা বিষয়ে একই উপলব্ধি বিরল ঘটনা।
কিবরিয়াঃ হুম……
শিবুঃ তবে মেঘদলের লিরিকর কাব্যপনা থেকে আমরা বের হতে চাই। কিন্তু সেটা কোন সচেতন প্রক্রিয়া নয়, স্বতঃস্ফূর্ত। শিল্পে ট্রান্সফর্মেশনে বিশ্বাস করি। আমি সূফীবাদ ভক্তিবাদের অনুসারী। বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের লোক আমি নই। আমার কাছে অধরাকে ধরাই শিল্পের একমাত্র প্রবণতা।
জয়ঃ প্রথম অ্যালবামের লিরিকের সাথে কিন্তু দ্বিতীয় অ্যালবামের লিরিকের বিস্তর ফারাক। প্রথমটা দেখে এতটা মনে হয় না যে আপনারা জীবনানন্দ দাশ দ্বারা প্রভাবিত। এর কারণটা কী? অ্যালবামে যা ধরতে চেয়েছেন এর জন্যেই পরিবর্তন?
কিবরিয়াঃ আমার ধারণা উজ্জ্বলের অনুপস্থিতি এর কারণ। লিরিকের শিবু প্রাধান্য। শিবু তো জীবনানন্দ স্বয়ং।
শিবুঃ উজ্জ্বল আমাদের একজন প্রধান গীতিকার আর কী পার্সন ছিল। যাই হোক, আমি ব্যক্তিগতভাবে জীবনানন্দের ভক্ত। আমার সাবকনসাসে সেটা থাকলে থাকতে পারে। কিন্তু শহরবন্দিতে একটা চাপ ছিল বিষয়ের। এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক যে এ্যালবামটা কীভাবে আলাদা হলো। যেহেতু আমার লেখা গান বেশি ছিল তাই প্রভাবটা পড়েছে।
কিবরিয়াঃ হুম……
জয়ঃ আসলেই। প্রথম অ্যালবামে আপনাদের দ্রোহটা বেশি ছিল। দ্বিতীয় অ্যালবামে সেটা খানিকটা বিষাদে রূপান্তরিত হয়ে গেল। যেমন ধরুন, প্রথম অ্যালবামে কিন্তু ‘ক্লাস্টার ফুল’, ‘বোমারু ভগবান’, পুতিন, জ্যাক শিরাক এই ধরণের ব্যাপারগুলো এসেছে, যেটা দ্বিতীয় অ্যালবামে একেবারেই অনুপস্থিত এবং শ্রোতা হিশেবে মনে হয় দ্বিতীয় অ্যালবামটাই বেশি ভালো।
শিবুঃ এটা ঠিক। প্রথম অ্যালবামে আমাদের অ্যানার্কির একটা প্রভাব আছে।
কিবরিয়াঃ হ্যাঁ। টেকনিক্যালিও দ্বিতীয় এ্যালবামটা ভালো। আর আমরাও পরিণত হয়েছি এই এ্যালবামে।
জয়ঃ আমার মনে হয়, প্রথম কিছু কিছু গান যদি আবার করা যেত তাহলে আরও ভালো হতো।
কিবরিয়াঃ হ্যাঁ। আমরাও সেটা ভাবছি।
জয়ঃ বাহ। তাহলে তো চমৎকার।
শিবুঃ হ্যাঁ, তবে সেটা অন্য গান হবে। আগের গানটা হবে না। আমি মনে করি রিমেইক কনসেপ্টটা ভুল। আগের গানটাকে আরাধ্য করে নতুন কিছু করবো। মেঘদলের প্রতি আমার প্রস্তাব সেই বিনির্মাণটা একই এ্যালবামে একাধিক না হলেই ভালো।
জয়ঃ আচ্ছা, মেঘদলের কিছু কিছু কম্পোজিশন শুনে হয় কোন কবিতার ভাব কম্পোজিশনে ধরার চেষ্টা করেছেন। মানে শ্রোতা হিশেবে অনেকটা এভাবেই ব্যাখ্যা করি। যেমন চার চার চৌকো গানটা শুনলে মনে হয়- জীবনানন্দের সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা একা কথা কয়- এই লাইনটা ধরে কম্পোজিশনটা করেছেন। এই লাইনের যে ভাবটা, সেটাই ঘুরে ঘুরে ফুটে উঠেছে।
