প্রথম পোপ
পশ্চিম ইউরোপের ইতিহাসের একটা বড় অংশ হল খৃষ্টধর্মের দুইটি প্রতিদ্বন্দ্বী ফ্যাকশনের মধ্যে লড়াই আর রক্তপাতের ইতিহাস–ক্যাথলিক বা রোমান ক্যাথলিক আর প্রোটেস্ট্যান্ট। চতুর্দশ শতকে জার্মানিতে মার্টিন লুথারের আবির্ভাবের আগাবধি পুরো পশ্চিম ইউরোপে ছিল রোমের বিশপ বা পোপের ক্যাথলিক চার্চের আধিপত্য। যীশুর মাছধরা জেলে শীষ্য সন্ত পিতরকে তিনি স্বর্গের চাবি দিয়ে দিয়েছিলেন আর এই সন্ত পিতরের উত্তরসূরী হল রোমের বিশপ বা পোপ। ১১ শতকে বাইজান্টাইন ইস্তাম্বুল আর রোমের বিভক্তি সূচনা করল অর্থোডক্স আর রোমান ক্যাথলিক চার্চের। রাশিয়া, গ্রীস,পূর্ব ইউরোপ আর মধ্যপ্রাচ্যে মোটামুটি গোলযোগ ছাড়াই অর্থোডক্স চার্চের রাজত্ব চলতে থাকল। ঘাপলা লাগল রোমকেণ্দ্রিক পশ্চিমাদের নিয়ে। এইখানে উল্লেখ্য যে এই পোপের আহ্বানেই পূর্ববর্তী শতকগুলোতে জেরুজালেমকেন্দ্রিক পবিত্রভূমির দখল নিয়ে একতাবদ্ধ পশ্চিম ইউরোপ মধ্যপ্রাচ্যীয় বিধর্মী মুসলিমদের সাথে ২০০ বছর ধর্মযুদ্ধ বা ক্রসেডে লিপ্ত ছিল। একসময় যুদ্ধের ইচ্ছা আর প্রয়োজন মিইয়ে গেল আর জেরুজালেমসহ পবিত্রভূমির সবটুকুই আবার হাতছাড়া হয়ে গেল।
মার্টিন লুথার
৯৫ থেসিস

১৫১৭ খ্রীষ্টাব্দ। হাজার বছর ধরে পশ্চিম ইউরোপীয় ভূখন্ডে বিরাজমান ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক নিশ্চয়তার জানালার কাঁচ ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ল। মার্টিন লুথার নামক বিদ্রোহী এক জার্মান যাজক তাঁর ৯৫ থেসিস বা প্রস্তাবনা স্যাক্সোনির এক ছোট্ট শহর উইটেনবার্গের গির্জার দেয়ালে পেরেক দিয়ে গেঁথে দিলেন। এই থেসিস বা প্রস্তাবনাসমমুহ ছিল তৎকালীন রোমান ক্যাথলিক চার্চের বহুবিধ অসঙ্গতি এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা। এই আপাত: সামান্য প্রতিরোধ এবং বিরুদ্ধাচরণের মাধ্যমে লুথার পুরো পশ্চিমা খ্রীষ্টীয় জগতকে এর ধর্মীয় কক্ষচ্যুত করেছিলেন। প্রোটেস্ট্যান্ট রিফর্মেশন বা সংস্কারের প্রবল জোয়াড়ের তরঙ্গোচ্ছাস সমগ্র উত্তর ইউরোপকে ভাসিয়ে দিল। লুথারের প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদ বাতাসের চেয়েও তীব্রবেগে জার্মানী, নেদারল্যান্ডস, ইংল্যান্ড ইত্যাদি দেশে ছড়িয়ে পড়ল আর পোপের নিরংকুশ ক্ষমতার প্রতি হুমকি আর দুই সেক্টের লোকজনের ভেতর চরম শত্রুতার করল সূচনা।
উইলিয়াম দ্য সাইলেন্ট
স্পেনরাজ দ্বিতীয় ফিলিপ

