রাজনৈতিক মতবাদের শ্রেণীকরণকে আমরা একরৈখিকভাবে দেখে অভ্যস্ত, এক পাশে ডান, অন্য পাশে বাম, মাঝখানে মধ্যপন্থী। এটা বাংলাদেশে যতোটা প্রচলিত, যুক্তরাষ্ট্রেও প্রায় ততোটাই। ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে বলা হয় তারা বাম দিকে ঝুঁকে, আর রিপাবলিকানরা ডানদিকে। সাধারণ চল হচ্ছে প্রগতিবাদ, সমাজতন্ত্র, সেকুলারবাদ, কমিউনিজম, নৈরাজ্যবাদ এদেরকে বাম হিসেবে গণ্য করা। আর ডান হলো রক্ষণশীলতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা, পুঁজিবাদ, নব্যউদারপন্থা, রাজতন্ত্র, ধর্মতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদ, ইত্যাদি।

কিন্তু এরকম একমাত্রিকভাবে রাজনৈতিক শ্রেণীকরণ করাটা সমস্যাজনক এবং প্রায়ই অকাজের। যেমন, ওবামা এই শ্রেণীকরণে বাম ঘেঁষা, আবার স্ট্যালিন এখানে চরম বাম। অন্যদিকে রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী রমনি ডান ঘেঁষা আর হিটলার এই শ্রেণীকরণ অনুযায়ী চরম ডান। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, অনেকক্ষেত্রেই স্ট্যালিন আর হিটলারের রাষ্ট্রের চরিত্র বেশি কাছাকাছি। যেমন, ব্যক্তির উপর রাষ্ট্রের আধিপত্যের প্রশ্নের। এবং সেটা কোনো গৌণ বিষয় নয়। তাহলে সরলরেখার দুইপাশের দুই চরমেরা মাঝখানের ওবামা আর রমনিকে ডিঙিয়ে এতো কাছাকাছি এলেন কীভাবে?

এরকম একমাত্রিকভাবে দেখার কারণে আমাদের মাঝে অনেক সময় একটা ফল্স ডিলেমা তৈরি হয়। অজস্র ইস্যুকে মোটাদাগে একটা বাইনারি চয়েজের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়। তবে বৈঠকখানার আলাপের জন্যে এভাবে দেখার কদরও অনেক। আসলে তো মাত্রা নিশ্চয়ই অজস্র। পৃথিবীতে হাজারটা ইস্যু। সমাজ, অর্থনীতি, ধর্ম, সেনাবাহিনী, পররাষ্ট্রনীতি। একেকটা মতবাদ এইসব ক্ষেত্রে একেকটা ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করে। কিন্তু একমাত্রিক পটের বদলে একটা পঞ্চমাত্রিক পটেও তো আমরা সহজে কল্পনা করতে পারি না। ত্রিমাত্রিক পটে কল্পনাই দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। তবে আমরা যদি একমাত্রিক চিন্তা থেকে অতোটুকুও উঠতে পারি, তার প্রাপ্তিও অনেক।

রাজনৈতিক শ্রেণীকরণে দুটো মাত্রা একসাথে বিবেচনা করা তাই ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে। একটি মাত্রা হলো মানুষের সামাজিক ইস্যু, অন্যটি হলো মানুষের অর্থনৈতিক ইস্যু। এতে সরলরেখার বদলে একটি ক্ষেত্রফল তৈরি হয়। আর ডান বামের বদলে তৈরি হয় চারটি চরম অবস্থান – ডান, বাম, উপর আর নীচ।

ডেভিড নোলান ও তার চার্ট (ছবি কৃতজ্ঞতা: উইকিমিডিয়া)

