লেখকঃ ইফতি
ব্লগে সম্প্রতি ”কৃত্রিম রোগ এইডস: শ্বাসরোধী সত্য।” শিরোনামে একটি লিখা প্রকাশিত হয়েছে। HIV মানুষের বানানো , বিজ্ঞানের অন্ধকার দিক , বিজ্ঞান বড় নিষ্ঠুর, এইসব বড় বড় বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। ওই লিখার বিষয়বস্তু সত্য হলে পৃথিবীবাসীর জন্য তা খুব ভয়ংকর হত কিন্তু সৌভাগ্যজনকভাবে তা হয়নি। বিষয়টা অনেক আগেই বাতিল হয়ে গেছে। প্রাগৌতিহাসিক এইসব বিষয়ে লিখতে হবে স্বপ্নেও ভাবিনি।কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।পোস্ট গ্রাহ্য করতাম না কিন্তু একটু নাক দিতেই হল যখন দেখি পোস্টে মন্তব্যের সংখ্যা দেড়শ পেরিয়ে যায়। আর সবাই দেখি পোস্ট নিজেদের আতঙ্কের কথা জানাচ্ছেন , ধিক্কার দিচ্ছেন বিজ্ঞানকে। দেড়শ মানুষ থেকে কত হাজার মানুষে একটা ভুল তথ্য ছড়িয়ে যেতে পারে। একটা জিনিস এতগুলা মানুষ ভুল জানবে এইটা মেনে নিয়ে ঘুমানো কষ্ট।

বিজ্ঞান নিয়ে লিখা , তথ্যের উপর তথ্য কিন্তু পুরা লেখাই কোন রেফারেন্স ছিল না !! রূপকথার গল্পের সাথে এমন লেখার কোনই পার্থক্য নেই। আমার এই পোস্টে আমি এমন কোন গল্প বলব না।খাট্টাখোট্টা রসকষহীন একটা লিখা পড়তে যাচ্ছেন আপনি। এই লিখাটা পুরোপুরি হবে রেফারেন্সনির্ভর। ওই পোস্টে বর্নবাদ , কালো নিধন প্রকল্প এমন অপ্রাসঙ্গিক অনেক কথাই বলা হয়েছে। আমি এখানে শুধু মুল বিষয়টা ফোকাস করব মানে পোলিও ভ্যাক্সিন থেকে HIV ভাইরাস আসার শ্বাসরোধী সত্য নামে যে অভিযোগটা করা হয়েছে ওইটা যে ভুয়া সেটা দেখাব।

পোস্টের বক্তব্য অতি সংক্ষেপে নিচে দিলাম,
১৯৫৭’এর দিকে আফ্রিকায় বানরের বদলের শিম্পাঞ্জির রক্ত, কিডনিতে কালচার করা হয়েছে পোলিও ভ্যাক্সিন। এই শিম্পাঞ্জিতে ছিল SIV নামক ভাইরাস।। তাই কালচার করার সময় ভ্যাক্সিন শিম্পাঞ্জির SIV দিয়ে contaminated হল। এই contaminated ভ্যাক্সিন আফ্রিকান শিশুকে খাওয়ানো হল। এইভাবে শিম্প থেকে মানুষে এল এই ভাইরাস । পোস্টের উপসংহার হল বিজ্ঞানীর হাত ধরেই এই HIV ভাইরাসের উৎপত্তি, বিজ্ঞানীরা (সাদা জাতি )আফ্রিকানদের গিনিপিগ বানিয়ে যা খুশি করছে । বিজ্ঞান খুবই খারাপ।

ওনার পুরা লিখায় এই বিষয়টার কেতাবি নাম নাই। আমি বলে দিচ্ছি।এই হাইপোথিসিসের ভাল নাম oral polio vaccine (OPV) AIDS hypothesis।