নেদারল্যান্ডস বা হল্যান্ড বহুবছর ছিল ক্যাথলিক স্পেনের করদরাজ্য আর প্রোটেস্ট্যান্ট ডাচদের উপর স্পেনীয়দের অবিচার-অত্যাচারের কোন সীমা ছিলনা। এটি একসময় স্পেনরাজ দ্বিতীয় ফিলিপের বিরূদ্ধে বিদ্রোহ আর সফল যুদ্ধের সূচনা করল। এই ৮০ বছরব্যাপি যুদ্ধের মূল নেতা ছিলেন এক অভিজাত ধনী ব্যাক্তি উইলিয়াম প্রিন্স অফ অরেঞ্জ। উইলিয়াম হল্যান্ডের খুব ছোট একটা অংশ উটরেখট এর স্টাডহোল্ডার বা হেরেডিটারী নেতা ছিলেন (ঠিক রাজা নয়)। এই হেরেটিক বিদ্রোহী প্রোটেস্ট্যান্ট প্রিন্স উইলিয়ামকে রাজা ফিলিপ আউট ল ঘোষনা করে তাকে হত্যার জন্য ২৫,০০০ স্বর্ণমুদ্রার ঘোষনা দিলেন।
বালথাজার জেরার্ড

ফ্রান্সের এক গোড়া রোমান ক্যাথলিক পরিবারে বালথাজার জিরার্ড এর জন্ম। সে নিজেও ভয়াবহ উগ্রপন্থী ক্যাথলিক আর স্পেনরাজ ফিলিপের পরমভক্ত। উইলিয়ামকে হত্যার জন্য ফিলিপের ঘোষনার অনেক আগেই সে ডোল বিশ্ববিদ্যালয়ে তার আইনশাস্ত্রের সহপাঠীদের কাছে ঘোষনা করেছিল যে সে একদিন উইলিয়ামের বুক বরাবর একটা ধারালো ছুরি বসিয়ে দিবে। ফিলিপের ঘোষনার পর তার সংকল্প আরও কঠিন হল। এবং সুযোগও একদিন এসে গেল। উইলিয়ামকে তার ডেল্ফট এর বাসভবনে গুলি চালিয়ে হত্যা করল সে। পৃথিবীর ইতিহাসে বন্দুকের সাহায্যে কোন রাজনৈতিক নেতাকে হত্যা এইটিই প্রথম। যাইহোক, গুলি চালানোর পরপরই বালথাজারের উপর উইলিয়ামের সৈনিক আর দেহরক্ষীদের লাথ্থি, ঘুষি ,তরবারী আর বণ্দুকের বাঁটের আঘাতের বর্ষণ হতে লাগল। হেচড়ে-পেঁচড়ে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় বালথাজার দেখল প্রিন্স অফ অরেঞ্জ তখনও জীবীত। ভয়াবহ আর্তনাদ করে উঠল সে: “ঠিক মতন বন্দুক সই করতে ব্যর্থ আমার হাতের উপর অভিশাপ, মহান ভগবান যীশুর শত্রুকে জাহান্নামে পাঠাতে যে হাত ব্যর্থ পঁচে যাক সেটা”।
প্রিন্স উইলিয়ামের মৃত্যু

বালথাজারকে শহরের ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে প্রথমে একটি প্রাথমিক জেরার মধ্য দিয়ে যেতে হল। তাকে একটুও ভীত, বিহ্বল বা উত্তেজিত মনে হল না। সে বরং খুব স্বাভাবিক ও উৎফুল্ল কন্ঠে দাউদ নবীর ফিলিস্তিন দৈত্য জালুতকে হত্যা করার উদ্ধৃতি দিল। এরপর ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচারের রায়ে তার মৃত্যুদন্ডের ঘোষনা দিলেন। ম্যাজিস্ট্রেটদের আদেশ অনু্যায়ী জেরার্ডের ডান হাত তপ্ত লোহার সাহায্যে পোড়ানোর পর সাড়াশীর সাহায্যে তার শরীরের ছয় জায়গা থেকে হাড় থেকে মাংস খুবলে তোলা হবে এবং সর্বশেষে তার পেট চিড়ে নাড়ি-ভুড়ি বের করে কুঁপিয়ে চার-টুকরো করা হবে; এই পর্যায়ে তার হৃৎপিন্ড কেঁটে বের করে তার মুখের সামনে দোলানো হবে এবং সবশেষে তার মাথা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হবে।