শিবুঃ এটা হতে পারে, তবে অবশ্যই সচেতনভাবে নয়। জীবনানন্দ আমাদের অবচেতনে আছেন তবে কোন কিছু নির্মাণের সময় আমার ব্যক্তিগতভাবে কারো কথা মাথায় থাকে না। তবে এই গানটার ব্যাখ্যা সুমন ভালো দিতে পারবে। সুমনের গান খুবই সৎ।
কিবরিয়াঃ হ্যা … সুমনের লিরিকে একটু সহজিয়া ব্যাপার আছে। নাগরিক ফোকের দিকে ঝোঁক আছে।
জয়ঃ সেই তুলনায় শিবুদার গান বেশ দুর্বোধ্য। শচীন, মান্না দে, হেমন্তর সময়কার লিরিকগুলো- এতটা দুর্বোধ্যতা কিছু নেই। মানে সেই প্রবণতা নেই, আবার ফোক গানের লিরিকগুলো যেন আমাদের আরও বেশি ভাবনায় ফেলে দেয়। যাপিত জীবনের একটা বাস্তব ধারণা থাকে শক্তভাবে।
কিবরিয়াঃ শিবু মনে হয় লিরিকাল মন্তাজ জাতীয় কিছু অজুহাত দিবে।
শিবুঃ লিরিকের দুর্বোধ্যতা নিয়ে আমার কিছু বলার নাই। এটা একটা ফর্ম হিশেবে দেখা যায়। এটা আমার এক্সপ্রেশন। তবে আমি কমলকুমার হতে চাই না। জনবিচ্ছিন্নতা আমার উদ্দেশ্য না।
জয়ঃ কমলকুমার কিন্তু আমার প্রিয় লেখকদের একজন।
শিবুঃ একটা বিষয় অত্যন্ত জরুরী- আমি যাই গাই না কেন, যাই বলি না কেন তার ওপর আস্থা রাখা। কোন স্টান্ট আমি সমর্থন করি না। শিল্পের দায় বলতে একটা কিছু আছে। বা সত্যের দায়। আমি সেটা পেতে চাই। আমি বলছি কমলকুমারের যে গদ্য তাতে আঙ্গিকগতভাবে জটিল। লোকে নিতে পারে না। বলা যায় উনি এত বড় মাপের লেখক হয়েও অপঠিত থেকে গেলেন। এটা যদি কেউ সচেতনভাবে প্র্যাকটিস করে তাহলে মুশকিল। আমাদের গানের ফর্ম নিয়ে অনেকেই নানা কথা বলে, একটা জনারে ফেলতে চায়। আমি নিজেও এর উত্তর জানি না। আমরা একটা ব্যান্ড, আমরা দলীয়ভাবে গান করছি- কিন্তু কি করছি তাঁর ব্যাখ্যা সব সময় আমাদের পক্ষে দেয়া সম্ভব না। এটা একটা প্রক্রিয়া বড়জোর।
জয়ঃ সেটাই বলছিলাম। শ্রোতারা কিংবা পাঠকেরাই শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখেন। কিছু অভিযোগ থাকলেও মেঘদলকে ভালোভাবেই গ্রহণ করছে। কারণ সামগ্রিকভাবে দেখলে এই প্রজন্মে আমাদের শ্রোতারা গদগদ ‘আমি তুমি ভালোবাসা’ ছাড়া লিরিক শুনতে অভ্যস্ত না। এটা আশাব্যঞ্জক যে মেঘদলকে তারা গ্রহণ করছে, তারা লিরিক নিয়ে ভাবছে।