যুক্তরাষ্ট্রের লিবার্টারিয়ান পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ডেভিড নোলান এরকম একটি দ্বিমাত্রিক রাজনৈতিক শ্রেণীকরণ প্রস্তাব করেন। সেটা নোলান চার্ট নামে পরিচিত। এই নোলান চার্টের উপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাবাদী রাজনৈতিক কর্মী মার্শাল ফ্রিৎস তৈরি করেন “পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম রাজনৈতিক কুইজ” নামে একটি কুইজ। সামাজিক আর অর্থনৈতিক, দুই ক্ষেত্রের জন্যে পাঁচটা পাঁচটা দশটা প্রশ্ন থাকে এতে। এই দশটা প্রশ্ন থেকে উত্তরকারীর রাজনৈতিক অবস্থান বের করা হয়। সামাজিক ক্ষেত্রে একটা প্রান্তে রয়েছে যারা সামাজিক ইস্যুতে ব্যক্তির উপরে গোষ্ঠিকে প্রাধান্য দেয়। অন্য প্রান্তের কাছে ব্যক্তির সামাজিক ইস্যু গোষ্ঠির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একইভাবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও তেমনি একপ্রান্তের ফোকাস হলো গোষ্ঠির ইস্যুতে, অন্য প্রান্তের ফোকাস ব্যক্তির অর্থনৈতিক ইস্যুতে।

প্রতিটি প্রশ্নের তিনটি অপশন, হ্যাঁ, হয়তো, আর না; এদের স্কোর যথাক্রমে ২০, ১০, এবং ০। সামাজিক ইস্যুর প্রশ্নে উত্তর সবগুলোতে হ্যাঁ হলে মোট নম্বর হবে ১০০। একইভাবে অর্থনৈতিক ইস্যুতেও মোট নম্বর ১০০। সামাজিক আর অর্থনৈতিক ইস্যু এই দুই ক্ষেত্রে যে দু’টি নম্বর পাওয়া যাবে, সেটাকে চার্টের গ্রিডে বসিয়ে পাওয়া যাবে রাজনৈতিক অবস্থান।

কুইজটা সরাসরি অ্যাডভোকেট ফর সেল্ফ গভর্নমেন্টের ওয়েবসাইট থেকে নেয়া যাবে। কুইজ আর চার্টটি নিচে বাংলায় অনুবাদ করলাম। প্রশ্নগুলো শুরু করা যাক।

সামাজিক বিষয়ে অবস্থানমূলক প্রশ্ন: (মোট ১০০ নম্বর)

১) রাষ্ট্র বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্র, মিডিয়া ও ইন্টারনেটকে সেন্সর করতে পারে না

– হ্যাঁ (২০) / হয়তো (১০) / না (০)

২) রাষ্ট্র কোন অবস্থায় নাগরিককে সামরিক বাহিনীতে প্রশিক্ষণ বা অংশগ্রহণের জন্যে বাধ্য করতে পারে না

– হ্যাঁ (২০) / হয়তো (১০) / না (০)

৩) পূর্ণবয়স্কের সম্মতিমূলক যেকোন প্রকার যৌন আচরণের ব্যাপারে রাষ্ট্র কোন বিধিনিষেধ জারি করতে পারে না

– হ্যাঁ (২০) / হয়তো (১০) / না (০)

৪) পূর্ণবয়স্ক মানুষের মাদক বহন বা গ্রহণের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়া উচিত বলে মনে করি

– হ্যাঁ (২০) / হয়তো (১০) / না (০)

৫) জাতীয় পরিচয় পত্র বলে কিছু গ্রহণের বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত নয় বলে মনে করি

– হ্যাঁ (২০) / হয়তো (১০) / না (০)

অর্থনৈতিক বিষয়ে অবস্থানমূলক প্রশ্ন: (মোট ১০০ নম্বর)

১) রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কর্পোরেটগুলোকে রক্ষা করতে প্রণোদনা প্যাকেজের মত কোন ব্যবস্থা থাকা উচিত নয় বলে মনে করি

– হ্যাঁ (২০) / হয়তো (১০) / না (০)

২) আন্তর্জাতিক মুক্ত বাণিজ্যকে রাষ্ট্র প্রতিহত করতে পারে না বলে মনে করি

– হ্যাঁ (২০) / হয়তো (১০) / না (০)

৩) রাষ্ট্র নয়, ব্যক্তি নিজেই তার অবসর বাছাইয়ের অধিকার রাখে বলে মনে করি

– হ্যাঁ (২০) / হয়তো (১০) / না (০)