পোস্টের কথাই আসি। নাটকীয় কথাবার্তায় ভরপুর। ”বাড়ছে এইডস। বিজ্ঞান-কম্যুনিটি একেবারে নিশ্চুপ। ..কেন এইডস রোগে মানুষ দশ হাজার বছর আগে থেকেই আক্রান্ত হয়নি?.. কেন হয়নি এমনকি দুইশ বছর আগেও? …তারপর অপ্রকৃত মানবদের বিলুপ্ত করার পথ শুরু হল। উত্তর আমেরিকায় প্রায় বিলুপ্ত। অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় বিলুপ্ত। দক্ষিণ আমেরিকায় সাপ্রেসড। কিন্তু আসল সমস্যা তো কাটে না।… এশিয়ার কেলেগুলো তো ঝাড়েবংশে বাড়ছে।.. বাড়ছে আফ্রিকার পশুগুলোও। কালো ঠেকাও। ভাইরাস ছড়িয়ে দাও। চলুন যাই পাঁচ হাজার বছর আগে…..” এইসব খুবই অপ্রয়োজনীয় কথা। কয়েকটা মানুষের ছাড়া ছাড়া কথা কোট করা ছাড়া আর কিছু নাই।ভুলভাবে লিখা অনেক কিছুই।বেশ অনেকবারই বলেছেন বানরে নাকি এইডস হয়। হা হা… বানরে এইডস হয় আর পুরুষের পেটে বাচ্ছা হয় এই দুইটা কথার মাঝে খুব বেশি পার্থক্য নেই।

বিজ্ঞান-কম্যুনিটি মোটেই নিশ্চুপ না। এই হাইপোথিসিস অনেক আগেই পুরোপুরি বাতিল হয়ে গেছে।

‘’In an August 1992 letter published in Science, Koprowski himself repudiated the OPV AIDS hypothesis, pointing to multiple errors of fact in its assertions. In October 1992, Science ran a story titled “Panel Nixes Congo Vaccine as AIDS source,” describing the findings of an independent panel which found each proposed step in the OPV-AIDS hypothesis “problematic”. The story concluded:

…it can be stated with almost complete certainty that the large polio vaccine trial… was not the origin of AIDS.’’

উপরে দেখতেই পাচ্ছেন যে কপরাস্কির কথা ওই পোস্টে বলা হইছে সে নিজেই পরে এটা বাতিল করছে। এইটা নিয়ে Science জার্নালে তার লেখা AIDS and the Polio Vaccine

পোলিও ভ্যাক্সিন ট্রায়াল টা হইছিল ১৯৫৭’এর দিকে কিন্তু মলিকুলার ডাটা যা বলে এই ভাইরাসের উৎপত্তি আরো আগে ,১৯৩১ এর দিকে।

এখানে দেখুন।

বানরে না করে শিম্পাঞ্জির কিডনীতে কালচার করার যে অভিযোগ করা হইছিল এইটাও পরীক্ষা করা হয়।আফসুস, শিম্পাঞ্জির ডিএনএ পাওয়া যায় নাই। পাওয়া গেছে ওই বানরের ডিএনএ। পুরা বিষয়টা সত্যিকার অর্থে এখানেই বাতিল হয়ে যায়।
Molecular Analyses of Oral Polio Vaccine Samples–>

বানর ব্যবহার করলে আর চিন্তা নাই কারন এই বানরে এই রিলেটেড ভাইরাস ছিল না। তবুও বিজ্ঞানীদের মন ভরে না।ওই ভ্যাক্সিন স্যাম্পল নিয়েও পরে পরীক্ষা করা হয়। কোন contamination পাওয়া যায় নি । এইটা নিয়ে ন্যাচার’ এ পেপার।
Polio vaccine samples not linked to AIDS—->

অতএব বিষয়টা যে বাতিল সেটা প্রমানিত। তবুও এমন সব শ্বাসরোধী বাতিল বিষয়ে নিয়ে আরো পোস্ট দিতে চাইলে নিচের লিংকে যান । পোলিওর মত Smallpox ভ্যাক্সিন থিওরী সবই পাওয়া যাবে..x(

এখানে

HIV ভাইরাস কই থেকে আসছে এটা নিয়ে এমন আরো অনেক থিওরি বাজারে আছে। The contaminated needle theory ,The colonialism theory । যে কোন একটা নিয়ে লাফালাফি করলে সমস্যা। আমিও তো একট থিওরি বানাইতে পারি। Extraterrestrial Origin of HIV! এই ভাইরাস এলিয়েনরা আনছে পৃথিবীতে ১৯৮০ সালে যে কারনে এইটা আগে হয়নি!! কথা হচ্ছে আমার হাইপোথিসিসের পক্ষে আমার প্রমাণ আছে কিনা, evidence যা হাতে আছে তার সাথে আমার হাইপোথিসিস কতটা সঙ্গতিপূর্ন। বিজ্ঞান চোখ বন্ধ করে কিছু মেনে নেয় না। যা সত্য তা কেন সত্য সেটার পক্ষে যেমন প্রমাণ খুজে যা মিথ্যা তা কেন মিথ্যা সেটা নিয়েও মাথা ঘামায়।