শিবুঃ আমার কী মনে হয় জানেন? আমি তুমি বা প্রেম বিষয়েই সব গান এটা প্রধান সমস্যা না। আপনি ঠুমরী শুনেন, খেয়াল শুনেন। সেখানে বাণী প্রধান না। একটা লাইনই ঘুরে ফিরে আসছে। কোথাও সমাজের কথা নেই। প্রেমে গদগদ একটা ব্যাপার আছে। সমর্পণের একটা জায়গা আছে। পূর্ব দেশের মানুষের একটা মূল প্রবণতা হচ্ছে বিচ্ছেদ। রাঁধা-কৃষ্ণের বিচ্ছেদ। দেখুন এখানে রক কিন্তু জনপ্রিয় হয় নি। আমার ধারণা, কারণ মানুষ মেলোডির বাইরে যেতে পারছে না। এখন রক যদি এই অঞ্চলে দাঁড়াতে চায় তবে তাকে এর আঞ্চলিকতাকে বাদ দিয়ে সম্ভব নয়। আমি তুমির বাইরে গেলেও কিন্তু নষ্ট কিছু নির্মাণ হবে। মানে সমস্যাটা রুচিগত- পেশাগত। যে আমি তুমির চর্চা হচ্ছে সেটা নকলনবিসী। মানের দিকে কারোরই নজর নেই। ফলে ‘হয় জ্বালা জ্বালা এই অন্তরে’ এই লিরিকগুলো আমরা দেখতে পাই।
কিবরিয়াঃ হ্যা … আমি তুমি নিয়ে গান লিখবো না এই পন করে কেউ গান করতে আসলে বিপদ হবে শ্রোতাদের।
জয়ঃ সুর আর বাণীর যে সমস্যাটার কথা বলছেন- সেটার সমন্বয়ের জন্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাও বলা যায়। অসাধারণভাবে তিনি সে কাজটা করেছেন। আমি তুমিতে সমস্যা নেই, কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে শিল্প হিশেবে এইসব আমি তুমি ভালোবাসা উত্তীর্ণ হচ্ছে কী না- প্রকাশের ভঙ্গিটা।
শিবুঃ ঠাকুর তো কবি ছিলেন, নিজেই গান কম্পোজ করতেন। এইযে কমপ্লিট একটা ব্যাপার এখন সেটা নেই। মানে প্লেব্যাকের মতো আরেকজনের লেখা সুর করা আরেকজন গেয়ে দিচ্ছে। সর্বোপরি মৌলিক গানের চর্চা বলে কিছু নেই। এটা মুশকিল। আমি বিশ্বাস করি প্রত্যেকের একটা আলাদা পয়েন্ট অফ ভিউ আছে। যেমন ধরুন, সেদিন এক লোকশিল্পী গাইছেন- ‘ফোন কেটে দিলে আর করবো না ফোন’। এই যে নাগরিক এক্সপ্রেশন আমি অনেক চেষ্টায়ও কিন্তু ধরতে পারছি না। উনি সেটা পারলেন। হয়তো ভালো হল না, কিন্তু সে আভগার্দ আমার মনে হয়।
কিবরিয়াঃ ফোন কেটে দিলে আর ধরবো না ফোন … দারুন তো … হাহাহাহাহা।
জয় হাহহাহ। যাই হোক, হ্যাঁ। যাই হোক, মুঠোফোন নিয়ে মেঘদলেরও চমৎকার একটা গান আমরা পেয়েছি। দ্বিতীয় অ্যালবামের প্রথম গানটাই।
শিবুঃ হ্যাঁ সেটাও দুর্বোধ্য বলে লোকে। একটা রেডিও শোতে একজন ফোন করে জানতে চাইলেন ‘হ্যালোজেন রোদ চিলতে বারান্দায় টিকটিকি তাই বলছে ভবিষ্যৎ’ এর মানে কী!! আপনি মানুষকে মেটাফোর বোঝাবেন কীভাবে!
কিবরিয়াঃ সমস্যাটা মনে হয় এইখানেই। যেখানে আমাদের অনুভূতিকে ডিক্টেট করতে দেয়া উচিত সেখানে আমরা খুব বেশি সচেতন হয়ে পড়ি।
জয়ঃ মানে যদি ধরিয়ে দেই, তাহলেই গিলবেন। নিজের ভাবনা থেকেও কল্পনা করার ব্যাপারটা গ্রো করেনি। এই ধরণের কিছু?
কিবরিয়াঃ রাইট …আমাদের তো কবিতা পড়ার সংস্কৃতিই নাই।
জয়ঃ হাহহাহা। আচ্ছা, দ্বিতীয় এ্যালবামে রঙিন ফেরেশতা গানটার কম্পোজিশন অন্য গানগুলোর থেকে আলাদা। একটু অন্যরকম। এই ধরণের কম্পোজিশন, মানে খানিকটা অন্য ঘরানার কম্পোজিশন করার কি আরও পরিকল্পনা আছে?