৪) দরিদ্রসেবা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নয়, কেবল ব্যক্তিগত দাতব্য, সেবামূলক উদ্যোগে হওয়া উচিত বলে মনে করি

– হ্যাঁ (২০) / হয়তো (১০) / না (০)

৫) রাষ্ট্রের কর ও অর্থব্যয় ৫০% বা ততোধিক হারে কমিয়ে আনা উচিত বলে মনে করি

– হ্যাঁ (২০) / হয়তো (১০) / না (০)

রাজনৈতিক অবস্থানের চার্ট

উপরের চার্টটিতে বামদিকে নিচে সামাজিক বিষয়ে স্কোরের দাগগুলো দেয়া আছে আর ডানদিকে নিচে দেয়া আছে অর্থনৈতিক বিষয়ে স্কোরের দাগ। দুইদিকের দাগগুলো একটা গ্রিড তৈরি করেছে। আপনার সামাজিক স্কোর যদি ৩০ হয় এবং অর্থনৈতিক স্কোর যদি হয় ২০, তাহলে আপনার রাজনৈতিক অবস্থান তুলনামূলকভাবে কর্তৃত্ববাদী। আপনি শক্তিশালী ও বৃহদাকার সরকারের পক্ষে। এভাবে কেবল ব্যক্তির নয়, একটা দলেরও রাজনৈতিক অবস্থান এই কুইজের মাধ্যমে নির্ণয় করা সম্ভব।

চার্টের বিভিন্ন অবস্থানের বর্ণনাকে মূল কুইজ থেকে ভাবানুবাদ করে নিচে দেওয়া হলো।

বাম উদারপন্থী

বাম উদারপন্থীরা সাধারণত সামাজিকতক্ষেত্রে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার পক্ষে; নাগরিক স্বাধীনতা, মত-প্রকাশের স্বাধীনতা, সমতা এবং বৈচিত্র্যকে তারা প্রাধান্য দেয়। তবে অর্থনৈতিক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকে তারা সমর্থন করে। তাই তারা বাম। মানে বাম উদারপন্থী নামকরণটা একটা ডান উদারপন্থীরও অস্তিত্বকে নির্দেশ করে না। বরং একরৈখিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যে এরা বামপন্থী হিসেবেই নির্ণীত হতেন, সেটাকেই বোঝায়। বাম উদাররা ব্যবসাকে রাষ্ট্র দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করার পক্ষে। তারা দুর্বল শ্রেণীর জন্যে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিশেষায়িত সাহায্য-সেবাকে সমর্থন করে।

স্বাধীনতাবাদী

স্বাধীনতাবাদীরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তির সর্বোচ্চ স্বাধীনতার পক্ষে। তারা ছোট সরকারের পক্ষে। সেই ছোট সরকারের দায়িত্ব কেবল ব্যক্তিকে জোর-জবরদস্তি, আক্রমণ, শারীরিক অত্যাচার থেকে রক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। তারা ব্যক্তির বৈচিত্র্য, মত-প্রকাশের স্বাধীনতা ও অন্যান্য সামাজিক এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে সমর্থনের পাশাপাশি ব্যক্তির দায়িত্বকে তার নিজের উপরই সমর্পণের পক্ষে। তারা রাষ্ট্রের আমলাতান্ত্রিকতা ও অতিরক্ত কর গ্রহণের বিপক্ষে। রাষ্ট্র-উদ্যোগের বিপরীতে ব্যক্তি-উদ্যোগের দরিদ্রসেবাকে এবং মুক্ত বাজার অর্থনীতিকে তারা সমর্থন করে। ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের আজ্ঞাবহ হিসেবে না দেখে স্বাধীনতাবাদীরা রাষ্ট্রকে ব্যক্তির আজ্ঞাবহ হিসেবে দেখে।