হান্টার থিওরি সবচেয়ে গ্রহনযোগ্য। যা কিছু প্রমাণ এইদিকেই। আরো যে কয়টা থিওরী আছে The contaminated needle theory ,The colonialism theory এইগুলাও আসলে হান্টার থিওরিও পরিবর্ধিত রুপ।সিম্পল থিওরি ।মানুষে এইচআইভি আসে শিম্পাঞ্জি খেতে গিয়ে বা মারতে গিয়ে।এইটাকে বলে cross-species transmission। এক প্রজাতি থেকে আরেক প্রজাতিতে লাফ দেয়া। উপরোক্ত ভ্যাক্সিন থিওরি ছাড়াই এই transmission ন্যাচারাল ভাবেই হতে পারে।

ফিগার ১ : বিজ্ঞানীদের ধারনা ১৯৩১’এর দিকে সাইউ ইস্ট ক্যামেরুনের এই শিম্পাঞ্জি কলোনি থেকেই SIV প্রথম ট্রান্সমিট হয় মানুষে

এমন উদাহরন আরো আছে। influenza A, Ebola, SARS, dengue সবই একইভাবে বিভিন্ন সময় অন্য প্রানী থেকে মানুষে আসছে। খেতে গিয়ে, মারতে গিয়ে ।বিভিন্ন পথে। হয় কি একটা ভাইরাস যখন তার অরিজিনাল পোষকে(host) থাকে তখন কোন ক্ষতি করে না। আমাদের অন্ত্রেও এমন কিছু ব্যাকটেরিয়া আছে। এইসব ব্যাকটেরিয়ার জন্য আমরা মানুষ হলাম অরিজিনাল পোষক।কোন সমস্যা নাই। এখন কোনভাবে যদি পোষক পরিবর্তন হয় ধরুন বাদুড়ের কোন ভাইরাস লাফ দিয়ে চলে আসল মানুষে। ভিন্ন পোষকে এই ভাইরাস তখন কোন রোগ তৈরি করবে।এইটা সবসময়েই হচ্ছে ।ভবিষ্যতেও হবে। আর এই লাফালাফি থেকেই জন্ম নিবে নতুন নতুন রোগ।

Cross-Species Virus Transmission and the Emergence of New Epidemic Diseases –>

ফিগার ২ : Sin Nombre (hantavirus) virus’এর ন্যাচারাল হোস্ট এই ইদুর।পরবর্তীতে মানুষে ট্রান্সমিট হয়ে পালমোনারি সিনড্রোম তৈরি করে।

এইভাবে কোন বাহকের মাধ্যমে পোষক পরিবর্তন করার আর একটা ভাল নাম আছে। Zoonosis। কুকুর বিড়াল , বাদুড় ,ভেড়া,বানর এমন অনেক বাহক প্রানী থেকেই মানুষে প্যাথোজেন আসার ঘটনা ঘটছে। খেয়াল করে দেখুন যেসব প্রানীর নাম বললাম সবার সাথেই মানুষের বেশ ভাল সম্পর্ক।যেখানেই যাবেন হাত বাড়ালেই পাবেন টাইপ।কিছু আছে গৃহপালিত প্রানী ,কিছু আমরা খাই ।এইসব প্রানী থেকে তাই বারবারই প্যাথোজেন ট্রান্সফারের ঘটনা ঘটছে।আর এটা খুব দ্রুত মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে।

এখানে আর
এখানে

ফিগার ৩ :প্যাথোজেন পিরামিড।প্রথমে কোন পোষক exposed হয় কোন প্যাথোজেনে। বারবার exposed হতে থাকলে একটা নিদির্ষ্ট সময় পর infection । Infectious dose (ID) একটা লেভেল পার হলেই পুরোপুরি ট্রান্সমিশন। অতঃপর মহামারী।