কিবরিয়াঃ রঙিন ফেরেশতা নিয়ে আমরা কিছু দুষ্টুমি করেছি। গানের একদম শেষ হাসিটা আমাদের রেকর্ডিস্ট আশীস এর। প্রথম দিন থেকেই আমরা খেয়াল করেছিলাম ওর হাসিটা।
জয়ঃ হ্যাঁ। একজনের হাসি না তো, দুই তিনজনের হাসি আছে একসাথে। এই গানটায় কিবরিয়া ভাইয়ের বেজ গিটার প্লেয়িং খুব ভালো লাগছে।
কিবরিয়াঃ হ্যাঁ। আমাদের সবার হাসিই আছে তবে আশীসের হাসিটা একদম শেষে আলাদাভাবে আছে। ফেড আউটের আগে।
জয়ঃ এই গানটা শুনে মনে হয়- একটা ইঁদুরের দৃষ্টি থেকে দেখলে চমৎকার লাগে। মানে নিজেকে ইঁদুর ধরণের কিছু। এই ধরণের কিছু কি আসলেই?
কিবরিয়াঃ হাহাহা… তাই নই কি আমরা?
জয়ঃ সেটা অবশ্যই। আমি গানটা শুনে এটা মনে করেছিলাম। পরে অ্যালবাম কাভারটা দেখে আরো আশ্বস্ত হয়েছি যে, যা ভেবেছি খুব ভুল ভাবি নি।
কিবরিয়াঃ হ্যা … সব্যসাচী মিস্ত্রি দুর্দান্ত কাজ করেছে। সব্য এর তুলনা হয় না।
জয়ঃ আচ্ছা, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যেভাবে অ্যালবাম বের করায় সহযোগিতা করছে এটা সম্পর্কে আপনাদের কি অভিমত?
কিবরিয়াঃ বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর এ্যালবামে প্রকাশে সহযোগিতা করায় আমার কোনো আপত্তি নাই। তবে কেউ যদি রাজনৈতিক সচেতনতার কারনে বহুজাতিকের কাছে যেতে রাজি না হয় সেটাকে আমি সন্মান করবো কন্সিডারিং দেয়ার আদার এ্যাক্টিভিটিস। আমি মৃত্তিকায় বাজাই। মৃত্তিকা বহুজাতিকের কাছে যাবে না এটা দলীয় সিদ্ধান্ত। আই স্যালুট। কিন্তু মেঘদল যদি যায় তাতে আমার আপত্তি নেই কারণ আমি ব্যাক্তিগত ভাবে আমি বহুজাতিক নিয়ে অতখানি স্পর্শকাতর নই।
জয়ঃ মেঘদল নিজেও কিন্তু অনেকটা সেই ধরণের মনোভাব পোষণ করে, যেটা মৃত্তিকা করে। কিন্তু মেঘদল কেন তাহলে সেই আপোষটা করছে? মানে বহুজাতিক কোম্পানির কথা বলছিলাম। প্রথম অ্যালবামে এটা নিয়ে কিছু কথাও ছিল যে সেই বহুজাতিকদের কাছেই ধরা দিতে হলো।
কিবরিয়াঃ না না না..। মেঘদল আপোস করেনি কিংবা এটাও বলে নি যে বহুজাতিকে যাবো না। কথার কথা হিসেবে বললাম।
শিবুঃ প্রথম এ্যালবামে একটা ভুল বোঝাবুঝি ছিল, সেটা ব্যাখ্যা করার দাবী রাখে। আর বহুজাতিক কোম্পানির কাছে আমাদের যেতেই হবে, নয়ত হারিয়ে যেতে হবে। এর মধ্যেই লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে নানা প্রক্রিয়ায়। আমি যখন প্রথম আলো পড়ি তখনও আমি আপোষ করি, এটা একটা আয়রনি। আমি জানি না এর উত্তরণ কীভাবে সম্ভব। আর বহুজাতিকদের উদ্দেশে একটা লাইন ছিল, ওটা আমাদের একটা স্পন্সর নেয়ার কথা ছিল ডিজুসের। সেটা শেষতক হয় নি। ফলে লাইনটা অর্থহীন হয়ে পড়ে।
জয়ঃ কিবরিয়া ভাই, বেজিস্ট হিশেবে আপনার কাকে ভালো লাগে?