ডেলফ্ট নগরী

বন্দীশালার প্রথম রাতে বালথাজারকে একটা খুঁটিতে বেধে আপাদমস্তক চাবকানো হল টানা পুরো ১ ঘন্টা । এরপর তার কাটা-ছেঁড়া ঘাগুলোতে মধু মেখে একটা ছাগল নিয়ে আসা হল এইটির ধারালো জিহ্বা দিয়ে চাটানোর জন্য। ছাগলটিকে দিয়ে অবশ্য কাজটি করানো গেলনা। এর পর আরও ২ ঘন্টা টর্চারের পর তার হাত-পা শক্ত করে বেধে তাকে গুটলির মতন ফেলে রাখা হল যাতে সে ঘুমাতে অক্ষম হয়। এর পরের টানা তিন রাত তাকে খুটির সাথে বেধে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হল। পুরো সময়টাতে তার হাতগুলোকে খুটির উল্টোপাশে শক্ত করে বেধে রাখা হয়। এরপর তার দুইপায়ের পায়ের বুড়ো-আঙ্গুলের সাথে পৃথকভাবে ১৩৬ কেজি ওজন ঝুলিয়ে রাখা হল আধ-ঘন্টার জন্য। এই আধ-ঘন্টা অতিক্রান্তের পর তার দুই পায়ে ভালোভাবে তেল মাখানো কুকুরের কাঁচা চামড়ার জুতা পড়িয়ে দেওয়া হল। এই জুতা আবার তার পায়ের সাইজের দুই ইঞ্চি ছোট করে বানানো। এই অবস্থাতে তার পায়ের কাছে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল। জুতা গরম হয়ে সংকুচিত হতে হতে তার পায়ের হাড্ডিগুড্ডি ভিতর থেকে চুড়চুড় করে দিল। এরপর চামড়ার এই জুতো তার পা থেকে টেনে-ছিড়ে খুলে ফেলা হল তার পায়ের চামড়া, মাংসও এর সাথে উঠে চলে আসল। একটা বড় ডান্ডা দিয়ে এরপর ভয়ংকর জোড়ে তার হাত-পায়ের গাঁটে-গাঁটে বাড়ি মেরে হাড্ডিগুড্ডি ভাঙ্গা হল বেশ ধিরে ধিরে। এরপর এ্যালকোহলে একটি শার্ট ভিজিয়ে তার গায়ে পড়িয়ে দিয়ে গলিত শুকরের চর্বি তার গায়ের বিভিন্ন অংশে ঢেলে দেওয়া হল। এরপর সাড়াশি দিয়ে মাড়িসহ তার দাঁতগুলো তুলে ধারালো চিমটা দিয়ে তার পুংস্তনের বোঁটাগুলো তুলে ফেলে রক্তারক্তি অবস্থা করা হল। তার দেহের মাংসের পরতে-পরতে লোহার নেইল ঢুকিয়ে হাত-পায়ের নখগুলো একে একে তুলে ফেলা হল। এই পুরোটা সময় বালথাজার অবিশ্বাস্যভাবে শান্ত ছিল–যেন সে তার প্রতিশ্রুত স্বর্গ-রাজ্যের দ্বার-প্রান্তে উপস্থিত হয়েছে। চারটি রাত কাটল এভাবে।