মধ্যপন্থী

মধ্যপন্থী বলে পরিচিতরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে মাঝামাঝি একটা অবস্থান নেয়। কিছু সামাজিক ক্ষেত্রে তারা ব্যক্তির সামাজিক স্বাধীনতার পক্ষাবলম্বন করলেও দেখা যায় অন্য কিছু ক্ষেত্রে তারা নিয়ন্ত্রণের পক্ষে। একইভাবে, অর্থনৈতিকক্ষেত্রেও তারা একতরফা রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের পক্ষে না, আবার পুরোপুরি মুক্ত অর্থনীতিকেও তারা সমর্থন করে না। তাদেরকে যেকোন দিকের রাজনৈতিক একমুখীতার বিপক্ষে থাকতে দেখা যায়, আবার সকল মতের প্রতি তাদের উদারতাও চোখে পড়ে।

ডান রক্ষণশীল

রক্ষণশীলেরা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার পক্ষে, কিন্তু ব্যক্তির সামাজিক স্বাধীনতাকে সে আইন দ্বারা সীমিত ও নিয়ন্ত্রণ করে রাখতে চায়। এর পেছনে তাদের “ঐতিহ্যকে ধরে রাখার” প্রেরণা কাজ করে। ঐতিহ্যগতভাবেই ব্যক্তির সামাজিক স্বাধীনতা যেহেতু সব সমাজেই রাষ্ট্র দ্বারা সীমিত, ব্যক্তির স্বাধীনতার বিপক্ষে তাদের কাজ করে এই ঐতিহ্য ধ্বংস হয়ে যাবার ভয়। তারা রাষ্ট্রের মাধ্যমে ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণের বিপক্ষে। তারা শক্তিশালী সামরিকবাহিনীকে সমর্থন করে, কিন্তু আমলাতান্ত্রিকতা ও উচ্চহারের করের তারা বিরোধী। আবার অন্যদিকে তারা সরকারি পদক্ষেপের মাধ্যমে নৈতিকতা এবং সনাতনী পারিবারিক কাঠামোকে রক্ষা করার পক্ষে। ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও মত-প্রকাশের অবাধ অধিকারের তারা বিপক্ষে। মুক্ত বাজার অর্থনীতি এবং আইন দ্বারা শক্তিশালীভাবে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ, উভয়েরই তারা পক্ষে।

কর্তৃত্ববাদী

কর্তৃত্ববাদীদের সরকার অতিকায় আকারের ও সকল ক্ষমতার অধিকারী হয়ে থাকে। তারা রাষ্ট্রে নাগরিকের অজস্র সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে। তারা প্রায়শই প্রচার করে যে অর্থনৈতিক ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা রাষ্ট্রে এখনো প্রয়োগ করার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় নি। তারা মুক্ত অর্থনীতিকে অবিশ্বাসের চোখে দেখে, উচ্চহারে কর গ্রহণ করে এবং সামাজিক বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তারা একটি কেন্দ্রমুখী পরিকল্পনার পক্ষাবলম্বন করে। ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও মত-প্রকাশের অধিকারের তারা বিপক্ষে। রাষ্ট্রকে ব্যক্তির আজ্ঞাবহ হিসেবে না দেখে কর্তৃত্ববাদীরা ব্যক্তিকে রাষ্ট্রের আজ্ঞাবহ হিসেবে দেখে।