কিবরিয়াঃ আমারতো সবাইকেই ভালো লাগে। অবাক হয়ে শুনি মানুষ এতো ভালো কেমনে বাজায়। ভিক্টর উটেন আমার খুব প্রিয়। বাই দা ওয়ে, আমার মেমরি গোল্ডফিসের মতো, কিছুই মনে থাকে না। আর কারো নাম মনে পড়ছে না। ও… তানিম আমার মতে সেরা..। দারুন বাজায়।
জয়ঃ বাংলাদেশের কার কার নাম বলবেন? বাংলাদেশে বেজ গিটার বলতেই তো সুমনকে বোঝায়। মানে শ্রোতাদের দিক থেকে কথাটা বলছি।
কিবরিয়াঃ ঐ যে বললাম তানিম ভাই। এছাড়া ..হ্যা সুমন ভাই খুব ভালো বেজিস্ট, স্কিল ওয়াইজ। তবে আমার মনে হয় বেজিস্টদের স্কিল একটু কম থাকাই ভালো। তাতে ওভারঅল কম্পোজিশনের প্রতি সুবিচার হয় …। হহাআহাহা
জয়ঃ হাহাহহা। নিজের আগ্রহ থেকে জিজ্ঞেস করছি, ব্ল্যাকের নতুন বেজিস্ট- উনার বাজানো কেমন লাগে? শুনেছেন কী? টিটুর কথা বলছিলাম।
কিবরিয়াঃ আমি শুনিনি। আমি আসলে বুড়া হয়ে গেছি খুব। নতুন কিছু শোনার আগ্রহ আর আগের মতো নেই। … খুব খারাপ।
জয়ঃ ব্যক্তিগতভাবে আমার সুমনের বাজানো এই কারণে ভালো লাগে না, মনে হয় কম্পোজিশনে স্কিল দেখানটাই মুখ্য তাঁর কাছে। গেল কী গেল না পুরো কম্পোজিশনের সাথে এটা নিয়ে কমই ভাবেন মনে হয় উনি।
কিবরিয়াঃ হ্যা … এটাই মিন করেছি। শোম্যানসিপ খারাপ না। কিন্তু সেটা সব শেষের বিবেচ্য।
জয়ঃ শেষ অ্যালবাম নিয়ে পরিকল্পনার কথা জানতে চাচ্ছিলাম।
শিবুঃ তৃতীয় অ্যালবাম কেমন হবে কী হবে এটা এখনো বুঝতে পারছি না। কারণ শুধু গানগুলোই রেডি, কোন কনসেপ্ট থাকবে না। একটা মিউজিকাল অ্যালবাম করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা নানা কারণেই হচ্ছে না। প্রডিউসার জটিলতা।
কিবরিয়াঃ মিউজিকাল ফিল্ম।
জয়ঃ কবে নাগাদ বের করার পরিকল্পনা?
শিবুঃ ২০১৩ সালের সারা বছর কাজ চলবে। এর মধ্যেই বের হবে আশা করি।
কিবরিয়াঃ শিবু, অ্যালবামের নাম এ্যালুমিনিয়ামের ডানা না রেখে প্রাজাপতি ছানা রাখা যেতে পারে। কি বলো? হাহহা।
জয়ঃ প্রজাপতির ছানা মহাকাব্যিক হবে। হাহহা।
শিবুঃ হাহাহ। নাম এখনো ফিক্সড না। দেখা যাক এগুলো দূরবর্তী কথাবার্তা।
কিবরিয়াঃ নিকটবর্তী কথাবার্তা হচ্ছে, সময় বের করা।
জয়ঃ শিবুদা, সলো এলবাম করার কোন ইচ্ছা বা পরিকল্পনা আছে?
শিবুঃ আবার সলো এলবাম কেন?