ফিগার ৪: পোষক পরিবর্তন করা কিছু প্যাথোজেনের তালিকা

আর মানুষ HIV আসায় সম্ভবত দুইটা cross-species transmission’এর ঘটনা ঘটছে। যেভাবে মানুষ, শিম্পাঞ্জি থেকে পাইছে ঠিক প্যারালাল ভাবেই শিম্পাঞ্জি এই ভাইরাস পাইছে বানর থেকে। দুইটাই cross-species transmission। গবেষনা যা বলে , শিম্পাঞ্জির SIV ভাইরাস আসলে একটা রিকমবিনেন্ট ভাইরাস।দুইটা বানর থেকে দুইটা রিলেটেড ভাইরাস SIVgsn (gsn-greater spot-nosed monkeys )আর SIVrcm (red-capped mangabeys) ট্রান্সমিট হইছে শিম্পাঞ্জিতে।ওই দুই ভাইরাসের রিকমবিনেশনে এই SIVcpz ভাইরাস (cpz-chimpanzees )। বানর পোষক থেকে লাফ দিয়ে ভিন্ন পোষক শিম্পাঞ্জিতে আসল ,ভাইরাসে কিছু মিউটেশন হল।নতুন পোষক’a নতুন রেসপেন্স।কিছু হালকা হালকা এইডস টাইপ সিনড্রোম শিম্পাঞ্জিতে দেখা গেল এই SIV এর কারনে। তবে এইডস না অবশ্যই। পরে শিম্পাঞ্জি থেকে মানুষে লাফ দিল।কিছু ব্যাপক মিউটেশন। বেচারা Nef gene টাই মাঝপথে নাই হয়ে গেল মানুষে ঢুকার পর। আরো কিছু মিউটেশন।সব মিলিয়ে T সেলকে আক্রমন করে immune সিস্টেমের পুরা বারটা বাজিয়ে দেয়ার ক্ষমতা চলে আসল। শুরু হল immunodeficiency । ভাইরাসের এই স্বভাবমতন নতুন পোষকে SIV বাদ দিয়ে নতুন নাম দেয়া হল HIV, Human immunodeficiency virus।

লিঙ্ক এখানে

আর এখানে

ফিগার ৫ : এই ফিগারটা বুঝার জন্য চমৎকার। একটা গুরুত্বপূর্ন কথা। এই ট্রান্সমিশন শুধু একবার না। হতে পারে অনেকবার। HIV’এর ক্ষেত্রে ধারনা করা হয় কমপক্ষে তিনবার SIV ট্রান্সমিট হইছে মানুষে। এর বেশিও হতে পারে। যে কারনে মানুষে HIV’এর তিনটা স্ট্রেইন দেখা যায়। টাইপ M, N , O ।

ফিগার ৬: সেই বিখ্যাত গোল ছবি। 😀

HIV অরিজিন নিয়ে আরো জানতে চাইলে-

দেখুন এখানে

আর এখানে

লেখাটা এখানেই শেষ করি। বদমাইশ HIV’এর গল্প বললে এতটুকু লেখায় শেষ করা যাবে না। তবে এইটুকু তো পরিষ্কার হল ১০০% প্রাকৃতিক উপায়ে প্যাথোজেন ট্রান্সফার হতে পারে..:D আর এটার ফল কখনো ভাল হয়নি। জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন রোগ। সামনে আসতে পারে HIV’এর চেয়ে বদমাইশ কোন ভাইরাস। বিজ্ঞানীরাও এই বিষয় নিয়ে ব্যাপক চিন্তিত। এই ব্যাপক চিন্তা , গবেষনার মাঝে ভুল তথ্য জেনে পিছিয়ে থাকার সময় নেই। জানতে হবে। এমনিতেই আমাদের দেশের মানুষদের বায়োলজি জ্ঞান কম আর তার মাঝে চারপাশের ভুলভাল তথ্য , ভুলে ভরা পাঠ্যবই সব মিলিয়ে একটা জগাখিচুড়ি অবস্থা । যা তা পাওয়া যায় ব্লগে ।বিজ্ঞানকে প্যাদানি দেয়া কথা বললে অনেকের আবার বেশ ভালও লাগে। এইসব ভুল চিন্তা ,ভুল তথ্য ভরা লেখা HIV ভাইরাসের মতনই ভয়ংকর। দুইটাই পরিত্যাজ্য। 😀

লেখকঃ ইফতি

মুক্তমনায় লেখকের পূর্বে প্রকাশিত লেখাঃ ঘটনা শেষ পর্যন্ত ঘটেই গেল !!