সর্বশেষে উপস্থিত সমস্ত যন্ত্রনা থেকে মুক্তির দিনটি-১৫৮৪ সালের ১৪ জুলাই। রাজকীয় ঘাতক বা ধর্মদ্রোহী-রাজদ্রোহী-দেশদ্রোহীর সাজার তৎকালীন ট্র্যাডিশনাল ইউরোপীয় পদ্ধতি অনুসরণ করা হল ধাপে ধাপে।প্রথমে তার উপর প্রয়োগ করা হলো আগুনের তপ্ত শিখায়ে লাল করা লোহার একটি খাপ।সেটির ভেতর তার ডান হাত চেপে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। মাংস পোড়া তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল আশপাশে। এরপর তার শরীরের ছয়টি স্থানে একটি সাড়াশী দিয়ে হাড় থেকে মাংস এবং অপর ৩৫ টি স্থানের মাংস ওই চিমটা দিয়ে খুবলে খুবলে তুলে ফেলা হলো।গলিত সালফার,মোম এবং সীসার মিশ্রণ দিয়ে আধা-আধিভাবে পুড়িয়ে এরপর তার জখমের উপর ফুটন্ত তেল ঢেলে দেওয়া হলো ।এর পর একটা ধারালো ছুরি দিয়ে তার জননেন্দ্রীয় কেটে খালি হাত দিয়ে টান মেরে তার অন্ডকোষগুলো ছিড়ে ফেলা হলো। এরপর জল্লাদের সহকারী বেদীর একপাশে আগুন জ্বালালো। জল্লাদ এরপর ছুড়ি দিয়ে পেট চিড়ে তার নাড়ি-ভুড়ি বের করে তখনও জীবিত জেরার্ডকে দেখালো।ভয়ংকর দুর্গন্ধে ভরপুর হয়ে উঠল বেদীর আশপাশ।জল্লাদ দুর্গন্ধ এড়ানোর জন্য নাড়ি-ভূড়িগুলো জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করল । পুরো প্রক্রিয়া জুড়ে বিস্ময়করভাবে শান্ত ছিল এই ধর্মোন্মাদ ঘাতক–ঠিক যেমনটি ছিল টর্চারের সময়। এরপর তাঁর বুক চিরে হৃৎপিন্ড বের করে আনল জল্লাদ এবং রায় অনুসারে জেরার্ডের মুখ বরাবর দোলালো। ততক্ষণে অবশ্য সে মারা গেছে। সর্বশেষে শুওর কাটার ধারালো ছুরি দিয়ে জল্লাদ তার হাত-পায়ের গাটে গাটে পোচ দিয়ে কেটে বিছিন্ন করে দিল এবং একটি কুড়ুল দিয়ে কুপিয়ে ধড় থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে দিল। মাথাবাদে মোট চারটুকরো হল ঘাতকের দেহ। একটি হাড়িতে জল্লাদের সহকারী জিড়া এবং লবনসহ পানি ফুটিয়ে এতে মাথাসহ দেহের চারখন্ড সেদ্ধ করল। এর কারণ হল তখনকার প্রথা মোতাবেক এগুলো ডেলফ্ট শহরে ঢোকার ব্রীজসহ চারটি স্থানে প্রদর্শনের জন্য খুঁটিতে ঝুলিয়ে রাখা হবে। পঁচনের দুর্গন্ধ এবং কাক বা চিলের উপদ্রব এড়াতে এই বাড়তি ব্যবস্থা।এইভাবেই হলো এক ঘাতকের মৃত্যু ।

রাজা ফিলিপ তার প্রতিশ্রুত ২৫০০০ স্বর্ণমুদ্রার বদলে বালথাজারের পিতা-মাতাকে তাদের ছেলের আত্মত্যাগের উপহারস্বরূপ তিনটি এস্টেটের আজীবন বংশপারম্পরিক জমিদারী দিয়ে দিলেন ।

তথ্যসূত্র:
(i)Seeing Europe with Famous Authors, Vol. IV: France and the Netherlands, Part II (Dodo Press)–Edited by F.W.Hasley
(ii)The Awful End of William the Silent: The First Assassination of A Head of State With A Handgun: London: HarperCollins: 2005, L.Jardine
(iii)Here I Stand: A Life of Martin Luther, 1991, R.H.Bainton
(iV)Europe: A History, 1998, N.Davies
(v)The Cambridge Modern History. Vol 2: The Reformation, 1903
(vi)The Rise of the Dutch Republic, 1856, J.L.Motley