জয়ঃ অনেকের মধ্যেই তো এই প্রবণতা থাকে সলো এলবাম বের করার।
শিবুঃ আসলে আমাদের অরিয়েন্টেশনটা পপুলারদের মতো না এটা তো জানেনই। আমরা গান হলেই খুশি।
জয়ঃ হ্যাঁ, জানি। কিন্তু এও সত্য যে মেঘদল বাদে আর কেউই ভবিষ্যতে থাকছে না।
শিবুঃ আলাদা একটা প্লাটফর্ম তৈরির যে রেওয়াজ সেই চিন্তা এখনো করি নি। মেঘদল থেকেও কিন্তু লাভ নেই, যদি একটিভিটিস না থাকে। বের হয়ে গিয়ে কেউ গান করলে সেটা পজিটিভ। আমাদের জয় দারুণ ড্রামস বাজাতো। কিন্তু সে বের হয়ে গিয়ে আর বাজাল না, এটা দুঃখের।
কিবরিয়াঃ সলো এ্যালবাম করে শিবুকে পপুলার করে দিয়ে সুই হয়ে বাজারে প্রবেশ করা যায় কিন্তু। শিবুর গলা ভালো। কিছু পপুলার গান করলে লোকে পছন্দ করবে।
জয়ঃ হাহহা, সেটা ভালো পরিকল্পনা। আর মেঘদলের সবচেয়ে পপুলার গান বোধহয় ‘চেনা অচেনা’। এটা বেশ পপুলার, যদিও আর্টিস্ট কে অনেকেই জানেন না………
কিবরিয়াঃ হ্যাঁ, চেনা অচেনা গানটা অনেকেই শুনেছে মনে হয়, আর নেফারতিতি।
জয়ঃ নেফারতিতিও পপুলার, কিন্তু চেনা অচেনা বোধহয় বেশি। আমি নিজেই যখন মেঘদল চিনতাম না তখন চেনা অচেনা শুনেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমার মনে হয় এই গানটায় মেঘদল সম্পূর্ণভাবে উপস্থিত না। মেঘদল্কে সম্পূর্ণ পাওয়া যায় ‘দূর পৃথিবী’ কিংবা ‘নির্বাণ’ গানগুলোর মধ্যে।
আপনারা টিভিতে আসেন না কেন? পপুলারিটির কথা ধরলেও আপনাদের থেকে অনেক কম পপুলার ব্যান্ডও কিন্তু নিয়মিত পারফর্ম করে রাত বিরাতে? এটা কি মিডিয়ার সাথে আদর্শিক বিরোধের জন্যে?
শিবুঃ মিডিয়ার সাথে আমাদের কোন বিরোধ নাই। আমাদের ডাকলে অবশ্যই যাবো। কিন্তু ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এখনো তাঁর আঁতুড়ঘরে আছে। ওদের কোন সংস্কৃতি গড়ে ওঠে নি। তারা আসলে কিসের বিচারে কাকে ডাকে আর কাকে ডাকে না এসব রীতিমত গবেষণার বিষয়। আর আমি পার্সোনালি মনে করি, পারফর্মিং আর্ট বা মিউজিক এসব ক্যামেরার সামনে হয় না। প্রমোশন হয়।
কিবরিয়াঃ না। আমাদের ডাকে না তাই। একটা ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের কর্মকাণ্ড নিয়মিত না সেটা একটা কারণ হতে পারে আমাদের নিয়মিত ডাক না পাওয়ার।
জয়ঃ হ্যাঁ। জলের গানের কিন্তু কোন এ্যালবামই বের হয়নি, তাদের নিয়মিত দেখা যায় বিভিন্ন টিভি শোতে। জলের গানের কথা মনে পড়ে গেল। জলের গানের গান কেমন লাগে?