এখন রাজনৈতিক শ্রেণীকরণে আমাদের হয়তো আগের চেয়ে একটু বেশি সুবিধা হবে। এখন আরেকটু হয়তো স্পষ্ট হলো হিটলার আর স্ট্যালিনই বা কেনো এতো কাছাকাছি। স্ট্যালিন আর হিটলার উভয়েই এখানে হবে কর্তৃত্ববাদী। কমিউনিস্টরা এই চার্টে সাধারণত বাম কর্তৃত্ববাদী হিসেবে নির্ণীত। আর ফ্যাসিবাদীরা ডান কর্তৃত্ববাদী হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এই চার্টে বাম উদারপন্থী হিসেবে চিহ্নিত হবে, আর রিপাবলিকানরা চিহ্নিত হবে ডান রক্ষণশীল হিসেবে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান এই চার্টে কেমন হবে? আমি আওয়ামী লীগকে যতোটা জানি, তারা ব্যক্তি স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বিএনপির চেয়ে বেশি উদার, তবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের প্রবণতা তাদের বেশি। তবে আওয়ামী লীগ ব্যক্তি স্বাধীনতার এতোটা পক্ষে নয় যে তারা উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত হবে। বরং বাংলাদেশের অনেক বামপন্থী রাজনৈতিক দল ব্যক্তি স্বাধীনতার পক্ষে তাদের চেয়ে অনেক বেশি সোচ্চার। অর্থনৈতিক ইস্যুতে বামপন্থী দলগুলো যেহেতু নির্ঘাতভাবেই রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের পক্ষে, ফলে তাদেরকে হয়তো বাম উদারপন্থী হিসেবে নির্ণয় করা সম্ভব। সেখানে আওয়ামী লীগ হয়তো বলা চলে অনেকটা বাম-ঘেঁষা মধ্যপন্থী। অন্যদিকে বাকশাল অনেকটাই ছিলো কর্তৃত্ববাদী। বাংলাদেশের মুসলমানের ঐতিহ্য ও প্রথার প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে বিএনপি ডান রক্ষণশীলতায় হয়তো অনেকটা ভালোই খাপ খাবে। আর জামায়তে ইসলামের ঘোষিত মতবাদ তথা ইসলামী শরিয়া নির্ঘাত একটি কর্তৃত্ববাদী অবস্থান।

কুইজটার সব প্রশ্ন হয়তো বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অতোটা সম্পর্কিত নয়। অবস্থানগুলোও কোনো অবজেক্টিভ সত্য নয়। তবে সাধারণ একটা ধারণা এখান থেকে পাওয়া যায়। ডান বামের একরৈখিক চিন্তা থেকে উঠে আসতে এটা অনেকটাই সাহায্য করে। আরেকটা জটিল ফল্স ডিলেমায় পড়াটা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। আমাদের উদ্দেশ্য মতবাদগুলোকে বিভিন্ন ইস্যুর সাপেক্ষে আলাদা করে যাচাই করতে শেখা। এই কুইজটার উদ্দেশ্য ব্যক্তির সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইস্যুর সাপেক্ষে মতবাদগুলোকে চিনতে শেখা।

কুইজটা থেকে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়, অনেক কর্তৃত্ববাদী মতবাদ ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যের নামে রাষ্ট্রের সার্বিক ক্ষমতা নেয়ার নীতি গ্রহণ করলেও ব্যক্তির অনেক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইস্যুতে স্বাধীনতা সমানভাবেই ব্যাহত হয়। সেটা কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হোক, উগ্র জাতীয়তাবাদী ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র হোক, আর ধর্মরাষ্ট্র হোক। ব্যক্তি স্বাধীনতার সাপেক্ষে এ জন্যে বাম উদারপন্থী, ডান রক্ষণশীল কিংবা মধ্যপন্থীরা এদের চেয়ে শ্রেয়।

পৃথিবীতে এখন অধিকাংশ আধুনিক রাষ্ট্রেই ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করা রাজনৈতিক দলগুলোকে মূলত মাঝখান থেকে একটু বামে অথবা ডানে হেলে থাকতেই বেশি দেখা যায়। খুব ব্যতিক্রমীভাবে মাঝে মাঝে ইতিহাসে পূর্ণ কর্তৃত্ববাদী শাসন দেখা গিয়েছে। ছোট খাটো দল হিসেবে অবশ্য বিভিন্ন ফ্লেভারের কর্তৃত্ববাদীরা (সমাজতন্ত্রী, ধর্মপন্থী কিংবা উগ্র জাতীয়তাবাদপন্থী) দেদারসে উপস্থিত। অন্যদিকে একটি স্বাধীনতাবাদী আধুনিক রাষ্ট্র আমরা এখনো দেখতে পাই নি। তেমন ধ্যান ধারণাযুক্ত দলের দেখা পাওয়াও এখনো কোনো প্রচলিত ঘটনা নয়।