কিবরিয়াঃ আমি ২/১ বার ওদের পারফরমেন্স দেখেছি। উম… কি বলবো … উদ্বেলিত হই নি। জানি না শব্দটা ঠিক মতো প্রয়োগ করতে পারলাম কি না। হাহাহাহা…
শিবুঃ জলের গান কোন ব্যান্ড কী না এখনো জানি না। তাদের কোন গান আমাকেও আকৃষ্ট করতে পারে নি। বিশেষ করে কম্পোজিশন ভালো লাগে নি। কফিল আহমেদ, দারুণ লিরিক। কিন্তু পারফর্মেন্স ভালো লাগে নি।
জয়ঃ কনক আদিত্যের একটা গান তো বেশ জনপ্রিয়, তুমি আমার পাশে বন্ধু হে…
কিবরিয়াঃ নতুন কিছু দল কিন্তু গড়ে উঠছে প্রমিজিং … শিবু। সেদিন আমরা যে ডাকসুতে গান করলাম ওদের কথা বলছি। বিস্কুট। মনোসরনি । মনোসরনির সাথে ব্যাক্তিগত ভাবে কাজ করার সুবাদে জানি, ওদের পক্ষে খুব ভালো কিছু কাজ করা সম্ভব।
শিবুঃ হ্যাঁ, এটা ইম্পরট্যান্ট। এবং তাদের লিরিকে একটা অ্যানার্কি লক্ষ করা যাচ্ছে। যেটা দিনদিন ম্যাচিউরড হবে বলে আশা করি এবং চমৎকার কিছু হবে। ওদের স্পিরিটটা দেখার মতো।
জয়ঃ খুব সম্ভবত আরেকটা গান ছিল ধ্রুব এষের লেখাই ‘আয় মেঘ আয় ছেলেবেলা’ – কনক আদিত্যেরই। সেটাও খারাপ লাগে নি।
কিবরিয়াঃ হ্যা … একটা বিষয় সবচেয়ে বেশী উল্লেখযোগ্য… এরা সবাই কিন্তু কবি। কবিতা থেকে গান গাইতে এসেছে।
জয়ঃ আমার তো মনে হয় এটা খুব ভালো।
শিবুঃ অবশ্যই। মৌলিক গানের চর্চা একটু হলেও বাড়ছে।
জয়ঃ এখন আর কার গান ভালো লাগে? মানে যারা বেশ পপুলার বলা যায়?
কিবরিয়াঃ অর্নব ইজ গ্রেট। এছাড়া … আসলে এমন কারো নাম মনে পড়ছেনা কারন ইদানিং গান খুব কম শোনা হয়। শিরোনামহীনও ভালো লাগে।
কিবরিয়াঃ অর্ণব তো আছেই, আর শিরোনামহীন অসাধারণ। আমরা তাদের বিগ ফ্যান। আনুশেহ, আর্টসেল। কৃষ্ণকলির প্রথম এ্যালবামটা সুন্দর। কিন্তু তিনি এখন প্রোপাগান্ডা করেন বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে পছন্দ করি না। চিরকুট নিয়ে একটা আশাবাদ ছিল। আমরা একসাথেই মিউজিক করতাম। শোয়েব বাজাতো। সুমিও মৌসুমি ভৌমিকের গান ভালো গাইতো। কিন্তু ওদের গান আমার ভালো লাগে নি। মানে প্রথম এ্যালবামটা। এখন তো ওরা অনেক পপুলার। দেখা যাক।
জয়ঃ ওদের দুএকটা গান কিন্তু বেশ ভালো লেগেছে। যেমন ‘বন্ধু’ কিংবা ‘কাটাকুটি’ গানটা একটু অন্যরকমের ছিল। মানে নিজেদের মিউজিকের ধরনটা তারা ধরতে পেরেছে বলে মনে হয়।
শিবুঃ হ্যাঁ।
জয়ঃ আপনাদের আগের প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে কাকে ভালো লাগে। যদি চারটা নাম বলি- নগর বাউল, এলআরবি, মাকসুদ কিংবা হাসান?
শিবুঃ হাসান বাদে সবাই।
জয়ঃ অনেক কথা হলো শিবুদা, কিবরিয়া ভাই। এবার আপনি মেঘদলের শ্রোতাদের উদ্দেশে কিছু বলেন? মানে জাতির উদ্দেশে ভাষণ আর কী। হাহহা।
কিবরিয়াঃ এই শিবু তুমি কিছু বলো। আমার পাবলিক স্পিকিং খুবই খারাপ।
শিবুঃ কী বলবো স্যার। আশা না কি হতাশার কথা?
কিবরিয়াঃ শিবু বল। শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে কিছু বল। ফার্স্ট এন্ড লাস্ট টাইম আমি বলেছিলাম প্রথম এ্যালবাম বের হওয়ার পরে কোন এক টিভিতে। শ্রোতাদের বলেছিলাম আমাদের এ্যালবাম কিনতে। যাতে আমাদের কিছু টাকা পয়সা হয়। এখন বন্ধু বান্ধব সবাইকে বলি ডাউনলোড করতে।
শিবুঃ গানকে এখন আর আয়োজনসর্বস্ব কিছু ভাবতে ইচ্ছা করে না। মনে হয় এই ডামাডোলটা কমলে মানুষের আরও কাছে পৌঁছানো সম্ভব। আর গান গেয়ে বিপ্লব সম্ভব কী না জানি না, তবে বিপ্লবে গানের দরকার আছে। ধীরে ধীরে এটি মানুষকে পরিবর্তন করে। তবে মেঘদল শুরু করেছিল যেখান থেকে আজকে দশ বছর পর গেলে মনে হয় আদর্শিক দিক থেকে খুব একটা দূরে সরে যাই নি। ভাবনার মেটামরফোসিস হচ্ছে। সেটা নিরন্তর হতেই থাকবে, আমরা এখন একটা সুপ্ত আশাবাদ নিয়েই বাঁচি যদিও জানি কোন কিছুরই অর্থ নেই। সূর্যের আলোকে ছুতে না পারলেও তাঁর আকাঙ্ষায় কিন্তু থেকে যাবে। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক, আমেন।
জয়ঃ আমেন। অনেক ধন্যবাদ আপনাদের দুজনকেই সময় দেয়ার জন্যে।
ফটো ক্রেডিটঃ ফাহাদ আল আলম
মেঘদলকে চিনি ২০১০ থেকে। চেনা অচেনা,ছেলেবেলা গানগুলো যখন প্রথম শুনি খুবই ভালো লেগেছিলো। এখনো তাই। মেঘদলের গানগুলো অন্যান্য গান থেকে একেবারেই আলাদা!
মেঘদলকে চি্নতাম একটা গান দিয়ে “আমি এক বিভ্রান্ত পথিক…………” ঐ গানটা খুব ভাল লাগে।
@mitu vinci,
এই গানটার নাম ‘চেনা অচেনা’, মেঘদলের প্রথম অ্যালবামের গান। 🙂
লেখা কেমন হইছে পরে পইড়া কমু। আপাততঃ জলহস্তি সাইজের যে ছবিটা দিয়া ভ্যারাচ্যারা লাগায় দিসিলা, সেইটা একটু ছোট কইরা দিলাম।
@অভিজিৎ দা,
হাহহাআ। ধন্যবাদ। :))
কোজাগরী চাঁদ নিয়ে আমারো সমস্যা ছিল।তবে প্রজাপতি ছানা অবশ্য শুনতাম না,অন্য কিছু একটা শুনতাম।শিবুদা এ নিয়ে বলেছিলেন ‘আমার উচ্চরনের তো বেহাল অবস্থা দেখছি’ ।আমি জানি সমস্যাটা আমার মধ্যেই।এখনো কিছু লাইনের অর্থ ধরতে পারিনা।তবে হয়ত ভাবতে ভাবতে বা হঠাত্ কোনদিন অর্থগুলো ধরা দেবে।
@সাদিয়া,
:)) সবাইই অন্যকিছু ধরণের কিছু শোনে।
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্যে।
বাসার নিচের ফাঁকা জায়গাটায় বিশাল সাউন্ড সিস্টেমে ওয়াজ হৈতেছে। পুরা রুম ওয়াজে ওয়াজে মো মো করছে। ঋণাত্মক শক্তি হিসেবে স্পিকারে তাই চালিয়ে দিছি মেঘদল, আগে এমন সময়ে ‘অর্থহীন’ বাজতো, কিন্তু সুমনটা একটা ছাগুভুত হয়ে গেছে বলে ওর কন্ঠ শুনতে রুচি হয় না।
ওমম এর মতো গান যারা কম্পোজ করেছে তাদের ‘মমিন তুমায় দাঁড়িয়ে করে সালাম’ ছাড়া আর কিইই বা বলার আছে?
@রায়হান আবীর,
কিছুই না। :))
যাই হোক, আপনার বাসার অইদিকে সারাবছরই ওয়াজ মাহফিল হয় না কি? 😛
আপনার উল্লেখিত শিবু কুমার শীল আর শুদ্ধস্বর প্রকাশনার অনেক বইয়ের প্রচ্ছদ শিল্পী শিবু কুমার শীল কি একই ব্যক্তি?
@গীতা দাস,
হ্যাঁ!